Skip to content →

আহমদ আখতারের বিদায়

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আহমদ আখতার আর নেই। নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে পরলোকে গমন করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। কবি ফররুখ আহমদের পুত্র হিসেবেই আহমদ আখতার বেশি পরিচিত ছিলেন। আহমদ আখতার তার কলমী নাম। আসল না সম্ভবত মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান। আসল নামে তাকে খুব কম লোকই জানত। তিনি সাংবাদিকতা করতেন ও কবিতা লিখতেন। তার কবিতা আমার পড়া হয়নি। দেশের দুটি জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রায় ২২ বছর তিনি আমার সহকর্মী ছিলেন। কিছুদিন থেকেই তার অসুস্থতার কথা শুনছিলাম। আশা করছিলাম তিনি সেরে উঠবেন। আমার আশায় কিছু যায় আসে না। আল্লাহর ইচ্ছাই চিরন্তন।

আহমদ আখতার ব্যক্তি হিসেবে সজ্জন ছিলেন। প্রায় সবসময় তাকে বিষন্ন ও চিন্তাযুক্ত দেখে আমার মনে হতো জীবন সম্পর্কে তিনি উন্নাসিক বা অন্তর্মুখী অথবা জীবন বিমুখ। কোনোকিছুতে আন্তরিকতা ছিল বলে মনে হতো না। সে জন্য কর্মক্ষেত্রে আমার অবস্থানগত কারণে ছোটখাট পেশাগত ভুলত্রুটি শুধরে দিতে দু’একবার তাকে ভৎর্সনাও করতে হয়েছে। পরে কাছে ডেকে দু:খ প্রকাশ করেছি, যাতে তিনি কিছু মনে না করেন। তিনি সবসময় মাথা নিচু করে থাকতেন। বিনয়ের সাথে কথা বলতেন। কেউ তাকে হাসতে বা উচু কণ্ঠে কথা বলতে শুনেছে বলে আমার মনে হয় না। তার পিতা ফররুখ আহমদকে আমি কখনো দেখিনি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রায় সবগুলোই পড়েছি এবং আমার সংগ্রহেও তাঁর বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। তাঁর কাহিনি কাব্য “হাতেম তায়ী” আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগত এবং একাধিকবার পড়ার পরও মনে হতো আরেকবার পড়ব।


১৯৮১ সালে আহমদ আখতারের বয়স কত ছিল? ১৯ বা ২০ বছর। সাধারণভাবে চাকুরি করার বয়স নয়। ওই বয়সে বাংলাদেশে গ্রাজুয়েশনই শেষ হয় না। আহমদ আখতার সাব-এডিটর হিসেবে দৈনিক সংগ্রামে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। পরিবারের নিশ্চয়ই আর্থিক চাপ ছিল। কবি ফররুখ আহমদ তাঁর শেষ জীবনে আর্থিক কষ্টে ছিলেন। ১৯৭৪ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ওই বছরই কবি ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফররুখ প্রেমিক বেশ ক’জন ছাত্র কবিকে আর্থিক সহায়তা করার উদ্দেশ্যে তাঁর স্মরণে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তাতে ফররুখ আহমদের বেশ কিছু নির্বাচিত কবিতা স্থান পায়। আমি এ উদ্যোগের কেউ ছিলাম না। ইংরেজি বিভাগে একজন সিনিয়র ছাত্র ফাওজুল কবীর (বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব) ছিলেন এ উদ্যোগের প্রধান। আমার সহপাঠি ও রুমমেট আবু তাহেরও ছিলেন। অনেক সময় আমাদের রুমে উদ্যোক্তারা মিলিত হয়ে তাদের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতেন। যথাসময়ে কাব্য সংকলন প্রকাশিত হলো এবং ‘পুশ সেল’ করে বেশ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল। টাকাগুলো কবি পরিবারের কাছে দেয়ার জন্য একদিন তাহের ভাই আমাকে নিয়ে গেলেন। কবি পরিবার তখনো ইস্কাটনের সরকারি কোয়ার্টারেই ছিল। কবির দ্বিতীয় পুত্র মঞ্জুরুল ইসলাম পরিবারের পক্ষে টাকা গ্রহণ করলেন। জানতে পারলাম মঞ্জুরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ব্যাচেই কমার্স ফ্যাকাল্টির ছাত্র। সেদিন আহমদ আখতার বা আর কারও সাথে দেখা হয়নি। একাশি সালে আহমদ আখতার সংগ্রামে যোগ দেয়ার পর তাদের বাসায় যাওয়ার কথা বলেছিলাম।


১৯৭৭ সালে ঢাকা ডাইজেস্ট কবি ফররুখ আহমদ স্মরণে তাঁর ওপর একটি কভার স্টোরি করার পরিকল্পনা করে। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় ফররুখ আহমদ সম্পর্কে দেশের বিশিষ্ট কবিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের। আমি কবি আল মাহমুদ, মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, আহসান হাবীব, হাসান হাফিজুর রহমান ও আবুদল মান্নান সৈয়দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। ফররুখ আহমদ সম্পর্কে তাদের ভালো ও মন্দ দু’ধরনের বক্তব্যই ছিল। কেউ বলেছেন, যারা প্রথম জীবনে কমিউনিষ্ট থাকে, তারা যদি আদর্শ বদলে ধর্মের দিকে ফেরেন, তাহলে তাল সামলাতে পারেন না। কবি ফররুখ আহমদেরও তাই হয়েছিল। তিনি নিজেকে একঘরে করে ফেলেছেন। কেউ বলেছেন, ইসলাম তাঁর মধ্যে শুরু থেকেই ছিল, যার স্ফুরণ ঘটেছে বিলম্বে। শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার নেয়ার কথা থাকলেও তিনি আমাকে কয়েকদিন ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকার দেননি। আমার এই অভিজ্ঞতার কথাও আখতারকে বলেছি।


আমার দৈনিক সংগ্রামে থাকাকালেই সম্ভবত ১৯৯১ বা ৯২ সালের কোনো একদিন আমরা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের ইউনিট সভা করছিলাম। করিডোরে হঠাৎ নারীকণ্ঠে প্রচণ্ড কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেল। সম্ভবত কন্ঠ শুনেই আহমদ আখতার সভা থেকে উঠল। আরও কয়েকজন তার সাথে এগিয়ে গেল। একটু পর একজন ফিরে এসে জানাল, মেয়েটি আহমদ আখতারের স্ত্রী। তাদের ছোট্ট সন্তান মারা গেছে। তার স্ত্রী দিশেহারা হয়ে অফিসে চলে এসেছেন। আখতার সম্ভবত তখন রামপুরায় থাকত। সভা স্থগিত রেখে আখতারের সহযোগিতায় যেতে হয়। এধরনের একটি ঘটনায় আখতারের স্ত্রীর অফিসে ছুটে আসার ঘটনা আমার কাছে স্বাভাবিক মনে হয়নি। তার প্রতিবেশীদের কেউ খবরটি দেয়ার জন্য অফিসে আসতে পারত বা ফোনে জানাতে পারত। পরদিনই আখতার অফিসে এসেছেন। আহমদ আখতার ভাবলেশহীন। সন্তান হারানোর বেদনার কোনো ছাপ ছিল না তার চেহারায়।


১৯৮৩ সালে আমি জার্মান সরকারের একটি বৃত্তি লাভ করে তিন মাসের এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার জন্য বার্লিন যাই। সেখানে অবস্থানকালে বেশ ক’জন বাংলাদেশী ও পাকিস্তানি ছাত্রের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বার্লিন ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্সের এক পাকিস্তানি ছাত্র আজফার আলী খান একদিন বললেন যে বাংলাদেশের এক মশহুর শায়েরের ছেলে বার্লিনে থাকেন। তার সাথে পরিচয় আছে। তার নাম মাসুদ। তবে শায়েরের নাম বলতে পারেননি তিনি। জেনে আমাকে জানাবেন বললেও এক রোববার শায়েরের পুত্রকে বার্লিনের ক্রুয়েজবার্গে আমার হোস্টেল ‘কলপিং হাউজে’ নিয়ে এলেন। ফররুখ আহমদের বড় ছেলে। তাকে বললাম, আপনি এখানে আছেন। অথচ আহমদ আখতার আমাকে বলেনি। তিনি বললেন, আখতার একটু খামখেয়ালী ধরনের। কোনোকিছুতে সিরিয়াস নয়। তিনি নিজেও পরিবারের সাথে তেমন যোগাযোগ রাখেন না। তিনি জানালেন যে তিনি আর বেশিদিন বার্লিনে থাকবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই ইংল্যাণ্ডে চলে যাবেন। সেখানে ড. সৈয়দ আলী আশরাফের (দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা) প্রতিষ্ঠানে তার একটি চাকুরি হয়েছে। আরেকদিন তার সাথে দেখা হয়েছিল। মাসখানেক পর একদিন ফোনে বললেন যে তিনি পরদিনই ইংল্যাণ্ড চলে যাচ্ছেন। বার্লিনের প্রোগ্রাম শেষ করে দেশে ফেরার আগে আমার লণ্ডন যাওয়ার কথা। তাকে বললাম আমি লন্ডনে গিয়ে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আমি লন্ডনে গিয়ে তার সাথে ফোনে কথা বলি। সৈয়দ আলী আশরাফের প্রতিষ্ঠান লণ্ডন থেকে বেশ দূরে। তিনি আমন্ত্রণ জানালেও আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ আমার লন্ডন অবস্থান ছিল মাত্র আট দিনের জন্য।


দেশে ফিরে আহমদ আখতারকে তার ভাইয়ের কথা বলার পর তিনিও বললেন যে ভাইয়ের সাথে তাদের তেমন যোগাযোগ নেই। সে জন্য আমাকে ভাইয়ের বার্লিনে অবস্থান করার জানায়নি। এর কয়েক মাস পর আখতার খবর দিল তার ভাই আত্মহত্যা করেছেন। শুনে স্তব্ধ হয়েছি, দু:খ পেয়েছি। আখতারের দ্বিতীয় ভাই মঞ্জুরুল পড়াশোনা শেষ করে বাংলাদেশ বেতারে যোগ দিয়েছিল বলে শুনেছিলাম। হঠাৎ একদিন তাকে রাস্তায় দেখলাম একটি ছেঁড়া প্যান্ট, গেঞ্জি গায়ে, খালি পায়ে হেঁটে যেতে। মাথার চুল এলোমেলো, হাঁটছে। কোনোদিকে মনোযোগ নেই। যতক্ষণ দেখা যায় আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এ সম্পর্কে আহমদ আখতারকে কিছু বলিনি। কবি পরিবারের সাথে ঘনিষ্ট এমন দু’একজনের কাছে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হই যে মঞ্জুরুল বেশ কিছুদিন থেকে মানসিক রোগগ্রস্থ। রেডিওর চাকুরি নেই অনেকদিন আগে থেকেই। উন্নত চিকিৎসা করানোর সামর্থ পরিবারের ছিল না। বাসায় রেখে যা চিকিৎসা করানো তা করা হয়েছে। কিন্তু সারাক্ষণ বাসায় আটকে রাখা সম্ভব হতো না। কিছুদিন পর জানতে পারি মঞ্জুরুল মারা গেছে।


২০০২ সালে আহমদ আখতার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) বাংলা বিভাগে সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেয়। তার যোগ দেয়ার কিছুদিন আগেই আমি বাসস এর সেন্ট্রাল ডেস্কে নিউজ এডিটর হিসেবে যোগ দিয়েছি। পুরোনো একজন সহকর্মীকে আবারও একই প্রতিষ্ঠানে পেয়ে ভালো লেগেছে। কিন্তু তার সাথে খুব একটা দেখা হতো না। আমি দোতলায় ইংরেজি বিভাগে বসতাম, বাংলা বিভাগ ছিল তিন তলায়। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছর পর্যন্ত বিএনপি আমলে বাসসে যোগদানকারী সাংবাদিকরা বহাল ছিলেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বাসস এর নতুন প্রশাসন ছাঁটাই শুরু করে। প্রথমে অনেককে ডেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। আহমদ আখতার নিতান্তই ভদ্রলোক। সে পদত্যাগ করে। আমি জানতে পারি তিনি চলে যাওয়ার পর। এরপর তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আহমদ আখতার নিজের সমস্যা কাউকে খুলে বলার মতো লোক ছিলেন না। তার শারীরিক সমস্যাও হয়তো দীর্ঘদিন পর্যন্ত সবার অজানা ছিল। যখন জানতে পেরেছেন তারা সাধ্যমতো সহায়তা করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে আগমন ও প্রস্থানের সিদ্ধান্ত যেহেতু একমাত্র আল্লাহর, অতএব তাঁর সিদ্ধান্তেই আহমদ আখতারকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছে। আমি তাঁর পরকালীন শান্তি কামনা করি।

Published in Uncategorized

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *