আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
৩৭ খ্রিস্টাব্দ। ১৯৮৪ বছর আগের কথা। রোমানরা শেষপর্যন্ত নতুন এক শাসক লাভ করে। তিনি সম্রাট গেইয়াস সিজার অগাস্টাস জার্মানিকাস ((Gaius Caesar Augustus Germanicus) যিনি ইতিহাসে ‘ক্যালিগুলা’ (caligula) নামেই অধিক খ্যাত। চব্বিশ বছর বয়সে তিনি রোমের তৃতীয় সম্রাট হিসেবে সিংহাসনের আরোহণ করেন। তার শাসনকাল ছিল মাত্র চার বছর। এই সম্রাটের দু:শাসন এত চরমে পৌঁছেছিল যে যার প্রতি তিনি বিরাগ পোষণ করেন তাকে হত্যা তো করতেনই, এমনকি তার জন্মদিন মনে রাখতে না পারা অপরাধে তিনি অবলীলায় মানুষকে প্রকাশ্যে মত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে প্রশান্তি লাভ করতেন। নির্যাতন নিপীড়নে রোমানরা এত ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেছিল যে একদল প্রহরী স্ত্রী ও কন্যাসহ তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে রোমান জাতিকে দুরাচারী শাসকের হাত থেকে মুক্ত করে এবং যেনতেনভাবে তাদেরকে কবরস্থ করে। ক্যালিগুলা সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছেন গবেষক ও ইতিহাসবিদ স্টিফেন ড্যান্ডো-কলিন্স। তিনি তার লেখা “কালিগুলা: দ্য ম্যাড এম্পেরর অফ রোম” গ্রন্থে সম্রাটকে অনেকটা কল্যাণকামী শাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ক্যালিগুলা ইটালির অ্যান্টিয়ামে (বর্তমান নাম অ্যানজিয়ো) ১২ খ্রিস্টাব্দের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার পিতা জার্মানিকাস ও মা অ্যাগ্রিপপিনা’র ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন। তাদের পরিবার ছিল রোমের অভিজাত পরিবারগুলোর অন্যতম। ক্যালিগুলার প্রপিতামহ (দাদার পিতা) ছিলেন জুলিয়স সিজার। তার দাদা অগাস্টাস ও পিতা জার্মানিকাস উভয়ে সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু ক্যালিগুলা নিজের পাশবিক আচরণের কারণে পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য ও মর্যাদা ধরে রাখতে পারেননি। রোমান প্রজাতন্ত্রের অবসানের পর কালিগুলা যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাট জুলিয়াস সিজারের পালিত পুত্র অগাস্টাস অক্টাভিয়ান সিজারের শাসনামলের শেষ পর্যায়। একক নেতৃত্বের অধীনে অগস্টাস নতুন ধরনের রোমান শাসনের সূচনা করেছিলেন, যা অভিজাতদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। অগাস্টাসের সৎ পুত্র টাইবেরিয়াস রোমের সম্রাট হওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ করতেন না। সে কারণে রাজ্য শাসনের দায়িত্ব যৌথভাবে অর্পিত হয় অগাস্টাসের দুই কিশোর নাতির ওপর। কিন্তু অগাস্টাসের মৃত্যুর আগেই তাঁর দুই নাতির মৃত্যু ঘটে। অনিচ্ছুক টাইবেরিয়াসকে পুত্রের পূর্ণ মর্যাদা ও উত্তরাধিকারী হিসেবে দত্তক নেয়া হয় এবং পাশাপাশি তাঁর ভাতিজা জার্মানিকাসকেও দত্তক গ্রহণ করা আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে, যাতে সৎ পিতা অগাস্টাসের মৃত্যুর পর সম্রাটের মুকূট ধারণের ক্ষেত্রে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি না হয়। ১৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ আগস্ট অগাস্টাসের মৃত্যুর পর টাইবেরিয়াস ক্ষমতায় বসেন এবং জার্মানিকাসকে পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে পাঠানো হয় প্রশাসক হিসেবে।
জার্মানিকাস যখন তাঁর পুত্র গেইয়াসকে যখন প্রথম যুদ্ধাভিযানে তখন গেইয়াসের বয়স মাত্র তিন বছর। শিশু সৈনিক হিসেবে গেইয়াস অতি অনুগত ছিলেন এবং তখনই তিনি ‘ক্যালিগুলা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন তার পায়ে পরা ছোট জুতার কারণে। ১৯ খ্রিস্টাব্দে জার্মানিকাস অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ক্যালিগুলার জীবনী লেখক গেইয়াস সুয়েটোনিয়াস ট্রানকুইলাস (Gaius Suetonius Tranquillus) বিশ্বাস করতেন যে, টাইবেরিয়াসের আদেশে বিষপ্রয়োগে জার্মানিকাসকে হত্যা করা হয়েছিল, যিনি ভয় করতেন জার্মানিকাস তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হতে পারেন। ক্যালিগুলার মা এগ্রিপপিনা তাঁর স্বামী হত্যার সন্দেহ নিয়ে সোচ্চার হয়ে ওঠায় টাইবেরিয়াস তাঁকে দূরের এক দ্বীপে কারাদন্ড েেদন, যেখানে ক্ষুধায় তাঁর মৃত্যু ঘটে। এরপর সম্রাট টাইবেরিয়াস তাঁর বড় দুই পত্রকে কারাগারে প্রেরণ করেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় এক ভাই আত্মহত্যা করেন এবং দ্বিতীয় জন মায়ের মত ক্ষুধার তাড়নায় মারা যান। ক্যালিগুলা ও তাঁর বোনদের পক্ষ থেকে যেহেতু তাৎক্ষণিক কোনো বিপদের আশঙ্কা করা হয়নি, সেজন্য তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার কথা ভাবেননি। তাদেরকে দাদির মা লিভিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর লিভিয়ার মৃত্যু হলে ক্যালিগুলা ও তার বোন দাদি অ্যান্টোনিয়ার হেফাজতে লালিত হতে থাকেন।
দাদির কাছে অবস্থানের সময়েই কিশোর বয়সে ভবিষ্যৎ সম্রাটের কুখ্যাতির সূচনা ঘটে আপন বোন ড্রুসিলার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে। অবশ্য এ ঘটনার সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। ক্যালিগুলার বয়স যখন ১৮ বা ১৯ বছর তখন সম্রাট টাইবেরিয়াস তাঁর প্রতি তরুণ ক্যালিগুলার আনুগত্য পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তাকে ক্যাপরি দ্বীপে তলব করেন। সম্রাট তাকে রাজপুত্র হিসেবে মর্যাদা দেয়ার উদ্দেশে অথবা বন্দিতে পরিণত করার জন্য তলব করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে পরস্পর বিরোধী বর্ণনা রয়েছে। ক্যাপরি দ্বীপে ক্যালিগুলার সাথে রাজপুত্রের মত আচরণ করা হলেও কার্যত ওই দ্বীপে সম্রাট টাইবেরিয়াসের বন্দি ছিলেন, যা ক্যালিগুলার ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে, যার পরিণতি ছিল ভয়াবহ। তখন থেকে তার নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে শুরু করে বলে সুয়েটোনিয়াস তাঁর বিবরণে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “ক্যালিগুলা মানুষের ওপর নির্যাতন চালানো ও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য দেখতে ভালোবাসতেন এবং পরচুলা ও আলখেল্লা পরিধান করে কেলেঙ্কারিপূর্ণ প্রমোদে লিপ্ত হতে অভ্যস্ত ও দানবীয় হয়ে ওঠেন।” তার নির্মমতা এত ভয়ঙ্কর ওয়ে ওঠে যে স্বয়ং সম্রাট টিবেরিয়াস মন্তব্য করেছিলেন, “রোমান জনগণের জন্য আমি এক বিষধর সাপ লালন করছি।”
সম্রাট টাইবেরিয়াস ৩৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক মাস পর মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পেছনে ক্যালিগুলার হাত ছিল বলে জনগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত, কিন্তু তাঁর মৃত্যুতে তারা উচ্ছাস প্রকাশ করে। ধারণা করা হয় যে, রোমানদের প্রিয়ভাজন সামরিক নেতা জার্মানিকাসের পুত্র ক্যালিগুলাকেও তার পিতার মত ভালোবাসতো। রোমান সিনেট জনগণের সম্মতির সাথে একমত পোষণ করে। ক্যালিগুলার বয়স তখন ২৪ বছর এবং যুদ্ধ, কূটনীতি বা সরকার পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। তবুও তাকে রোমের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। প্রথম দিকে ক্যালিগুলার শাসনকে জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করে। পূর্ববর্তী সম্রাট যাদেরকে অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক রেখেছিলেন, তিনি তাদেরকে মুক্তি দেন, সার্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না এমন কর বিলোপ করেন। খেলাধূলাসহ জনগণের পছন্দনীয় অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু তার শাসনের ছয়-সাত মাসের মধ্যে সবকিছু পাল্টে যেতে শুরু করে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন ক্যালিগুলা এবং অল্পের জন্য মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসেন। ৩৭ সালের অক্টোবর মাসে তিনি সেরে ওঠলেও তাকে আর আগের মত সুস্বাস্থ্যের অধিকারী দেখা যায়নি।
তার আচরণ ক্রমশ উন্মাদতূল্য হয়ে যায়। তার বিলাসবহুল জীবনযাপন ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের জন্য তিনি উচ্চহারে করারোপ করেন। ক্যাপরিতে থাকাকালে তিনি যেসব নিষ্ঠুরতায় অভ্যস্ত হয়েছিলেন সেগুলো তার মাঝে আরও ভয়াবহ হয়ে ফিরে আসে এবং তিনি হয়ে ওঠেন রোমের কুখ্যাত কাম-বিলাসী, অজাচারী সম্রাট। ইতিহাসবিদদের মতে যে ব্যাধি তাকে মৃত্যুর মুখে নিয়ে ছিল তিনি তা থেকে শারীরিকভাবে আরোগ্য লাভ করলেও তার মাঝে মানসিক বিকৃতি এনে দিয়েছিল। তার অসংযত ব্যক্তিত্বের প্রভাব পড়ে প্রশাসনে এবং জনগণের ওপর স্টিফেন ড্যান্ডো-কলিন্স তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “শীঘ্রই তিনি সকলের প্রতি এবং সবকিছুর প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন। এমনকি রথ চালনার প্রতিযোগিতায় দর্শকরা যদি তার প্রিয় নীল দলের পরিবর্তে অন্য কোনো দলের সমর্থনে উচ্ছাস প্রকাশ করতো তিনি বিদ্রƒপের সাথে তাদের সকলকে মৃত্যুদন্ড দান করতেন।” কারও প্রতি অসন্তুষ্ট হলে তিনি তার ঘনিষ্ট জনকেও মৃত্যুর মুখে পাঠাতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেন না। তিনি তার জ্ঞাতি ভাই ও দত্তক নেয়া পুত্র টাইবেরিয়াস গ্যামেলাসকে হত্যা করেন। এতে তার দাদি ক্ষোভ প্রকাশ করলে স্বেচ্ছাচারী সম্রাট তাকেও মৃত্যুদন্ড দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। রোমানদেরকে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, “মনে রেখো, যে কারো ওপর আমার যে কোনোকিছু করার অধিকার রয়েছে।” এবং তিনি সে অধিকারের যথেচ্ছ প্রয়োগ করেন। তার জন্মদিন ভুলে যাওয়ার অপরাধে তিনি তার দু’জন উপদেষ্টাকে হত্যা করার আদেশ দেন। সিনেটররা সম্রাটের কোনো পদক্ষেপ সম্পর্কে পরস্পরের সাথে আলোচনা করতেও সন্ত্রস্ত থাকত। কারণ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের ধার ধারতেন না তিনি। তিনি মনে করতেন যে, “তার কথাই সর্বোচ্চ আইন।” তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তা কার্যকর করায় ব্যতিক্রম ঘটার কোনো সুযোগ ছিল না।
ক্যালিগুলা নিজেকে জীবন্ত দেবতা বলে ঘোষণা করেছিলেন বলে অনেক বিবরণীতে পাওয়া যায়। তিনি যে শুরু হারকিউলিস, মারকারি, ভেনাস ও অ্যাপোলো ইত্যাদি দেবতা ও উপদেবতাদের পোশাক পরিধান করতেন তাই নয়; তার প্রাসাদ থেকে জুপিটারের মন্দিরকে সংযুক্তকারী একটি সেতু নির্মাণের আদেশও দিয়েছিলেন। একবার তিনি সিনেটে ঘোষণা করেন যে তিনি মিশরে যাবেন, কারণ সেখানে তাকে জীবন্ত দেবতা হিসেবে পূজা করা হবে। এ ধরনের পাগলামির মাধ্যমে তিনি রোমান সম্রাজ্যের ক্ষমতার কেন্দ্রকে এতটাই কলুষিত করে ফেলেছিলেন, যা কেউ ভালো চোখে দেখেনি। যাদেরকে তিনি মৃত্যুদণ্ড দিতেন তাদের মা-বাবাকে সেই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার জন্য উপস্থিত থাকতে বাধ্য করতেন। এমনকি একটি ঘটনায় পুত্রের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দৃশ্য অবলোকনের জন্য দন্ডপ্রাপ্তের বৃদ্ধ পিতাকে আনার জন্য বাহন পাঠানো হয়েছিল। আরেক ব্যক্তি পুত্রের দণ্ড কার্যকর করার সময় চোখ বন্ধ রাখার অনুমতি চাওয়ার অপরাধে তাকেও হত্যা করা হয়। আরেকটি ঘটনায় ক্যালিগুলা তার দ্বারা দণ্ডিত এক ব্যক্তির বাবাকে ভোজে আমন্ত্রণ করেন, যার পুত্রকে সেদিনই হত্যা করা হয়েছিল। শোকার্ত পিতাকে পুরো সন্ধ্যাকাল সম্রাটের রসিকতা শুনে হাসতে বাধ্য করা হয়েছে; তা না হলে তাকেও তার পুত্রের ভাগ্য বরণ করতে হতো।
এক পর্যায়ে তিনি বিভিন্ন মূর্তির মাথা অপসারণ করে সেখানে নিজের মাথা স্থাপন করার আদেশ দেন। তার স্ত্রী-কন্যার চেয়ে তার ঘোড়া ইনসাইটাটাসের প্রতি তার অধিক ভালোবাসা ছিল। এমন কাহিনিও প্রচলিত রয়েছে যে ক্যালিগুলা তার ঘোড়াকে সিনেটর পদ দিতে চেয়েছিলেন। তার আত্মকেন্দ্রিকতা এখানেই শেষ হয়নি। তিনি যে নিজেকে দেবতা ভাবতেন যা সকল সরকারি দলিলপত্রে উল্লেখ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দীর্ঘ জীবনের আশায় তিনি ভিনেগারে মুক্তা দ্রবীভূত করে পান করতেন। ঘোড়ার গলায় পরিয়েছিলেন মূল্যবান রত্মপাথর শোভিত মালা এবং সমুদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তাকে ঘিরে কাহিনির সীমা-পরিসীমা ছিল না।
অ্যালোয়েস উইন্টারলিং এর লেখা ক্যালিগুলার জীবনীতে সম্রাটের উন্মত্ততার চরমাবস্থা সম্পর্কে বিস্ময়কর কথা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, “যেকোনো কারণে আধুনিক সকল লেখক ক্যালিগুলাকে পাগল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ‘পাগল’ সম্রাটের খ্যাতিকে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা অনেকটাই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছেন। অনেক ইতিহাসবিদ তাকে পাগল বললেও এর পেছনে সঠিক কারণ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি। একটি তথ্যে পাওয়া যায় যে মৃগীরোগের প্রকোপ তার মাথাব্যথার প্রধান কারণ ছিল এবং তিনি তখন মৃত্যুভয়ে আচ্ছন্ন থাকতেন। এ অবস্থায় তিনি চাঁদের সাথে কথা বলতেন বলেও জানা যায়।” ড্যান্ডো কলিন্সের মতে, “তার মধ্যে বাইপোলার অবস্থা ভর করত। শৈশবে তার মৃগীরোগ সনাক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু বাইপোলারের লক্ষণগুলো সনাক্ত করা হয়নি, কারণ ওই সময়ের চিকিৎসকদের কাছে বাইপোলার সমস্যা সম্পর্কে জানা ছিল না।”
ক্যালিগুলার কামলিপ্সা যে অদম্য ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নৈশভোজের আগে নারী অতিথিদের দেহ প্রদর্শনী উপভোগ করা তার প্রিয় রীতি ছিল, যাতে তিনি অতিথিদের মধ্য থেকে রাতে অবশিষ্ট সময়ের জন্য একজনকে যৌন সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। তিনি গেইয়াস পিসো (রাজ পরিবারের সদস্য) ও লিভিয়া ওরেস্টিলা’র বিয়েতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ওরেস্টিলাকে দেখে তার কাম লালসা চেগিয়ে ওঠে এবং বিয়ের ভোজ চলাকালে ক্যালিগুলা পিসোকে নির্দেশ দেন ওরেস্টিলার হাত ছেড়ে দিতে। তিনি ওরেস্টিলাকে তার সাথে বাড়ি নিয়ে যান এবং বিয়ে করেন। কিন্তু মাত্র দুদিন পর তাকে তালাক দেন। তিনি নিজে যখন কোনো অভিজাত নারীর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত না হতেন তখন তাদেরকে অন্যান্য পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন। বিলাসিতা ও প্রমোদের সাথে তার রাজকোষ শূন্য হয়ে গেলে তিনি অর্থ সংগ্রহের নতুন কৌশল হিসেবে প্রাসাদকে বেশ্যালয়ের রূপ দেন। রোমের সকল বিবাহিতা অভিজাত রমণী এবং বেশ কিছু সুদর্শন তরুণকে এই রাজকীয় বেশ্যালয়ে যৌনলিপ্সুদের নিয়োগ করা হয়েছিল কামবিলাসীদের মনোরঞ্জনের কাজে। ক্যালিগুলার রক্ষীরা যেসব ব্যক্তিকে রোমের রাজপথ থেকে বলপূর্বক ধরে আনতো তারাই ছিল অভিজাত বেশ্যা নারী ও তরুণ বেশ্যাদের খদ্দের।
ক্যালিগুলা প্রকাশ্য যৌনকর্মের সমারোহ করতেন বলে বিভিন্ন গ্রন্থে যা বর্ণনা করা হয়েছে ড্যান্ডো কলিন্স তা আংশিক সত্য বলে উল্লেখ করেছেন এবং সম্রাট টাইবেরিয়াসকে দোষারূপ করেছেন এহেন কর্মের জন্য, যিনি শিশুদের সাথে যৌনকর্মের জন্য কুখ্যাত ছিলেন এবং ক্যালিগুলা যখন কিশোর ছিলেন তখন পুরুষ বেশ্যাদের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন। কিন্তু ক্যালিগুলা সম্রাট হওয়ার পর রোম থেকে পুরুষ বেশ্যাদের বিতাড়ন করেন।” বোন ড্রুসিলার সাথে ক্যালিগুলার যৌন সম্পর্কের কাহিনিকেও ড্যান্ডো কলিন্স খারিজ করে দিয়েছেন। তার মতে, “ক্যালিগুলা তার বোনের সাথে যৌনকর্ম করেননি। ড্রুসিলা তার প্রিয়ভাজন ছিলেন এবং তাদের এ ঘনিষ্টতাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।” তবে তিনি যে সুশাসক ছিলেন না, ড্যান্ডো কলিন্স তা স্বীকার করেছেন। “তার মর্জি বা পাগলামির শিকারে পরিণত হয়ে অসংখ্য মানুষ জীবন হারিয়েছে। তিনি তার প্রশাসনের প্রথম মাসগুলোতে অনেক অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু প্রশাসক ও নেতা হিসেবে তার ব্যর্থতা ছিল বিপর্যয়কর। কারণ তিনি নি:সন্দেহে নিষ্ঠুর, খামখেয়ালী এবং উন্মাদ ছিলেন।”
পূর্ববর্তী সম্রাটের কবলমুক্ত হওয়ার পর ক্যালিগুলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন রোমানরা তাকে স্বাগত জানালেও তিনি কখনো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। রোমানরা তার দু:শাসনে অতীষ্ঠ হয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার জন্য গোপনে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। ৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি একটি ক্রীড়া উৎসবের পর একদল প্রহরী তাকে হত্যা করে। তার দেহে ত্রিশটি আঘাত হানা হয়েছিল। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু ঘটে। তার স্ত্রী ও কন্যাকেও কুপিয়ে হত্যা করা হয় এবং যেনতেনভাবে খোড়া গর্তে পুঁতে রাখা হয়। ঘাতকরা ক্যালিগুলাকে হত্যা করে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। রোমান ইতিহাস থেকে এই ব্যক্তিকে মুছে ফেলতে আগ্রহী ছিল সিনেট। তারা রোম থেকে ক্যালিগুলার সকল মূর্তি ধ্বংস করার নির্দেশ দেয় এবং ক্যালিগুলার চাচা ক্লদিয়াসকে নেতৃত্বে বসিয়ে নতুন রোমান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ক্লদিয়াসের পরিবারের প্রায় সকল সদস্যকে হত্যা করেছিলেন ক্যালিগুলা এবং ক্লদিয়াস আত্মগোপন করে প্রাণরক্ষা করেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার যে, ক্যালিগুলাকে হত্যার পর প্রাচীন রোমের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছিল এবং যারা ক্যালিগুলাকে হত্যা করেছিল ক্লদিয়াস তাদের কঠোর দণ্ড বিধান করেছিলেন।
১৯৭৯ হলিউডে সম্রাট ক্যালিগুলার জীবন ভিত্তিক মুভি “ক্যালিগুলা” (https://www.youtube.com/watch?v=h2_uJJVz0tY) নির্মিত হয়েছে। যৌন দৃশ্যে ভরা এই মুভিতে কুখ্যাত রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার উত্থান ও পতন দেখানো হয়েছে। ইটালিয়ান পরিচালক গিয়োভান্নি টিন্টো ব্রাস পরিচালিত মুভিতে ক্যালিগুলার অভিনয় করেছেন ম্যালকম ম্যাকডোয়েল। পার্শ্ব চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন তাদের মধ্যে ‘লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া’ খ্যাত অভিনেতা পিটার ও’তুলে রয়েছেন। ক্যালিগুলা’ মুভিতে যৌন দৃশ্য প্রাধান্য পাওয়ায় পরিচালক টিন্টো ব্রাস আপত্তি করেছেন যে, তিনি মূলত একটি ব্যঙ্গরসাত্মক মুভি তৈরি করেছিলেন, যেখানে অনেক রাজনৈতিক দৃশ্য ছিল। কিন্তু প্রযোজক অনেক দৃশ্য বাদ দিয়ে নতুন করে শ্যুটিং করিয়েছেন এবং পুরো মুভিকে যৌন দৃশ্য নির্ভর মুভি হিসেবে রিলিজ করেছেন। কানাডা, আইসল্যান্ডসহ বেশ কিছু সংখ্যক দেশে এখনও ‘ক্যালিগুলা’ প্রদর্শন নিষিদ্ধ।
Comments