Skip to content →

কাজীর কাঠগড়ায় আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ভূমিকা: এক সাক্ষাৎকারে এক বই, এমন ঘটনা বাংলা ভাষা/সাহিত্যে এখন আর বিরল নয়। প্রায় এক যুগ আমি খণ্ডকালীন সাংবাদিকতা করেছি। সেই সময়ে বহু মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছি। আমার পছন্দের বিষয় যেহেতু শিল্প-সাহিত্য, সাক্ষাৎকার গ্রহনের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরাও ছিলেন কবি, লেখক, শিল্পী, অভিনেতা। কখনোই কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহন করিনি। সেইসব সাক্ষাৎকার যেহেতু পত্রিকা/ম্যাগাজিনের জন্য নিয়েছি, সঙ্গত কারণেই কলেবরও খুব ছোটো ছিল এবং সেইসব সাক্ষাৎকার আমি সংগ্রহ করেও রাখিনি। এখন, এই পরিণত বয়সে এসে, এমন কোনো কাজ করতে চাই না যা খুব সহজেই কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে পারে, নিদেনপক্ষে আমার কাজগুলো গ্রন্থবদ্ধ হোক, তারপর মহাকাল যদি মুছে দেয় তো দেবে।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুর এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণের দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, আমাদের দুজনের ভৌগোলিক অবস্থান খুব কাছে। চাইলে রোজই আমরা দেখা-সাক্ষাৎ করতে পারি, কথা বলতে পারি। দিনের পর দিন কথা বলে জেনেছি তার জীবন বর্ণাঢ্য, বিচিত্র অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন, পরস্পর বিপরীত মেরুর গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের এবং বিদেশের বহু আলোচিত-সমালোচিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদেরকে কাছে থেকে দেখেছেন। বিশ্বসাহিত্যের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। দেশের এবং বিদেশের অনেক সেরা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করেছেন। আমি মনে করেছি তার অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানের আলো যদি লিপিবদ্ধ করা যায় বাংলা ভাষার পাঠক সমৃদ্ধ হবেন। এটিই দ্বিতীয় কারণ, আমি চেয়েছি তিনি তার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যা অর্জন করেছেন তার কিছুটা হলেও বের করে আনি, উন্মুক্ত করি সকলের জন্য।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আমার দেখা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী মানুষ। তিনি খুব সাহসীও। তার এই সাহস কখনো কখনো প্রিয়জনদের ভয়েরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সত্য প্রকাশে তিনি অকপট। আপোষকামিতা তাকে কখনোই স্পর্শ করে না। প্রাপ্তির প্রত্যাশা কিংবা হারানোর ভয় তার নেই। আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ তাই মৃত্যুভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না।

এই গ্রন্থের নাম কেন “কাজীর কাঠগড়ায় আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু”? কাঠগড়া শব্দটি প্রতীকী। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে যেমন সত্য বলার শপথ করতে হয়, আমি চেয়েছি এই সাক্ষাৎকারে সাক্ষাৎকারদাতা তেমনি সকল প্রশ্নের উত্তরে সত্য বলার একটি নৈতিক শপথের মধ্যে থাকবেন। এখন থেকে আমি নিয়মিত এই কাজ করবো বলে আশা রাখছি। “কাজীর কাঠগড়ায়” এই শব্দবন্ধ সাক্ষাৎকার দাতার নামের আগে গ্রন্থের শিরোনাম হিসেবে সব সময় থাকবে। অর্থাৎ আমার গৃহীত সাক্ষাৎকার গ্রন্থসিরিজ হবে “কাজীর কাঠগড়ায়”।

আমি এবং মঞ্জু ভাই ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন, কখনো আমার বাসায়, কখনো তার বাসায়, কখনো কোনো পার্কে, কখনো রাস্তায় কথা বলেছি। এইসব আলোচনার মধ্য থেকে সুচিন্তিতভাবেই প্রশ্ন নির্বাচন করেছি। চেষ্টা করেছি তার ব্যক্তিজীবন, সাংবাদিক জীবন, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে আন্তক্রিয়া, শিল্প-সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, বিশ্ব পরিস্থিতি, উপমহাদেশ বিষয়ে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্জাত দৃষ্টিভঙ্গির সুস্পষ্ট চিত্রটি যাতে তুলে ধরতে পারি এই গ্রন্থে। তথ্য ও বক্তব্যের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য চেষ্টা করেছি লিখিতভাবে উত্তর সংগ্রহ করতে। লিখিত উত্তর পাওয়ার পরে কখনো কখনো সেই সব নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সাক্ষাতে বা ফোনে কথা বলে নিয়েছি। এভাবে প্রায় তিন মাস ধরে এই সাক্ষাৎকার গ্রন্থটি নির্মাণ করি আমরা দুজন মিলেই। আমি জানি তিনি একজন ধীর স্থির ও ধৈর্য্যশীল মানুষ, তার পরেও এই গ্রন্থের শুদ্ধতা রক্ষার জন্য তাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে, বাড়তি ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হয়েছে, এজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। ওরিয়ানা ফালাচির বিখ্যাত সাক্ষাতকার গ্রন্থ ‘ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি’ বাংলায় তরজমা করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, আমি সেই গ্রন্থ গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করেছি। কাজেই আমরা দুজনই ইন্টারভিউ দেবার এবং ইন্টারভিউ নেবার বিষয়ে আমাদের অধীত জ্ঞানের আলোকে সব সময়ই সচেতন থেকেছি।

আমি বার বার মঞ্জু ভাইকে বলেছি, মন খুলে বলেন, হাত খুলে লেখেন। তিনি কথা রেখেছেন। অনেক প্রশ্নের উত্তরই তাই কলেবরে দীর্ঘ কিন্তু এই দৈর্ঘ্যে বাহুল্য নেই বলেই আমার মনে হয়েছে। এই সাক্ষাতকারে ইতিহাসের অনেক লুকোনো সত্য উঠে এসেছে, রাজনীতির অনেক ঘটনা যা বিস্মৃত হতে চলেছে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, তা উঠে এসেছে। সমাজ ও রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে এই সাক্ষাৎকার এন্টারটেইনিং এবং তথ্যবহুল হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

খুশবন্ত সিং বলেছেন তার লেখালেখি ৩টি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, নতুন তথ্য দেওয়া, মানুষকে আনন্দ দেওয়া এবং মানুষকে ক্ষেপানো। এই সাক্ষাতকারেও এই ৩ নীতির প্রতিফলন আছে।

পাঠকের প্রতি অন্তহীন ভালোবাসা।

কাজী জহিরুল ইসলাম

হলিসউড, নিউইয়র্ক। ১৫ নভেম্বর ২০২০।

——————————————–

কাজী জহিরুল ইসলামঃ ছেলেবেলায় বাবা-মা, গ্হৃশিক্ষক, পাড়ার মুরুব্বিরা জিজ্ঞেস করেন, জীবনের লক্ষ্য কি? বড় হয়ে কি হতে চাও? কখনো কি এর উত্তরে বলেছিলেন সাংবাদিক হতে চাই? কিভাবে সাংবাদিকতায় এলেন?

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জুঃ একেবারে শৈশবে কার এ ধরনের প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছি তা আমার মনে নেই। তবে আমার মা চাইতেন তাঁর ছেলেমেয়েদের কোনো একজন ডাক্তার হোক। কারণ তাঁর ভাইসহ তাঁর দিকের অনেকেই ডাক্তার ছিলেন। আমার নানা ছিলেন ওই এলাকার একজন নামী কবিরাজ। পরে আমার দুই মামার আট ছেলের মধ্যে চার জন ডাক্তার হয়েছেন। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের কেউ ডাক্তার হওয়ার দিকে যায়নি। আমাদের বৃহত্তর পরিবারেও কোনো ডাক্তার ছিল না। শতভাগ কৃষিজীবী সম্পন্ন পরিবার। জমি-ফসলের বাইরে আর কিছু ভাবেনি কেউ। এর মধ্য থেকেও আমার আব্বা ও চাচা কৃষি বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে দুজনই কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে চাকুরি করেন।

জহিরুলঃ মায়ের প্রত্যাশা কি আপনার মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করতে পারলো? মানে ডাক্তার হওয়ার জন্য প্রত্যয় তৈরি হলো?

মঞ্জুঃ না, পারিনি। ক্লাস নাইনে ওঠার পরই বুঝে যাই, মায়ের আশা পূরণ করতে পারবো না। বিজ্ঞান মাথায় ঢুকতো না। সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস গড়ে ওঠেছিল ক্লাস ফাইভ থেকে। আব্বা তখন একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখতেন। হকার দিয়ে যাওয়ার পর ষোলো পৃষ্ঠার পত্রিকা একদিনেই পড়ে ফেলতাম। প্রতি সংখ্যায় শিশু-কিশোরদের জন্য দুটি পৃষ্ঠা থাকতো। তাতে একটি প্রশ্নোত্তর বিভাগও ছিল। পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হতো। দু’এক বছর পর ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ার সময় আমিও দু’একটা প্রশ্ন পাঠিয়েছি; বালসুলভ প্রশ্ন। কোনোটির উত্তর পেয়েছি, কোনোটির পাইনি। ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখলে মনে হতো সপ্তম আসমানে ওঠে গেছি। দৈনিক পত্রিকা পড়তে শুরু করি ক্লাস এইটে। প্রতিদিন বিকেলে এক বিহারি নাপিতের দোকান ‘আনারকলি সেলুনে’ গিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক পড়তাম। নাপিতের দোকানে ইত্তেফাক পড়া ছাড়াও একটি ওষুধের দোকানে দৈনিক আজাদ পড়তাম। ইতোমধ্যে আমি সংবাদ লেখার ধরন অনুসরণ করা শুরু করেছিলাম। বিশেষ করে দুর্ঘটনার খবর। আমি অবাক হতাম যে প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার খবর শেষ হতো “দুর্ঘটনার পর ড্রাইভার নিরাপদে পালাইয়া যাইতে সক্ষম হয়” এবং “লাশ ময়না তদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়”। ময়না তদন্ত কী তা বোঝানোর মতো কেউ ছিল না। কাউকে জিজ্ঞাসা করতে লজ্জাবোধ হতো, যদি ভেবে বসে ক্লাস এইট-নাইনে পড়ে, অথচ ‘ময়না তদন্ত’ বোঝে না। অবশেষে কারো কাছে জানতে পারলাম যে ময়না তদন্ত কী। শেরপুরে তখনকার শহর সীমানার একেবারে এক প্রান্তে, মেথর পট্টির কাছেই নাকি লাশকাটা ঘর আছে। এর ওর কাছে শুনে বুঝতে পারি দুর্ঘটনা, হত্যা ও আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে ওই ঘরে লাশ চিড়ে দেখা হয় শরীরের কোথায় আঘাত লেগেছিল, কী দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল, বিষ খেলে বা ফাঁসিতে ঝুললে কী বিষ ও কতোটুকু পান করেছিল, বা কতো সময় ধরে ফাঁসিতে লটকে ছিল ইত্যাদি।

একদিন আমি লাশকাটা ঘরটিও দেখে আসি। তখন সেটি পরিত্যক্ত ছিল। ময়না তদন্ত করার কাজ হতো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। ওই সময়ে আমাদের ওখানে দুটি দৈনিকের সংবাদদাতা ছিলেন, একজন শহরের ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক সুনীল বরণ দে, তিনি দৈনিক পাকিস্তান এর নিজস্ব সংবাদদাতা ছিলেন। আরেকজন খন্দকার মুজিবুর রহমান, পেশায় ঘড়ির মেকানিক হলেও মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন এবং দৈনিক আজাদ এর নিজস্ব সংবাদদাতা ছিলেন। (খন্দকার মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতার পর শেরপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন)। তাদের দু’জনের বাড়ির সামনে সংশ্লিষ্ট দৈনিক দুটির নিজস্ব সংবাদদাতার পরিচয় সম্বলিত বড় নেমপ্লেট ঝুলানো ছিল। আমার মনে হতো, কবে আমি এমন নেমপ্লেট ঝুলাবো।

জহিরুলঃ তো সাংবাদিক হওয়ার যাত্রা তখন থেকেই শুরু?

মঞ্জুঃ হ্যাঁ, ক্লাস নাইনে পড়ার সময়েই আমি এক সিনিয়র বন্ধুর সাথে ঢাকায় আসি। তখন ১৯৬৭ সাল। আমার অবস্থানকাল ছিল দুই সপ্তাহ এবং পুরো সময়টাই কাটিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সপ্তাহ ছিলাম ফজলুল হক হলে, আরেক সপ্তাহ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। হলে রাত কাটিয়েছি, হলের ডাইনিং, ক্যান্টিনে খেয়েছি। যাদের সাথে তখন পরিচয় ঘটেছিল, তাদের কোনো এক একজন পাকিস্তান অবজারভার অথবা দৈনিক পূর্বদেশ এ কাজ করতেন। তাঁর নাম ভুলে গেছি। তাঁর অফিস দেখতে চাইলে তিনি এক সন্ধ্যায় আমাকে এবং আমি যে বন্ধুর সাথে ঢাকায় গিয়েছিলাম তাকে তার অফিসে নিয়ে যান। নিউজ রুম, কম্পোজ করার জায়গা, এবং প্রেস ঘুরিয়ে দেখান। ওই সময় পত্রিকা ছাপানো হতো ভোর রাতে। অতএব ছাপানো দেখতে পারিনি। তিনি যতটুকু বুঝিয়েছেন – নিউজপ্রিন্টের বিশাল রোল কোথায় দেওয়া হয়, কিভাবে কোথায় প্লেট লাগানো হয়, পত্রিকা ছাপা হয়ে কিভাবে ভাঁজ হয় – সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেন। আমার কাছে বিষয়গুলো বিস্ময়ের মতো ছিল। তিনি একই দিনে দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক আজাদ ও দৈনিক পয়গাম অফিস ঘুরিয়ে দেখান। এজন্য আমি তাঁর কাছে এখনো কৃতজ্ঞ।

সংবাদপত্র অফিস ভ্রমণের পর আমি মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলি যে, ভবিষ্যতে যদি কোনো কাজ করতে হয়, তাহলে আমি সাংবাদিকতাই করবো। তবে মনের পেছন দিকে আরেকটা চিন্তা ছিল, সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার, প্রথমত আমাদের সম্প্রসারিত পরিবারের এক দাদা ও এক চাচা সেনাবাহিনীতে ছিলেন এবং দূর সম্পর্কের এক ভাই বিমান বাহিনীতে ছিলেন। সারা বছর তারা পশ্চিম পাকিস্তানে থাকতেন, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের কাছে যুদ্ধের কাহিনী শুনে সামরিক বাহিনীতে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। যাহোক, ঢাকা থেকে ফেরার পর আমাদের এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে আমি ছোটখাট খবর লিখে দৈনিক আজাদ বা দৈনিক পয়গামে পাঠিয়ে দিতাম। পয়গাম আমাদের এলাকায় তেমন চলতো না, অতএব পয়গামে আমার পাঠানো কোনো খবর ছাপা হয়েছে কিনা তা দেখিনি। তবে আজাদে আমার বেশ কটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে আমার সাংবাদিকতার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। আমি নিজে থেকে সংবাদপত্র অফিসে যোগাযোগ করতে শিখি। আরো কিছু মাসিক সাময়িকীর গ্রাহক হই – মাহে নও, বাংলা ডাইজেস্ট, আজকের জার্মানি। আব্বা কৃষি বিভাগে চাকুরি করার কারণে প্রতি মাসে ‘কৃষি কথা’ আসতো। মাঝে মাঝে মার্কিন পরিক্রমাও আসতো। গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম সবগুলো।

ইতোমধ্যে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন শুরু হয়, যার দোলা আমাদের ছোট মফস্বল শহরেও লেগেছিল। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, মেম্বারদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছিল। মুসলিম লীগের একজন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন এবং তার বাড়িতে যেসব আন্দোলনকারী গিয়েছিল তাদের ওপর বন্দুকের গুলি ছোড়েন। গুলিতে দারোগ আলী নামে আমাদের স্কুলের ক্লাস নাইনের এক ছাত্র নিহত হয়। তার স্মৃতিতে স্থানীয় পার্কের নাম ‘শহীদ দারোগ আলী পার্ক’ রাখা হয়েছে। ওই বছর আমার এসএসসি পরীক্ষা। সামরিক আইন জারি হওয়ায় পরীক্ষা পিছিয়ে গেল। পরীক্ষা দেওয়ার পর কয়েক মাসের বিরতিতে ফলাফল পেয়ে স্থানীয় কলেজে ভর্তি হই। ঊনসত্তরের শেষ দিকে সকল সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেখছিলাম যে দৈনিক সংগ্রাম নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হবে। যারা বিভিন্ন স্থান থেকে সংবাদদাতা হতে ইচ্ছুক তাদেরকে আবেদন করতে বলা হয়েছে। আমি আবেদন করি এবং আমাকে শেরপুর সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ ও পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। সংগ্রামের প্রকাশনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৯৭০ সালের ১৭ই জানুয়ারী। ঘটনাচক্রে আমি তার দু’দিন আগে থেকেই ঢাকায় ছিলাম। একদিন ওয়ারীর ৩১ র‌্যাাঙ্কিন ষ্ট্রিটে গিয়ে পত্রিকাটির অফিসও দেখে এসেছি। ১৭ই জানুয়ারি সকালে ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে দৈনিক সংগ্রামের উদ্বোধনী সংখ্যা কিনে ট্রেনে চেপে বাড়ি চলে যাই। আমি কখনো উচ্ছাস প্রকাশ করি না। তবে মনে মনে আমি উচ্ছসিত ছিলাম।

জহিরুলঃ বলা যায় সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্নটি আস্তে আস্তে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে শুরু করলো।

মঞ্জুঃ একদম ঠিক। তখন থেকে সাংবাদিকতা আমাকে জড়িয়ে রাখে, আমিও সাংবাদিকতাকে ধারণ করি। ১৯৭০ সালের পুরো সময় এবং ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রচুর খবর পাঠিয়েছি। প্রতিটি খবর যথাযথ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর চলে আসার আগেই আমরা গ্রামের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম এবং আমার পক্ষে আর কোনো খবর সংগ্রহ বা পাঠানোর সুযোগ হয়নি। একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বরের পর দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।

জহিরুলঃ জন্ম ও বেড়ে ওঠার গল্প বলেন। চারপাশের আর্থসামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ, পরিবারের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, অর্থাৎ যেসব উপকরণ শিশুর মনস্তত্বে প্রভাব ফেলে, শৈশব-কৈশোর গড়ে তোলে, পরিপুষ্ট করে তোলে সেইসব গল্প শুনতে চাই।

মঞ্জুঃ আমার জন্ম ১৯৫৪ সালে। বর্তমান শেরপুর জেলার শ্রীবর্দি উপজেলাধীন গড়জরিপা গ্রামে। আব্বার ছোট্ট এক নোটবুকে লেখা ছিল ১লা ফালগুন, কিন্তু বাংলা সনের উল্লেখ ছিল না। লেখা ছিল ১৯৫৪। দিনটি গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুসারে ফেব্রুয়ারী মাসের ১৩ অথবা ১৪ তারিখে পড়ে। সার্টিফিকেট অনুযায়ী বয়স প্রকৃত বয়সের চেয়ে কয়েকদিন বেশি। আমাদের পরিবার বর্ধিষ্ণু কৃষি পরিবার। দাদার যে পরিমাণ আবাদি জমি ছিল তা ওই সময়ে মানুষের ঈর্ষার কারণ ঘটাতো। তিনি ছিলেন ওই অঞ্চলের বহু গ্রামের মধ্যে একমাত্র হাজি। হাজি সাহেবকে দেখতে ও তাঁর দোয়া নিতে এবং তাঁর কাঠের দোতলা বাড়ি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসতো। লোকজন তাঁকে আরো সম্মান করতো গ্রামের বড় মসজিদে তিনি বিনা হাদিয়ায় জু’মা নামাজ ও দুই ঈদের জামাতে ইমামতি করার কারণে। তাঁর নাতি হিসেবে আমরা এলাকাবাসীর কাছে শৈশব থেকেই অন্য শিশুদের চেয়ে বেশি কদর পেয়েছি। আগেই কলেছি, আব্বা ও চাচা কৃষি বিভাগে চাকুরি করতেন। কৃষি বিভাগের চাকুরিতে যোগ দেয়ার আগে আব্বা বগুড়া আজিজুল হক কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করতেন, তখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ওই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেখান থেকে তিনি ঢাকার শেরে বাংলা নগর কৃষি ইন্সটিটিউটে (বর্তমানে শেরে বাংলানগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) পড়াশোনা করে সরাসরি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের চাকুরিতে যোগ দেন। দাদা চেয়েছিলেন তার বড় ছেলে জমির দেখাশোনা করবে। তা হয়নি। আব্বাকে অনুসরণ করে আমার চাচাও শেরপুর কৃষি ইন্সটিটিউটে (বর্তমানে কলেজ) পড়াশোনা করে চাকুরি শুরু করেন। আমাদের সম্প্রসারিত পরিবারে আব্বাই প্রথম চাকুরিজীবী।

আমাদের গ্রামের অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের যে কোনো গ্রামের চেয়ে ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী। গ্রামের চারপাশ ঘিরে উঁচু টিলা, আমরা ‘জাঙাল’ বলতাম। টিলায় ছিল প্রচুর গাছ, বেজি, শিয়াল ও পাখির অভয়াশ্রম। আমরা দিনের বেলায় গাছে ঢাকা টিলার দিকে যেতে ভয় করতাম। কোনো কোনো অংশ বেশ উঁচু, কোথাও বা লোকজন বাড়িঘর বানিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম পাশ দিয়ে টিলার কোল-ঘেঁষে বেশ প্রশস্ত খাল, দক্ষিণ-পশ্চিম কোনায় একটি বড়সড় বিল, যার নাম ‘কালিদহ’ সাগর। এটিকে কেন্দ্র করে আমরা ছেলেবেলা থেকেই বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। প্রথম টিলার পর দ্বিতীয় টিলার অস্তিত্বও দেখেছি গ্রামের প্রায় অর্ধেকটা তখনো বেষ্টন করে ছিল। বাকি অর্ধেক সমতলভূমিতে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় একটি টিলার অংশবিশেষও দেখেছি আমরা। শুনেছি একজন জরিপ শাহ নামে একজন শাসক ছিলেন, যিনি তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য করার জন্য এভাবে সাত স্তরে মাটির টিলা ও পরিখা খনন করেছিলেন। তার নামানুসারেই আমাদের গ্রামের নাম গড়জরিপা। আমাদের গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পুরোনো আমলের অনেক ইট এবং মাটির নিচে অর্ধেকটা দেবে যাওয়া একটি নির্মাণাধীন অট্টালিকার সাথে জড়িত নানা কাহিনি আমার জন্য রূপকথা ও ইতিহাসের আদি পাঠ ছিল।

আমাদের পরিবার ধর্মীয় দিক থেকে রক্ষণশীল হলেও গোঁড়া ছিল না। দাদা চাইতেন পরিবারে সকলেই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, কিন্তু ধর্ম চর্চা ঠিকমতো করুক। তিনি তাঁর পরিবারের কাউকে মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণের দিকে ঠেলে দেননি। সে কারণে আমাদের বৃহত্তর পরিবারে মাদ্রাসা পড়ুয়া কেউ নেই। অন্য কোনো ওয়াক্তের নামাজ পড়ি আর না পড়ি, সন্ধ্যার আগে বাড়ি এসে মাগরিবের নামাজ পড়া অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল। নামাজের সময়ের আগে বাড়িতে থাকলে আমাকে অথবা আমার বড় ভাইকে মাগরিবের আজানও দিতে হতো। মামাদের পরিবার তেমন রক্ষণশীল ছিল না, আধুনিক শিক্ষার কদর বেশি ছিল। কৃষির দিকে তারা কখনো মনোযোগ দেননি। আমরা এই দু’য়ের সমন্বয়ে বেড়ে উঠি। আমার বড় মামার ছেলে ডা: আবু মালেক (লেবু ভাই) এবং ছোট মামার মেয়ে শেফালি বু’ আমাদের কাছে আদর্শ ছিলেন। আম্মা সবসময় এই দু’জনের গল্প বলতেন। লেবু ভাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইংল্যাণ্ডে চলে যান। বর্তমানে বার্মিংহামে আছেন। শেফালি বু’ সরকারি গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে অবসর নিয়েছেন।

জহিরুলঃ আপনাদের পরিবার ধার্মিক ছিল কিন্তু গোঁড়া ছিল না, পত্র পত্রিকা এবং বইপত্র ছিল, তাঁর মানে কিছুটা মুক্ত বুদ্ধির চর্চা ছিল। আর সাংস্কৃতিক চর্চা?

মঞ্জুঃ আমাদের পরিবারে কখনো গোঁড়ামি ছিল না। তবে আমাদের গ্রামে সংস্কৃতি চর্চারও কোনো সুযোগ ছিল না। হয়তো ওই সময়ে অধিকাংশ গ্রামের চিত্র অভিন্ন ছিল। গ্রামের কারো বাড়িতে কোনো রেডিও, গ্রামোফোন বা কলের গান পর্যন্ত ছিল না। সন্ধ্যায় কোনো কোনো বাড়ির সামনে পুঁথি পাঠের আসর বসতো এবং রাত পর্যন্ত চলতো। বাড়ির পেছনের দিকে কয়েক ঘর জেলে ছিল, একবার তারা কলের গান ভাড়া করে আনে রূপবানের কাহিনি ও গান শোনার জন্য। আমি তখন ক্লাস টু’তে পড়ি। পাঁচটি বা ছয়টি রেকর্ডে পুরো কাহিনি ছিল। জেলে বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না আমাদের। রূপবান গান শোনার জন্য দাদি বিশেষ অনুমতি নিয়ে কারো সঙ্গে যেতে দেন। মহাবিস্ময়ে কলের গান দেখি ও রূপবান শুনি। আরেকটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুমতি ছিল, সেটি কালিহদ সাগরের দক্ষিণ পাশে আয়োজিত চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা। আমাদের গ্রামে কোনো হিন্দু নেই। কিন্তু কালিদহের পাশে চৈত্র সংক্রান্তি মেলায় দূরদূরান্ত থেকে হিন্দুরা আসতো স্নান করতে এবং অন্যান্য ধর্মীয় আচার পালন করতে। আমরা মেলায় গিয়ে বাঁশি, বেলুন, আম কাটার জন্য চাকু, বাতাসা, চিনি ও গুড়ের সাজ ও মুড়কি কিনে সন্ধ্যায় মহানন্দে বাঁশি বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরতাম। পহেলা বৈশাখের কোনো অনুষ্ঠান না হলেও ওইদিন বিশেষ কিছু খাবার রান্না করা হতো। যার মধ্যে কয়েকটি আইটেম হতো তিতা স্বাদের – করলা পাতা, নিম পাতা সহযোগে বানানো হতো। সংস্কৃতি চর্চা বলতে এটুকুই ছিল। গ্রামের বাড়িতে কোনো পত্রপত্রিকাও দেখিনি। ধর্মীয় বই এবং কিছু পুঁথি ও গল্প-উপন্যাসের বই ছিল। বছরের দুই ঈদের প্রভাব আমাদের ওপর বেশি ছিল। সারা বছর অপেক্ষা করতাম, কখন রোজার মাস আসবে। ১৯৬২ সালে ক্লাস ফোরে ওঠার পর আমরা গ্রাম থেকে ছয় মাইল দূরে শেরপুর শহরে চলে আসি। জিকে হাইস্কুলে (তখন স্কুলটির পুরো নাম ছিল গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউশন) আমাকে ক্লাস ফোরে এবং আমার বড় ভাইকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করানো হয়।

জহিরুলঃ কখন প্রথম বাড়ি ছাড়েন, কেমন ছিল সেই বাড়ি-ছাড়া, আপনজন ছাড়া জীবন?

মঞ্জুঃ প্রথম বাড়ি ছাড়ি ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার জন্য ঢাকায় আসি। এ বাড়ি ছাড়া যদিও মাত্র এক মাসের জন্য। তবুও টানা এক মাস মা’কে ছেড়ে থাকা আমার জন্য কষ্টকর ছিল। পরীক্ষা শেষে বাড়ি চলে যাই। এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর আবার আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য। এ সময়টি দীর্ঘ ছিল। সারাদেশে তখন বন্যা। বাড্ডায় কয়েক বন্ধু একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল। আমি তাদের সাথে কাটাই প্রায় দেড় মাস। সবাই ঘনিষ্ট ছিলাম বলে মায়ের শূন্যতা ছাড়া তেমন কষ্টবোধ হয়নি। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ক্লাস শুরু হয় তখন মা’কে ছেড়ে কীভাবে এতোগুলো বছর কাটাবো ভাবতেই বুক ভারি হয়ে উঠতো, একা থাকলে চোখে পানি গড়াতো। প্রথম দিকে তো বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করেই বাসস্ট্যাণ্ড বা কমলাপুর ষ্টেশনে চলে যেতাম। শুক্রবার, শনিবার কাটিয়ে রোববার দুপুরের বাসে উঠে ঢাকায় ফিরে আসতাম। এ অবস্থা চলেছে দুই বছরের বেশি সময়। এরপর আমি সাংবাদিকতা শুরু করায় বাড়ি যাওয়া কমতে থাকে।

জহিরুলঃ ঢাকায় আসেন কবে? মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন? সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলেন।

মঞ্জুঃ আগেই বলেছি ঢাকায় বলতে গেলে স্থায়ীভাবে এসেছি ১৯৭৪ সালে। প্রথম ঢাকায় এসেছিলাম ১৯৬৬ সালে আব্বার সাথে। এরপর প্রায় প্রতিবছর অন্তত একবার করে আসা হতো। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস অর্থাৎ ওই বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত শেরপুর শহরের বাড়িতে ছিলাম। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী শেরপুর প্রবেশ করে। এর আগেই আমরা শহর থেকে ছয় মাইল দূরে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাঁচা-মরার চেয়েও আমার প্রধান উদ্বেগ ছিল আমার বই নিয়ে। শহরের বাড়িতে আমার পাঁচ শতাধিক বই, ম্যাগাজিন ছিল। গ্রামের বাড়িতে বই স্থানান্তর করা কঠিন হয়ে ওঠেছিল। বই বলে নয়, যে কোনো কিছু। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ শহর থেকে বের হওয়ায় প্রতিটি পয়েন্টে প্রহরা বসিয়েছিল কেউ যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমণের খবর শুনে আতঙ্কিত না হয়। তারা প্রতিদিন ঘোষণা করছিল যে, শহরে অবস্থান করেই পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করা হবে। কারণ লোকজন শহর ছাড়তে শুরু করলেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছিলেন তারা। কিন্তু তাদের ঘোষণায় কেউ আশ্বস্ত হতে পারছিল না। আমিও না। লোকজন যার যার মতো রাতের অন্ধকারে শহর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। আমি সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে, ক্যারিয়ারে ঝুলিয়ে, প্রহরা এড়িয়ে, আলপথে সাইকেল ঠেলে দিনে দু’বার তিনবার করে বই পরিবহন করি টানা ১০ দিন।

এপ্রিলের ২৯ বা ত্রিশ তারিখে জামালপুর থেকে আমার চাচার শ্যালক সিরাজুল হক (১৯৯১ সালে বিএনপির সংসদ সদস্য ও স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী) তার দুই বন্ধুসহ আমাদের বাড়িতে আসেন। তাদের কাছে জানা গেল একদিন আগে জামালপুরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেছে। বাড়িঘর জ্বালাচ্ছে। যুবকদের পেলেই ধরে ধরে গুলি করছে। তারা ভারতে যাবেন। রাতের বেলায় গ্রামের আরো লোকজন আসে তাদের কাছে খবর শোনার জন্য। শোনার পর সকলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আমিও সিদ্ধান্ত নেই পরদিন তাদের সাথে ভারতের উদ্দেশে রওয়ানা হবো। সকালে উঠে খাওয়া-দাওয়ার পর একটা বোচকা বেঁধে প্রস্তুত হই। আমার বড় ভাই ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। তিনি তার সংগঠনের লোকজনের সাথে আগেই ভারতে চলে গেছেন। আম্মা কান্নাকাটি করেন, আমিও কাঁদি। কিন্তু সন্তানের নিরাপত্তা তাঁর কাছে বড়। কান্নকাকাটির মধ্যেই আম্মা ১১৬ টাকা দেন। আল্লাহর নামে বের হয়ে পড়ি। পেছনে বাড়ির ও পাড়াপড়শি মহিলাদের ভিড়। সবাই কান্নাকাটি করছে। কেউ জানে না ভাগ্যে কী আছে। দশ মাইল রাস্তা অতিক্রম করার পর ভারত-সীমান্তের পাঁচ মাইলের মধ্যে আমাদের এক ফুপার বাড়ি। শরীফ উদ্দিন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী। আকলিমা ফুপু আমাদের চার জনকে যত্ন করে খাওয়ান। বিকেলে ফুপা আমাদের নিয়ে সীমান্তের উদ্দেশে রওয়ানা হন। পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সকাল না হলে সীমান্ত অতিক্রম করতে দেয়া হবে না। রাত কাটাই ইপিআর ক্যাম্পে। রাতে ক্যাম্পে থাকতে দিলেও তারা খেতে দেয়নি। পরদিন সকালেও তারা কিছু খেতে দেয় না। পাহাড়ের মধ্যে দোকানও নেই যে খাবার পাওয়া যাবে। এ সময়ে শেরপুরের ন্যাপ নেতা কাশেম ভাই এলেন। উনি জানতে চাইলেন কিছু খেয়েছি কিনা। খাইনি শুনে সাথে নিয়ে উত্তরদিকে হাঁটা দিলেন। সীমান্ত ঘেঁষা জায়গায় একটি কুড়েঘর। প্রায় বিশজন তরুণ। সবাই পরিচিত। ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মী। আমার বড় ভাই শেরপুর ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। ওই সময় সেখানে না থাকলেও কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন। ততক্ষণে আমি খেসারির ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি। বিশ ঘন্টা অভুক্ত থাকার পর ওটাই অমৃত ছিল।

আমার ভাইয়ের সাথে দেখা না হলেই বোধ হয় ভালো হতো। খাওয়ার পর আমাকে বলেন, “তুই বাড়ি চলে যা। আব্বা আম্মাকে দেখ। দুই জনের একসাথে বাইরে থাকা ঠিক হবে না”। তার সঙ্গী কাবুল দা, কাজল দা, বিপ্লবা দা-সহ অন্যরাও তাই বললেন। ছোট থেকেই বড় ভাইয়ের সাথে কোনো কিছুতে আমার মিল নেই। কিন্তু কখনো ভাইয়ের কথা অগ্রাহ্য করিনি। এবারও গ্রাহ্য করতে হলো। আমার কাছে টাকা আছে কিনা জানতে চাইলে আমি আম্মার দেয়া ১১৬ টাকা তাকে দিয়ে বাড়ির পথ ধরি। সিরাজ চাচার সাথে যে দু’জন ছিল তাদের একজন জালাল সিদ্ধান্ত পাল্টে আমার সাথে ফিরে আসে।

দু’দিন পর পাকিস্তানি বাহিনীর সীমান্তের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় ওই পথের দু’এক মাইলের মধ্যে আমাদের যেসব আত্মীয়ের বাড়ি, তাদের মধ্যে বড় মামা ডা: মহসীন ও শেফালি বু’র পরিবার আমাদের বাড়ি চলে আসে। তখন আমাদের বাড়িটি ছিল বিরাট, দোতলা ঘর ছাড়া পৃথক একটি বড় ঘর এবং বাইরে একটি খানকাহ ঘর ছিল। থাকার কোনো সমস্যা ছিল না। তবে এতোগুলো মানুষের রান্না করার জন্য বাড়ির মহিলাদের প্রায় দিনরাত রান্নাঘরেই কাটাতে হচ্ছিল। মাস খানেক পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল মনে হলে সবাই যার যার বাড়ি চলে যান। কিন্তু আমরা শেরপুরের বাড়িতে যাচ্ছিলাম না। শহর থেকে শুধু লুটপাট, বাড়িতে আগুন দেয়ার খবর শুনি। ভাবনায় অস্থির থাকেন আব্বা আম্মা শেরপুর ফিরে গেলে সবকিছু ঠিকঠাক পাওয়া যাবে কিনা। আব্বাই প্রথমে শেরপুর যান। একরাত শেরপুরের বাড়িতে কাটান। গ্রামের বাড়িতে ফিরে বলেন, শহর নিস্তব্ধ, যাকে বলে “শহর-ই-খামোশান”Ñ নিস্তব্ধ নগরী। আমাদের বেশ কিছু জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে। সকালে ফজরের আজান শোনেননি। তাঁর অফিসে দু’একজন লোক ফিরেছেন। দুই মামার পরিবার তখনো শহরের বাড়িতে ওঠেনি। তারা গেলে আম্মাও যাবেন। সম্ভবত জুন মাসের শেষ দিকে শেরপুর যাই। কারণ এইচএসসি পরীক্ষার তারিখ দেয়া হয়েছে। ফরম পূরণ করতে হবে। সারা বছর ক্লাস হয়নি। যাই হোক প্রস্তুতি নিতে হবে পরীক্ষার। জুলাই বা আগষ্ট মাসে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অর্ধেকের মতো ছাত্র পরীক্ষা দিচ্ছিল। ক্লাস হয়নি, পড়াশোনা হয়নি। যেন তেন পরীক্ষা দেই। পরীক্ষার ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছিল, তৃতীয় বিভাগ। এভাবে ডিসেম্বর চলে আসে। এরপর ডিসেম্বর পর্যন্ত কখনো গ্রামের বাড়ি কখনো শহরের বাড়িতে কাটাই। আম্মার কাছে বড় ভাইয়ের খবর মাঝে মাঝে আসতো। শেরপুর পাকিস্তানী বাহিনীর পতন ঘটে ৭ ডিসেম্বর। বিকেলে শহর পরিণত হয় জনারণ্যে। জানতে পারি, ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা হেলিকপ্টারে নামবেন স্থানীয় পার্কের মাঠে। বন্ধুবান্ধবের সাথে আমিও যাই। অরোরা আসেন, সামান্য বক্তব্য রাখেন এবং চলে যান। রাতের মধ্যে শহর ছেয়ে যায় ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিযোদ্ধায়। তবে সবাই সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। লক্ষ্য ঢাকা। আমার ভাইয়ের খবর না পেয়ে আম্মা চিন্তিত। পরে জানা যায়, তার ইউনিট ময়মনসিংহ শহরে আছে। আম্মা নিশ্চিন্ত হন।

জহিরুলঃ সাংবাদিক তা ছাড়া আর কোনো পেশা গ্রহন করেছেন কখনো?

মঞ্জুঃ জি না, সাংবাদিকতা ছাড়া আমি অন্য পেশা গ্রহণ করিনি। তবে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত ষোলো মাস আমি সাংবাদিকতার বাইরে ছিলাম। একেবারে সাংবাদিকতার বাইরেও বলবো না। এ সময় ইউএনডিপি’র অর্থায়নে পরিচালিত সাংবাদিকদের একটি এডভোকেসি গ্রুপে কাজ করেছি। অধিক অর্থাগম ও নিয়মিত বিদেশ সফরের সুযোগ থাকা সত্বেও কাজটিতে মন বসাতে পারিনি। নিউইয়র্কে আসার পর তিন মাস একটি ফার্মেসিতে কাজ করেছি। সাংবাদিকতার বাইরে এই সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আমি কখনো অন্য কোনো পেশা গ্রহণ করিনি।

জহিরুলঃ সাংবাদিকতা জীবনের ধারাবাহিক গল্পটা শুনতে চাই।

মঞ্জুঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি অনিয়মিতভাবে বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লিখছিলাম। ইতোমধ্যে রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বা সোজা কথায় একদলীয় শাসন বা বাকশাল প্রতিষ্ঠার কারণে রাজনৈতিক দলের উপর ও সংবাদপত্র প্রকাশনার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৯৭৬ সালে তা প্রত্যাহার করা হয়। যেসব সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়েছিল সেগুলো পুনরায় প্রকাশের উপর থেকে বিধিনিষেধ উঠে গেলে আবারও পত্রপত্রিকাগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। জানতে পারি যে, দৈনিক সংগ্রাম পুন:প্রকাশের জন্যও আবেদন করা হয়েছে। সংগ্রামের প্রকাশনা বন্ধ হয়েছিল অনেক আগে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। দৈনিক সংগ্রামের র‌্যাঙ্কিন ষ্ট্রিটের অফিস, প্রেস দখল করে সেখান থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলÑজাসদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক গণকণ্ঠ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রকাশের অনুমতি লাভ করে। আমার যেহেতু মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে পত্রিকাটির সঙ্গে সাবেক যোগসূত্র ছিল, সেই সুবাদে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য আবেদন করি এবং তা মঞ্জুর হলে আমি কাজ শুরু করি ১৯৭৭ সালের ১৭ই জানুয়ারী দৈনিক সংগ্রাম পুন:প্রকাশের দিন থেকে। এক বছরের মধ্যে আমি স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে ফুলটাইম সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হই। আর পেছনে তাকাইনি। ১৯৮৩ সালে সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা করার জন্য একটি বৃত্তি পেয়ে পশ্চিম বার্লিনে ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ জার্নালিজম এ যাই। তখন জার্মানি ছিল বিভক্ত দেশ এবং পশ্চিম বার্লিন ছিল প্রাচীর বেষ্টিত অবরুদ্ধ নগরী। এরপর ১৯৮৮ সালে রয়টার্সের একটি বৃত্তি লাভ করে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ১৯৮৮-৮৯ সালে জন এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। ১৯৮৩ সালে রয়টার্স ফাউন্ডেশন এ ফেলোশিপ কর্মসূচি চালু করার পর বাংলাদেশে আমিই প্রথম এই ফেলোশিপ লাভের সম্মান অর্জন করি। আমার জন্য এটি একটি বড় পুরস্কার ছিল। প্রোগ্রাম শেষে দেশে ফিরে গিয়ে দেখি সংগ্রামে আমার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে গেছে। যদিও তখন আমাকে বার্তা সম্পদক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়েছিল এবং ঢাকায় মূলধারার দৈনিকগুলোতে আমি সবচেয়ে কমবয়সী বার্তা সম্পাদক হয়েছিলাম, আমার প্রতি ঈর্ষাকাতরদের যন্ত্রণায় দায়িত্ব পালন করা কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। আমার বিরুদ্ধে স্বয়ং সম্পাদক খড়গহস্ত হয়েছিলেন। তার কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিলাম না। ওই সময়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনে ইনফরমেশন অফিসারের একটি ওপেনিং দেখে আবেদন করি, ইন্টারভিউ হয় এবং আমি নির্বাচিত হই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাদেরকে জানিয়ে দেই আমি যোগ দেব না। সাংবাদিকতা ছাড়তে মন সায় দেয়নি। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা কাটানোর জন্য আমি ভারতীয় পার্লামেন্টের ইন্সটিটিউট অফ পার্লামেন্টারি এন্ড কন্সটিটিউশনাল স্টাডিজ এ একটি ফেলোশিপের জন্য আবেদন করি। এটির তহবিলদাতা ছিল কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিষ্ট্যান্স প্রোগ্রাম। আমি নির্বাচিত হয়ে ১৯৯২ সালের নভেম্বরে দিল্লি চলে যাই। কর্মসূচি শেষে ১৯৯৩ সালের জুন বা জুলাই মাসে ফিরে আসি। আমার অবর্তমানে যিনি ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক আমাকে দায়িত্ব বুঝে নিতে বলেন। কিন্তু সম্পাদক তাকে বলেন আমাকে দায়িত্ব না দিতে। অর্থ্যাৎ আমার বার্তা সম্পাদকের পদ আর আমার জন্য ছিল না। আমাকে বলা হয় সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিতে। আমি অস্বীকার করলে আমাকে বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করতে বলা হয়। কিন্তু আমি বেঁকে বসি। বার্তা সম্পাদকের পদে ফিরে আমি প্রয়োজনে পদত্যাগ করবো, তবুও আমি যে পদ থেকে ছুটিতে গিয়েছিলাম একদিনের জন্য হলেও সেই পদে আমাকে যোগ দিতে হবে। সংগ্রামের প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশ পাবলিকেশন্সের চেয়ারম্যান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক সদস্য শামসুর রহমান আমাকে বার্তা সম্পাদক পদে বহালের আদেশ দেন। আমি আবার বার্তা সম্পাদক পদে যোগদান করি এবং সাত দিন পর পদত্যাগ করে বিশেষ সংবাদদাতা পদে ফিরে যাই। এবার আমার ওপর সংগ্রাম সম্পাদকের ঝাল ঝাড়ার সময়। তিনি বার্তা সম্পাদককে নির্দেশ দেন আমার কোনো রিপোর্ট প্রকাশ না করতে। অতএব আমি রিপোর্ট জমা দিলেও আমার কোনো রিপোর্ট প্রকাশ করা হচ্ছিল না। অত্যন্ত অপমানবোধ করছিলাম। ভারতে যাওয়ার কারণে আমাকে রীতিমতো ভারতীয় এজেন্ট হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছিল্। আমি পরবর্তী তিনটি বছর শুধু অফিসে গেছি আর বাসায় ফিরে এসেছি। বেতন ঠিকই দেয়া হচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল, ভালো মানুষগুলোর আসল চেহারা না দেখা পর্যন্ত এভাবেই থাকবো।

জহিরুলঃ তো এভাবেই সংগ্রামে ঝুলে থাকলেন? অন্য কিছু করার কথা চিন্তা করেন নি?

মঞ্জুঃ অবশ্যই করেছি। সবসময় চিন্তা ছিল রিডার্স ডাইজেস্ট, পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত উর্দু ম্যাগাজিন মাসিক উর্দু ডাইজেস্ট বা সাইয়্যারা ডাইজেস্ট অথবা ভারতে মালয়ালম ভাষায় প্রকাশিত মনোরমা ধরনের একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করার। সংগ্রামে থাকার ঘটনা ঠিক ঝুলে থাকা নয়। তখন ঢাকার সবগুলো দৈনিক সংবাদপত্রে যে বেতন কাঠামো ছিল সে অনুযায়ী সংগ্রামে যে বেতন পাচ্ছিলাম তা কম ছিল না। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পর উইকলি হলিডে সম্পাদক এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান এবং ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু আমাকে তাদের সাথে কাজ করার অফার দেন। আমি কারণে আমি রাজি হইনি যে নতুন জায়গায় কাজ করা মানে নতুন করে জায়গা করে নিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মধ্যে পড়া, যা আমি চাইনি। পুরনো জায়গায় থাকাকেই প্রাধান্য দিয়েছি। ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে আমি নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করি। সাথে আমার তিন সহকর্মী ছিলেন। অল্পদিনেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল ঢাকা ডাইজেস্ট। এটিও আমার বিরুদ্ধে ইর্ষা ও অপপ্রচারের একটি কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালের জুনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর আসন সংখ্যা ১৯৮৬ সালের সংসদে ১০টি এবং ১৯৯১ সালের সংসদে ১৮টির স্থলে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩টিতে নেমে আসে। নির্বাচন বিশ্লেষণ করে আমি ঢাকা ডাইজেস্টে একটি নিবন্ধ লিখি, যার শিরোনাম ছিল: “ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ: জামায়াতের রাজনৈতিক বালখিল্যতা।” এটি ভীমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়ার মতো ছিল। নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার তিন মাস পর অক্টোবর মাসে আমাকে দৈনিক সংগ্রাম থেকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। পরের মাসেই আমি মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার ফিচার এডিটর হিসেবে যোগ দেই। এক বছর পর মতিউর রহমান চৌধুরী দৈনিক মানবজমিন প্রকাশের উদ্যোগ নিলে তার সাথে বাংলাবাজার পত্রিকা ত্যাগ করি। মানবজমিনে কাজ করি এক বছর। এসময় বাংলাবাজার পত্রিকায় কোনো বার্তা সম্পাদক ছিলেন না। সেখান থেকে আমাকে ডাকা হলে আমি দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগ দেই। বছর খানেক পর দৈনিক বাংলার বাণীর পক্ষ থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করা হয় তাদের বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য। বাংলাবাজার পত্রিকার কোনো ভবিষ্যত ছিল না, বাংলার বাণীর সার্কুলেশন বেশি না হলেও মূলধারার সংবাদপত্র এবং আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আমি ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। শেখ সেলিম সম্পাদক হিসেবে থাকলেও তখন বাংলার বাণী পরিচালনা করছিলেন পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মণির ছোট ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। বয়স কম হলেও বেশ অ্যাসারটিভ। আমার সাথে অল্পদিনের তাঁর হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার পছন্দ অনুযায়ী কিছু সাংবাদিককে নিয়োগ দেয়ার স্বাধীনতাও দেয়া হয় আমাকে। কিন্তু আমি সে সুযোগের অপব্যবহার করিনি। মাত্র দু’জন অত্যন্ত যোগ্য তরুণ সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়েছিল। তারা এখন সাংবাদিকতায় ভালো করছেন। কিন্তু ২০০১ সালে কর্তৃপক্ষ বাংলার বাণী বন্ধ করে দেয়। কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে বাংলার বাণীর মতো একটি পুরোনো দৈনিক বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমি পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম। সেখানেই পুরো সময় দিতে থাকি। এ সময় এটিএন বাংলার হেড অফ নিউজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন বর্তমানে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সম্পাদক নঈম নিজাম। আমাকে একদিন ফোন করে এটিএন বাংলায় যোগ দিতে বলেন। চেয়াম্যান মাহফুজুর রহমান ও উপদেষ্টা সাইফুল বারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কবে থেকে যোগ দেব জানতে চান চেয়ারম্যান। আমি সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সময় চেয়ে নেই। কারণ তখন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) নিয়োগের একটি প্রক্রিয়া চলছিল এবং আমার নিয়োগ বিবেচনাধীন ছিল। তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের সঙ্গে আমার বেশ খাতির ছিল। উনিই চাইছিলেন আমি যাতে বাসস-এ যোগ দেই। কিন্তু বাসস এর প্রধান সম্পাদক ও এমডি আমানুল্লাহ কবীর টালবাহানা করছিলেন। তিনি বিএনপি সমর্থক সাংবাদিকদের নিয়োগ দেয়ার পরিবর্তে নিজের পছন্দ অনুযায়ী নিয়োগ দিচ্ছিলেন। এতে বিএনপি পন্থী সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা খোন্দকার মনিরুল আলম ফোন করে বলেন, আমি যাতে অন্য কোথাও যোগ না দেই। তথ্যমন্ত্রী আমানুল্লাহ কবীরের কাছে আপনাকে সহ আট জনের একটি তালিকা পাঠিয়ে অবিলম্বে নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ক’দিন অপেক্ষা করতে বলেন খোন্দকার মনির ভাই। আমি অপেক্ষা করি। এটিএন বাংলা থেকে সাইফুল বারী ফোন করেন, ‘আপনি জয়েন করছেন না কেন?’ আমি তাঁকে জানাই, এসে কথা বলি। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনা বলি। তিনিও বলেন বাসস-এ চাকুরি হলে এটিএন বাংলায় যোগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। ২০০২ সালের অক্টোবরে বাসস এর ইংরেজি সেকশনে বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। আমানুল্লাহ কবীরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে বাসস এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে আসেন গাজীউল হাসান খান্। তিনি আমাকে উপ-প্রধান বার্তা সম্পদক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্বও দেন। তার দুই বছরের চুক্তি শেষ হয় ২০০৭ সালের শুরুতে কেয়াটেকার সরকারের সময়। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বাসস এর বিশেষ সংবাদদাতা জগলুল আহমেদ চৌধুরী। তিনি আমার ওপর আস্থা রাখতেন এবং চিফ রিপোর্টার পদে বহাল রাখেন। কিন্তু ওই সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পন্থী রিপোর্টারদের ঠেলাঠেলি ও আমার উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করায় আমি চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব ছেড়ে দেই এবং উপ-প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৬ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। প্রধান সম্পাদক হিসেবে আসেন ইহসানুল করিম হেলাল। উনি বাসস-এর সিনিয়র সাংবাদিক এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রিয়ভাজন। এ সময়ে বিএনপি আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদের ডেকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলা হচ্ছিল। বিশেষত যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটে ত্রুটি ছিল। ২০০৯ সাল ভালোভাবে কাটে। ২০১০ সালে গুমোট অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২০১০ এর এপ্রিলে আমি এক মাসের বিনোদন ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসি। এখানে আমার মেয়ে তখন ফিলাডেলফিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একা অবস্থান করছিল। ওকে দেখে মে মাসে দেশে ফিরে আবার কাজে যোগ দেই। জুলাই মাসে আবার যুক্তরাষ্ট্রে আসি। ছুটি শেষ হওয়ার আগে আমি আরো এক মাস ছুটি বাড়ানোর আবেদন করি। কিন্তু নভেম্বর মাসে আমার স্ত্রী ঢাকা থেকে জানায় বাসস থেকে চাকুরিচ্যুতির নোটিশ বাসায় গেছে। আমি আফসোস না করে আলহামদুলিল্লাহ বলে আমার স্ত্রীকে বলি অফিসে আমার ডেস্ক ও আলমারির চাবি নিয়ে কাগজপত্রগুলো বুঝিয়ে দিয়ে আসতে। সে যায় এবং সব বুঝিয়ে দিয়ে আসে। অফিসে কিছু পাওনা ছিল। আমার সহকর্মীরা তাকে সহযোগিতা করে টাকা তুলে নিতে। প্রধান সম্পাদক তাঁর অফিসে ডেকে কফি খাওয়ান এবং ওপরের নির্দেশে তাঁকে আমার চাকুরিচ্যুতির নোটিশে স্বাক্ষর করতে হয়েছে বলে দু:খ প্রকাশও করেন। আমি দেশে গিয়ে কোথায় কারও কাছে নতুন করে চাকুরির জন্য নিবেদন করবো, এমন ভাবনা কষ্টকর ছিল বলে দেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিহার করি এবং নিউইয়র্কে কমিউনিটি সংবাদপত্র সাপ্তাহিক বাংলাদেশ এর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই।

জহিরুলঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাংবাদিকেরা বেশ অনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করে, এ ধরনের ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন কখনো?

মঞ্জুঃ আমি যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছি তখন খুব কম সংখ্যক সাংবাদিককে অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত দেখেছি। দু’এক জন ছিল; তাদেরকে সাংবাদিকরাও পছন্দ করতো না। সংবাদপত্রের সংখ্যা কম ছিল, সাংবাদিকের সংখ্যাও কম ছিল। কে কি করলো তা সহজে জানা যেতো। সাংবাদিকরা যদি অনৈতিক কাজে জড়িত হন, তাহলে সেটি ঘটে ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা অবৈধ সুবিধা দিয়ে নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট খবর প্রকাশে প্ররোচিত করে তাদেরকে দুর্নীতিগ্রস্থ করার কারণে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সংবাদপত্র প্রকাশের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ায় এবং নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বেসরকারি টেলিভিশন অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের একটি অংশের মধ্যে দ্রুত ওপরে উঠার প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা শুরু করে। তারা প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে অথবা ব্যবহৃত হয়। আমি সবসময় সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদার সাথে নিজের মর্যাদার কথা ভেবেছি। তা না হলে আমার পক্ষে বাংলাদেশে ১৯৭৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে সম্মান নিয়ে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হতো না।

জহিরুলঃ সংগ্রাম এবং বাংলার বাণী, দুই মেরুর দুই কাগজ, দুটোতেই আপনি কাজ করেছেন, কিভাবে ম্যানেজ করেছেন?

মঞ্জুঃ কোনো বিশেষ দল বা মতের প্রতি আমার কখনো কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হইনি। পরবর্তীতেও আমার পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠন ছাড়া কোনো সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করিনি। আমার রাজনৈতিক চিন্তা ও পক্ষপাতিত্ব সবসময় আমার নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সবসময় বস্তুনিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আমার সাথে যারা কাজ করেছেন, তাদেরকেও একই কথা বলেছি যে তারা তাদের পেশাগত কাজ করতে কোনো রাজনৈতিক মতামতের প্রতিফলন না ঘটান। বলতে পারেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মতো ছিল আমার নীতি, “ফ্রেণ্ডশিপ টু অল, ম্যালিস টু নান” (সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়)। সেজন্য একজন সাধারণ পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে সকল রাজনৈতিক মতধারার সাংবাদিকদের কাছে আমি কমবেশি গ্রহণযোগ্য ছিলাম। বাংলার বাণীতে আমি মালিক থেকে সহকর্মী পর্যন্ত সকলের সহযোগিতা পেয়েছি। বার্তা সম্পাদক হিসেবে আমার সিদ্ধান্তে সম্পাদকও হস্তক্ষেপ করেননি।

জহিরুলঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতি মিডিয়াকে খুব প্রভাবিত করে, এক্ষেত্রে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

মঞ্জুঃ শুধু তৃতীয় বিশ্বে নয়, উন্নত বিশ্বেও রাজনীতি মিডিয়াকে প্রভাবিত করে। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়াও রাজনীতিকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে। মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বের ওপর অনেক সময় রাজনীতির ব্যারোমিটার ওঠানামা করে। তৃতীয় বিশ্বে বিষয়টি নগ্নভাবে প্রকাশ পায়, উন্নত বিশ্বে সুপ্ত থাকে। তৃতীয় বিশ্বে সরকার মিডিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ হলে সেন্সরশিপ আরোপ করে, সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেয়, নানা আইনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে, গুম করে ফেলে, মারধোর করার জন্য মাস্তান লেলিয়ে দেয়। উন্নত বিশ্বে হয়তো তা হয় না। আমি সবসময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছি বলে আমার ভূমিকার কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে, আমার অধীনস্থ কোনো সাংবাদিককে অথবা আমি যেসব সংবাদ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি, সেসব প্রতিষ্ঠানকে কখনো কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়নি।

জহিরুলঃ ওরিয়ানা ফালাচির ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি – এই গ্রন্থ অনুবাদ করার পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক মোটিভেশন কাজ করেছে? কেন এটি অনুবাদ করলেন?

মঞ্জুঃ ওরিয়ানা ফালাচির নেয়া বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকারের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর। তিনি আয়াতুল্লাহ খোমেনির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, যেটি বাংলায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায়। তাঁর সাহসী ও আক্রমণাত্মক প্রশ্ন এবং তিনি যে তথ্য বের করে আনতে চান তা সাক্ষাৎকারদানকারীর মুখ দিয়ে বলানোর কৌশল আমাকে আকৃষ্ট করে। এরপর তাঁর একটি বই পড়ি “লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন”। প্রফেসর আনু মুহাম্মদ এটি অনুবাদ করেছিলেন। বইটি ভালো লেগেছিল। আমি যখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম তখন বুকস্টোরে তার নেয়া সাক্ষাৎকারের একটি সংকলন গ্রন্থ পাই, “ইন্টারভিউ উইথ হিস্টরি,” । যারা সাংবাদিকতা করছেন, বিশেষ করে যারা রিপোর্টিং এ আছেন তাদেরকে প্রতিনিয়ত সাক্ষাৎকার নিতে হয়, যারা সাংবাদিকতার ওপর পড়াশোনা করেন তাদেরকেও সাক্ষাৎকারের ওপর পড়ানো হয়। সে কারণেই মূলত বইটি অনুবাদ করার তাগিদ অনুভব করেছি। সাক্ষাৎকারগুলো ঢাকা ডাইজেস্টে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার কথা ভাবি এবং সাক্ষাৎকারগুলো প্রকাশ করতে শুরু করার পর পাঠকরা সবসময় পরবর্তী সাক্ষাৎকার পড়ার জন্য উদগ্রীব থাকতেন। ওরিয়ানা ফালাচি বহু বিশ্বনেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কিন্তু ‘ইন্টারভিউ অফ হিস্টরি’তে সবার সাক্ষাৎকার নেই। শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারও বইটতে অন্তর্ভূক্ত ছিল না। অন্য কোনো সূত্র থেকে সেটি পাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ইন্দিরা গান্ধী, জুলফিকার আলী ভূট্টো এবং হেনরি কিসিঞ্জারের সাক্ষাৎকারের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার প্রকাশ না করলে পুরো ব্যাপারটি সঙ্গতিহীন মনে হতো। তাছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানে সাক্ষাৎকার কেন প্রকাশ করছি না, এমন চাপ ছিল পাঠকদের পক্ষ থেকে। এর পেছনে রাজনৈতিক কোনো মোটিভেশন ছিল না। বইটি সাধারণ মানুষের জানার খোরাকে ঠাসা এবং নবীন সাংবাদিকদের জন্য সবসময় শিক্ষণীয় হ্যাণ্ডবুকের মতো।

জহিরুলঃ খুশবন্ত সিং, সন্দেহ নেই খুব বড় মাপের একজন লেখক, তার অনেকগুলো গ্রন্থ আপনি অনুবাদ করেছেন, খুশবন্ত সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হলেন কেন? তার লিখিত অনুমতি সংগ্রহ করতে কি খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল? তার সঙ্গে দেখা করার গল্পটা জানতে চাই।

মঞ্জুঃ ভারতে যারা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন, তাদের মধ্যে খুশবন্তু সিং অন্যতম; বরং বলা যায় ভারতে সর্বাধিক পঠিত লেখক। বর্তমানে ভারতে এবং ভারতের বাইরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত বিশ্বমানের বহু লেখক সৃষ্টি হয়েছে, তাদের অনেকের রচিত বই অত্যন্ত জনপ্রিয়, তারা আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করছেন, অনেকে বিতর্কও সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয়দের দ্বারা ইংরেজি সাহিত্য চর্চার ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন, এখনো এর বয়স দেড়শ বছর হয়নি। যদিও এর আগেও ইংরেজিতে ভারতীয়রা নন-ফিকশন ধরনের লেখা লিখেছেন এবং ধারণা করা হয় যে কোনো ভারতীয় কর্তৃক ইংরেজিতে প্রকাশিত বইয়ের প্রথম লেখক ছিলেন শেখ দীন মোহাম্মদ, যার লেখা “দ্য ট্রাভেলস অফ দীন মোহাম্মদ” প্রকাশিত হয় ১৭৯৩ সালে। রাজনৈতিক ও আত্মজীবনীমূলক কিছু ইংরেজি বই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে লেখা হলেও ভারতে প্রথম পর্যায়ের ইংরেজি সাহিত্য সৃষ্টিকারীরা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে তাদের কাজ শুরু করেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং তারা এখন আমাদের কাছেও ইংরেজি লেখক হিসেবেই পরিচিত, আমরা তাদের বই পড়ি এবং তাদের সময়ের মানুষ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে নির্মোহ ধারণা পাই। প্রথম পর্যায়ের ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের প্রসঙ্গ আসলে আমরা আর,কে নারায়ণ, মুলক রাজ আনন্দ, রাজা রাও এর কথা ভাবি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই সময়েই তাঁর অনেক কবিতা ও অন্যান্য লেখা নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন।

জহিরুলঃ এর কিছুকাল পরেই তো খুশবন্ত সিং, নীরদ সি চৌধুরীদের আবির্ভাব ঘটলো।

মঞ্জুঃ জি। নীরদ সি চৌধুরী লেখালেখির শুরু ১৯২৫ সালে। তবে তাঁর প্রথম বই ‘দ্য অটোবায়োগ্রাফি অফ অ্যান আননোন ইণ্ডিয়ান’ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে। খুশবন্ত সিং এর চেয়ে বয়সেও তিনি বেশ বড়। খুশবন্ত সিং তাদের একটু পর সাহিত্য চর্চায় পা রাখেন। তিনি বরাবর ইংরেজিতেই লিখেছেন। তুলনামূলভাবে একটু বিলম্বে। তাঁর জীবন বৈচিত্রে ভরা। পড়াশোনা করেছেন কেমব্রিজ ও ইনার টেম্পলে। আইনজীবী, কূটনীতিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও লেখক হিসেবে কাজ করেছেন জীবনের এক এক পর্যায়ে। সম্ভবত তিনি প্রথম জীবনে স্থির করতে পারেননি পেশা হিসেবে কোন্ কাজটি বেছে নেবেন। এ কারণেই আমি বলেছি যে সাহিত্য চর্চায় তিনি এসেছেন তুলনামূলকভাবে বিলম্বে। তাঁর প্রথম উপন্যাস “ট্রেন টু পাকিস্তান” প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৪ সালে, তখন তাঁর বয়স ৩৯ বছর। এরপর তিনি আর থেমে ছিলেন না। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু উপন্যাসের মধ্যে সীমিত ছিল না; বরং তাঁর সবচেয়ে বড় কাজ হলো দুই খণ্ডে শিখদের ইতিহাস। তাঁর জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে সাহিত্যের অবদানের চেয়ে তাঁর সিণ্ডিকেটেড কলামের ভূমিকা অধিক। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত তাঁর কলাম ভারতের ৫০টির বেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো।

বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তাঁর বইয়ের সংখ্যা আশিটির বেশি। আমি তাঁর মাত্র পনেরোটি বই অনুবাদ করেছি, যার মধ্যে রয়েছে তাঁর সবগুলো উপন্যাস, তাঁর আত্মজীবনী, দুটি ছোটগল্প সংকলন, একটি প্রবন্ধ সংকলন এবং একটি জোকস এর বই। ১৯৮৪ সালের আগে খুশবন্ত সিং এর সাহিত্য সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না, তাঁর নামও জানতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমি ভারতের বেশ কয়েকটি ইংরেজি ও হিন্দি ম্যাগাজিনের অনিয়মিত গ্রাহক ছিলাম, যা পরবর্তী সময়েও অব্যাহত ছিল। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিড়লা গ্রুপের “ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইণ্ডিয়া।” ম্যাগাজিনটির আদ্যোপান্ত পড়তাম। ১৯৮৪ সালে ওই ম্যাগাজিনের দুই সংখ্যায় “দ্য লাস্ট এণ্ড দ্য লোনলি সিটি” নামে বড় একটি লেখা ছিল খুশবন্ত সিংয়ের। ঐতিহাসিক কাহিনি নির্ভর লেখা এবং কাহিনির মূল চরিত্র বিখ্যাত উর্দু কবি মীর তকী মীর। এটি তাঁর প্রকাশিতব্য একটি উপন্যাসের অংশ বলে উল্লেখ করা ছিল। আমি তখন ঢাকার কিছু ম্যাগাজিনের জন্য গল্প অনুবাদ করতাম। খুশবন্ত সিংয়ের ওই লেখাটিও অনুবাদ করি। কিন্তু নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের রগরগে বর্ণনা থাকায় আমি যে ম্যাগাজিনগুলোতে লিখতাম গেন ম্যাগাজিনগুলো অনুবাদটি প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। আমার এক বন্ধু, যিনি পাক্ষিক নিপূণে কাজ করতেন তিনি বললেন লেখাটি মোস্তফা জব্বারের নিপূণে দিতে। মোস্তফা জব্বার কাঁটছাঁট করে ছাপতে রাজি হলেন। অনুবাদ করার সময়ই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে আমি অনুবাদ করবো। সৌভাগ্যক্রমে ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইণ্ডিয়া’য় চিঠিপত্র কলামে খুশবন্ত সিংয়ের একটি চিঠি ছিল। তাঁর বাড়ির ঠিকানা লেখা একটি পোস্টকার্ড, যাতে তিনি ম্যাগাজিনের ওই সময়ের সম্পাদক প্রীতিশ নন্দীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন ম্যাগাজিনটি ভালো হচ্ছে মর্মে প্রশংসা করে। প্রীতিশ নন্দী উত্তর দিয়েছে যে খুশবন্ত সিংয়ের সময়েই বরং ম্যাগাজিনটি অনেক জনপ্রিয় ছিল। তখনই জানতে পারি যে খুশবন্ত সিং ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইণ্ডিয়া’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যাহোক, আমি খুশবন্ত সিংকে একটি চিঠি লিখে আমার ইচ্ছার কথা জানাই। তিনি তখন ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার সদস্য। ধরেই নিয়েছিলাম উত্তর পাবো না। কিন্তু দেড় সপ্তাহের মাথায় তাঁর উত্তর আসে। তিনি জানান, উপন্যাসটি ১৯৯০ সালের আগে শেষ হবে না। আমার বাংলা অনুবাদ পাঠাতে বলেন। একটু খটকা লাগছিল। কারণ প্রকাশিত অনুবাদ যথেষ্ট কাঁটছাঁট করা। তবুও আমি পাঠিয়ে দেই। আবারও তাঁর উত্তর আসে, তিনি তাঁর সাথে যোগাযোগ রাখতে বলেন।

জহিরুলঃ তো বইটি পাওয়ার জন্য ৯০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন?

মঞ্জুঃ আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৮৮ সালে আমি ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি বৃত্তি পেয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে আসি। ক্লাস শেষে, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্যাম্পাস সংলগ্ন সিটি পালো আল্টোর শপিং মল, অন্যান্য দোকানপাট, বুকষ্টোর ঘুরে কাটাই। একদিন এক পুরোনো বইয়ের দোকানে বই ঘাটতে ঘাটতে খুশবন্ত সিংয়ের “ট্রেন টু পাকিস্তান” বইটি পাই। সেটি ছিল প্রথম সংস্করণ। অবিশ্বাস্য দাম। মাত্র ২৫ সেন্ট। পড়তে শুরু করে বিস্মিত হই। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের অনেক গল্প উপন্যাস পড়েছি। অধিকাংশই ভারতীয় বা পাকিস্তানি লেখকদের। কিন্তু খুশবন্ত সিংয়ের ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ এর প্রতিটি চরিত্রকে ঘটনার সাথে এমন আবেগ দিয়ে তুলে আনা আমাকে বিস্মিত করে। মনে হয় আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে দেশ বিভাগের বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করছি। আমার অনুবাদের তালিকায় বইটি রাখি। খুশবন্ত সিং এর ওপর আমার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়।

১৯৮৯ সালের শেষ দিকে আমি দেশে ফিরে যাই। খুশবন্ত সিংকে আমার যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান, তাঁর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ পাঠ সম্পর্কে জানাই এবং তাঁর প্রকাশিতব্য উপন্যাসের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাই। তখন তিনি আর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন না। পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯৯০ সালে আমার আগ্রহের বইটি প্রকাশ পাবে। আমি আমার কাজের ফাঁকে শুধু ভাবছিলাম, আহা, দিল্লিতে যদি দীর্ঘ সময় কাটানোর একটা সুযোগ পেতাম। আমার সম্পাদকও আমার সাথে বৈরী আচরণ শুরু করেছিলেন এবং একসময় যারা আমার ঘনিষ্ট ছিল তাদের আচরণেও এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল যে আমি দম নেয়ার জন্য দেশের বাইরে কাটিয়ে আসার কথা ভাবছিলাম। কোথায় কিভাবে সেই সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তা খুঁজছিলাম। প্রায় দুই বছর লেগে গেল। ১৯৯২ সালে কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় দিল্লিতে ছয় মাসের জন্য একটি ফেলোশিপ পেয়ে দিল্লি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কিছুদিন অন্তত মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস নিতে পারবো। মোগল-দিল্লি দেখতে পারবো এবং সবচেয়ে বড় কথা খুশবন্ত সিংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবো। আমাকে যেতে হবে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে। ভারত জুড়ে তখন বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে চরম উত্তপ্ত এক অবস্থা। ঘনিষ্টজনেরা নিষেধ করলো। কারো কথায় কান দেওয়ার অভ্যাস কোনোকালে ছিল না। অতএব ব্যাগ গুছিয়ে এক সন্ধ্যায় কলকাতাগামী প্লেনে ওঠে পড়ি, সেখান থেকে দিল্লি পৌঁছে গেলাম।

সবকিছু গুছিয়ে ওঠার সময়ের মধ্যেই ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো। আমার সাথে রুহুল আমিন নামে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের একজন প্রটোকল অফিসারও প্রোগ্রামে ছিলেন। একসঙ্গে এক শিখ ভদ্রলাকের বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতাম। তাঁর নাম ছিল মনোহর লাল দং। তাঁর তিন ছেলে, দুই মেয়ের সাথে আমাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। সৃষ্ট পরিস্থিতি তাঁকে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তিনি বলছিলেন, আমি খুব সাধারণ মানুষ, তোমাদের কিছু হলে আমি নিরাপত্তা দিতে পারবো না। বাকি জীবন আমাকে, আমার পরিবারকে অপরাধ বোধের মধ্যে কাটাতে হবে। তোমরা বরং দেশে চলে যাও। আমরা তাঁকে আশ্বস্ত করি। তবে দিল্লিতে খুব বেশি দাঙ্গা হয়নি। আমাদের ক্লাস চলছিল, একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।। বাসা থেকে বাসে এক ঘন্টার দূরত্বে ইন্সটিটিউট পর্যন্ত পথের কোনো কোনো স্পট বেশ নাজুক ছিল। কিন্তু দিল্লির পরিস্থিতি শিগগিরই শান্ত হয়ে আসে।

জহিরুলঃ খুশবন্ত সিংয়ের সাথে দেখা করার চিন্তা নিশ্চয়ই দাঙ্গার ভয়ে বাদ দেন নি?

মঞ্জুঃ প্রশ্নই ওঠে না। ইতোমধ্যে আমি খুশবন্ত সিংয়ের উপন্যাস “দিল্লি’ কিনে নিয়েছিলাম, আমার অনুবাদ করা অংশটিও ‘দিল্লি’তে আছে। ইতিহাসাশ্রয়ী অসাধারণ একটি উপন্যাস। প্রায় এক হাজার বছরের ইতিহাস তুলে আনা হয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক চরিত্রকে উপস্থাপনের মাধ্যমে। আমাদের প্রোগ্রামে ভারতীয় পার্লামেন্টের বেশ ক’জন অফিসার ছিলেন। তাদের কাছে খুশবন্ত সিংয়ের ফোন নাম্বার চাইলে তারা আমাকে সংগ্রহ করে দিলেন। ইন্সটিটিউট থেকে ফোন করে তাঁর সাথে দেখা করার আগ্রহ জানালে তিনি তাঁর বাড়ির পরিবর্তে ‘ইণ্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার’ এ যাওয়ার দিন ও সময় বলে দিলেন। আমি যথাসময়ে গেলাম। দিল্লির অন্যতম অভিজাত ক্লাব ‘ইণ্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব’। তাঁকে ঘিরে আছে অনেকে। এটেন্ডেন্টরা অপরিচিত দেখে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি কাকে চাই? আমি বলার পর একজন খুশবন্ত সিংয়ের কাছে ঝুঁকে আমার কথা বলার পর তিনি ওঠে দাঁড়ালেন এবং আমাদের একা রেখে অন্যরা চলে গেলেন। হাত মিলিয়ে বললেন, আপনাকে আরো বয়স্ক ভেবেছিলাম। আমি ড্রিঙ্ক করি কিনা জানতে চাইলেন। যেহেতু পান করি না, আমার জন্য সমুচা ও কফি দিতে বললেন। বেয়ারাররা জানে তাঁকে কী দিতে হবে। তিনি জানালেন রাস্তার ওপারেই প্রায় হাঁটা দূরত্বে সুজন সিং পার্কে তাঁর বাড়ি। আমি কী কখনো তাঁর বাড়ি আসতে পারি জানতে চাইলে তিনি আরেকদিন ফোন করে জেনে নিতে বললেন। আমার প্রয়োজন তাঁর বই অনুবাদ করার অনুমতি সংগ্রহ করা এবং একান্তে তাঁর বইগুলো সম্পর্কে জানা। ক্লাবে তা সম্ভব ছিল না।

ডিসেম্বরের শেষ দিকে এক বিকেলে দিল্লির হাড্ডি কাঁপানো ও হৃদস্প্ন্দন থামিয়ে দেওয়ার মতো ঠান্ডার মধ্যে তাঁর সুজন সিং পার্কের বাসায় গেলাম। ইতোমধ্যে আমি জেনে নিয়েছিলাম যে খুশবন্ত সিং অতিথি আপ্যায়নে খুব উদার নন এবং অথবা লোকজনকে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারেন না। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর কিছু স্মৃতির কথা বলেছিলেন, সেটি ছিল ১৯৭২ সালে যখন নিউইয়র্ক টাইমস এর পক্ষে রিপোর্ট করতে ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিতে আসেন। কফি দিতে বলার আগেই আমি তাঁর বই প্রকাশের অনুমতি চাইলাম। তিনি বললেন, আমার মনে আছে। তাঁর নাম ঠিকানা মুদ্রিত লেখা প্যাডে তিনি তিন চার লাইনে আমাকে তাঁর যে কোনো বই অনুবাদ করার অনুমতিপত্র লিখে দিলেন। কফি শেষ করে আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়ার সময় দেশে ফিরে যাওয়ার আগে তাঁর সাথে দেখা করে যেতে বলেন।

জহিরুলঃ খুশবন্ত সিং বলেছেন তার সাহিত্যকর্ম তিনটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, অন্যকে জানানো, আনন্দ দেয়া এবং ক্ষেপানো। একজন লেখক অন্যকে ক্ষেপানোর জন্য লেখেন, এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মঞ্জুঃ খুশবন্ত সিং আসলে কথাটি বলেছেন যে তাঁর লেখার মূল উদ্দেশ “ঞড় রহভড়ৎস, ঃড় বহঃবৎঃধরহ ধহফ ঃড় ধমরঃধঃব” অর্থ্যাৎ পাঠকদের অবহিত করা, বিনোদন দেয়া ও ক্ষেপিয়ে তোলা। শুধু সাহিত্যের ক্ষেত্রে একথা বলেননি, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তিনি একই বিশ্বাস থেকে কলাম লিখেছেন। তাঁর গল্প, উপন্যাস এবং তাঁর উপ-সম্পাদকীয় কলামগুলো পড়লেই বোঝা যাবে যে তিনি একই লেখায় তথ্য জানানোর পাশাপাশি হালকা অথবা সিরিয়াস ধরনের রসিকতা করে পাঠকদের বিনোদন দিয়েছেন এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো কথাও বলেছেন। এজন্য তাঁকে বিশেষ করে তাঁরই সম্প্রদায়ভূক্ত শিখদের বড় অংশ পছন্দ করতো না। তিনি সম্ভবত এটাও উপভোগ করতেন। কানাডা থেকে কোনো শিখ তাঁর ওপর ক্ষোভ ঝাড়তে তাঁকে চিঠি লিখে ঠিকানা হিসেবে লিখেছে “বাষ্টার্ড খুশবন্ত সিং, দিল্লি, ইণ্ডিয়া”। এতো বড় দিল্লিতে ডাকবিভাগের পিয়ন ঠিকই জায়গামতো প্রাপককে চিঠি পৌঁছে দিয়েছে। রাজনীতিবিদদের একটি অংশ তাঁর নিন্দা করতেন ও পাকিস্তানের দালাল অভিহিত করতেন। ভিন্দ্রালওয়ালের শিখ সন্ত্রাসীদের হিট লিস্টে ছিলেন তিনি, যে কারণে প্রায় দশ বছর তাঁকে পুলিশ প্রটেকশনে থাকতে হয়েছে। খুশবন্ত সিংয়ের লেখা আমি যতোটা পড়েছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তাঁর ক্ষেপানোটা তাঁর লেখার স্টাইলে পরিণত হয়েছিল, যা অন্য কারো পক্ষে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়। ক্ষেপানোর মধ্য দিয়েও তিনি আসলে সত্য তুলে ধরতেই চেষ্টা করেছেন। আমার চার দশকের সাংবাদিকতায় ব্যক্তিগতভাবে আমি ক্ষেপানোর মতো কোনো কিছু লিখিনি। হয়তো আমার সে যোগ্যতাও ছিল না। ক্ষেপানোর প্রতিক্রিয়া সামলানোর মতো অবস্থাও আমার ছিল না বা নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে কোনো পক্ষেরই সামান্য সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য সহ্য করার মতো সহনশীলতা নেই। খুশবন্ত সিং পেরেছেন তাঁর পারিবারিক পটভূমি, পেশাগত অবস্থান ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, খ্যাতি ও পরিচিতির বিশাল গণ্ডির কারণে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমি বলতে পারি, আমাদের সামাজিক কাঠামোতে চিন্তার দৈন্যতা কাটিয়ে ওঠা শুধু কঠিন নয়, প্রায় অসম্ভব, অতএব যে কোনো লেখক-সাহিত্যিকের উচিত ক্ষেপিয়ে তোলার কাজ যথাসম্ভব পরিহার করা।

জহিরুলঃ খুশবন্তের বেশির ভাগ লেখাই আত্মজীবনী ধরনের, ফিকশনে সত্য থাকতেই হবে এমন নয়, কিন্তু যখন ইতিহাস বা আত্মজীবনীমূলক ফিকশন হয়, তখন পাঠক সেখানে সত্য খুঁজতে শুরু করেন। আপনি তো তাকে নিবিড়ভাবে পাঠ করেছেন, তিনি এইসব ক্ষেত্রে কতটা সত্যের কাছাকাছি ছিলেন বলে মনে করেন?

মঞ্জুঃ এটা ঠিক নয় যে তাঁর বেশির ভাগ লেখা আত্মজীবনীমূলক। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট হচ্ছে, অধিকাংশ লেখাড প্রধান চরিত্রকে তুলে ধরার জন্য ফার্ষ্ট পার্সন বা প্রথম পুরুষে বর্ণনা করা। যদি ‘দিল্লি’ উপন্যাসের কথা বলি, তাহলে দেখতে পাবেন, নিজামুদ্দিনকে বর্ণনা করে যাচ্ছেন অতি সাধারণ এক রাজ কর্মচারি, সম্রাট শাহজাহানকে তুলে ধরছেন একজন মেথর এবং লেখক স্বয়ং ফার্ষ্ট পার্সনে দিল্লির নানা বিষয়ের সাথে পাঠকের পরিচয় ঘটিয়ে দিচ্ছেন। অন্যান্য উপন্যাস ও ছোটগল্পেও তিনি কমবেশি একই কাজ করেছেন। ফিকশনের পাঠক হিসেবে অথবা মুভি দেখার সময় আমরা প্রধান চরিত্র বা নায়ক-নায়িকার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাই। নিজেদেরকে প্রধান চরিত্রগুলোর মধ্যে দেখি। খলনায়কের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠি। একটি কাহিনি শুনেছি যে নীল চাষের সময় নীলকুঠির সাহেবদের অত্যাচারের ওপর নাটক মঞ্চায়নকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর চটি ছুঁড়ে মেরেছিলেন অভিনয়কারী নীলকুঠির সাহেবের দিকে। অতএব পাঠক যদি সত্য খুঁজে পেতে চান, তাহলেও সেটি লেখকের সার্থকতা। আমি খুশবন্তের প্রায় সব বই পড়েছি, তাঁর ওপর আলোচনা ও তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনা এবং তাঁর সাক্ষাৎকারগুলো পাঠ করেছি। তাঁর উপন্যাসের মধ্যে তিনটি ‘ট্রেন টু পাকিস্তান,’ ‘আই শ্যাল নট হিয়ার দ্য নাইটিঙ্গেল,’ এবং ‘দিল্লি’ ইতিহাসশ্রয়ী বা ঐতিহাসিক ঘটনা বা ইতিহাস সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে লিখিত। ঘটনা সত্য এবং ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল। তিনি নিজেই এ সম্পর্কে লিখেছেন, “ইতিহাস আমাকে দিয়েছে উপন্যাসের কঙ্কাল। আমি সংযোজন করেছি মাংস এবং তাতে রক্ত ও বীর্যসহ তরল উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছি।” খুশবন্ত সিং বলেছেন যে তার ‘দিল্লি’ লেখার অনুপ্রেরণা ছিল নোবেল বিজয়ী সার্ব লেখক আইভো অ্যানড্রিচ এর ‘দ্য ব্রিজ অন দ্য দ্রিনা’ উপন্যাসটি। ওই বইটিও আমি অনুবাদ করেছি, যে বইয়ের সিংহভাগ জুড়ে আছে অটোম্যানদের ওই অঞ্চলে শাসন সম্পর্কিত ঘটনাবলী। একটি সেতুকে কেন্দ্র করে বইয়ে তিনশ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। পাঠক হিসেবে আমি তো বর্ণিত সেতু, সেতুর আশপাশের জায়গাগুলোতে চলে যাই এবং এখানেই একজন সাহিত্যিকের সার্থকতা বলে আমি বিশ্বাস করি।

জহিরুলঃ ওয়েস্টার্ন সাহিত্যের চেয়ে অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনার ওরিয়েন্টাল সাহিত্যের প্রতি অধিক আগ্রহ, এর কারণ কি?

মঞ্জুঃ আমার ওরিয়েন্টাল সাহিত্য অনুবাদ করার প্রধান কারণ বাংলাভাষী পাঠকদের প্রাচ্যের সমৃদ্ধ সাহিত্যের প্রতি অধিকতর আগ্রহী করে তোলা। পাশ্চাত্যের সাহিত্য আমরা পড়ছি, এখনকার তরুণরা আরো বেশি পড়ছে। কিন্তু এর ফলে বর্তমান প্রজন্মের ধারণা হতে পারে যে প্রাচ্যে সমৃদ্ধ কোনো সাহিত্য নেই। ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি ভাষায় বা পাশ্চাত্যে অন্যান্য ভাষায় বহু সেরা রচনা আছে। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারসহ সকল আন্তর্জাতিক সাহিত্য পুরস্কার যারা লাভ করেছেন তাদের অধিকাংশই পাশ্চাত্যের। এর ফলে আমাদের দেশের পাঠকদের মধ্যে একটা ধারণা প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে, প্রাচ্যে ভালো কোনো সাহিত্য হয় না। বাংলাদেশে প্রতিবছর যতো সংখ্যক থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন, অন্যান্য ফিকশন, নন-ফিকশন বাংলায় অনুবাদ হয়, সেগুলোর ৯০ শতাংশই ওয়েষ্টার্ন সাহিত্য। এখনকার বাংলাভাষী পাঠকদের বড় অংশ হয়তো বিশ্বাসই করতে পারবে না যে কীভাবে প্রাচ্যের সাহিত্য দ্বারা পাশ্চাত্যের সাহিত্য প্রভাবিত। হিব্রু, ফারসি ও আরবি সাহিত্য পাশ্চাত্যে এসেছে দর্শন ও ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে রচিত হিব্রু বাইবেল, যা খ্রিষ্টান বাইবেলের ভিত্তি সেটিই মূলত পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও সাহিত্যে বলা যায় চিরদিনের মতো পরিবর্তন এনে দিয়েছে। একইভাবে কোরআনও আরবি সাহিত্যকলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অনুপম নিদর্শন, যা মুসলিম বিশ্ব ছাড়িয়ে মুসলমানরা ইউরোপের যেসব ভূখণ্ড শাসন করেছে, সেসব স্থানে সাহিত্যের আধুনিক বিকাশে ভূমিকা রেখেছে এবং পাশ্চাত্য পর্যায়ক্রমে নিজেদের সাহিত্যের ধরন ও স্টাইল তৈরি করে নিয়েছে। আরব্য উপন্যাস আরবিতে লিখিত কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্য, একইভাবে ফারসি শাহনামাও কল্পনাশ্রয়ী। এসব গ্রন্থ কালোত্তীর্ণ এবং সকল সভ্যতা সাদরে গ্রহণ করেছে ও অনুসরণ করার চেষ্টা করেছে। পাশ্চাত্যে কল্পনাশ্রয়ী সাহিত্য এসেছে অনেক পরে। জোনাথন সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস, জুলে ভার্নের বইগুলোর অধিকাংশই কল্পনা নির্ভর, একইভাবে আমি লুইস ক্যারলের এলিস ইন দ্য ওয়াণ্ডারল্যাণ্ড, গ্রীম ব্রাদার্সের রূপকথা, ক্রিস্টোফার মারলো’র ‘ডক্টর ফস্টাস’ এর কথা বলতে পারি। পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্যের সাহিত্যে কল্পনার মধ্যে বিজ্ঞান বড় স্থান দখল করে নিয়েছে, যখন প্রাচ্য বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো পরবর্তী সময়ে, হয়তো এখন থেকে দেড়শ বছর পাশ্চাত্য সাহিত্যে, বিশেষ করে কবিতার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতার মধ্যে টেনে এনেছে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির প্রেমের কবিতা এবং তাঁর দীর্ঘ কাব্য ‘মসনভী’। আটশ’ বছর আগে সুফি কবি যা লিখে গেছেন, পাশ্চাত্য এখন তা ধারণ করছে। কিন্তু বাংলাদেশে রুমি এখন সাহিত্য বোদ্ধাদের কাছে প্রায় অপরিচিত। এই কারণগুলো আমাকে প্রাচ্যের সাহিত্য সম্পর্কে আরো বেশি জানার ও পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে।

জহিরুলঃ আপনি মূলত সাংবাদিক, সৃজনশীল সাহিত্যের অনুবাদে কেন হাত দিলেন? এর পেছনে কোনো গল্প আছে কি?

মঞ্জুঃ সাংবাদিকতা আমার পেশা এবং সাহিত্য আমার আবেগ। সাংবাদিকতার প্রতি আমার আগ্রহ সৃষ্টির অনেক আগে থেকেই আমি একজন পাঠক। আমি বই পেলেই পড়তাম। আমার মনে আছে আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, আমাদের এক আত্মীয়, যিনি কলেজে বিএ ক্লাসে পড়তেন, তার বইগুলো আমাদের বাড়িতে রেখে যান। আমি তাঁর বইগুলো সব পড়ে ফেলেছিলাম। সবকিছু বোধগম্য ছিল না। তবুও পড়েছি। তার একটি বই ছিল লজিকের ওপর; আমি তখন লজিক্যাল ফ্যালাসি পড়েছি। যখন সাংবাদিকতা শুরু করি, তখন আমার কাজ ছিল সামান্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোটখাট বিষয় লিখে দিয়েই আমার কাজ শেষ। কিন্তু আমি নিউজ এডিটরের কাছে ইংরেজি স্ক্রিপ্ট চেয়ে নিয়ে বাংলা করে দিতাম। সংবাদপত্রে অনুবাদের কাজগুলো করেন মূলত সাব-এডিটররা। আমি বরাবর রিপোর্টিংয়ে কাজ করেছি। কিন্তু অনুবাদ করেছি ব্যক্তিগত আগ্রহে। এভাবে ছোটগল্প অনুবাদ শুরু করি। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে দেই। শুধু ইংরেজি থেকে নয়, হিন্দি শিখেছিলাম ১৯৭২-৭৩ সালে। হিন্দি থেকেও গল্প অনুবাদ করতাম। ঢাকায় আসার আগে কোনো ইংরেজি ফিকশন পুরোপুরি পড়িনি। কারণ তখন ইংরেজি তেমন বুঝতাম না। যখন বুঝে পড়তে শুরু করলাম তখন ইংরেজি ছোটগল্প ও উপন্যাসের বিষয়বস্তু, উপস্থাপনার স্টাইল, ব্যাপকতা, গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করতে লাগল এবং ক্রমেই বাংলা উপন্যাস ও ছোটগল্পের দৈন্যতা ধরা পড়তে লাগলো আমার কাছে। নিজেকেও হীন মনে হতে লাগলো এই ভেবে যে, আমার মাতৃভাষা কী এতো দুর্বল, আমাদের কল্পনা কী এতো সীমিত! আমি প্রাচ্য সাহিত্যের দিকে ফিরলাম, কারণ প্রাচ্যই আমাদের হৃদয়ের কাছে, প্রাচ্যের চিন্তাভাবনাই আমাদের চিন্তাভাবনা। আমার কাছে যে বইগুলো পড়ে ভালো লাগতো আমি তা অনুবাদ করার কথা ভাবতাম। কিন্তু ইংরজিতে দুর্বল থাকায় বড় কোনো কাজে হাত দেওয়ার সাহস হয়নি। ১৯৮৮-৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে আসার সুযোগ পেয়ে আমার ইংরেজি চর্চার সুযোগ হয় এবং দেশে ফিরে গিয়ে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সৌখিন অনুবাদক হিসেবে অনুবাদের কাজ শুরু করি। আমার অনুবাদের লক্ষ্য সাধারণ পাঠক নয়, আমি সবসময় চেয়েছি যাতে পাঠকদের পাঠরুচি বৃদ্ধি পায় এবং পাঠকরা অনুবাদ পাঠ করার পর যারা বাংলা সাহিত্য রচনা করছেন, অন্তত তাদেরকে বলার সুযোগ পান কেন তাদের সৃষ্টি আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না।

জহিরুলঃ আপনি প্রচুর কবিতা পড়েন, কবিতার একজন নিবেদিত পাঠক, জালালুদ্দিন রুমির কবিতা অনুবাদও করেছেন, নিজে কবি না হয়ে কবিতার অনুবাদ করা বেশ কঠিন এবং সেটির মান দুর্বল হবার খুব সম্ভাবনা থাকে, কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে এই আশঙ্কা কি আপনার মধ্যে কাজ করেছে?

মঞ্জুঃ জি, পাঠক হিসেবে কবিতার প্রতি আমার অনুরাগ রয়েছে। যে কোনো শিশুর মতো আমারও কবিতার শিক্ষক আমার মা। আম্মা খুব কম পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু এতো কবিতা কিভাবে পড়েছেন বা মনে রেখেছেন তা এখনো আমাকে বিস্মিত করে। স্কুলের বাংলা ও ইংরেজি বইয়ে যেসব কবিতা থাকতো সেগুলো আমার প্রায় কণ্ঠস্থ ছিল। এমনকি মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যের অংশবিশেষ ক্লাস নাইন, টেন এবং ইন্টারমেডিয়েট পর্যায়ে থাকতো, যা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে দুর্বোধ মনে হতো, সেটুকু তো আমার মুখস্থ ছিলই, মেঘনাদ বধ কাব্য সংগ্রহ করে অতি আগ্রহে আমি পাঠ করি এবং প্রায় চারশ’ লাইন মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি কখনো কবিতা লেখার চেষ্টা করিনি। শৈশবে কোনো ওয়াজ মাহফিলে গেলে ওয়ায়েজিনদের মুখে জালালুদ্দিন রুমির অনেক কবিতা উচ্চারিত হতে শুনেছি এবং কোনো কোনো কবিতার উদ্ধৃতি মুখস্থও হয়ে গিয়েছিল। যদিও কবিতাগুলোর অর্থ বোঝার উপায় ছিল না। তারা শেখ সাদী, ফেরদৌসির কবিতা থেকেও উদ্ধৃতি দিতেন। রুমির কবিতার প্রতি আগ্রহ জাগে ২০০০ সালের পর। নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দুই মাস পর নভেম্বর মাসে টাইম ম্যাগাজিন জালালুদ্দিন রুমির ওপর একটি কভার স্টোরি করে। আমি সেটি পাঠ করি এবং অবাক হই যে পশ্চিমা জগৎ এবং বিশ্বের মুসলিম বিরোধীরা যখন মুসলমানদের ঢালাওভাবে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করছে, ঠিক এ সময়ে টাইম ম্যাগাজিন রুমিকে এতো প্রাধান্য দিল কেন? মূলত তখন আমেরিকান এক শিক্ষাবিদ ও কবি কোলম্যান বার্কস রুমির একটি কবিতা সংকলন ইংরেজিতে “দ্য সোল অফ রুমি” নামে প্রকাশ করেন। বইটির ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুসলিম, বিশেষত সুফিদের প্রেমের বাণী চর্চার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। রুমির ওপর আমারও আগ্রহ বাড়ে। “দ্য সোল অফ রুমি” সংগ্রহ করে অনুবাদ করতে শুরু করি। কবিতা অনুবাদ করা সত্যিই কঠিন এক কাজ। কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন এবং আমি কী বুঝছি, দু’য়ের মধে যথেষ্ট ফারাক থেকে যায়। গদ্যে সবকিছু প্রকাশ্য বা স্পষ্ট, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘এক্সপ্লিসিট’, অন্যদিকে কবিতায় অনেক কিছু থাকে উহ্য বা অন্তর্নিহিত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়, ‘ইমপ্লিসিট’। একজন কবির পক্ষেই ভিন্ন এক ভাষার কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন তা উপলব্ধি করা সম্ভব এবং কোনো ভালো কবি যদি রুমির কবিতা অনুবাদ করতেন বা করেন তাহলে নি:সন্দেহে ভালো করবেন। আমার কবিতা অনুবাদ শাব্দিক অনুবাদ হয়েছে এবং দ্বাদশ শতাব্দীর একজন আধ্যাত্মিক কবির কবিতার ভাবের কাছে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তিনি যে একটির পর একটি উপমা উপস্থাপন করেছেন, আমি সেই উপমাগুলোকে একের পর এক আনতে চেষ্টা করেছি। বাকিটুকু বিচারের ভার পাঠকদের ওপর।

কাজী জহিরুল ইসলামঃ লক্ষ করেছি বিভিন্ন সময়ে আপনি উর্দু, হিন্দি কিংবা ফার্সি কবিতা আওড়াতে পছন্দ করেন, এর কারণ কি? বিশেষ কোনো কারণে, (হতে পারে আপনার কাছে মান সম্মত মনে হয় না) বাংলা কবিতার প্রতি কি অনীহা আছে?

মঞ্জুঃ বাংলা কবিতার প্রতি আমার কোনো অনীহা নেই। বাংলা কবিতা দিয়েই মূলত কবিতার সাথে আমার পরিচয়, যা আমি আগের প্রশ্নে বলেছি। আমি প্রচুর বাংলা কবিতা পাঠ করি। অনেক বাংলা কবিতা মুখস্থও থাকে। কিন্তু আমার মাঝে বেশির ভাগ বাংলা কবিতার গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। উপমহাদেশে উর্দু সবচেয়ে নতুন বা কমবয়সী ভাষা। বাংলা ভাষা সেই তুলনায় অনেক প্রাচীন। মাতৃভাষা হওয়া সত্বেও আমার কাছে বাংলা ভাষাকে মনে হয়েছে যে বাংলা ভাষা এক একটি পর্যায়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে এবং সেখান থেকে ওঠে আসতে কষ্ট হয়েছে। প্রতিটি পর্যায়ে বাংলা ভাষার শব্দ, উচ্চারণ ও বানান রীতিতে পার্থক্য এসেছে এবং এখনো এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান ঘটেনি। আমি ভাষাবিদ নই, সকল প্রাচীন ভাষার ক্ষেত্রেই হয়তো এই পরিমার্জন ও পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে। বাংলার ক্ষেত্রে আরো একটি সমস্যা হলো, বাংলা কখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল না। স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হলেও গত পাঁচ দশকে বাংলাভাষা আংশিকভাবে রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে চালু রয়েছে। এ কারণে সাহিত্যের প্রকাশেও দুর্বলতা আছে এবং তা কবিতার ক্ষেত্রেও।

অন্যদিকে উর্দু ভাষা শুরু থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছে। রাজ দরবারে মুশায়রার আয়োজন ছিল এবং মুশায়রার মধ্য দিয়ে কবিরা প্রতিযোগিতামূলকভাবে তাদের কবিতার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ গ্রহণ করতেন। ফারসি অতি প্রাচীন ভাষা এবং ফারসি ভাষার ক্ষেত্রে এটি আরো বেশি প্রযোজ্য। আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হলো, আমাদের শহরে একটি সিনেমা হল ছিল। প্রতিদিন প্রতিটি শো আরম্ভ হওয়ার আগে মাইক্রোফোনে উর্দু ও হিন্দি গান বাজানো হতো। গানগুলো শুনে আসছিলাম যখন ক্লাস ফোরে পড়ি তখন থেকে। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গানের কথাগুলো বুঝতাম না। অতএব বোঝার একটি আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। বাহাত্তর সালে আমি হিন্দি শিখতে শুরু করি এবং অনেক উর্দু গান বা কবিতা হিন্দিতে পড়ার সুযোগ পাই। এভাবে অনেক কবিতা পাঠ করি এবং ভালো লাগলে মুখস্থ করি। ফারসি কবিতা খুব বেশি মুখস্থ নেই। শেখ সা’দী বা রুমির কবিতা পড়েছি ইংরেজি অনুবাদে। খুশবন্ত সিং তাঁর অনেক লেখায় মূল উচ্চারণসহ ফারসি কবিতার উদ্ধৃতি এবং ইংরেজি অনুবাদ দিয়েছেন। সেগুলো আমি মুখস্থ করেছি।

জহিরুলঃ আপনি তো বিশ্বসাহিত্যের অনেক বিখ্যাত ফিকশন অনুবাদ করেছেন, বাংলা ভাষার কথা সাহিত্যের সাথে সেইসব ফিকশনের যদি কিছুটা তুলনামুলক আলোচনা করেন আমরা উপকৃত হই।

মঞ্জুঃ বিশ্ব সাহিত্য থেকে আমি খুব একটা অনুবাদ করিনি। বিশ্ব সাহিত্য বিশাল ব্যাপার। আমার জ্ঞানসীমা ও উপলব্ধির বাইরে। তবে কয়েকজন আধুনিক নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকের বই অনুবাদ করেছি, তাদের মধ্যে গ্যাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেজের “মেমোরিজ অফ মাই মেলানকোলি হোরস,” ভিএস নাইপলে “হাফ এ লাইফ,” আইভো অ্যানড্রিচের “দ্য ব্রিজ অন দ্য দ্রিনা,” নাগিব মাহফুজের “কায়রো ট্রিলজি,” “খুফু’জ উইজডম,” ও “থেবস অ্যাট ওয়ার,” এবং ওরহান পামুকের “ইস্তাম্বুল: মেমোরিজ অফ দ্য সিটি।” আমাকে যদি এর যে কোনো একটি বইয়ের সঙ্গে বাংলা ফিকশনের তুলনা করতে বলেন, তাহলে আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলবো যে, ওপরের কোনো একটি ফিকশনের তুলনীয় কোনো ফিকশন বাংলা সাহিত্যে নেই। সেজন্যই আমি আমার অনুবাদের টার্গেট গ্রুপ হিসেবে সাধারণ পাঠকদের চেয়ে বাংলা ফিকশন লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই অনুবাদ করি, যদি তারা এসব পাঠ করে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ ভারতে অখন্ড বাংলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র ও বঙ্কিমচন্দ্রের পর পশ্চিমবঙ্গে অনেক বাঙালি সাহিত্যিক বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় উন্নত সাহিত্যকর্ম উপহার দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে ওই পর্যায়ের কোনো ফিকশন আসেনি। সন্দেহ নেই অনেক ভালো কবিতা হয়েছে। ফিকশন লেখকদের মধ্যে আমি দু’জনের কথা বলবো আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলী। তারা খুব বেশি না লিখলেও যা লিখেছেন ভালো লিখেছেন।

জহিরুলঃ বাংলা ভাষার কিছু বিখ্যাত কথাসাহিত্যের কথা বলবেন কি যেগুলোকে বিশ্বমানের সাহিত্য মনে হয়েছে এবং তা কোন গুণাবলির কারণে?

মঞ্জুঃ আগের প্রশ্নের উত্তরে এর কিছুটা বলেছি। কবিতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্যই অনেক বিশ্বমানের কবিতা উপহার দিয়েছেন, যেগুলোর আবেদন সার্বজনীন। তাঁর কোনো কোনো উপন্যাস বাংলাভাষীদের পাঠের জন্য ভালো, সহজ-সরল ভাষায় লেখা, পরিচিত পটভূমি, সাংসারিক জটিলতা ছাড়া আর কিছু নেই। মানুষ তাঁর উপন্যাসে নিজেকে দেখে, নিজের পরিচিত পরিবেশকে দেখে। কিন্তু সেগুলোই যদি ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়, তাহলে ইংরেজি পাঠকরা তাদের উপযোগী ভাববেন না। আমি সুনির্দিষ্টভাবে আমার পড়া তাঁর সব বইয়ের নাম উল্লেখ করে বলতে পারবো না। কারণ তাঁর সব কবিতা উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রবন্ধ ও চিঠিপত্র আমার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়া। বলতে গেলে কোনো বইয়ের চরিত্রের সাথে আরেক বইয়ের চরিত্র মিলে যেতে পারে। এছাড়া দুলাল চন্দ্র (অবধুত), বিভূতিভূষণ, অদ্বৈত মল্লবর্মন, মহাশ্বেতা দেবী; পরবর্তী সময়ের লেখক সমরেশ বসু ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেক সাহিত্যকর্ম আমার কাছে বিশ্বমানের মনে হয়, এসব ফিকশনের বিস্তৃত পটভূমি এবং মানুষের জীবনকে পরিপূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলার কারণে। তাদের সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও শওকত আলীকেও একই কারণে যোগ করা যায়।

জহিরুলঃ উপমহাদেশের আর কার লেখা আপনি অনুবাদ করেছেন?

মঞ্জুঃ উপমহাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কমলা দাশ, মঞ্জু কাপুর, গুলজার, মির্জা হাদিরুসওয়ার বই অনুবাদ করেছি। এর বাইরে অনেকের ছোটগল্প অনুবাদ করেছি, যেগুলো আমি সংরক্ষণ করে রাখতে পারিনি। তবে লেখকদের অনেকের নাম মনে আছে, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন: খাজা আহমদ আব্বাস, সাদাত হাসান মান্টু, মুনশি প্রেমচাঁদ, অমর জালীল, নন্দিনী শতপতি, কেটি মোজাম্মদ, ভৈকম মোহাম্মদ বশীর, অজিত কাউর।

জহিরুলঃ খুশবন্ত সিং তাঁর সকল বই অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি দিলেন আপনাকে এবং সেই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজ হাতে আপনার সামনেই সম্ভবত বাংলায় লিখে দিলেন। তিনি কিভাবে বাংলা শিখলেন তা কি জানতে পেরেছিলেন?

মঞ্জুঃ জ্বি, ঘটনাটি ঘটে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে, এ সম্পর্কে আমি এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছি। তারিখটি আমার স্মরণে নেই। তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর, ডিসেম্বরের শেষ দিকে। না, বাংলায় নয়, উনি ইংরেজিতে লিখেছেন। আমার কফি পানের সময়ের মধ্যেই লিখে দিয়েছেন। ১৯৮৪ থেকে মাঝে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে আমাকে তিনটি বা চারটি চিঠি লিখেছেন। লিখেছেন বলতে আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। প্রতিটি চিঠি ইংরেজিতেই লিখেছেন। প্রতিটি চিঠিতে আমাকে সম্বোধন করেছেন “আনোয়ার ভাই,” বলে। আমি বিব্রত বোধ করেছি। কারণ আমি যখন তাঁর প্রথম চিঠি পাই তখন আমার বয়স ৩০ বছর, আর তাঁর বয়স ৬৯ বছর। তাঁর সাথে যখন আমার দেখা হয় তখন তাঁর বয়স ৭৭ বছর। প্রথম চিঠি প্রাপ্তি নিয়েও একটি মজার ঘটনা আছে। আমি তখন দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টার। খুশবন্ত সিং এর যে লেখাটির অনুবাদ পাক্ষিক নিপূণ প্রকাশ করেছিল, সেটি আমার অফিসের অনেকে পড়েছেন। আমি খুশবন্ত সিং সম্পর্কে অনেক কথা ইতোমধ্যে অনেককে বলেছি। তখন সংবাদপত্রে সন্ধ্যার শিফট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশেষ করে রিপোর্টাররা সবাই সন্ধ্যায় অফিসে হাজির হতেন। এক সন্ধ্যায় আমি অফিসে যাওয়ার পরই আমাদের তরুণ রিপোর্টার আজম মীর খুব উৎসাহে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, “উস্তাদ মিষ্টি খাওয়ান।” আমি বুঝতে পারছিলাম না মিষ্টি খেতে চাওয়ার মতো কী ঘটলো। আজম মীর নাছোড়বান্দা টাইপের ছেলে। মিষ্টি না হোক, সিঙ্গারা-চা এর পয়সা আদায় করে আমাকে খুশবন্ত সিংয়ের চিঠি ধরিয়ে দিল। অত্যন্ত আনন্দিত হলাম, সিঙ্গারা-চা এর দাম আদায় বৃথা যায়নি। তাঁর সব কটি চিঠি এবং বই অনুবাদ করার জন্য দেয়া অনুমতিপত্র আমি সযত্নে সংরক্ষণ করেছিলাম। ২০১০ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার স্ত্রী তিনবার বাসা বদল করেছে। এ সময়ে আমার বই ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কোথায় কীভাবে রেখেছে তা বলতে পারে না।

খুশবন্ত সিং কখনো বাংলা শিখেননি। তিনি থেমে থেমে বাংলা পড়তে পারতেন। বললে সবই বুঝতেন। ‘কেমন আছেন?’ ‘আমি ভালো আছি?’ ‘আমি বাংলাদেশ ভালোবাসি,’ অথবা ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ ধরনের কমন বাংলা বলতে পারতেন। তবে আমাকে বলেছিলেন, কিছু রবীন্দ্র সঙ্গীত তাঁর খুব ভালো লাগে। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত “জনগণমন ভারত ভাগ্যবিধাতা,” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা, সেটি পুরোটাই জানেন এবং বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’র কয়েক লাইন তিনি গুনগুন করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর তিনি যখন প্রথমবার বাংলাদেশ সফর করেন তখন তিান মানুষের মুখে এবং দোকানপাট, সর্বত্র বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত উচ্চারিত হতে শুনেছেন।

জহিরুলঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার কিছু লেখালেখি আছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীর সাথে দেখা করেন এবং তার সাক্ষাৎকার নেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার মূল বক্তব্যটা কি ছিল? তিনি এবং সম্প্রতি ভারতের আধ্যাত্মিক গুরু সতগুরুর এক মন্তব্য থেকে বুঝতে পারি যেসব হিন্দু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছেন তাদেরকে তারা ভারতীয় বলে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশের বা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের ডেমোগ্রাফি সম্পর্কে তাদের কিছুটা অজ্ঞতাই কি এতে প্রকাশ পায় না?

মঞ্জুঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা রয়েছে। ওই সময়ে তিনি ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইণ্ডিয়া’র সম্পাদক ছিলেন এবং একই সময়ে নিউইয়র্ক টাইমস তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর রিপোর্ট করার জন্য দায়িত্ব দিয়েছিল। এই সূত্রে তিনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় থেকে যুদ্ধে বিজয় অর্জন পর্যন্ত এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সফর করে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, ওই সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি পাকিস্তানেও যান এবং “বাংলার কশাই” খ্যাত জেনারেল টিক্কা খানের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, ইস্টার্ন কমাণ্ডের প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, জেনারেল এমএজি ওসমানি, খন্দকার মুশতাক আহমেদ, মাওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিং, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কবি জসীমউদ্দিন, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক রওনক জাহান প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার এসব নিবন্ধ, রিপোর্ট ও সাক্ষাৎকার “ওয়ার এণ্ড পিস ইন ইণ্ডিয়া, পাকিস্তান এণ্ড বাংলাদেশ” নামে একটি গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। শিগগিরই গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি তাঁর এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন: “হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ণ করার জন্য বাংলার মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীকে সাহায্য করতে এবং বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত একমাত্র বৈধ সরকারকে পুন:প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব আমরা তা করব। আমাদের উচিত আমাদের প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বোঝানো যে, তাদের শাসকরা কিভাবে অবদমন, নিপীড়ণ ও স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছে এবং আমাদের উচিত এভাবে সামরিক গোষ্ঠীকে অসহযোগিতা করার জন্য তাদেরকে উৎসাহিত করা।” ভারতের সতগুরু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হিন্দুদের ভারতীয় বলে দাবী করে থাকলে নি:সন্দেহে বড় ধরনের ভুল করেছেন। তাঁর বক্তব্য বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর। কারণ আজ পর্যন্ত ভারত সরকারিভাবে কখনো বলেনি যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের হিন্দু নাগরিকরা অংশগ্রহণ করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করার কথা স্বীকার করে। ভারতীয় কোনো বেসামরিক হিন্দু নাগরিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে সতগুরুর এমন দাবী বিভ্রান্তিকর। আমার অনেক হিন্দু বন্ধুসহ বাংলাদেশের বহু হিন্দু তরুণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাদের অনেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে আত্মদান করেছেন। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর একজন হিন্দু গুরুর এ ধরনের বক্তব্য দান অজ্ঞতাপ্রসূত অথবা উদ্দেশমূলক।

জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্ট নামে তো একটি পত্রিকা ছিল, নতুন করে একই নামে আপনি আরো একটি পত্রিকা কেন বের করলেন? অবশ্য আপনার সম্পাদিত ও প্রকাশিত ডাইজেস্টই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ঢাকা ডাইজেস্টের এই বিপুল পাঠকপ্রিয়তার মূল কারণ কি ছিল এবং কোন বয়সের পাঠক সবচেয়ে বেশি ছিল?

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আশির দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাজারে ছিল। তারও আগে ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘বাংলা ডাইজেস্ট’ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন ছিল। আমি স্কুল জীবন থেকে ‘বাংলা ডাউজেস্ট’ এর গ্রাহক ছিলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা ডাইজেস্ট আর প্রকাশিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আমি ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ অফিসে যাতায়াত শুরু করি এবং মাঝে মাঝে কিছু লেখাও দেই। এটির অফিস ছিল তোপখানা রোডে। ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন রশীদ চৌধুরী নামে একজন ব্যবসায়ী এবং নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন ফজলে আজিম নামে একজন সাবেক কলেজ শিক্ষক। এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে নাজির আহমেদ নামে আরো একজন ছিলেন। কিন্তু সক্রিয় ছিলেন না। যাহোক, তারা আমাকে মাঝে মাঝে এসাইনমেন্ট দিতে শুরু করেন। আমি উৎসাহের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করি। তখন থেকেই আমার মনে হতো কখনো সম্ভব হলে আমি এ ধরনের একটি ম্যাগাজিন বের করবো। সম্ভবত ১৯৮২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ডাইজেস্ট বন্ধ হয়ে যায়। আমি তখন দৈনিক সংগ্রামে স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছিলাম। আমার মাথায় মাসিক ম্যাগাজিনের ধারণা তখনো কাজ করছিল। কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি এবং তারাও উৎসাহিত হন। আমরা আসলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঢাকা ডাইজেস্ট পুন:প্রকাশের কথাই ভেবেছিলাম। সেজন্য ম্যাগাজিনের তিন মালিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আগে যেভাবে প্রকাশিত হতো সেভাবে তাদের নামেই প্রকাশের আগ্রহের কথা জানালে তারা সম্মত হন। পরিচালনার শর্ত কি হবে না হবে, তারা নির্ধারণ করে দেন। কিন্তু দলিল স্বাক্ষরের মুহূর্তে তাদের দুজন রশীদ চৌধুরী ও ফজলে আজিম টালবাহানা শুরু করলে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। তৃতীয় মালিক আমাকে বলেন উনাদের পেছনে সময় ব্যয় না করে আমি কেন নতুন একটি ম্যাগাজিন প্রকাশের ডিক্লারেশন নেয়ার চেষ্টা করছি না। তাঁর পরামর্শ আমাকে সাহসী করে তোলে। তবে ঢাকা ডাইজেস্টের যে সুনাম ছিল তা কাজে লাগানোর ইচ্ছায় ও দুই মালিকের ওপর ক্ষোভের কারণে ঢাকা ডাইজেস্টের প্রথমে ‘নতুন’ শব্দ যোগ করে ডিক্লারেশনের জন্য আবেদন করি। ডিক্লারেশন পাওয়া কঠিন এক প্রক্রিয়া। ডিপার্টমেন্ট অফ ফিল্মস এন্ড পাবলিকেশন্স (ডিএফপি), পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), ন্যাশনাল সিকিউরিটির ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক শাখা, তথ্য মন্ত্রণালয় ঘুরে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে কয়েক মাস লেগে যায়। প্রতিটি অফিসে গিয়ে ফাইল আটকে যেত। প্রতিটি অফিসে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ধর্ণা দিয়ে ফাইল এক অফিস থেকে আরেক অফিসে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কোনো কোনো অফিসে ‘চা-পানির’ খরচও দিতে হয়েছে।

জহিরুলঃ এতসব কাজ একা একাই করলেন, নাকি একটি টিম ছিল?

মঞ্জুঃ আমার সঙ্গে আরো তিন জন ছিলেন। তারা সবাই সাংবাদিক ছিলেন। তাদের মধ্যে শুধু একজন সাংবাদিকতায় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছেন, তিনি মাসুমুর রহমান খলিলী। অপর দু’জন সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। আমরা ১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসে মাসিক ‘নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট’ এর প্রথম সংখ্যা বের করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা দু’একটি সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেই এবং হকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। প্রথম সংখ্যা যাতে পাঠকদের মন কাড়তে পারে সেজন্য আমরা কবি আল মাহমুদের লেখাসহ পাঠকপ্রিয় কবি ও লেখকদের গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ প্রকাশ করি, যথাসময়ে এজেন্ট ও হকারদের কাছে পৌঁছানো এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম সংখ্যা সাদরে গৃহীত হয় এবং আমাদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি হয় যে আমরা দিন দিন ম্যাগাজিনের মান বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকি। প্রতিষ্ঠিত কবি লেখকরা তো আমাদের সাথে ছিলেন, পাশাপাশি দেশের নবীন লেখকদের উৎসাহিত করার জন্য যারাই লেখা পাঠাতো, সেগুলো যদি মানসম্মত নাও হয়, প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে প্রকাশ করতে শুরু করি। প্রতিটি সংখ্যায় ‘এ সংখ্যার বই’ বিভাগে দেশি বা বিদেশি বিখ্যাত কোনো উপন্যাস সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করি, একসময় রিডার্স ডাইজেস্ট যা করতো এবং সেরা উপন্যাসগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ পাঠকরা গোগ্রাসে পড়তেন ও পরামর্শ দিতেন কোন্ উপন্যাসগুলো আমাদের ছাপা উচিত। সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর বিশ্লেষণধর্মী লেখার জন্য বেশ ক’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, আমলা ও সাংবাদিকের সাথে যোগাযোগ করি। তারা নিয়মিত লিখতেন। এসব কারণে ঢাকা ডাইজেস্ট দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। ওই সময় ঢাকা ডাইজেস্টের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। সেবা প্রকাশনীর মাসিক রহস্য পত্রিকা ছাড়া বুক সাইজের আর কোনো ম্যগাজিন ছিল না। রহস্য পত্রিকার বিষয়বস্তুর বৈচিত্রের চেয়ে আমাদের বিষয়বৈচিত্র ছিল অনেক বেশি।

জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্টের টার্গেট অডিয়েন্স কারা ছিল? মানে কোন এইজ বা ইনকাম গ্রুপ? আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি ছাত্রদের মধ্যে এর বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।

মঞ্জুঃ জ্বি, আপনি ঠিকই বলেছেন। নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের পাঠকদের মধ্যে ছাত্র সংখ্যাই ছিল বেশি। স্কুলের উচ্চ শ্রেনির ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই আমাদের পাঠক ছিল। তারা পেশাদার হকারের কাছ থেকে ম্যাগাজিন নেয়ার জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে নিজেরাই এজেন্সি নিয়ে নিতো। বন্ধুবান্ধবদের কাছে বিতরণ করতো। এর মূখ্য কারণ ছিল ছাত্রদের কাজে লাগার মতো অনেক খোরাক দেয়ার চেষ্টা করতাম আমরা। এমনকি আমরা এমনও দেখেছি, বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বাজারে যেসব গাইড বই বিক্রি হতো, সেগুলোতে অবধারিতভাবে ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর ফলে আমরা সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যেও পড়েছিলাম এবং ম্যাগাজিনে আরো পাঠযোগ্য বিষয় দেয়ার কথা ভাবতাম। আমরা অনুবাদ সাহিত্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলাম এবং ঢাকা ডাইজেস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মেধাবী ছাত্ররা নির্বাচিত গল্প ও নাটক অনুবাদ করতেন। ইংরেজি, উর্দু ও আরবি ভাষা থেকেই তারা অনুবাদ করতেন। এছাড়া আমরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী আয়োজন করতাম। চার-পাঁচজন সাংবাদিক একজনের সাক্ষাৎকার নিতাম। দীর্ঘ সাক্ষাৎকার, পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা ব্যয় হতো, সাক্ষাৎকারের মাঝে আমরা কোনো চাইনিজ রেষ্টেুরেন্টে মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা রাখতাম। এভাবে আমরা গ্রহণ করেছিলাম কবি আল মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর মুহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক গোলাম আজম, বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ। কাজী জাফর আহমেদ অবশ্য দু’দিনে তাঁর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তাঁর দফতরে। এভাবে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার প্রকাশ করায় ঢাকা ডাইজেস্টের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছিল। আমি কোনো নির্দিষ্ট ইনকাম গ্রুপের কথা ভাবিনি। সব ইনকাম গ্রুপের লোকজন ঢাকা ডাইজেস্টের পাঠক ছিলেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, পাঠকদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং আমার বিশ্বাস, আমরা তাতে সফল হয়েছিলাম।

জহিরুলঃ ‘উপমহাদেশ’ উপন্যাসটি আল মাহমুদ লেখেন ঢাকা ডাইজেস্ট পত্রিকার জন্য। এই উপন্যাসটি লেখার পেছনে বেশ নাটকীয় ঘটনা আছে। রীতিমতো অ্যারেস্ট করে তাকে লিখতে বসানো হয়েছে, সেইসব গল্প শুনতে চাই।

মঞ্জুঃ সে এক দীর্ঘ কাহিনি। এ প্রসঙ্গে আমি ইতোমধ্যে আমার এক লেখায় উল্লেখ করেছি। আল মাহমুদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সাংবাদিক নেতা মুহাম্মদ আবদুল্লাহ এক ভিডিও কনফারেন্সের আয়োজন করে, আমাকেও অতিথি হিসেবে রেখেছিলেন, সেখানেও ঢাকা ডাইজেস্টে ‘উপমহাদেশ’ প্রকাশের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছি। প্রসঙ্গটি যখন আবার এসেছে, আমি আল মাহমুদের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচনা থেকে বলতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ১৯৭৬ বা ’৭৭ সাল থেকে আমি একাধিক সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ফিচার লিখতে শুরু করেছিলাম। ওই সময়ে রশীদ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ঢাকা ডাইজেষ্ট আমাকে দায়িত্ব দেয় কবি ফররুখ আহমদ সম্পর্কে অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কবির মূল্যায়ন জানতে। আমি কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি আহসান হাবীব, কবি মোহাম্মদ মাহফুজুল্লাহ, কবি আল মাহমুদ, কবি শামসুর রাহমান, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ও কবি আসাদ চৌধুরীর সাক্ষা]কার গ্রহণ করি। শুধুমাত্র শামসুর রাহমানের সাক্ষাৎকার নিতে পারিনি। আজ না, অমুক দিন বলে বলে কয়েক দিন ঘোরাানোর পর আমি আর তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে যাইনি। ওই সাক্ষাৎকারগুলো দিয়েই ম্যাগাজিনের কভার ষ্টোরি করা হয়েছিল। আল মাহমুদ শিল্পকলা একাডেমীর সহকারী পরিচালক। তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাতেই ঘনিষ্ট হয়ে উঠি এবং সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে বলেই ফেলি যে, “এতো ছোট একটা চাকুরি না নিলেই কী ভালো হতো না?’ যখন ঢাকায় আসিনি তখন মফ:স্বল শহরে ইত্তেফাক ও আজাদের পাশাপাশি দৈনিক গণকন্ঠ পড়তাম। গণকণ্ঠে সরকার বিরোধী খবর বেশি থাকতো। গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদ। একজন সম্পাদক হিসেবে আমার কাছে তাঁর অবস্থান ও মর্যাদা ছিল দেবতূল্য। তাঁর ওপর তিনি একজন কবি। বেশ কম বয়সে, স্কুলের শেষ দিকে থাকতে তাঁর কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর’ পড়েই মুগ্ধ হই। আমার প্রশ্নে তিনি বিব্রত হন না। স্মিত হেসে মাথা নেড়ে বলেন, “মঞ্জু মিয়া, আমিও নিজেকে তাই ভাবতাম। কর্ম জীবনের শুরু থেকে সাংবাদিকতাই করেছি। একজন সাংবাদিকের সম্পাদক হওয়ার আকাংখা থাকে। যে কোনো পেশায় প্রত্যেকের স্বপ্ন থাকে শীর্ষ পদটিতে যাওয়ার। কিন্তু সে আকাংখা পূরণ হওয়া খুব সহজ নয়। সাংবাদিক হিসেবে আমি সেই পদ অলংকৃত করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু পরিবারকে অসহায় অবস্থার মধ্যে ফেলে যদি কারাগারে কাটাতে হয়, কারাগার থেকে বের হয়ে যদি দেখতে পাও, তুমি যে চাকুরিটি করতে তা আর নেই, কী করবে তুমি?” তাঁর কথাই হয়তো সত্যি। তবুও আমার মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে আমার সেই মুগ্ধতা তাঁর প্রতি ভক্তিতে পরিণত হয়। প্রথম সাক্ষাতের পর কালেভদ্রে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু যখনই হতো, তখন আন্তরিকতার সাথে কুশল জানতে চাইতেন। শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক হিসেবে তিনি অবসর নেন। আসলে যে অবস্থায় তাঁকে ওই ক্ষুদ্র চাকুরিটি গ্রহণ করতে হয়েছিল সেটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ন্যাক্কারজনক অধ্যায় হয়ে আছে। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাতিল করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। সব দল নিষিদ্ধ করে “বাকশাল” নামে এক দল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সকল সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা হয়েছিল। অন্যান্য সকল পত্রপত্রিকার মতো সেই বিলুপ্তির শিকার হয়েছিল স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকার বিরোধী একমাত্র সংবাদপত্র দৈনিক গণকন্ঠ; যে পত্রিকাটির সম্পাদনা করতেন আল মাহমুদ। বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্রের শতশত সাংবাদিক-কর্মচারি বেকার হয়ে পড়েন। বেকার সাংবাদিকদের আন্দোলনের মুখে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার বিভিন্ন সরকারি, বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কর্পোরেশনে বেশ কিছু সাংবাদিকের চাকুরির ব্যবস্থা করে। আল মাহমুদকে দেয়া হয় শিল্পকলা একাডেমীর সহকারী পরিচালকের একটি পদ। একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক সরকারি চাকুরি কাঠামোর একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে নিয়োগ পান। কোনো উপায় ছিল না তাঁর। অনেকগুলো সন্তানসহ একটি বড় পরিবার কিভাবে সামাল দেবেন?

জহিরুলঃ তো আল মাহমুদের সাথে আপনার যোগাযোগটা কখন ঘটে?

মঞ্জুঃ কবি আল মাহমুদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ও সাক্ষাৎ ঘটতে থাকে ১৯৮৭ সালে আমার সম্পাদনায় মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেষ্ট প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে। এর এক দশক আগে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ডাইজেস্টের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তার ছোটগল্প “তৃষিত জলধি”। এরপর ঢাকা ডাইজেষ্টে তাঁর কবিতা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী এবং একটি উপন্যাস “উপমহাদেশ” প্রকাশিত হয়েছে। আল মাহমুদের কাছ থেকে লেখা আদায় করা কঠিন কাজ ছিল। এ নিয়ে অনেক সময় তাঁর ওপর রাগও করেছি। কিন্তু তিনি কখনো রাগ করতেন না। তাঁর মুখের হাসি কখনো অমলিন হয়ে যেতো না। তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায়ের অভিজ্ঞতার ওপর আমি ফেসবুকে একটি ষ্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। তাতে আমি যা উল্লেখ করেছি, আমার এ সাক্ষাৎকার যারা পড়বেন তাদের জন্য তা এখানে উপস্থাপন করছি:

“আল মাহমুদ এর কাছ থেকে লেখা আদায় করা সাধনার মতই ছিল। তাঁর লেখা হাতে পাওয়া মানে সেই সাধনায় সিদ্ধি লাভ। মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতনের মত অবস্থা। এই সিদ্ধি লাভ করতে গিয়ে মাসুমুর রহমান খলিলি, বুলবুল সরওয়ার সহ নতুন ঢাকা ডাইজেষ্টের একাধিক কর্মীর কলকে ফাটার উপক্রম হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ডাইজেস্ট এর অনেক সংখ্যা তাঁর লেখায় সমৃদ্ধ হয়েই প্রকাশিত হয়েছে। ডাইজেষ্টে তিনি তাঁর সব ধরনের লেখা দিয়েছেন। কবিতা, ছোটগল্প, তাঁর ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা এবং উপন্যাস। চার-পাঁচজন সাংবাদিক মিলে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকারও নিয়েছি ঢাকা ডাইজেষ্টের জন্য। সেই সাক্ষাৎকার দিয়ে তাঁর ওপর কভার ষ্টোরি করেছি। আল মাহমুদ যখন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ-ভিত্তিক উপন্যাস ‘উপমহাদেশ’ ধারাবাহিকভাবে নতুন ঢাকা ডাইজেষ্টে লেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন আমরা ডাইজেস্ট পরিবারের সদস্যরা উচ্ছসিত হয়েছিলাম। তাঁর হাতে এডভান্সও গুঁজে দিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম কয়েক সংখ্যার জন্য নিয়মিতই লিখলেন। এরপর তাঁর বাসায় গিয়ে ধর্ণা দিতে হয়। বাসা থেকে ধরে অফিসে এনে আটকে রাখতে হয়। খাওয়ার ব্যবস্থা করি, তাঁর জন্য সিগারেট কিনে আনি। কিন্তু এক বসায় তিনি লেখা শেষ করেন না। কখনো অর্ধেক পৃষ্ঠা লিখেন, লোকজন এলে আড্ডায় মেতে ওঠেন। হঠাৎ উঠে বলেন, ‘আজ ছেড়ে দাও, কাল সকালে লেখা শেষ করে তোমাকে দিয়ে যাব।’ অনেক সময় বলেন, ‘এখন আমার সাথে দোকানে চলো। তোমার ভাবী কী কী বলে দিয়েছে, কিনতে হবে।’ তাঁর সাথে দোকানে যাই, তিনি চাল, ডাল, তেল, আরও টুকটাক জিনিস নেন। দাম চুকিয়ে জিনিসগুলো রিকশায় তুলে রিকশাওয়ালার হাতে ভাড়াও দিয়ে দেই। আল মাহমুদের জন্য এসব করতে ভালই লাগত। কিন্তু লেখা যথাসময়ে না দেয়ার বিরক্তিও ঝাড়তাম তার ওপর। ‘উপমহাদেশ’ যখন একেবারেই শেষদিকে; হয়ত আর আট-দশ সংখ্যায় ছাপা হলেই শেষ হবে, তখন তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করা ক্রমেই কঠিন হতে লাগল। তিনি বলেন, ‘আজ আর কাউকে আসতে হবে না। শরীফকে (তাঁর বড় ছেলে) দিয়ে লেখা পাঠিয়ে দেব; ইত্যাদি প্রতিশ্রুতির পর এক সংখ্যায় তিনি লেখা দিতে পারলেন না। বললেন, ‘এ সংখ্যায় বাদ দাও, নানা ঝামেলার মধ্যে আছি। পরে বলব।’ মেজাজ খারাপ করলাম। লাভ কী! ডাইজেষ্ট ছাপায় বিলম্ব হলো। এজেন্টদের অভিযোগ। ততদিনে ‘উপমহাদেশ’ পড়তে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন পাঠকরা। তারা পরবর্তী সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করতেন। ঢাকা সিটির বহু পাঠক সরাসরি অফিসে এসে জানতে চাইতেন, এ সংখ্যায় ‘উপমহাদেশ’ নেই কেন? মফ:স্বলের পাঠকরা চিঠি লিখে তাদের উষ্মা ও বিরক্তি প্রকাশ করতেন। আল মাহমুদকে তাঁর ভক্তদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানাই। তিনি বলেন, ‘এমন আর হবে না’। যদিও তিনি হেসে হেসে বলেন, কিন্তু প্রতিবার লেখা আদায় করার প্রচেষ্টা প্রাণান্তকর। যখনই তিনি তাঁর প্রয়োজনের কথা বলেন, তা পূরণ করতে কার্পণ্য করি না। তিনি কখনও দাবী করেন না। বিনয়ের সাথে বলেন। ‘উপমহাদেশ’ যখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে। হয়ত আর চার-পাঁচ সংখ্যায় শেষ হয়ে যাবে, তখন তিনি লেখা দিতে অনিয়মিত হয়ে গেলেন। পাঠকদের অভিযোগের কী জবাব দেই, কিভাবে তাদের শান্ত করি? একদিন ফোন করলাম আল মাহমুদকে। কঠোরভাবেই বললাম, ‘নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট’ এ খ্যাতিমান কারও লেখা ছাপি না। কারণ কাউকে তেল দেয়ার সময় ও সাধ্য আমাদের নেই। আপনার লেখা ছাড়াই দেশের সব সেরা পত্রপত্রিকা চলে। আমাদের ক্ষুদ্র মাসিকটিও চলবে। মাঝখান থেকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন। আমি আর আপনার কাছে চেয়ে লেখা চেয়ে নেব না।’ পর পর দুই সংখ্যায় ‘উপমহাদেশ’ ছাপা হলো না। কেউ অভিযোগ করলে বলি, ‘কবির কাছেই জিজ্ঞাসা করুন।’ তার টেলিফোন নম্বর দিয়ে দেই। এ পরিস্থিতির মধ্যে একদিন ফোন করলেন তখনকার সচিব শাহ আবদুল হান্নান। সম্ভবত তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশনের সচিব ছিলেন। তিনি জানান ‘উপমহাদেশ’ তিনি নিয়মিত পড়েন। ডাইজেষ্টে লেখা না পেয়ে আল মাহমুদকে ফোন করেছেন। আল মাহমুদ তাঁকে বলেছেন, ‘মঞ্জু আমার উপর রাগ করেছে।’ সেজন্য শাহ হান্নান আমাকে ফোন করেছেন। তিনি বললেন, ‘কবিদের এটুকু মানতে হবে। উনার সাথে আমার কথা হয়েছে। লেখা দিতে আর বিলম্ব করবেন না। একটা ভাল কাজ হচ্ছে। শেষ করো। উনার উপর রাগ করো না। বিরাট সংসার তাঁর। সংসার চালাতে তাঁকে হিসসিম খেতে হয়। এরপরও যে লিখেন, সেটাই তো দেশের মানুষের জন্য অনেক। তাকে যদি আরও কিছু টাকা দিতে হয়, আমার কাছ থেকে নিয়ে উনাকে দিয়ো। আমি সরাসরি দিলে তাঁর ইগোতে লাগতে পারে।’ তাঁকে জানাই, টাকা কোনো সমস্যা নয়। তাঁর জন্য কিছু করতে পারলেই তৃপ্তি বোধ করি। শাহ হান্নানের কথায় আবার আল মাহমুদের কাছে ধর্ণা দেই। অফিসে ধরে আনি। বাসায় কাউকে বসিয়ে রাখি। এভাবে শেষ হয় তাঁর ‘উপমহাদেশ’।”

জহিরুলঃ আমারও অভিজ্ঞতা হচ্ছে তাঁর কাছ থেকে লেখা আদায় করা বেশ কঠিন। প্রথম লেখাটি তাঁর কাছ থেকে কিভাবে আদায় করেন?

মঞ্জুঃ আপনাকে ধন্যবাদ । সেই কথাটিই এখন বলবো। এখানে নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের উদ্বোধনী সংখ্যায় আল মাহমুদের প্রথম লেখা আদায় করার কাহিনি বলার ইচ্ছা আমি দমন করতে পারছি না। ডাইজেস্টের শুরু থেকে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে প্রকাশনা বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ চৌদ্দ বছর শিল্পী ফরিদী নুমান ম্যাগাজিনের অলঙ্করণ ও অঙ্গসজ্জার কাজে যুক্ত ছিলেন। তিনি কিছুদিন আগে সেই কাহিনি উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত চমকপ্রদ। আমি ফরিদী নুমানের জবানীতেই তা উপস্থাপন করছি:

“একটি গল্প, একজন কবি, একটি ইতিহাস এবং একটি আলোকচিত্র…

১৯৮৭ সাল। কাঁঠালবাগান ঢালের উপরের ডানপাশের বাড়িটিতে আমাদের আবাসিক অফিস। এখানে প্রায়ই আড্ডা হতো বাংলাদেশের নবীন-প্রবীন কবি-শিল্পী-সাহিত্যের মানুষদের। কবি আল মাহমুদ সেখানে নিয়মিত মধ্যমণি। পাশেই কবি আবিদ আজাদের প্রকাশনা সংস্থা শিল্পতরু। পাশাপাশি হওয়ায় ম্যারাথন আড্ডাও হত। অর্থাৎ কবি আবিদ আজাদের ওখানে আড্ডা শেষ করে আমাদের অফিসে, কিংবা আমাদের অফিসে শেষ করে শিল্পতরুতে। আমাদের অফিস বলতে নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের অফিস।

যে সময়ের কথা বলছি, পত্রিকাটি তখনো বের হয়নি। সম্পাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু ভাইয়ের ইচ্ছে প্রতিসংখ্যায় ‘এ সংখ্যার বই’ নামে একটি বিভাগ থাকবে। প্রথম সংখ্যায় আল মাহমুদ একটা বড়গল্প দিতে রাজী হলেন যেটা ঐ বিভাগে ছাপা হবে। লেখা আদায়ের দায়িত্ব নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী ভাইয়ের। কবি আমাদের আড্ডায় নিয়মিত আসেন। খলিলী ভাই গল্পের কথা জিজ্ঞেস করলেই বলেন, ‘আরে তোমার গল্প প্রায় শেষ। এই তো দিচ্ছি…. কাল না হয় পরশু…. পেয়ে যাবে।’ খলিলী ভাই কবির বাসা কিংবা শিল্পকলায় তাঁর অফিস, শিল্পতরু কিংবা আমাদের আড্ডা, যেখানে পান সেখানেই কবিকে লেখাটা দেয়ার জন্য তাগাদা দেন। গল্পের জন্য ঘুরে দু’একজোড়া স্যান্ডেলও মনে হয় শেষ করে ফেলেছেন। কবি স্বভাবসুলভ উত্তর দেন, আরে পেয়ে যাবে। এদিকে পত্রিকা বাজারে দেয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। সব রেডি… কিন্তু আল মাহমুদের গল্পের খবর নাই।

শেষমেষ লেখা আদায়ের জন্য খলিলী ভাই একটা কৌশল বের করলেন। কবিকে পটিয়ে পটিয়ে একদিন আমাদের অফিসে আনা হলো। কবিকে বলা হলো আজ সারাদিন আপনি আমাদের মেহমান। তাঁর কাপড় বদল করে লুঙ্গি পরিয়ে দেয়া হলো। কবির পছন্দের খিচুড়ী আর মাগুর মাছ রান্নার আয়োজন হলো। কবির প্রিয় শলাকা গোল্ডলীফ সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে আমার রুমটি ছেড়ে দেয়া হলো। কাগজ কলম দেয়া হলো। শর্ত একটাই গল্প না লিখে রুম থেকে বেরোনো যাবে না। এরপর বাইরে থেকে রুম বন্ধ করে দেয়া হলো। আমি আর শফিউল আলম রতন থাকলাম কবির পাহারায়। যদি তাঁর কোনো কিছুর প্রয়োজন হয় সেজন্য। কবি প্রথমে গাঁই-গুই করলেও শেষমেষ লিখতে বসলেন। আমার পুরনো কাঠের টেবিলে বসেই কবি লিখে চললেন…. সমুদ্রে হিজবুল বাহার জাহাজে দূরদর্শী প্রেসিডেন্টকে নিয়ে অসাধারণ এক গল্প। গল্পটি আসলে গল্প নয় ইতিহাসকে আরাধ্য করে লেখা ঐতিহাসিক সাক্ষ্য। গল্পের নাম ‘তৃষিত জলধি’। আল মাহমুদের জীবনে এক বসায় এরকম গল্প বা উপন্যাস লেখার কোনো ঘটনা আছে কিনা আমি জানিনা। আর লেখা আদায় করতে কোনো কবিবে এরকম ‘হাউস এ্যারেস্ট’ হতে হয়েছে কিনা তা-ও জানি না।

সেই ঐতিহাসিক গল্পটি লেখার সময় ছবিটি আমি তুলে রেখেছিলাম।”

আল মাহমুদকে ডাইজেস্টে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পেয়েছিলাম। ডাইজেস্ট তাঁর লেখায় সমৃদ্ধ হয়েছে এবং ওই সময়গুলো তাঁর জন্যও অত্যন্ত উৎপাদনশীল সময় গেছে বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য আমরা গর্বিত। আল মাহমুদ একজন কবি হিসেবে সবসময় মানুষের মাঝে থাকবেন। তিনি শেষ হয়ে যাবেন না। তিনি বলেছেন, “যেদিন আমি কবরে প্রবেশ করলাম, সেইদিন থেকে শুরু হলো আমার আরেক জগৎ; আমি শেষ হয়ে যাব না।”

এ সম্পর্কে কবি মির্জা গালিবের কবিতাংশ উদ্ধৃত করছি:

“ইয়া রব, জমানা মুঝকো মিটাতা হ্যায় কিস লিয়ে

লোহ-এ জাহান পে হরফে মুকাররার নাহি হুঁ ম্যায়:”

(হে খোদা, পৃথিবী কেন আমাকে মুছে ফেলতে চায়?

আমি এমন এক অক্ষর, যা জীবনের শ্লেটে মুছে ফেলা যায় না)।

জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্টে লিখে লেখক হয়ে উঠেছেন এমন কিছু লেখকের কথা বলুন।

মঞ্জুঃ এই সংখ্যা অনেক। ঢাকা ডাইজেস্টে প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে পরিচিত লেখকে পরিণত হয়েছেন, তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আবু রুশদ, পরবর্তী সময়ে যিনি বাংলাদেশে সামরিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কৌশলের ওপর লেখার ক্ষেত্রে বলা যায় বিরাট পরিবর্তন এনেছিলেন। যে সময়ে সামরিক বিষয়ে লেখা স্পর্শকাতর বিবেচনা করে কেউ হাত দিতে চাইতো না, তিনি সেই অচলায়তন ভাঙেন। ঢাকা ডাইজেস্টে তাঁর প্রকাশিত ধারাবাহিক লেখাগুলো দিয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এর বাইরেও তিনি বেশ ক’টি বই লিখেছেন। পরবর্তীতে তিনি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নেন। বর্তমানে “ডিফেন্স জার্নাল” নামে আন্তর্জাতিক মানের একটি সাময়িকী প্রকাশ করছেন। রাজশাহীর বিশিষ্ট সাংবাদিক সরদার আবদুর রহমান ইতিহাসের ওপর লিখতেন। নাজমুল আলম সিজার বাংলাদেশে প্রচলিত ধরনের সায়েন্স ফিকশনের চেয়ে ব্যতিক্রমী সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন ঢাকা ডাইজেস্টে। তাঁরও প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছে ডাইজেস্টে এবং ধারাবাহিক লেখাগুলো পাঠকপ্রিয় ছিল। তিনিও ভালো লেখক হয়ে ওঠেন। মাসরুর আরেফিন ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ডাইজেস্টে নিয়মিত লিখতেন। তিনিও এখন জনপ্রিয় লেখক, সাদাত হুসাইন নামে একজন প্রবীণ লেখক আছেন, যার কয়েকটি বই আগে প্রকাশিত হলেও তিনি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঢাকা ডাইজেস্টে তাঁকে লিখতে অনুপ্রাণিত করার পর তিনি নিয়মিত লিখতেন এবং এভাবে তিনি আবার বই লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। আমলাদের মধ্যে সাবেক সচিব ড. মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব, মরহুম সচিব জাফর আহমেদ চৌধুরী, মরহুম সচিব মাহবুবুর রহমান (মাহবুব মোর্শেদ নামে লিখতেন), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. আবদুল লতিফ মাসুম, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মাহবুবুর রহমান, প্রবীণ সাংবাদিক মীযানুল করীম প্রমুখ বিচ্ছিন্নভাবে লেখালেখি করলেও তাদেরকে নিয়মিত লেখক হিসেবে গড়ে তুলতে ঢাকা ডাইজেস্টের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। আমি উল্লেখযোগ্য কিছু লেখকের নাম উল্লেখ করলাম, যাদের কথা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। এর বাইরেও ঢাকা ডাইজেস্টে লিখেই লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন এমন অনেকেই আছেন, যাদের কথা স্মরণ করতে পারছি না।

জহিরুলঃ আজ আমরা যাদের খ্যাতিমান লেখক বলে জানি এমন কিছু লেখকের কথা বলুন যারা ঢাকা ডাইজেস্টে নিয়মিত লিখতেন।

মঞ্জুঃ সৈয়দ আলী আহসান, কবি আল মাহমুদ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আফজাল চৌধুরী, খোন্দকার আলী আশরাফ, আবুল আসাদ, রাবেয়া খাতুন, আল মুজাহিদী, রণজিৎ কুমার বিশ্বাস, মাফরুহা চৌধুরী, আহমদ ইমরান (ভারতীয় পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য), সালাহউদ্দিন বাবর, রেজাউদ্দিন স্টালিন, রবীন্দ্র গোপ, হাসান হাফিজ, সোহরাব হাসান, হালিম আজাদ, আহমেদ ফারুক হাসান, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মাসরুর আরেফিন, মতিউর রহমান মল্লিক, মুজতাহিদ ফারুকী, শাকিল রিয়াজ, ওয়ারেসুল হক, কাওসার আহমেদ। পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখক সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ, আবুল বাশার ও সাংবাদিক পরিতোষ পাল, আসামের সাংবাদিক নব ঠাকুরিয়া।

জহিরুলঃ এমন জনপ্রিয় এবং শিক্ষনীয় উপাদানে সমৃদ্ধ একটি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল কেন? আবার শুরু করার ইচ্ছে আছে কি?

মঞ্জুঃ একাধিক কারণে বন্ধ হয়েছে। প্রথমত: ১৯৯১ সালের বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংবাদপত্রের প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে। বিশেষ করে ডিক্লারেশন পাওয়ার বিষয়টি অনেক সহজ করে দেয়। আমি নতুন ঢাকা ডাইজেস্ট-এর ডিক্লারেশন নেয়ার ক্ষেত্রে যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলেছি, এসব নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো তুলে দেয়া হয়। ডিএফপি থেকে পত্রিকার নামের ক্লিয়ারেন্স নিয়ে জেলা প্রশাসকের দফতরে গিয়ে দরখাস্ত করলেই মোটামুটি ডিক্লারেশন পাওয়া যেত। এর ফলে ঢাকা থেকেই প্রায় একযোগে অনেকগুলো দৈনিক সংবাদপত্র বের হয়। এগুলোর মধ্যে বাংলাবাজার পত্রিকা, ভোরের কাগজ, আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ, আসে প্রথম পর্যায়ে, দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে ডেইলি স্টার, ডেইলি ইণ্ডিপেন্ডেন্ট, প্রথম আলোসহ আরো কয়েকটি দৈনিক। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি দৈনিক প্রতি সপ্তাহে ২/৩টা করে ফ্রি ম্যাগাজিন দিতে শুরু করে। শুধু ঢাকা ডাইজেষ্ট নয়, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর সাকুর্লেশনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। ঢাকা ডাইজেস্ট বিক্রয় নির্ভর ম্যাগাজিন ছিল। আয়ের আশি শতাংশই আসতো বিক্রয় থেকে।

দ্বিতীয় আরেকটি কারণে ঢাকা ডাইজেস্টের সার্কুলেশনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছিল। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী, যে নির্বাচন সকল বিরোধী দল বর্জন করে এবং বিএনপি এ-নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৭৮ আসন পায়। ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ২১ শতাংশ। এটি স্বল্পমেয়াদী একটি সংসদ ছিল। মাত্র ১২ দিন স্থায়ী ছিল এই সংসদ। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থার বিধান সম্বলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস করার মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের অবসান ঘটে। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার পদত্যাগ করার পর কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধান বিচারপতি হাবিুবর রহমান এবং তাঁর অধীনে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন লাভ করে, বিএনপি পায় ১১৬টি আসন, জাতীয় পার্টি জয়ী হয় ৩২টি আসনে এবং জামায়াতে ইসলামী মাত্র তিনটি আসন লাভ করে। বলা যায় জামায়াতে ইসলামীর ভরাডুবি ঘটে এ নির্বাচনে। এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১০টি এবং ১৯৯১ সালে পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। আপনার আরো একটি বিষয় জানা থাকার কথা যে জামায়াতে ইসলামী ১৯৮১ সাল থেকেই কেয়ারটেকার সরকার চালুর দাবীতে আন্দোলন করে আসছিল এবং দশ বছর পর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ ছোট বামপন্থী দলগুলো একযোগে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে মাঠে নামে এবং এ দাবী আদায় হয় সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে। জামায়াত এটিকে তাদের রাজনৈতিক বিজয় বলে বিবেচনা করতো। অতএব কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন, অর্থ্যাৎ সপ্তম সংসদ নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রাথী দেয়। জয়ী হয় মাত্র ৩টি আসনে। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় ৪৯টি আসনে জামায়াত যদি প্রাথী না দিয়ে বিএনপির প্রার্থীকে সমর্থন করতো তাহলে ওই আসনগুলোতে বিএনপি প্রাথী জয়ী হতে পারতো। অথবা বিএনপি ও জামায়াত নির্বাচনী জোট করে ওই আসনগুলোতে একক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতো, তাহলে বিএনপি বা বিএনপি-জামায়াত জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতো। ঢাকা ডাইজেস্ট সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে থেকেই নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি ও সম্ভাব্য ফলাফলের ওপর বিশ্লেষণ ও বিভিন্ন জরিপ প্রকাশ করে আসছিল এবং প্রতিটিতে নির্বাচনে জামায়াত যে ভালো করবে না, সেই পূর্বাভাস ছিল। এতে জামায়াত ক্ষুব্ধ হয়। নির্বাচনের পর আমার এক নিবন্ধে জামায়াতের কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন, ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয়া, অন্তত ৫০টি আসনে নিশ্চিত বিজয়ের আশা করা নিয়ে অতি তীর্ষক ভাষায় সমালোচনা করি। জুলাই ১৯৯৬ সংখ্যায় লেখাটি ঢাকা ডাইজেস্টে প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াত মহলে আমি ‘পারসন নন গ্রাটা’ হয়ে পড়ি। কিছু হুমকি-ধামকিও আসে। জামায়াত আনঅফিসিয়ালি তাদের নেতাকর্মীদের ঢাকা ডাইজেস্ট না পড়ার নির্দেশ দেয়। ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনাসহ জামায়াতের নিয়ন্ত্রণাধীন কিছু প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সার্কুলেশন কিছুটা কমে যায়। আয়ে ঘাটতি পড়ে। কিন্তু পরবর্তী কয়েক সংখ্যায় আমি একই ভাষায় জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করে আমার লেখা অব্যাহত রাখি। বিশেষ করে গোটা পৃথিবীতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে বা অন্তবর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনাকে বৈধ ভাবা হলেও বাংলাদেশে নির্বোচন পরিচালনা করতে জামায়াতের কেন কেয়ারটেকার সরকার লাগবে, এ নিয়ে আমার লেখায় জামায়াত নেতৃবৃন্দের দৈন্যতা তুলে ধরে তাদের তুলোধুনা করি। ফলে চার মাস পর ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে দৈনিক সংগ্রাম থেকে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়। আমি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় যোগ দেই। ঢাকা ডাইজেস্টের সার্কুলেশন এবং বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তাতেও সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু নিউজপ্রিন্টের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। ১৯৮৭ সালে ডাইজেস্ট শুরু করার সময় এক টন নিউজপ্রিন্টের দাম ছিল ১৮ হাজার টাকা, ১৯৯৮ সালে তা ৩১ হাজারে উঠে। আমরা ডাইজেস্টের দাম রেখেছিলাম দশ টাকা, তা কখনো বৃদ্ধি করিনি। ফলে ঘাটতি পোষানো যাচ্ছিল না। দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর ফ্রি ম্যাগাজিনের পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা বিস্তৃত হওয়ায়, আমরা সার্কুলেশন বৃদ্ধির চেষ্টা করে কোনোভাবেই সার্কুলেশন বৃদ্ধি করতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা ডাইজেস্ট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই। দুই বছর বন্ধ থাকার পর একটি বাণিজ্যিক গ্রুপ ঢাকা ডাইজেস্ট পুন:প্রকাশের জন্য তহবিল যোগান দিতে এগিয়ে আসে। তারা আমাকে অফিস দেয়, দু’জন সাংবাদিকসহ ৬ জন কর্মীর বেতন দিতে সম্মত হয়। নতুন উৎসাহে আমরা আবার কাজ শুরু করি এবং আগের চেয়েও মানসম্পন্ন ডাইজেস্ট প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাণিজ্যিক গ্রুপটি বিএনপি সরকারের রোষানলে পড়ে এবং তাদের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। এ পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে ঢাকা ডাইজেস্টকে আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। ২০০৬ সালের জুলাই সংখ্যার পর ঢাকা ডাইজেস্টের প্রকাশনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হই। ২০১৩ সাল থেকে ঢাকা ডাইজেস্ট অনলাইন-এ চালানোর উদ্যোগ নেই। দুই বছর পর্যন্ত নিয়মিত আপলোড করেছি। এরপর আর সম্ভব হয়নি। তবে এখনো পরিকল্পনা রয়েছে অনলাইনে এই জনপ্রিয় ম্যাগাজিনকে নিয়মিত করার।

জহিরুলঃ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ আছে তারা অচেনা লেখকদের লেখা ছাপেন না। এই বদনামের দায় ঢাকা ডাইজেস্টের সম্পাদককে কি দেয়া যাবে?

মঞ্জুঃ এ অভিযোগ আমার নিজেরও আছে। শুধু অচেনা নয়, পরিচিত ও খাতিরের লোকজনের লেখা ছাড়া স্বল্প পরিচিত ও ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দের লেখকদের লেখাও তারা ছাপেন না। এটি একটি কোটারির মতো হয়ে গেছে। এছাড়া সংবাদপত্রগুলোর দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতেও কবি ও লেখকদের সম্পৃক্ত করে ফেলার প্রবণতাও দেখা যায় দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সম্পাদকদের মধ্যে। কোনো সংবাদপত্রে যদি কোন একজন লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়, তাহলে অন্য আরেকটি সংবাদপত্র তার লেখা ছাপে না। খ্যাতিমান কয়েকজন লেখকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ লেখকরা সাহিত্য সম্পাদকদের সুনজরে আসেন না। ঢাকা ডাইজেস্টে আমরা অচেনা লেখকদের লেখাই বেশি প্রকাশ করেছি। মফস্বল থেকে পাঠানো কবি, লেখক যদি মোটামুটি মানের লেখাও পাঠাতেন তাহলে আমরা কিছু সংশোধন ও পরিমার্জন করে প্রকাশ করতাম, যা ডাইজেস্টের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেক অবদান রেখেছে। শুধু তাই নয়, যার লেখাই ডাইজেস্টে প্রকাশিত হতো, মাসের শুরুতে প্রত্যেকের সম্মানী গুনে গুনে খামে ভরে রাখতাম। এমন বহু লেখক আছেন, যারা ঢাকা ডাইজেস্ট থেকে তাদের প্রকাশিত লেখার জন্য প্রথম সম্মানী পেয়েছেন। আমি মফস্বলের এক কবির কথা বলতে চাই। ডাকে কবিতা পাঠাতেন এবং আমি নিয়মিত তাঁর কবিতা ছাপতাম। তাঁর নাম আবদুল হালিম খাঁ। ঠিকানা হিসেবে লিখতেন টাঙ্গাইলের ভূয়াঁপুরের এক প্রাইমারী স্কুলের নাম। একদিন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পড়া মলিন চেহারার মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক ডাইজেস্ট অফিসে এলেন। বসার পর পরিচয় জানতে চাইলে বললেন, তিনি আবদুল হালিম খাঁ। ভূয়াঁপুরের এক প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। আসলে আমি তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম, ঢাকায় এলে যাতে দেখা করেন। তিনি এতো ভদ্র যে চোখ তুলেও তাকান না। চা-বিস্কুট খাওয়ানোর পর একটি খামে তাঁর জমা সম্মানী তুলে দিলে তিনি প্রায় কেঁদেই ফেললেন। বললেন যে, ঢাকার কোনো পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হবে তা তিনি কখনো কল্পনাও করেননি। ঢাকা ডাইজেস্ট তাঁর কবিতা ছাপানোর কারণে এলাকায় তার সম্মান আরো বেড়েছে। কিছুতেই তিনি সম্মানী নেবেন না। বেশ জোর করেই তাঁর পকেটে সম্মানীর অর্থ তুলে দিয়েছিলাম।

জহিরুলঃ বাংলাদেশের নারীবাদ আন্দোলনকে আপনি একজন সাংবাদিক হিসেবে কতটা আগ্রহ নিয়ে কাভার করেছেন। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন? হুমায়ূন আজাদ বা তসলিমা নাসরিনের নারীবাদকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মঞ্জুঃ আপনার কাছে আমার পাল্টা প্রশ্ন হচ্ছে যে, বাংলাদেশে কী আদৌ কোনো নারীবাদী আন্দোলন আছে? গত ত্রিশ বছর যাবত বাংলাদেশের সরকার ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে নারী নেতৃত্ব। এই ত্রিশ বছরের মধ্যে কোনো পুরুষ প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার পরিচালনা করেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব করেছেন নারী। বিরোধী দলেও ছিলেন নারী। জাতীয় সংসদের স্পীকারও বর্তমানে নারী। ওইসব পর্যায় থেকে যখন বলা হয় বাংলাদেশে নারীরা কতো স্বাধীন এবং সর্বত্র তাদের অধিকার এবং নারী সংগঠনগুলো যখন তাদের কথা মেনে নেয় তখন নারীবাদী আন্দোলনের আর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো বাংলাদেশে নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। নারীর ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে হয়নি। যদিও সরকারি চাকুরিতে, বিশেষ করে সিভিল সার্ভিস ও শিক্ষকতায় নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের সংখ্যার কাছাকাছি এবং ফলাফলও ভালো করছে, কিন্ত সামগ্রিক বিশ্লেষণে দেখা যাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন রাখা হয়েছিল ১৫টি, যা ১৫ বছর বহাল থাকবে বলে বলা হয়েছিল। সংবিধান প্রণেতারা আশা করেছিলেন যে, ১৫ বছরের মধ্যে নারীরা যথেষ্ট এগিয়ে আসবেন এবং তাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন পড়বে না। এরপর তারা পুরুষদের মতোই সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদে আসবেন জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে। কিন্তু তা হয়নি। ১৯৯০ সালে সংবিধানের দশম সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসনের ১০ বছরের মেয়াদ শুধু বৃদ্ধি করা নয়, সংরক্ষিত নারী আসন ১৫টি থেকে ৩০ এ উন্নীত করা হয়, ২০০৪ সালের সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসন ৩০ থেকে ৪৫ এ বৃদ্ধি করা হয় এবং ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত করা হয়। বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার যা যা স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তা পূরণ হয়েছে বা হচ্ছে, কিন্তু সংসদকে সংরক্ষিত নারী আসন মুক্ত করার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সংরক্ষিত সুবিধা মানুষকে এবং ব্যাপক অর্থে সমাজকে কলুষিত ও দুর্নীতিগ্রস্থ করে। রাজনীতি সচেতন সকলের মনে থাকার কথা যে, সংসদের সংরক্ষিত ৩০টি আসনে মনোনীত হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতায় সংশ্লিষ্ট নারীরা প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে তুষ্ট করতে কী কী করেছেন। এর ওপর লিখে প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার এড়াতে দেশ ছেড়ে গোপনে পালাতে হয়েছিল এবং তাঁর সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন যায় যায় দিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন হয়তো এরশাদ নেই, কিন্তু সংরক্ষণ ব্যবস্থা থাকলে সংসদ সদস্য হওয়ার মতো লাভজনক পদে মনোনয়ন লাভের জন্য উমেদারদের একটি অংশ যে দুর্নীতির আশ্রয় নেবেন তাতে সন্দেহ নেই। নারীর ক্ষমতায়ন সঠিকভাবে হলে এই সংকট সৃষ্টি হতো না। এসব সত্বেও আমি বলবো যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সাধারণভাবে নারীরা যেভাবে শোষিত ও বঞ্চিত, তার তুলনায় বাংলাদেশে নারীদের অবস্থান ভালো। কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, যৌন শিকারে পরিণত করা, সামাজিকভাবে দমিয়ে রাখার প্রবণতা বাংলাদেশেও বিদ্যমান, যা দূর করতে নারী সংগঠনগুলোর আরো সক্রিয় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।

আমার সাংবাদিকতার ক্ষেত্র কখনোই নারীবাদ ছিল না। আমি মূলত রাজনীতি, অর্থনীতি ও জাতীয় সংসদ কভার করতাম। এসব ক্ষেত্রে নারী প্রতিনিধিদের কোনো ভূমিকা থাকলে সেগুলোকে প্রাপ্য কভারেজের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিতাম এই বোধ থেকে যে, পনের জনের মধ্যে তো মাত্র একজন নারী কথা বলেছেন, অতএব তিনি অনেক পুরুষ প্রতিনিধির চেয়ে অনেক বেশি কভারেজ পাওয়ার অধিকারী। তসলিমা নাসরিন ও হুমায়ুন আজাদের যে নারীবাদী বক্তব্য তা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর হীন অবস্থান এবং বিভিন্ন ধর্মের বিধিবিধানে নারীকে সীমিত গণ্ডিতে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তসলিমা নাসরিন এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের ওপর তার বিষোদগার করেছেন এবং বিদ্বেষপ্রসূত কথা বলেছেন। তিনি নারীর সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে কোরআন-হাদিস সংশোধন, বোরকা পুড়িয়ে ফেলার আহবান জানিয়েছেন। তিনি মুসলিম দেশগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার জন্য একমাত্র পথ হিসেবে ইসলামের কঠোর সমালোচনায় অবতীর্ণ হতে বলেছেন। পক্ষান্তবে হুমায়ুন আজাদ একাডেমিক আলোচনা করেছেন। নারীবাদী বলতে তিনি সোজাসাপ্টা বলেছেন: “যিনি নারী-পুরুষের সাম্যে ও সমান অধিকারে বিশ্বাস রাখেন তিনিই নারীবাদী। নারীকে মনে রাখতে হবে, সে মানুষ, নারী নয়। নারী তার লৈঙ্গিক পরিচয় মাত্র। ক্রোমোজমের পার্থক্যের কারণে একজন প্রভু আরেকজন পরিচারিকা হতে পারে না,” ইত্যাদি। উভয়েই নারীর সাথে বৈষম্যের বিষয় আলোচনা করতে প্রধানত প্রাচ্যের দিকে, বিশেষত ইসলামের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। কিন্তু ইতিহাস বলে যে, পাশ্চাত্যে নারীরা প্রাচ্য দেশগুলোর চেয়ে আদৌ কম নিগৃহীত ছিল না। মধ্যযুগীয় ইউরোপে নারীর শিক্ষালাভ ও সরকারি দায়িত্বে অংশগ্রহণ করার অধিকার ছিল না। তাদের কাজকর্ম গণ্ডিবদ্ধ ছিল ঘরে। তাদেরও মাথা আবৃত করে রাখতে হতো, স্বামীরা স্ত্রীকে বিক্রয় করে দেয়ার অধিকার রাখতো, ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদের ভোটের অধিকার ছিল না। এমনকি স্বামীর অনমুতি ছাড়া সন্তানের ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না। পাশ্চাত্যকে “সম-বেতন আইন” করতে হয়েছে ১৯৬৩ সালে। একথা সত্য যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীর অর্থনৈতিক, শারীরিক, সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করে রাখে, ফলে তাদের মানসিক বিকাশের পথ অবরুদ্ধ থাকে। তসলিমা নাসরিন যেসব গ্রন্থ রচনা করেছেন সেগুলোতে নারীকে তুলে ধরতে গিয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও উত্তাপ সৃষ্টি করেছেন, যা কোনো বিচক্ষণ মানুষের কাজ হতে পারে না। তাঁর ভূমিকা তার প্রতিপক্ষকে উগ্র করেছে এবং নারী স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে নারীকে আরো অবদমনের পথ খুলে দিয়েছে। আমার মনে আছে নব্বইয়ের দশকে তাঁর সমালোচনা করতে গিয়ে একজন লেখক তাকে “ইন্টেলেকচুয়াল প্রস্টিটিউট” বলে উল্লেখ করেছিলেন, কারণ তিনি তাঁর মেধাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজে সংস্কার আনার কোনো হিতোপদেশ দেননি।

জহিরুলঃ বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকা শিল্প-সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ, অনেক বিখ্যাত লেখকের জন্ম হয়েছে আপনাদের অঞ্চলে। আপনার কাছ থেকে ময়মনসিংহ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ লেখক, শিল্পীদের একটি আউটলাইন জেনে নিতে চাই। আপনার বিবেচনায় কারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং কারা বিখ্যাত বা জনপ্রিয় হয়েছেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়?

মঞ্জুঃ শুধু শিল্প-সাহিত্য নয়, অনেক দিক থেকেই ময়মনসিংহ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিলা। যদিও ছোটবেলায় শুনেছি “হাওড় জঙ্গল মোষের সিং, এই তিনে ময়মনসিং।” কিন্তু বাস্তবে এই তিনটি ছাড়াও ময়মনসিংহের বৈচিত্র সীমাহীন এবং ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। এ জেলার রাজনৈতিক অবদান সীমাহীন। স্বাধীন বাংলাদেশে ঊনিশজন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন, তাদের পাঁচ জনই বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার। ব্রিটিশ আমলে ব্রহ্মপুত্র নদীর উত্তর থেকে গারো হিলস, যা বর্তমানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের অন্তর্গত, সেই এলাকাকে নিয়ে “আদিস্থান” নামে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন করেছিলেন ময়মনসিংহের তিন নেতা। যাদের মধ্যে রবি নিয়োগী ও জলধর পালের নাম আমার মনে আছে। রবি নিয়োগী শেরপুরের মানুষ, ব্রিটিশ সরকার যাকে দ্বীপান্তরের শাস্তি দিয়েছিল এবং তিনি দীর্ঘদিন আন্দামানের কুখ্যাত সেল্যুলার কারাগারে বন্দী ছিলেন। পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময় তিনি কারাগারে কাটিয়েছেন। তার স্ত্রীও কারাগারে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন। তাদের ছোট ছেলে কাজল নিয়োগী স্কুলে আমার সহপাঠি ছিল, তার জন্ম হয়েছে কারাগারে। এ ছাড়া ফকির বিদ্রোহ, সন্যাসী বিদ্রোহ, টিপু পাগলার বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল ময়মনসিংহ।

শিল্প -সাহিত্যের কথা বলতে গেলে “ময়মনসিংহ গীতিকা”র কথা বলবো। বিক্ষিপ্তভাবে মহুয়া, মলুয়ার কাহিনি পাঠ করলেও দীনেশ চন্দ্র সেন সংকলিত পুরো ময়মনসিংহ গীতিকা পড়ার সুযোগ পাই সম্ভবত আমি যখন দশম শ্রেনিতে পড়ি তখন। প্রতিটি কাহিনির বর্ণনার সরলতায় মুগ্ধ হয়েছি। ছোটদের জন্য লিখেছেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও সুকুমার রায়। তাদের গল্প পড়ার বহু পর জানতে পেরেছি যে তারা ময়মনসিংহের মানুষ। মীর মোশাররফ হোসেন কুষ্টিয়ার মানুষ হলেও কর্মজীবন কাটিয়েছেন টাঙ্গাইলে এবং তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “বিষাদ সিন্ধু” প্রথম ছাপা হয়েছে শেরপুরের জগৎ প্রেসে। গিরিশ চন্দ্র সেনের কোরআনের বঙ্গানুবাদও জগৎ প্রেসে ছাপা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। পরবর্তী সময়ে যাদেরকে সরাসরি দেখার ও তাদের বই পড়ার সুযোগ পেয়েছি তাদের মধ্যে লেখক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আবদুস সুলতান, খন্দকার আবদুল হামিদ উল্লেখযোগ্য। গোলাম সামদানী কোরায়শী সর্বজন পরিচিত সাহিত্যিক। ইব্রাহিম খাঁ একইসাথে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেব পরিচিত নাম। সাহিত্যের জগতে দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র নির্মলেন্দু গুণ ও হুমায়ুন আহমেদ তাদের অবদানের কারণেই দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন। বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন শুধু বাংলাদেশে নয়, নারীবাদী হিসেবে পাশ্চাত্যেও সুপরিচিত। এছাড়াও নাম উল্লেখ করতে পারি ড: আশরাফ সিদ্দিকীর, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, আবিদ আজাদ, সাযযাদ কাদীর, মোশাররফ করিম, রাহাত খান, মাহবুব সাদিক, মাহবুব হাসান, খালেকদাদ চৌধুরী, মাহবুব আনাম, মাহফুজ আনাম, রেজওয়ান সিদ্দিক প্রমুখের। শিল্পীদের মধ্যে যাদুকর পিসি সরকার, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, উৎপল দত্ত খ্যাতির অধিকারী। শিল্পাচার্য খ্যাত জয়নুল আবেদিন ময়মনসিংহের অহঙ্কার। স্যার জগদিশ চন্দ্র বসু, খ্যাতনামা লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপ্যাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহে। বাংলা চলচ্চিত্রে আনোয়ার হোসেন ও আমজাদ হোসেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তারাও ময়মনসিংহের। এর বাইরেও আরো অনেকে আছেন, যারা বাংলা সাহিত্যে অবদান রেখেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে তাদের নাম স্মরণ করতে পারছি না। আমি যাদের নাম উল্লেখ করেছি, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ কাজে স্বকীয়তার ছাপ রেখেছেন এবং অধিকাংশ ব্যক্তিই তার অবদান অনুযায়ী জনপ্রিয়। কাউকে আমি খাটো করে দেখতে চাই না। একজন যদি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বা পছন্দনীয় না হন, তাহলেও অনেকের কাছে তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ।

জহিরুলঃ নিজে ধর্মচর্চা না করেও ধর্মভিত্তিক একটি রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে জাতির পিতার মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নিজে শ্রমিক না হয়ে শ্রমিকদের নিয়ে গঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় অনেক নেতাকে, কট্টর কম্যুনিস্টকে দেখি আমেরিকার কঠোর সমালোচক হয়েও আমেরিকাতেই অভিবাস গ্রহন করেন। আপনার মধ্যে মুসলিম সংস্কৃতি ও জীবনাচারের প্রতি পক্ষপাত লক্ষ্য করেছি, ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে জানি আপনি ধর্মের রীতিনীতি ও রিচুয়ালসের চর্চা তেমন করেন না। নবী মোহাম্মদ (স.) যে নিজে মিষ্টি খাওয়া বন্ধ করে অন্যকে না খেতে উপদেশ দিয়েছেন সেই আলোকে এই বিষয়গুলো আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মঞ্জুঃ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আপনাকে বলতে পারি যে, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ব্যক্তিগত ধর্ম চর্চা করা না করার সাথে পাকিস্তান নামে মুসলমানদের একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনো সম্পর্ক ছিল না। তিনি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেননি এবং ধর্মীয় রাষ্ট্রের জাতির পিতাও হননি। তাঁর আন্দোলন ছিল মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, কারণ এ-ছাড়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে মুসলমানদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প ছিল না। জিন্নাহ কখনোই বলেননি যে তিনি পাকিস্তানকে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে যাচ্ছেন। এমনকি ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তিনি গণপরিষদে যে ভাষণ দেন, তাতে তিনি যে কথাগুলো বলেছেন তা হচ্ছে, ‘আমাদের সামনে যে আদর্শ থাকবে তাতে সবাই দেখবেন যে ধর্মবোধ থেকে এক সময়ে হিন্দুরা আর নিজেদেরকে হিন্দু ভাববে না, মুসলমানেরা নিজেদেরকে আর মুসলমান বলে ভাববে না, কারণ ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাবোধ থেকে প্রত্যেকে নিজেকে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে ভাববে।’ জিন্নাহ পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত জীবিত ছিলেন না। ১৯৪৮ সালেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সংবিধান প্রণয়ন পর্যন্ত তিনি জীবিত থাকলে গণপরিষদে জিন্নাহর বক্তব্যই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হতো বলে এক পক্ষ দাবী করেন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানিদের অধিকাংশের যুক্তিও সেটি।

কিন্তু গণপরিষদের এক পক্ষ, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, জিন্নাহ’র বিভিন্ন সময়ের ইসলাম বিষয়ক বক্তব্যের জের টেনে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার জন্য উঠে পড়ে লাগে। সেই সব বক্তব্যে জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি, বিধিবিধান, রীতিনীতি, উৎসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র মুসলিম সমাজ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে যৌথভাবে ও এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।’ “অবজেকটিভ রেজ্যুলিউশন” নিয়ে গণপরিষদের বিতর্কে তারা যুক্তি দেন যে, জিন্নাহ সংখ্যালঘুদের এবং মুসলমানদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেগুলো প্রকৃতপক্ষে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার প্রতিশ্রুতি। এই বিতর্কের শেষ হয়নি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নয় বছর পর ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু জিন্নাহর ১১ আগষ্টের ভাষণ ছিল সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের সেক্যুলার মেনিফেস্টো। এর পক্ষে আরেকটি দৃষ্টান্ত দেয়া হয়, জিন্নাহ যখন পাকিস্তানের উদ্দেশে দিল্লি ত্যাগ করেন তখন ইস্কান্দার মির্জা তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমরা তো সবাই পাকিস্তানে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিচয় কী হবে? আপনি কী পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন?’ জিন্নাহর উত্তর ছিল, ‘ননসেন্স, আমি একটি আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি।’ দীর্ঘদিন আগে আমি জিন্নাহর ওপর একটি বই পড়তে গিয়েও দেখেছি যে, পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার শ্রী প্রকাশের সাথে একাধিক সাক্ষাতে পাকিস্তানকে তিনি সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথা বলেছেন। তাছাড়া পাকিস্তানের গণপরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল নামে একজন হিন্দু। পাকিস্তানকে যদি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছা জিন্নাহ’র থাকতো, তাহলে পাকিস্তান গণপরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে অন্তত একজন হিন্দুকে নির্বাচিত করা হতো না। অতএব, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে একটি মুসলিম নেশন স্টেট এর জাতির পিতা বলা যায়, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের জাতির পিতা নয়।

বৈপরীত্য মানুষের বৈশিষ্ট। প্রতিটি ধর্মগ্রন্থে এজন্য সতর্ক করা হয়েছে। কোরআনে বলা হয়েছে, “লেমা তা কুলুনা মা’লা তাফালুন,” তোমরা যা করো না তা বলো কেন। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। আমাদের দেশে প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকদের নেতা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। শ্রমিক না হয়েও শ্রমিকদের নেতা হিসেবে খ্যাত ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদও অলঙ্কৃত করেছিলেন। এমন অনেক আছে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট নেতা বা প্রবক্তাদের পুঁজিবাদী দেশে আশ্রয় নেয়ার ঘটনা তো আমরা কমই দেখি। আমি একটা পরিসংখ্যানের কথা স্মরণ করতে পারি। চীনের পলিটব্যুরোর নয় জন নেতার মধ্যে সাত জনের সন্তান পড়াশোনা করতেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদের অনেকে আর চীনে ফেরত যাননি। নবী মোহাম্মদের নিজে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করে একটি শিশুকে মিষ্টি না খাওয়ার উপদেশ দেয়ার ঘটনার সত্যতা নিয়ে কথা আছে। কিন্তু কোনো বিষয়ে কাউকে উপদেশ দিতে হলে আগে নিজেকে সে বিষয়ে অনুশীলন করতে হবে। আমরা সচরাচর বলে থাকি, “আপনি আচরি ধর্ম পরকে শিখাবে।” কথাটি আমরা অহরহ বলি, কিন্তু নিজের ক্ষেত্রে পালন বা চর্চা করি না।

জহিরুলঃ সুফি দর্শনের প্রতি আপনার গভীর আগ্রহ আছে, রুমি কিংবা তাবরেজির জীবন দর্শন দ্বারা আপনি অনুপ্রাণিত, তাদের কাজ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। সুফি দর্শন আসলে কি? আপনি নিজে কি একজন সুফিবাদের অনুসারী, যদি হন, কিভাবে আপনি সুফি চর্চা করেন?

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন যে সূফি দর্শনের প্রতি আমার বেশ আগ্রহ আছে। মাওলানা জালালুদ্দীন রুমির জীবন দর্শন আমাকে সূফিবাদ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করেছে। তিনি যাকে তাঁর ওস্তাদ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেই শামস-ই-তাবরিজী সম্পর্কে জানতে পারি অনেক পরে। আপনি জানেন যে, ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতীয় উপমহাদেশে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার আগে সমগ্র ভারতবর্ষ প্রায় সাতশ’ বছর মুসলিম শাসনাধীনে ছিল, যার মধ্যে তিনশ বছর ছিল মোগলদের অধীনে। এই দীর্ঘ সময়ে ভারতের অফিস আদালতে ফারসি ভাষা ব্যবহৃত হতো। শিক্ষার মাধ্যমও ছিল ফারসি। ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল ব্যাপক। ইংরেজরা যেহেতু মুসলিম শাসকদের হটিয়ে শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল, সেজন্য ক্ষমতায় এসে মুসলমানদের কোনঠাসা করার জন্য যা যা করার তা করেছে। কিন্তু তা সত্বেও তাদের দুশ’ বছরের শাসনামলে ইংরেজি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেও ফারসিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারেনি। ইংরেজির মধ্যে বহু শব্দকে তারা গ্রহণ করেছিল, যাতে জমিজমা, প্রশাসন, ব্যবসা, আদালতের কাজে বহু ফারসি শব্দ রয়েছে, যা সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতো সেগুলো বাদ দিতে পারেনি। দৈনন্দিন জীবনে আমরা কথা বলার সময় এখনো বহু ফারসি শব্দ ব্যবহার করি, যে শব্দগুলো বাংলাভাষার শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকাস্থ ইরানি দূতাবাসের তত্বাবধানে পরিচালিত ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র একবার বাংলাদেশে ফারসি ভাষার প্রভাবের ওপর একটি জরিপ চালিয়ে বাংলা ভাষায় সম্পৃক্ত আট হাজারের অধিক ফারসি শব্দের অস্তিত্ব পেয়েছে। পাকিস্তানি শাসনামল পর্যন্ত বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে ফারসি ও উর্দু ভাষা চালু ছিল এবং মাদ্রাসা শিক্ষিতরা আরবির পাশাপাশি ফারসি ও উর্দু সাহিত্যের চর্চা করতো। খারেজি ও কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ফারসি ও উর্দু চর্চা আরো বেশি হতো। এখন সীমিত আকারে চালু আছে বলে জানি। কারণ বাংলাদেশে ফারসি ও উর্দু শেখানোর শিক্ষক এখন বলতে গেলে পাওয়াই যায় না।

জহিরুলঃ এক সময় আমাদের দেশের মাওলানারা ওয়াজ মাহফিলে আরবির পাশাপাশি ফার্সি গজল সুর করে গাইতেন। সেই চর্চা এখনও আছে, তবে ইদানীং দেখি ওয়াজের মাওলানারা বাংলা গানও গেয়ে থাকেন।

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর শীত মওসুমে গ্রাম এলাকায় ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হতো, এখনও হয়। সেসব মাহফিলে খ্যাতিমান মাওলানা ও ওয়ায়েজিনরা আসতেন। ছোট সময় দাদার হাত ধরে অনেক ওয়াজ মাহফিলে গেছি। পরবর্তী সময়েও বন্ধুবান্ধবের সাথে গেছি। ওয়াজের প্রতি তেমন মনোযোগী হতে না পারলেও মাওলানা সাহেবদের মুখে গানের সুরে উচ্চারণ করা দুর্বোধ্য ফারসি বয়েত শুনতে ভালো লাগতো। তারা যেসব ব্যক্তির বয়েত গাইতেন, তাদের মধ্যে মাওলানা জালালুদ্দীন রুমি, শেখ সা’দী, হাফিজ, ইমাম গাজ্জালীর নাম বেশি শুনেছি। নামগুলো মনে গেঁথে গিয়েছিল। স্কুলের ওপরের ক্লাসে ওঠে কাজী নজরুল ইসলামের অনুবাদে ‘দিওয়ান-ই-হাফিজ’ পড়েছি, শেখ সা’দীর ‘গুলিস্তান’ পড়েছি। কিশোর বয়সেই ‘গুলিস্তান’ একাধিকবার পড়েছি। উপদেশমূলক বাণীর সাথে প্রেমমূলক বাণীও আছে এই কাব্যগ্রন্থে, অশ্লীলতাও আছে। কিন্তু যেহেতু শেখ সা’দীর কবিতা অতএব তাঁর অশ্লীল কবিতাগুলোকে কেউ অশ্লীল বিবেচনা করতো না। বিশেষ করে শেখ সা’দী রচিত একটি আরবি কবিতা “বালাগাল উলাবি জামালিহি, কাশাফাদ দোজাবি জামালিহি, হাসুনাত জামিউ খিসালিহী, সাল্লু আলাইহি ওয়ালিহী” তিলাওয়াত ছাড়া বাংলাদেশে মিলাদ মাহফিল কল্পনাই করা যেতো না, এখনো এই বয়েত ছাড়া মিলাদ অনুষ্ঠান অকল্পনীয়। অতএব শেখ সা’দী তাঁর কবিতায় উপমা হিসেবে নারী-পুরুষের স্পর্শকাতর অঙ্গ হাতাহাতি করলেও তাঁর মর্যাদা ও সাবর্জনীন গ্রহণযোগ্যতার কারণে তাঁর কবিতা চর্চাকে বরং পূণ্যের কাজ ভাবা হতো। কারণ গ্রন্থটির ভূমিকা অনুযায়ী এতে কোরআন ও সুন্নাহর মর্মানুযায়ী কিসসা-কাহিনি ও উপদেশাবলী সন্নিবেশিত হয়েছে। যেহেতু আজকাল বাংলাদেশে আধুনিক মানুষ খুব সা’দী বা হাফিজ চর্চা করেন না, তারা সা’দী সম্পর্কে আমার বক্তব্যকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে ভাবতে পারেন। সেজন্য আমি আমার মুখস্থ করা শেখ সা’দীর কয়েকটি বয়েত আপনার মাধ্যমে পাঠকদের জানাতে চাই। আরেকটি হচ্ছে:

“পীরে হাফতাদ সালাহ জানে মফুনা,

কোরে মোকারি বখার নয় চশ রোশ,

জোরে বাইয়াদ না জর কে বা জানুরা,

গাজরে ছাখত বেহকে দাহমন গোশ।”

(সত্তরের বৃদ্ধ কখনো যুবকের মতো হতে পারে না,

জন্মান্ধ যেমন স্বপ্নেও দৃষ্টি ফিরে পায় না,

নারীর প্রয়োজন পুরুষের শক্তি, বিপুল বিত্ত নয়,

পুরুষাঙ্গ তার কাছে দশ মণ মাংসের চেয়ে উত্তম)।

এমন অনেক বয়েত আছে, আমি আর একটি উল্লেখ করেই এ প্রসঙ্গ শেষ করবো:

“রুয়ে জীবা জামায়ে দীবা,

সিনদুল ওউদ ওরঙ্গ ও বুয়ে ও হাউছ,

ই’হামা জিনাতে জেনানে বাশাদ,

মরদেরা কির ও খাইয়া জিনাত বছ।”

(আকর্ষণীয় চেহারা ও দামী পোশাক,

সিঁদুর চন্দন রঙ ও সুগন্ধি,

এসব মিলেই নারীর সৌন্দর্য, আর,

পুরুষের আসল সৌন্দর্য হলো তার লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ)।

শৈশবে আমরা অনেকে পাঠ্যবইয়ে শেখ সা’দীর একটি কবিতার বঙ্গানুরূপ পড়েছি। কে সেই কবিতাটি বাংলায় কাব্যানুবাদ করেছেন এ মুহূর্তে আমার মনে নেই। অসাধারণ লাগতো। কবিতাটির মর্মকথা ছিল, ‘একদিন প্রিয়ার হাত থেকে সুগন্ধিযুক্ত এক টুকরা মাটি আমার হাতে এলো। সুগন্ধিতে মুগ্ধ হয়ে মাটিকে বললাম, তুমি কী মেশক, না কি আম্বর। মাটি বললো, আমি নিকৃষ্ট মাটি ছিলাম, কিছু সময়ের জন্য সুগন্ধিপূর্ণ গোলাপের সংস্পর্শে আসি, সেই সাহচর্য আমাকে সুগন্ধি দিয়েছে; তা না হলে আমার মাঝে তো শুধু মাটির গুণই বিদ্যমান ছিল। বড় হয়ে সেই অসাধারণ ফারসি বয়েত পড়ার সুযোগ হয়েছে:

“গুলে খুশবু ইয়েদর হাম্মামে রোযজ,

রছিদ আজ দস্তে মেহবুবে বদস্তম,

বদু গুফতাম কে মেশকি ইয়া আবেরি,

কে আজ বুয়ে দেলাবিজে তুমস্তম,

বগুফ্তা মান গুলে না-চিজে বুদাম,

ওয়ালেকিন মুদ্দতে বা-গুল নেশাস্তম,

জামালে হামনশি দরমান আছর করদ,

ওয়াগার না মান হুমা খাকম কে হাস্তম।”

আমাদের শৈশব-কৈশোরে দেখেছি সামান্য অশ্লীল শব্দমালা সমৃদ্ধ বাংলা বইগুলোর ওপরে লেখা থাকতো “কেবলমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য”, কিন্তু ‘গুলিস্তান’ বা এ ধরনের বইয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কভারগুলো ছিল ইসলামী বইয়ের কভারে এখন যেমন ইসলামী শিল্পকলার বৈশিষ্ট থাকে তেমন অলঙ্করণ শোভিত এবং বইগুলো সম্মানের সাথে সংরক্ষণ করা থাকতো। এগুলো সহজলভ্যও ছিল। স্কুলের কোনো প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার হিসেবে এই বইগুলো দেয়া হতো। কিন্তু জালালুদ্দীন রুমির কোনে বই তখনো আমার হাতে পড়েনি বা পড়ার সুযোগ হয়নি। জালালুদ্দীন রুমির কবিতার সাথে আমার পরিচয় ঘটে অনেক পরে ২০০০ সালের পর। বলতে পারেন পরিণত বয়সে। তাঁর প্রেমের কবিতা, মসনবীর অংশবিশেষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। কবিতা যেহেতু ভালো লাগতো, রুমির কবিতাও ভালো লাগে এবং রুমির কবিতার পাশাপাশি আরও অনেক সূফি কবির কবিতা পড়তে থাকি। রুমির সূত্র ধরে পরিচয় ঘটে সূফিবাদের রহস্য পুরুষ শামস-ই-তাবরিজীর সাথে। রুমির জীবনে শামস এর রহস্যময় আবির্ভাব ও অন্তর্ধান তাঁর সম্পর্কে জানতে আমাকে আগ্রহী করে তোলে। এভাবে সূফি ব্যক্তিত্ব, সূফি সাহিত্য, সঙ্গীত ও ঘূর্ণায়মান দরবেশ নৃত্য সম্পর্কে আমি আরও বেশি জানার চেষ্টা করি। আমি নিজেকে সূফিবাদের অনুসারী বলে মনে করি না এবং সূফিবাদ চর্চা করি না। আমার কৌতুহল ও আগ্রহের স্থান হলো সূফি সাহিত্য, যা আমি অনেকের মতো সূফি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে আধুনিক বাংলায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার এ চেষ্টার অংশ হিসেবে আমি অনুবাদ করেছি কোলম্যান বার্কস এর ইংরেজি কবিতা সংকলন ‘দ্য সোল অফ রুমী,’ ‘রুমীর সংলাপ,’ ‘এ ইয়ার উইথ রুমী,’ ‘ফরবিডেন রুমী,’ এবং শামস-ই-তাবরিজীর আত্মকথন ‘মাকালাত’ এর, যার বাংলা নাম “আমি এবং রুমী”। ইংরেজিতে এ বইটির অনুবাদ করেছেন আমেরিকান সূফি গবেষক উইলিয়াম চিতিক। সূফিবাদের ওপর এখনও প্রচুর পড়াশোনা করছি এবং সম্ভব হলে সূফিবাদের সাহিত্যের ওপর আরো কিছু কাজ করবো। এখন ওয়াজ মাহফিলে মাওলানা সাহেবরা বাংলা গান গেয়ে থাকেন, এর কারণ মাদ্রাসাগুলোতে ফারসি ও উর্দু পড়ানোর ব্যবস্থা নেই বলে। তা সত্বেও অনেকে ফারসি বয়েত শোনান।

জহিরুলঃ সুফি দর্শন সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা শুনতে চাই।

মঞ্জুঃ আমি সূফি দর্শন ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত লোক নই। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়ার মতো যোগ্যতা আমার নেই। সূফিবাদ সম্পর্কে সীমিত পাঠ ও চেষ্টায় আমি যতোটুকু বুঝেছি, তাতে বলতে পারি, আল্লাহর সাথে সরাসরি ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ঐশ্বরিক প্রেম ও অভিজ্ঞতা অর্জনের আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টাই সূফি দর্শনের মূলমন্ত্র। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সূফিরা সবসময় ‘মুরাকাবা’ বা ধ্যান করেন এবং এই ধ্যানের মধ্য দিয়ে নিজের মাঝে সৃষ্টিকর্তার উপস্থিতির অভিজ্ঞতা লাভ করেন। নির্জনে এই ধ্যানের মধ্যে তারা কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করেন অব্যাহতভাবে, অভুক্ত থাকেন, মোহমুক্ত হওয়ার সাধনা করেন। আমি এখন যেভাবে সূফি সাহিত্য পাঠের সুযোগ পাচ্ছি তা যদি আরো আগেও শুরু করতাম, তাহলে হয়তো সুফি দর্শন সম্পর্কে মোটামুটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারতাম।

জহিরুলঃ সুফি চর্চার সাথে শারিয়া চর্চা সাংঘর্ষিক, এ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিবাদ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার ব্যাপক পড়াশোনা আছে, যদি বিষয়গুলো একটু ব্যাখ্যা করেন, সংঘর্ষের মূল জায়গাটা কোথায়, এটা এড়ানোর কোনো উপায় আছে কি-না।

মঞ্জুঃ এ কথা সত্য যে সূফিবাদকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনা করা হয়। বহু মুসলিম দেশে সূফিবাদী ও কট্টরপন্থী মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং অনেক মুসলিম দেশে সূফিদের ঘূর্ণায়মান নৃত্য এবং বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সূফি সঙ্গীত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় সূফি দরবেশ সারমাদকে নগ্ন থাকার অভিযোগে হত্যা করা হয়। তাঁর অনুসারীদের বিতাড়ন করা হয়। ইসলাম ও সূফিবাদের মধ্যে যে বিরোধ আমি নিগূঢ ধর্মতাত্ত্বিক দিক ব্যাখ্যা করার মতো পড়াশোনা আমার নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি সূফিবাদকে ইসলামে একেবারেই অপ্রয়োজনীয় বা অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে করি না। সূফিবাদী উদারতা না থাকলে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের বিস্তার বা বিকাশ বিলম্বিত হতো। সূফিরাই যে বাংলাদেশে ইসলামের বিস্তার ঘটিয়েছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিতর্কে গিয়ে আমার কী লাভ কী? ইসলামে এবং সকল ধর্মে পরস্পর বিরোধী মত, পথ, ফেরকা আছে। ইসলামে শিয়া-সুন্নী মতবাদ আছে। এসবের মধ্যেও আবার নানা মাজহাব, নানা ফেরকা আছে। একজন আরেকজনের কল্লা কাটে। একদল জিহাদকে উৎসাহিত করে, আরেক পক্ষ জিহাদের ঘোর বিরোধী। সূফি দার্শনিকরা দাবী করেন সূফিবাদ হচ্ছে, ইসলামের নির্যাস অর্থ্যাৎ নশ্বরত্ব, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্ম-পরিশুদ্ধি, যা ছাড়া যতো ইবাদত বা প্রার্থনা করা হোক না কেন তা কোনো ব্যক্তির কাজে আসবে না। সূফিবাদের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের আপন সত্তা বা ‘নফস’কে নিয়ন্ত্রণ করা বা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কথা কোরআন ও হাদিসেই নিহিত এবং ইবাদত বা আল্লাহকে স্মরণ করার মধ্য দিয়ে সূফিরা পরিশুদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছার চেষ্টা চালান। এটা যদি কোরআন সুন্নাহ বিরোধী হয়, তাহলে তা সূফিবাদ হতে পারে না। কট্টরপন্থী মুসলমান, যারা জিহাদ ছাড়া কিছু বুঝতে চান না, তাদের উদ্দেশে ইমাম গাজ্জালী বলেছেন, ‘তেরোটি দুশমনের বিরুদ্ধে তুমি জিহাদ ঘোষণা করো, যার মধ্যে বারোটি দুশমনকে তুমি দেখতে পাও না। সেগুলো হচ্ছে: অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, দাম্ভিকতা, স্বার্থপরতা, লোভ, কাম, ক্রোধ, অসহিষ্ণুতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, গুজব রটনা ও পরচর্চা। এগুলোর ওপর যদি তুমি বিজয়ী হতে বা ধ্বংস করতে পারো, শুধু তখনই তুমি সেই দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি নিতে পারো, যে দুশমনকে তুমি দেখতে পাও।’ আমরা এই দুশমনদের ধ্বংস করতে পারি না, কিন্তু পরস্পরকে হত্যা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। সুফিবাদ এর বিপরীতে, শৃঙ্খলা ও সহনশীলতার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে। জালালুদ্দীন রুমি বলেছেন, ‘ওহে মুসলমানরা, আমি কী বলবো; আমি তো নিজেকেই জানি না; আমি খ্রিষ্টান নই, ইহুদি বা জরোস্ট্রিয় নই, এমনকি আমি মুসলিমও নই।’

কেউ যদি ভ্রান্তভাবে সূফিবাদের চর্চা করে, অথবা বিশ্বাসের সাথেই সূফি পথ অনুসরণ করার উদ্যোগ নিয়ে ভুল করে, তাহলে সেই ব্যক্তি ইসলামের বিরোধিতা করে। পরিশুদ্ধির উপায় হলো ভুলকে শুধরে নেয়া ও সঠিক পথ ধরে অগ্রসর হওয়া। তা না হলে ব্যক্তির ভুল সূফিবাদের ওপর কলঙ্কারোপ করতে পারে এবং অনেক অশিক্ষিত লোক সূফিবাদকে সোজা নাকচ করে দিতে পারে। একজন সূফি হওয়ার অর্থ কী? বর্ণ-গোত্রবাদ ও সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণ দ্বন্দ্ব ও রেষারেষি এবং ধর্মের নামে ঔদ্ধত্তের উর্ধে ওঠা। সূফিবাদে এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, আমরাই সঠিক পথ অনুসরণ করছি, বাদবাকি সবই ভ্রান্ত। কিন্তু রাজনৈতিক ইসলাম ব্যবহৃত হয় ভ্রাতৃত্ব ও সামাজিক সৌহার্দের ধারণাকে নির্মূল করার কাজে। সূফিবাদ বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত। রুমি বলেছেন, ‘এসো এসো। তুমি কে অথবা তুমি এখানে কেন, তা কোনো ব্যাপার নয়।’ ঐশ্বরিক নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সকল মানুষ সমান অংশীদার। একজন সূফি সকল ধর্ম, সকল বিশ্বাস ও সকল ধ্যানধারণার প্রতি সহনশীল। সমস্যা সেখানেই সৃষ্টি হয়, যখন কেউ জোর গলায় দাবী করেন যে তিনি শুধু তার ধর্ম জানেন, তাহলে ধরেই নিতে হবে যে তিনি তার নিজের ধর্ম সম্পর্কেও জানেন না। সমাজে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীরা থাকলে তাদের ধর্ম ও তাদের সম্পর্কেও জানা উচিত। পরস্পরকে ভালোভাবে না জানার কারণে সমাজে ব্যবধান সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট নয়।

রাজনৈতিক ইসলামের বিপরীতে সূফিবাদ নিষ্ঠার সাথে আহবান জানায় মানুষকে রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য। অন্যের জানমাল রক্ষা, একে অপরকে শ্রদ্ধা করা এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার অর্থ হচ্ছে স্রষ্টাকে শ্রদ্ধা করা। রাজনৈতিক ইসলামের নামে ধ্বংস, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের কারণে যে ঘৃণার বীজ বপন করা হয়েছে এবং সমাজ ও মানুষের মধ্যে বিভাজনের যে সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছে তাতে রাজনৈতিক ইসলামের প্রভাব দূর করতে ইসলামের পরমতসহিষ্ণু ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে সূফিবাদ মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সূফিবাদের নামে ইসলাম বিরোধী যে সব কর্মকাণ্ড চালানো হয়, সেগুলোকেও পরিহার করতে হবে, যাতে সূফিবাদের উদারতাকে ভণ্ড সূফিরা তাদের স্বার্থে ব্যবহার না করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন সূফিবাদকে, হয়তো আত্ম-রূপান্তরের মাধ্যমে, আত্ম-মুক্তির আন্দোলনকে নৈতিক মূল্যবোধের সংস্কারের আন্দোলনে রূপান্তর ঘটাতে হবে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, মানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাহলেই হয়তো বর্তমান সাংঘর্ষিক অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

জহিরুলঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে সেক্যুলারিজম বলতে বুঝি সকল ধর্ম, সকল মতবাদ সহ্য করা, বিরক্ত হয়ে বা কষ্ট করে না, ন্যাচারালি। ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করে, ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ করে সেক্যুলার হওয়া যায় না। আপনি কি বলেন?

মঞ্জুঃ সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে আমি বা আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। যারা কট্টরভাবে ধর্মে বিশ্বাস করেন, বা ধর্মের ব্যাপারে রক্ষণশীল, তারা ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ইশ্বর বা আল্লাহহীন একটি ব্যবস্থা বোঝেন। সোজা কথায় ধর্মের মাঝে ধর্মনিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস। একজন যদি চায় সে তার ধর্ম পালন করবে, অথবা ধর্ম পালন না করার স্বাধীনতাও তার থাকবে। বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতির মধ্যে একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। এখনো তা আছে, কিন্তু ভিন্নভাবে বলা হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’। একই সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সংবিধানের শুরুতে আছে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম।’ এটি বোঝার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য গোঁজামিল দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখন একটি শ্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ এর জন্য কোনো শ্লোগানের প্রয়োজন ছিল না। আমরা শৈশব থেকেই স্কুল কলেজে হিন্দু বন্ধুদের সাথে স্বরস্বতী পূজায় গেছি, প্রসাদ খেয়েছি এবং পূজায় ব্যবহৃত বেলপাতা ও ফুলের পাঁপড়ি বইয়ের মাঝে গুঁজে রেখেছি। দুর্গাপূজায় আমাদের ওখানে প্রতিটি মণ্ডপ ঘুরে ঘুরে প্রতিমা দরশন করেছি, মহিষ-পাঠার বলি দেখতে জড়ো হয়েছি, প্রতিদিন সন্ধ্যায় মণ্ডপে মণ্ডপে আরতি দেখতে গেছি এবং প্রতিমা বিসর্জনের দিন বিসর্জন দেখার পর হিন্দু বন্ধুদের ‘শুভ বিজয়া’ বলে শুভেচ্ছা জানিয়েছি। একইভাবে হিন্দু ছাত্ররা ১২ই রবিউল আওয়াল উপলক্ষে মিলাদ মাহফিলে এসে বসেছে, রমজানে ইফতারে অংশ নিয়েছে, ঈদের দিন মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি গেছে। এক ধর্মের উৎসব তো সনাতন কাল থেকেই অন্য ধর্মাবলম্বীরও উৎসব ছিল। কিন্তু যখন কথাটি নতুন করে শ্লোগান হিসেবে বলা হয় তখন এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ আছে বলে কেউ সন্দেহ করতেই পারে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করলেই ঝামেলা সৃষ্টি হয়। অনেক মুসলিম জন্মগতভাবে ও বংশ পরম্পরায় মুসলিম, কিন্তু ধর্ম চর্চা করে না, অনেক হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের লোকও বংশ পরম্পরায় ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অন্তর্ভূক্ত, তারাও ধর্মের আচার-প্রথা মানে না। ধর্ম পালনে কেউ যেমন কাউকে বাধ্য করতে পারে না, ধর্ম না মানলেও কেউ বাঁধা দিতে পারে না, যদি না সাংবিধানিকভাবে ধর্ম পালনের প্রতি বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ও সামান্য পড়াশোনা থেকে জানি, যেখানেই কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানে চাপা ক্ষোভ জমা হতে হতে এক পর্যায়ে বিস্ফোরিত হয়েছে। সমাজে হানাহানি সৃষ্টি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে গেছে।

জহিরুলঃ হ্যাঁ, চাপানোর চেষ্টা মানেই একটা সমূহ ধ্বংসের সম্ভাবনা তৈরি করা।

মঞ্জুঃ ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কোনো ধর্মীয় সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি। কোনো মন্দির, মসজিদের দ্বারোদঘাটন করতে যাননি। এখনো সংবিধান অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু কারা শাসন ক্ষমতায় থাকে তাদের ওপর নির্ভর করে সংবিধানের মর্যাদা কীভাবে রক্ষা করবে। অযোধ্যায় রামের জন্মভূমি ইস্যুতে ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে বাবরি মসজিদ ইস্যুতে সব মামলার চূড়ান্ত নিস্পত্তি এখনো হয়নি। তবে একটি রায়ে মসজিদ ও মন্দিরের জমির স্থান ও পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অংশীদার দলগুলোর মধ্যে ছিল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি। ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানে রামমন্দিরের শিলান্যাস করে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত সংবিধান লংঘন করেছেন। অতএব বিষয়টি হলো দৃষ্টিভঙ্গির এবং যার যার বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির। এ সম্পর্কে আমি আরেকটি দৃষ্টান্ত দিতে পারি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় আমি দিল্লিতে ছিলাম। বাবরি মসজিদ নিয়ে দ্বন্দ্বের ওপর একটি মামলা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি মানেপাল্লি নারায়ণা রাও ভেঙ্কটচালিয়ার (পরে তিনি সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) বেঞ্চে বিচারাধীন ছিল। তিনি তথাকথিত কর সেবকদের আদেশ দিয়েছিলেন যাতে তাদের সমাবেশ কিছুতেই বেষ্টনি দিয়ে ঘেরা বাবরি মসজিদের ত্রিসীমানায় যেতে না পারে। আদেশ অনুযায়ী প্রশাসন নিরাপত্তা বাহিনীও মোতায়েন করেছিল। কিন্তু মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ভারতীয় পার্লামেন্ট ক্যাম্পাসে আমার যেখানে ক্লাস হতো তার পাশেই কন্সটিটিউশন ক্লাব। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরদিন ৭ ডিসেম্বর বিকেলে সেই ক্লাবে বিজেপি ও রাম জন্মভূমি আন্দোলনের শরীক সংগঠনগুলোর সমাবেশ হয়। সেই সমাবেশে অনেক জাদরেল নেতা জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তব্য দিচ্ছেলেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংয়ের বক্তব্য শুনে ভালো লেগেছিল যে তিনি একজন খাঁটি হিন্দু হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর কথা ছিল, সুপ্রীম কোর্ট বাবরি মসজিদের আশেপাশে না যাওয়ার আদেশ দিয়েছে ভালো কথা। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের আদেশ ভগবানের আদেশের চেয়ে বড়? সুপ্রীম কোর্টের না মানা যদি কনটেম্পট অফ কোর্ট হয়, তাহলে ভগবানের আদেশ পালন না করা হবে কনটেম্পট অফ ভগবান। অতএব যারা ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দেশ চালায়, দিন শেষে তারাও ধার্মিক। অথচ কল্যাণ সিং বিচারপতি ভেঙ্কটচালিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে কেউ বাবরি মসজিদ স্পর্শ করবে না। একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখেছি, টানা দুই যুগ সিপিএম বা কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে ছিল, যাদের ধর্ম নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। সিপিএম’র এক হিন্দু নেতা বিধান সভার নির্বাচনে প্রার্থী। মাথায় গেরুয়া কাপড় বেঁধে, কপালে চন্দন মেখে এক মন্দিরে গেছেন। এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, আপনি কমিউনিস্ট মানুষ, মন্দিরে ভোট চাইতে এসেছেন কেন? তাঁর উত্তর ছিল, কমিউনিস্ট হলেও তো আমি একজন হিন্দু। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও আপনি নির্বাচনকালে এই দৃশ্য দেখতে পাবেন। কোনো শ্বেতাঙ্গ প্রার্থী মুসলিম এলাকায় টুপি পরে মসজিদে যাচ্ছেন, বিকাল বেলায় গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করে হিন্দু মন্দির ও নেইবারহুডে ঘুরছেন, সন্ধ্যায় পাগড়ি মাথায় দিয়ে শিখ গুরুদুয়ারায় গিয়ে বসছেন। রাজনৈতিকভাবে যিনি ধর্ম মানেন না, দাঙ্গার সময় অন্য ধর্মের মসজিদ, মন্দির, গির্জা ভাঙেন, দোকান লুট করেন, খুন-ধর্ষণ করেন। তখন ধর্মনিরপেক্ষরাও ধর্মযোদ্ধা হয়ে যান। ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের নীতি হতে পারে, মানুষের পরিচিতির ক্ষেত্রে ধর্মীয় পরিচয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় শক্তি। ২০০২ সালে গুজরাটের দাঙ্গায় কয়েক হাজার মুসলিম নিহত হয়েছিল, অসংখ্য মুসলমানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, মুসলমানদের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন ও ধ্বংস করা হয়েছিল। নিহতদের মধ্যে একজন ছিলেন লোকসভার কংগ্রেস দলীয় সাবেক সদস্য ইহসান জাফরি। তাঁর পরিবারের ১৮ জন নারীপুরুষ সেই দাঙ্গায় নিহত হয়। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। কিন্তু নিহত হয়েছেন মুসলিম হওয়ার কারণে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানুষের ধর্মীয় পরিচয় মুছে দিতে পারে না।

জহিরুলঃ ইসলামে ধর্ম নিরপেক্ষতার জায়গা কতটুকু?

মঞ্জুঃ ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে অন্যান্য ধর্ম জায়গা করে দিতে পারলেও আপনি যদি ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান আছে কিনা জানতে চান, তাহলে বলবো, ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিটি ক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক। কেউ ইসলামকে আদর্শ হিসেবে বেছে নিলে তাকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ত্যাগ করতে হবে। কারণ শারিয়াহ বা ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান কোনোভাবে পরিবর্তনযোগ্য নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা প্রাপ্তবয়স্ক নারীপুরুষের পারস্পরিক সম্মতিতে যৌনাচারকে বৈধ বিবেচনা করে, যা ইসলামে শাস্তিযোগ্য ব্যভিচার। ধর্মনিরপেক্ষ অর্থনীতিতে সূদ হচ্ছে সকল অর্থনৈতিক লেনদেনের ভিত্তি, ইসলামে সূদ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে মদ তৈরি, বিক্রয়, পান করা নিষিদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতায় তা অনুমোদিত। ধর্মনিরপেক্ষতা জীবনের সবকিছু থেকে ধর্মকে পৃথক করে, আইন ও বিধিবিধান দ্বারা সবকিছু পরিচালিত হয়, যা আল্লাহর আইন ও নবী মুহাম্মদের বিধান নয়। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ বলে যে, রাজনীতিতে ধর্ম নয় এবং ধর্মে রাজনীতি নয়; অথবা ধর্ম হচ্ছে আল্লাহর জন্য, আর রাষ্ট্র জনগণের জন্য। এর মাধ্যমে ইসলামকে শুধু ব্যক্তির জীবনে ও প্রার্থনার স্থানে সীমাবদ্ধ রাখাই যথেষ্ট বলে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। জনগণের নামে সবকিছু চালিয়ে দেয়ার যে চেষ্টা তা যারা দেশ শাসন করে, তাদের ব্যাখ্যার কাছে সবকিছু অচল। তারা তখন মুফতি, ফকিহ, মুহাদ্দিস ও মুফাসসির হয়ে যান। ইসলামে সার্বভৌমত্ব আল্লাহর, জবাবদিহিতা মানুষের। ধর্মনিরপেক্ষতায় সার্বভৌমত্ব জনগণের এবং জবাবদিহিতা জনগণের প্রতিনিধির। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে সার্বভৌমত্ব ছিল জনগণের, তা সংশোধন করে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব স্থাপন করা হয়েছিল, যা পুনরায় সংশোধন করে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুন:স্থাপিত হয়েছে। অতএব কারা শাসনক্ষমতায় আছেন তাদের ওপর নির্ভর করে সার্বভৌমত্ব কার হবে। এ বিতর্কের শেষ নেই।

জহিরুলঃ বাংলা সাহিত্য থেকে ‘উপদেশ’ প্রায় উঠে গেছে, বলা হয় উপদেশ শিল্পের পরিপন্থি, এটি কি সাহিত্যের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা বা দিকভ্রান্তি? আপনি কি মনে করেন?

মঞ্জুঃ সাহিত্য বলতে যদি কথা বলা বা প্রকাশ করার অর্থে বোঝানো হয়, তাহলে সাহিত্য থেকে উপদেশ ওঠে গেছে বলার সুযোগ নেই। আপনার এক প্রশ্নের উত্তরে আমি ওরিয়েন্টাল ও ওয়েষ্টার্ন সাহিত্যের ওপর কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আধুনিক সাহিত্যের উৎসের সন্ধান করতে গেলে আমাদেরকে অনিবার্যভাবেই ধর্মীয় গ্রন্থগুলোর দিকে ফিরে যেতে হবে। সে ধর্মগ্রন্থ, তা হিব্রু বাইবেল, খ্রিস্টান বাইবেল হোক, হিন্দুদের গীতা, মহাভারত, বেদ, মনুসংহিতা হোক, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক, কনফুসিয়ান ধর্মের বিবরণী, মুসলমানদের কোরআন বা শিখ ধর্মাবলম্বীদের গ্রন্থ সাহিব হোক না কেন, কোনোটারই সাহিত্য মূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই। ধর্মগ্রন্থ মানেই উপদেশের সমাহার। মানুষের করণীয় ও বর্জনীয়, আদেশ ও নিষেধসহ মানুষের জীবনের এমন কোনো বিষয়, এমন কোনো দিক নেই, যে সম্পর্কে উপদশ দেয়া হয়নি। পরবর্তীতেও দার্শনিকরাও ধর্মের আলোকে তাদের উপদেশাবলীকেই গ্রন্থিত করেছেন। আপনি খিস্টপূর্ব ৩০০ সালে কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ এর কথা বলুন অথবা ষোড়শ শতাব্দীতে মেকিয়াভেলি রচিত ‘দ্য প্রিন্স’ এর কথা বলুন, দুটি গ্রন্থের রচনাকালের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান, একটি গ্রন্থ লেখা হয়েছে প্রাচ্যে, আরেকটি পাশ্চাত্যে। কিন্তু দুটি গ্রন্থের বিষয়বস্তু মোটামুটি একই Ñ রাজ্য শাসন করতে, রাজা, রাজপুত্র ও অমাত্যদের কী করতে হবে, সে সম্পর্কিত নির্দেশনা ও উপদেশ। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিষ্টটল যা বলেছেন ও রচনা করেছেন, সেগুলোর বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে উপদেশ এবং সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার কারণও ছিল তাঁর উপদেশ। সাহিত্য শিল্পেরই একটি শাখা, অক্ষর ও শব্দ সহযোগে যার প্রকাশ। এই প্রকাশের মধ্যে যদি মানুষ থাকে, পরিবার ও সমাজ থাকে, রাজনীতি থাকে তাহলে তো উপদেশ থাকবেই। এমনকি হাসি-পরিহাসের মধ্যেও উপদেশ নিহিত থাকে। জনপ্রিয় সাহিত্যের স্থায়ী মূল্য থাকে, মানুষের মাঝে ঠাঁই করে নেয়ার গভীর মর্ম থাকে এবং পাঠকরা এর মধ্য থেকে তাদের প্রয়োজনীয় অংশ বেছে নেয় নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করার জন্য। উপদেশকে যারা শিল্পের পরিপন্থী বলেন, তাদের যুক্তি আমি জানি না। তারা কীভাবে উপদেশ বর্জিত শিল্প তৈরি করেছেন তাও আমি দেখিনি, হয়তো আমার সীমাবদ্ধতার কারণে। তবে আমি বলবো তারা যদি এমন বলেন তাহলে তারা তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা ভুলে যান এবং সমাজকে সৃজনশীল কিছু দেয়ার কোনো ইচ্ছাও প্রকাশ করেন না।

জহিরুলঃ ইন্দোনেশিয়া একটি মুসলিম রাষ্ট্র কিন্তু সে দেশের মানুষের জীবনাচারের গভীরে প্রোথিত রামায়ণ-মহাভারতের সংস্কৃতি, মানুষের নাম-ধামেও রামায়ণ-মহাভারত। একইভাবে দেখি ভারতের হিন্দি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে এবং বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে এসব বিষয়ে ‘জাত গেল’ ধরনের একটি শংকা। মাটি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতির চর্চা কি অধর্মের কাজ? এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

মঞ্জুঃ আমি মনে করি, ধর্ম মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয়। ধর্মীয় পরিচয় নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহণ করে, বেড়ে ওঠে, জীবন গড়ার প্রাথমিক শিক্ষাও ধর্ম থেকেই আহরণ করে। আপনি ইন্দোনেশিয়ার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একসময় রামায়ণ-মহাভারতের যোগসূত্র ছিল এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল। ইসলাম ধর্মে ব্যাপক ধর্মান্তরের পর তারা ইসলাম চর্চা করছে, কিন্তু যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তারা একসময় ধারণ করতো সে সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসেনি। বের করে আনার ব্যাপারে হয়তো জবরদস্তিও ছিল না। এ শুধু ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে নয়, ইসলামের সূতিকাগার মক্কার কাবাঘরকে যে তাওয়াফ করা হয়, সে তাওয়াফ করার রীতি তো ইসলাম পূর্ব সময় থেকেই ছিল। আগে কাবাঘরের ভেতর মূর্তির আরাধনায় তাওয়াফ হতো, ইসলামের আবির্ভাবের পর সেগুলো অপসারিত হয়, তাওয়াফের রীতিতে পরিবর্তন আসে। কাবাঘরের এক কোণায় স্থাপিত হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরটি ইসলামের আগেও পবিত্র ছিল, ইসলামের আগমণের পরও পবিত্র জ্ঞানে চুম্বন করা হয়। সেই পৌত্তলিক সংস্কৃতিকে তো বর্জন করা হয়নি, পরিমার্জন ও ইসলামীকরণ করা হয়েছে। আমি যা প্রত্যক্ষ করেছি, কিছু পড়াশোনার মাধ্যমে যা জেনেছি, সেটুকুই বলার চেষ্টা করলাম। এ সম্পর্কে ইসলামের ব্যাখ্যা কী তা আমার জানা নেই। নামের ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলামানদের নামে পার্থক্য শুধু শব্দগত, অর্থের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। ইন্দোনেশিয়ায় মুসলামানদের নাম রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাখা হলেও তা সংস্কৃতিগত কারণেই রাখা হয়। বাঙালি হিন্দুরা হয়তো বেশি কট্টর এবং এ কারণে সবকিছুর মধ্যে এর প্রকাশ ঘটায়। মুসলিম নাম ‘শামসু,’ হলে, হিন্দু নাম হয় ‘রবি’, মুসলিম নাম ‘কামরু’ বা ‘চান মিয়া,’ ‘মাহতাব,’ হলে হিন্দু নাম হয় ‘চন্দ্র’, ‘ইন্দু’ বা ‘শশী’। এমন দৃষ্টান্ত আপনি হাজারটা পাবেন। নাম বলে নয়, সম্বোধনের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার হিন্দুদের সাথে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের হিন্দুদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবেন।

ব্রিটিশ-পূর্ব ভারতে প্রায় সাত শতাব্দী মুসলিম শাসন চালু ছিল এবং সরকারি দফতরে ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হতো ফারসি ভাষা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তুর্কি ভাষারও প্রচলন ছিল। সরকারি চাকুরি পাওয়ার জন্য হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলকে ফারসি ভাষা শিখতে হতো। ওই সময়ে ফারসি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে অনেক হিন্দু খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন। হিন্দুরা মুসলিম সংস্কৃতিকে অনেক ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছিল। সেই সংস্কৃতির চর্চা পোশাক-পরিচ্ছদ, খাওয়া-দাওয়া, শিল্প-সঙ্গীতের মধ্যে দৃশ্যমান ছিল।

এ সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমদ নির্মোহভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর থেকে বাংলায় মুসলিম শাসন চাপের মধ্যে পড়ে এবং ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ দমনের নামে মোগল সাম্রাজ্যের চির অবসানের পর সার্বিকভাবে সমগ্র ভারতে মুসলমানদের ওপর ব্রিটিশ ও হিন্দুদের নিস্পেষণ এমনভাবে নেমে আসে যে তাদের আর কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর উপায় ছিল না। লর্ড কর্ণওয়ালিশ ১৭৯৩ সালে বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নামে জমিদারদের মাধ্যমে ভূমিকর আদায়ের সীমা নির্ধারণ করে দেয়, অর্থ্যাৎ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি জমিদারদের উপর বার্ষিক যে খাজনা ধার্য করবে তার বিনিময়ে তারা স্থায়ীভাবে জমিদারী ভোগদখল করতে পারবে। মোগল আমলে খাজনার যে হার ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে খাজনার পরিমাণ তা থেকে বহুগুণ বেড়ে যায়। জমিদাররা কৃষকের উপর চাপ সৃষ্টি করে বর্ধিত খাজনা আদায়ের জন্য। মোগল এবং ব্রিটিশ যুগেও অবিভক্ত বাংলায় পূর্ববঙ্গ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ছিল কৃষক এবং তারা হিন্দু জমিদারদের প্রজা। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলিম জমিদারও ছিল। হিন্দু জমিদাররা পূর্ব বাংলায় জমিদারী করলেও বসবাস করতেন কলকাতায়, তাদের সন্তানরা পড়াশোনা করতো কলকাতায়। আবুল মনসুর আহমদের ভাষায় জমিদারদের কাছে পূর্ববঙ্গ ছিল খামার বাংলা এবং কলকাতা কেন্দ্রিক বাংলা ছিল ‘টাওয়ার বাংলা’। জমিদাররা পূর্ব বাংলার উন্নয়নে কিছু না করে কলকাতা কেন্দ্রিক টাওয়ার বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছেন। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। কিছু কিছু জমিদার পূর্ববঙ্গে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন, তাও ব্রিটিশ প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে। আমার নিজ এলাকা শেরপুরের কথাই যদি বলি, দু’জন হিন্দু জমিদার দুটি হাইস্কুল স্থাপন করেছিলেন। একটির নাম ‘ভিক্টোরিয়া একাডেমী’, অর্থ্যাৎ রানি ভিক্টোরিয়ার নামে। ১৮৮৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার ২৫তম করোনেশন উপলক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয়। আরেকটি স্কুল ‘গোবিন্দ কুমার পিস মেমোরিয়াল ইন্সাটিটিউশন’, আমি যে স্কুলের ছাত্র। ১৯১৯ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিতে ব্রিটিশ সরকারকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে। শিক্ষাদীক্ষা নিয়ন্ত্রিত হতো কলকাতা থেকে এবং স্থানীয় নিয়ন্ত্রণকারীরা ছিলেন হিন্দু জমিদার। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণও তারাই করতেন। সে সংস্কৃতি ছিল ‘বাবু সংস্কৃতি’ এবং ভারতের অন্য অংশের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। আপনি যদি শুধু সম্বোধনের ক্ষেত্রে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সার্বজনীনভাবে ব্যবহৃত আব্বা, আম্মা, চাচা, ফুফু, খালা, দাদা, দাদি শুনতে পান, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের মুখে যথাক্রমে শুনতে পাবেন বাবা, মা, কাকা, পিসী, মাসি, ঠাকুরদা, ঠাকুরমা। সমগ্র ভারতে ব্যবহৃত পানি শব্দটি পশ্চিমবঙ্গে জল। কেউ পানি বললেই বাবুরা নির্ঘাত ধরে নেন শব্দের উচ্চারণকারী একজন মুসলিম। শুধু সম্বোধন নয়, বহু ক্ষেত্রে আপনি এ পার্থক্য দেখতে পাবেন। এসব দিক থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা অনেক উদার। তারা হিন্দু বা মুসলিম সংস্কৃতির দেশে মাটি থেকে উদ্ভুত সংস্কৃতিকেই ধারণ করেছেন এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর এ স্বকীয়তা আরো বিকশিত হয়েছে এবং এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই।

জহিরুলঃ নারী নেতৃত্ব নিয়ে ইসলামে নেতিবাচক কথা আছে, এই জায়গাটিতে মানসিকতার এবং ধর্ম বিশ্বাসের সংস্কার প্রয়োজন বলে আধুনিক চিন্তাবিদেরা মনে করেন। এসব বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?

মঞ্জুঃ ইসলামে নারী নেতৃত্ব নিয়ে নেতিবাচক কোনো বক্তব্য নেই। ইসলামে পুরুষ ও নারীকে সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কোরআনে নারীর ওপর পুরুষের এবং পুরুষের ওপর নারীর অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য বস্ত্র এবং তোমরাও তাদের জন্য বস্ত্র।’ শারিয়াহ’য় পুরুষ ও নারীর মধ্যে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি। নবী মুহাম্মদ বলেছেন, নারীরা পুরুষের সঙ্গী, প্রতিরূপ। তাঁর একটি হাদিস বহুল আলোচিত যে, এক সাহাবী তাঁর কাছে জানতে চান, পিতা-মাতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মর্যাদার কে, তিনি বলেন, তোমার মা। সাহাবী আবার জানতে চান, এরপর কে? তিনি আবারও বলেন, তোমার মা। এভাবে তিনবার বলার পর চতুর্থ বার নবী বলেন, তোমার বাবা। এ থেকেও কী বোঝা যায় না যে, নারীকে দাবিয়ে রাখার অধিকার পুরুষকে দেয়া হয়নি। শুধু তাই নয়, নারীকে যাতে অবমাননা না করা হয় সেজন্য অন্যায়ভাবে কোনো নারীকে অপবাদ দেয়া হলে কোরআনে অপবাদকারীর জন্য শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। সূরা আন-নূর এর একটি আয়াতে এমনকি একথাও বলা হয়েছে যে, কেউ যদি কোনো সচ্চরিত্র নারী ওপর অপবাদ আরোপ করে এবং অপবাদ প্রমাণ করতে চারজন সাক্ষী না নিয়ে আসে, তাহলে অপবাদ দানকারীকে আশিটি বেত্রাঘাত করা হয় এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণ না করা হয়। ইসলামে যদি এভাবে নারীর মর্যাদা ও অধিকারের পক্ষে বলা হয়, সেক্ষেত্রে ইসলামে নারী নেতৃত্বের বিরোধিতা করা হয়েছে বা নেতিবাচক কথা বলা হয়েছে দাবী করা অর্থহীন। আধুনিক চিন্তাবিদরা যদি ইসলামে নারী অধিকার নেই দাবী করে ধর্মীয় বিধানে সংস্কার আনতে বলেন, তাহলে তারা তা বলেন তাদের অজ্ঞতা ও ইসলাম বিরোধিতার কারণে। তারা দুনিয়ার সকল ধর্ম ও আদর্শ সম্পর্কে পড়াশোনা করতে রাজি, কিন্তু নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানতে অনাগ্রহী। তারা পূজায় অংশগ্রহণ করেন, বড়দিনের অনুষ্ঠানে যান, কিন্তু মিলাদে বা ঈদের জামাতে যান না। আমি বহু মুসলিম বুদ্ধিজীবীকে দেখেছি, তারা নিকটজন বা খ্যাতিমান কেউ মারা গেলে তাদের জানাজা দেখতে যান, জানাজা নামাজে অংশগ্রহণ করেন না।

ইসলামের ইতিহাসে আপনি অনেক নারী নেতৃত্বের সাক্ষাৎ পাবেন। নবী মুহাম্মদের স্ত্রী আয়িশা পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতে মামলুক বংশের শাসনামলে সুলতানা রাজিয়ার নেতৃত্বের কথা আমরা জানি। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহে অযোধ্যার হযরত মহল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে খ্যাত হয়ে আছেন। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে না। শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়ে এসেছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং ভালো করছেন। নারী যদি যোগ্য হয়, তাহলে প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা কর্তৃত্বের অধিকারী হতে পারেন।

জহিরুলঃ আপনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থি মানুষ হিসেবে বিবেচনা করেন, শিল্পচর্চার পৃষ্ঠপোষক এবং অনুরাগী। আপনার স্ত্রী একজন চিত্রশিল্পী, তার শিল্পচর্চায় কিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন বা উৎসাহ দেন?

মঞ্জুঃ জি আমি নন্দনতত্ত্ব ও শিল্পের অনুরাগী। যখন থেকে গ্রীক ভাস্কর্য, মেসোপটেমিয়ার কীলকাকৃতির অক্ষর যাকে কিউনিফর্ম বলা হয়, মিশরের পিরামিড ও বিশেষ করে মমি সংরক্ষণ করার কফিনে অঙ্কিত চিত্র, ইলোরা-অজন্তার গুহাচিত্রের সাথে পরিচয় হয়েছে, তখন থেকে আমি এসব শিল্প সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করি। এক পর্যায়ে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার প্রেমে পড়ে যাই। আমার রুমে দীর্ঘদিন পর্যন্ত মোনালিসার বিরাট একটি পোষ্টার সেগুন কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করে টানিয়ে রেখেছিলাম। প্যারিসের ল্যুভ যাদুঘর থেকে মোনালিসা চুরি ও সেটির উদ্ধারের কাহিনি ভিত্তিক চমৎকার একটি বই আছে, আর, এ স্কটের লেখা বইটির নাম “ভ্যানিশড স্মাইল: দ্য মিস্টিরিয়াস থেফট অফ মোনালিসা।” বইটির তথ্য অনুযায়ী মোনালিসাকে যে চুরি করেছিল, সেই চোরের নাম পর্যন্ত আমার মনে আছে, ভিনসেনজো পেরুগিয়া। কাহিনি আপনাকে রহস্যোপন্যাসের মতো টেনে নিয়ে যাবে। আমি বইটির সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছিলাম এবং সেটি ঢাকা ডাইজেস্টের ‘এ সংখ্যার বই’ হিসেবে কোনো একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বিয়ের পর আমি জানতে পারি আমার স্ত্রী কামরুননাহার মণি চিত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহী। আমি পুলকিত হই। তিনি চারুকলা ইন্সটিটিউটের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু পারিবারিক রক্ষণশীলতার কারণে তাকে চারুকলা ছাড়তে হয় এবং পরে ইডেন কলেজে ভর্তি হন। শিল্পের প্রতি তার আগ্রহের কারণে আমি তাকে উৎসাহ দেই বাড়িতে শিল্প চর্চা করতে ও বিশিষ্ট শিল্পীদের কাছে চিত্রকর্ম শিখতে। ক্যানভাস, রঙ, তুলিসহ অন্যান্য উপকরণ কিনে দেই, যাতে পড়াশোনার পাশাপাশি চিত্রকর্ম অঙ্কনের অনুশীলণ চালিয়ে যেতে পারেন। দু’জন শিল্পী রেজাউল করিম ও স্বপন চৌধুরীর কাছে তিনি শিক্ষা নেন। বেশ কিছু সংখ্যক চিত্র অঙ্কন করেন। ঢাকায় দুটি চিত্র প্রদর্শনী এবং ২০০৭ সালে নিউইয়র্কের একটি আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি মিলনায়তনে মঞ্চের ব্যাকগ্রাউণ্ড হিসেবে ২৫ ফুট দীর্ঘ ও তিন ফুট প্রস্থের একটি তৈলচিত্র। আমার উৎসাহে একটি ম্যাগাজিনে ইলাসট্রেশনের কাজও করেছেন কিছুদিন। এখনও তিনি তাঁর চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন, তবে তা অত্যন্ত মন্থর।

জহিরুলঃ গান্ধী কি দেশভাগ এবং ৪৭ সালের রায়ট এড়াতে পারতেন, কিছু কি ছিল করার, যা না করার কারণে তাকে জীবন দিতে হলো?

মঞ্জুঃ পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে গান্ধীর একার পক্ষে ভারত বিভাগ এড়ানো সম্ভব ছিল না। জিন্নাহকে যদিও দ্বিজাতি তত্ত্বের জনক বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় হিন্দুত্ব দর্শনের ভিত্তিতে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন ছিল হিন্দু মহাসভার নেতা বীর সাভারকর। তার বক্তব্য ছিল মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা হিন্দুদের ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত এবং এর প্রতিকার সম্ভব হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে। ভারত যেহেতু হিন্দু প্রধান রাষ্ট্র, অতএব তার এ তত্ত্ব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং হিন্দু-মুসলিম সৌহার্দ্য বিনষ্ট হতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে মুসলমানরাও পৃথক আবাসভূমির দাবীতে সোচ্চার হয়, যার ফলশ্রুতিতে মুসলিম লীগ লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম রাষ্ট্রের রূপরেখা গ্রহণ করে এবং লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়। বিভাগ-পূর্ব ভারতে ১৯৪৬ সাল থেকেই মুসলিম, শিখ ও হিন্দু সম্প্রদায় পরস্পরের প্রতি চরম বিদ্বেষী হয়ে একে অপরকে হত্যা করতে শুরু করে এবং ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করার পরও হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও দখল অব্যাহত ছিল। এক কথায় অগনিত মানুষের রক্তের বিনিময়ে ও বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে দুটি দেশ স্বাধীন হয়। গান্ধী যদিও শেষ পর্যন্ত ভারতকে এক রাখার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস নেতারা তাকে নানাভাবে বাধাগ্রস্থ করেন। স্বাধীনতার কয়েক মাস পর তাকে হত্যা করা হয় এবং তাকে হত্যার চক্রান্তে জড়িত থাকার পেছনেও সাভারকর ছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য পরবর্তীতে তাকে এ অভিযোগ থেকে মুক্ত করা হয়েছিল। গান্ধীকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি অনশন করছিলেন মূলত মুসলমানদের হত্যা ও বিতাড়ন, তাদের সম্পত্তি দখলের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানকে তাদের পাওনা পরিশোধ করার দাবীতে। তিনি তখন ভারত বিভাগ মেনে নিয়েই তাঁর দাবী উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু উগ্র হিন্দুরা তাঁর এই দাবীতেও নাখোশ ছিল বলেই তাঁকে হত্যা করেছে।

জহিরুলঃ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিবিসি-জরিপের এই ফলাফল জেনে কবি নির্মলেন্দু গুণ কষ্টে কেঁদেছিলেন, কবি সালেম সুলেরী একদিন এক আড্ডায় এই কথা জানান। গুণ দা’র বিচারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বিষয়টি খুব স্পর্শকাতর চিন্তা করে পুনরায় নিশ্চিত হওয়ার জন্য সালেম সুলেরীর সাথে যোগাযোগ করি। প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলে তার কোনো আপত্তি আছে কি-না জানতে চাই। তিনি লিখিতভাবে জানান, ‘না, আপত্তি নেই, কারণ ঘটনা সত্য। তারিখটি ২০০৪-এর ১৮ আগস্ট। গুণ’দা বলেছিলেন, কবিরা শুদ্ধতাবাদী। রাজনীতিকরা মানুষ হত্যায় জড়িত থাকেন। কবিরা মানুষ হত্যা করে না বিধায় শ্রেষ্ঠত্ব তাদের। কবির পরাজয়ে তিনি তিনদিন স্বস্থিমতো ঘুমাতে পারেননি। কথাগুলো বলেন তোপখানা রোডস্থ সাদাকালো, নিউজব্যাংক অফিসে’। শ্রেষ্ঠ বাঙালি বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি? এবং প্রসঙ্গত বঙ্গবন্ধুর অবদান সম্পর্কে আপনার মূল্যায়নও জানতে চাই।

মঞ্জুঃ বিবিসি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। একটি গণমাধ্যমের সার্টিফিকেটের আগে শেখ মুজিবুর রহমানকে কেউ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করেনি। অর্থ্যাৎ বিবিসি যদি তাদের পরিচালিত জরিপ ফলাফলের ভিত্তিতে এই সার্টিফিকেট না দিতো, তাহলে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হতেন না। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাঁর নেতৃত্বের অবদান, দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে সপরিবারে জীবন উৎসর্গ করার কারণে বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে তাদের হৃদয়ে স্থায়ী আসন দিয়েছে, জাতির পিতার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে Ñ এর চেয়ে বড় সম্মান আর কী হতে পারে! তাঁর অবদানকে কেউ অস্বীকার করে না। এখন বিবিসি যদি নতুন করে একই বিষয়ের ওপর আরেকটি জরিপ পরিচালনা করে, অথবা ভয়েস অফ আমেরিকার মতো গণমাধ্যম একটি অনুরূপ জরিপ পরিচালনা করে এবং ফলাফল ভিন্নরকম আসে, তখন কী শেখ মুজিবের শ্রেষ্ঠত্বের স্থান পরিবর্তিত হবে? অতএব কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট চূড়ান্ত নয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিবিসি শ্রেষ্ঠত্বের আসন না দেয়ার কারণে কবি নির্মলেন্দু গুণ যদি কষ্ট পেয়ে কান্নাকাটি করেন সেটিও যৌক্তিক হতে পারে না। মানুষ সম্মানিত হয় তাঁর কর্ম ও অবদানের কারণে। যারা মানুষের জন্য, দেশ ও সমাজের জন্য অবদান রাখেন তারা কখনো বাড়তি সম্মান পাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন তাদের ভেতরের তাগিদ থেকে। জোর করে, দাবী জানিয়ে সম্মানিত হওয়া যায় না।

জহিরুলঃ আপনি অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছেন। কার কার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং সাক্ষাৎকার গ্রহনকালে তাদের দলীয় পদ-পদবী এবং সরকারে কী অবস্থান ছিল?

মঞ্জুঃ বাংলাদেশের সকল প্রধান, মাঝারি ও ছোট রাজনৈতিক দলের শীর্ষ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ হয়েছে আমার। তাদের মধ্যে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা, সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ, সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান, সাবেক অর্থমন্ত্রী ফসিহউজ্জামান মাহতাব, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ওবায়দুল্লাহ খান, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাঈদুজ্জামান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব:) মাহমুদুল হাসান উল্লেখযোগ্য। তবে তাদের মধ্যে শুধু কাজী জাফর আহমেদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তিনি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। খন্দকার মুশতাক ও এরশাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের ক্ষমতা থেকে অব্যাহতি গ্রহণের পর। শেখ হাসিনা, আতাউর রহমান খান ও মিজানুর রহমান খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে। কৃষিমন্ত্রী ওবায়দুল্লাহ খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মাহমুদুল হাসান ও অর্থমন্ত্রী সাঈদুজ্জামানে সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের দায়িত্ব পালনকালে। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক নেতার মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর জামায়াতে ইসলামীর তিন আমির আব্বাস আলী খান, অধ্যাপক গোলাম আজম ও মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জাসদের সভাপতি মেজর (অব) এম এ জলিল ও আসম আবদুর রব, মুসলিম লীগের খান এ সবুর, এমএ মতিন ও বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী, সিপিবির সভাপতি কমরেড মনি সিং ও কমরেড ফরহাদ আহমদ, সাম্যবাদী দলের কমরেড তোয়াহা, মুসলিম লীগের সভাপতি খান এ সবুর, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মহীউদ্দিন আহমেদ ও নূরে আলম সিদ্দিকী, ন্যাপের সভাপতি অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ, ওয়াকার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামানসহ আরো অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। অনেকের সাক্ষাৎকার একাধিকবার নিতে হয়েছে।

জহিরুলঃ শেখ হাসিনা, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, গোলাম আযম, এই তিনজন দলীয় প্রধানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। একজন শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহনের আগে যে ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তা ব্যাখ্যা করুন। কখনো কি মনে হয়েছে প্রস্তুতির ঘাটছি ছিল বলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বা সাক্ষাৎকার আশানুরূপ হয়নি?

মঞ্জুঃ প্রত্যেকের সাক্ষাৎকার গ্রহণের আগে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সম্পর্কে একজন রিপোর্টারের মোটামুটি সবই জানা থাকে। কারণ প্রতিনিয়ত তাদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে। অনেক সময় ঘনিষ্ট হয়ে ওঠাও সম্ভব হয়। আপনি যে তিনজনের নাম উল্লেখ করেছেন তাদের খুটিনাটি বিষয়ও জানা ছিল। তবে অনেক রিপোর্টার আছেন বা আমাদের বন্ধুদের মধ্যেও ছিলেন, যারা উপস্থিতভাবে সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করতেন। এর ফলে অনেক সময় যার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তিনিই রিপোর্টারকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে বসতেন যে এমন তথ্য তিনি কোথায় পেলেন। বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক সহনশীলতা ও শালীনতা বর্জিত দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে যে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করার সুযোগ নেই, তা অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তা সত্বেও কারো সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা রিপোর্টারের জন্য জরুরী। যার সাক্ষাৎকার নেয়া হবে তার সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলে নেয়া প্রয়োজন, এমন একটি আবহ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যাতে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সম্পর্কে তার মধ্যে আস্থার সৃষ্টি হয়। মুখোমুখি হয়েই যদি কেউ সোজা প্রশ্নে চলে যান, তাহলে যে কারণে সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে তা ভেস্তে যেতে পারে। এমনকি রিপোর্টারের চেহারায় যদি বিরক্তি, অস্বস্থির ভাব ফুটে ওঠে তাতেও কাঙ্খিত ফললাভ বিঘ্নিত হবে। এখন তো সবকিছু রেকর্ড করা হয়, যা আমার সময়ে কমই ছিল। আমি অধিকাংশ সাক্ষাৎকার টুকে নিয়েছি। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হতো যে সাক্ষাৎকার দানকারীর প্রতিটি কথা তা প্রয়োজনীয় হোক বা না হোক তা লিখতে হবে। যদি তার মনে হয় রিপোর্টার তার কথাগুলোতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তাহলে সাক্ষাৎকার হঠাৎ করেই স্বল্পস্থায়ী হয়ে যাবে। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে ও নোট নিতে হবে। আমি আগেই বলেছি, বাংলাদেশের মতো দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতাকে আক্রমণাত্মক কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ একেবারেই নেই। তবুও যদি কেউ সেই দু:সাহস করেন তাহলে হ্যাণ্ডবুক হিসেবে ইটালির খ্যাতনামা সাংবাদিক, ওরিয়ানা ফালাচির “ইন্টারভিউ অফ হিস্টরি” পড়ে নেয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ওরিয়ানা ফালাচি মূলত বিশ্বনেতাদের সাক্ষাৎকার নিয়েই খ্যাতির অধিকারী হয়েছেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করেছেন। অনেক সময় তিনি বিপদেও পড়েছেন। তার মতে, একজন রিপোর্টার যখন তার অফিসে বসে রিপোর্ট লিখেন তখন তিনি অত্যন্ত সাহসী। কিন্তু ক্ষমতাসীন কোনো ব্যক্তির মুখোমুখি হয়ে তিনি আর সাহসী হয়ে উঠতে পারেন না। তাদের পক্ষে এমন প্রশ্ন করা সম্ভব নয় যে, “জনাব, আপনি যেহেতু একজন একনায়ক, আমরা সবাই জানি, আপনি দুর্নীতিগ্রস্থ। আপনি কী মাত্রায় দুর্নীতিপরায়ণ?” কিন্তু অবাক ব্যাপার যে ফালাচি রাষ্ট্রপ্রধান, রাজা এবং গেরিলা নেতাদের পর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য করেছেন। এজন্য তিনি যে কৌশলগুলো অবলম্বন করেছেন তা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী রিপোর্টারদের জানা আবশ্যক। ফালাচির আরেকটি গুণ ছিল তিনি অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠতে পারতেন। এই গুণও একজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী সাংবাদিকের থাকা জরুরী।

জহিরুলঃ শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহনের সময়কাল, পরিপ্রেক্ষিত এবং উল্লেখযোগ্য হাইলাইটস যদি বলেন খুব ভালো হয়।

মঞ্জুঃ শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি ১৯৮৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। এ সাক্ষাৎকার বাংলাদেশের কোনো সংবাদপত্রের জন্য গ্রহণ করিনি এবং আমি একা এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করিনি। আমি তখন দৈনিক সংগ্রামের সিনিয়র রিপোর্টারের পাশাপাশি লণ্ডন থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি মাসিক ম্যাগাজিন ‘অ্যারাবিয়া’র ঢাকাস্থ প্রতিনিধি ছিলাম। ওই সময় ঢাকায় ত্রয়োদশ ইসলামিক ফরেন মিনিষ্টার্স কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। এর আগে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে এতবড় আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক কোনো অনুষ্ঠানের উপযুক্ত জায়গাও ছিল না ঢাকায়। অতএব স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয় জাতীয় সংসদ ভবনকে। এ অনুষ্ঠান কভার করার জন্য বিশ্বের বহু দেশ, বিশেষ করে প্রতিটি মুসলিম দেশ থেকে সাংবাদিকরা ঢাকায় আসেন। লণ্ডন থেকে ‘অ্যারাবিয়া’র সহকারী সম্পাদক আসলাম আবদুল্লাহ কনফারেন্স কভার করতে আসবেন বলে আমাকে জানানো হয়েছিল। যথাসময়ে তিনি ঢাকায় আসেন এবং আমরা একসাথে কনফারেন্স কভার করি। ঢাকায় পৌঁছেই আসলাম আবদুল্লাহ জানান যে কনফারেন্স শেষে তিনি বাংলাদেশের বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে চান। বিশেষ করে তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, বিএনপির চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি ও ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি খন্দকার মুশতাক আহমেদের সাক্ষাৎকার গ্রহণে আগ্রহী, আমি যেন তাদের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখি।

আসলাম আবদুল্লাহ ভারতীয় নাগরিক এবং তার সাথে আলোচনা করে জানতে পারি, সাংবাদিকতার সঙ্গে বলতে গেলে শৈশব থেকে তিনি জড়িত। কারণ তার পিতা মাওলানা মোহাম্মদ মুসলিম দিল্লি থেকে প্রকাশিত উর্দু দৈনিক মুসলিম এর সম্পাদক। এর আগে তিনি তাদের জন্মস্থান ভূপালে দৈনিক নাদিম এর সম্পাদক ছিলেন। শৈশবেই তিনি তাদের বাড়িতে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শঙ্কর দয়াল শর্মা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইকে গুজরাল, খ্যাতনামা সাংবাদিক কূলদীপ নায়ারসহ অনেক রাজনৈতিক নেতা ও সাংবাদিককে আসতে দেখেছেন। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে ব্যাচেলর করার পর মাষ্টার্স ও পিএইচডি করার জন্য যুক্তরাজ্যে গেছেন। যেহেতু তার রক্তে সাংবাদিকতা রয়েছে, লণ্ডনে গিয়েও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন।

জহিরুলঃ এতো বড় একজন সাংবাদিকের সঙ্গে থেকে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ নিশ্চয় আপনাকে ভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করে।

মঞ্জুঃ জ্বি। ইসলামিক ফরেন মিনিষ্টার্স কনফারেন্স চলা পর্যন্ত আসলাম আবদুল্লাহ হোটেল পূর্বাণীতে ছিলেন। সেখান থেকে কনফারেন্স ভেন্যুতে সাংবাদিকদের যাতায়াত, খবর প্রেরণের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর মগবাজারে, আমার বাসার কাছেই তার থাকার জায়গার ব্যবস্থা করেছিলাম, যাতে তার পরবর্তী কাজগুলো করতে সুবিধা হয়। পরবর্তী কাজ বলতে নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা। বড় দলগুলোর শীর্ষ নেতারা দেশের কোনো সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে তেমন আগ্রহবোধ না করলেও বিদেশি সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতের ব্যাপারে উদার। সম্ভবত তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র একই চিত্র। লণ্ডন থেকে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ম্যাগাজিনের সাংবাদিকের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করতে বেগ পেতে হয়নি। আমার পক্ষে নেতাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দেয়া ছাড়া তার সাথে সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে আমি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য তাকে সঙ্গ দিতে আগ্রহ বোধ করি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি শুধু তার ছোট বোন ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। প্রায় সাত বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটানোর পর দেড় বছর আগে দেশে ফিরেছেন। তিনি ভারতে থাকতেই আওয়ামী লীগ তাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করেছিল। তাঁকে কাছে থেকে দেখা এবং তাঁর কথা শোনার জন্য সাংবাদিক হিসেবে আমার আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। আমরা দু’জন অনেকগুলো প্রশ্ন ঠিক করলাম। সাক্ষাৎকারের স্থান ৩২ নম্বরের বাড়ি। নিদিষ্ট দিনে দুপুরের পর পর আমরা হাজির হলাম। শেখ হাসিনা তখনো এসে পৌঁছাননি। দীর্ঘ বারান্দায় আমরা অপেক্ষা করছিলাম। মতিয়া চৌধুরী ছিলেন। একটু পর এলেন আওয়ামী লীগের ওই সময়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক এম এ জলিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ হাসিনা এলেন, বিলম্বের জন্য দু:খপ্রকাশ করে নিচতলায় লাইব্রেরি রুমে নিয়ে গেলেন। পরিচয় পর্বে আসলাম আবদুল্লাহ দিল্লিবাসী জেনে শেখ হাসিনা উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন। দীর্ঘদিন তার দিল্লি অবস্থান এবং নানা স্মৃতির কথা বললেন আসলাম আবদুল্লাহকে। বোঝা গেল সাক্ষাৎকার গ্রহণ সহজ হবে। শেখ হাসিনা মন খুলে কথা বলবেন। কেউ নাশতা দিয়ে গেল এবং শেখ হাসিনা নিজ হাতে পরিবেশন করলেন। স্বভাবসুলভ রসিকতায় আমাকে বললেন যে আমি আসলাম আবদুল্লাহকে ঢাকার খাবারের সঙ্গে পরিচিত করিয়েছি কিনা।

আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার শুরু হলো। শেখ হাসিনা তখন ইংরেজি বলতে তেমন অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। তিনি বাংলায় উত্তর দেবেন এবং ইংরেজিতে তরজমা করবেন এম এ জলিল। আসলাম আবদুল্লাহই অধিকাংশ প্রশ্ন করলেন। আমার জন্য কয়েকটি প্রশ্ন তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি তার বাবা-মা, শেখ কামাল, শেখ জামাল ও তাদের স্ত্রী এবং শেখ রাসেলের স্মৃতি রোমন্থন করতে দীর্ঘ সময় নিলেন। তাদেরকে হারানোর কষ্টে তার কণ্ঠ অবরুদ্ধ। আমরা তাঁকে বলতে দিলাম। কথাগুলো হয়তো তিনি একইভাবে বহুজনের কাছে বহুবার বলেছেন। কিন্তু মনে হলো তিনি গতকাল ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন। ইংরেজিতে তরজমা করার কারণে স্বাভাবিকভাবেই সময় বেশি লাগছিল। তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। আমরা কোনো রাজনৈতিক প্রশ্নেই আসতে পারিনি। এমএ জলিল তাঁকে একটি সভার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি বললেন, আজ তো শেষ করা যাবে না। কাল এ সময়েই আসুন। অন্য কোনো প্রোগ্রাম থাকলেও আমি কাল সময় দেব। আসলাম আবদুল্লাহ বললেন যে, বাড়িটি তিনি ঘুরে দেখতে পারেন কিনা। শেখ হাসিনা উঠলেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নিয়ে গেলেন। এখানে ওখানে গুলির দাগ, সিঁড়ির কোথায় তাঁর পিতার লাশ পড়েছিল আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিলেন। ১৫ আগস্ট রাতে বাড়িটি যে অবস্থা ছিল সে অবস্থাই রাখা। ধূলিতে আচ্ছাদিত রুম। খাটের ওপর জাজিম ছিঁড়ে নারকেলের ছোবড়া ও আঁশ বের হয়ে আছে। তিনি দেখালেন কোনটা তাঁর বাবা-মার রুম, শেখ কামাল ও শেখ জামালের রুম। তিনি দেখাচ্ছেন। কথা বলতে পারছেন না। বললেন, ‘আমি ওপরে উঠতে সাহস পাই না। বহুদিন পর আজ ওঠলাম।’ আমরাও ভারাক্রান্ত। তাঁর পেছন পেছন নিচে নেমে এলাম। পরদিন আসতে বলে তিনি গাড়িতে উঠলেন এমএ জলিলের সাথে।

পরদিন আবারও আমরা ৩২ নম্বরে গেলাম। এবার সরাসরি রাজনৈতিক প্রশ্ন। তিনি তাঁর দলকে পুনর্গঠন, এরশাদের তথাকথিত ঘরোয়া রাজনীতি শেষ হলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন জোরদার করার কর্মসূচি, দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার ব্যাপারে তাঁর পিতার স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। শীতকালে দিন দ্রুত ফুরিয়ে যায়। চা নাশতা এলে আগের দিনের মতো নিজ হাতে পরিবেশন করলেন। তিনি বেশ উৎফুল্ল ছিলেন। আসলাম আবদুল্লাহকে পুরনো দিল্লির বিভিন্ন খাবারের কথা বললেন। সময় পেলে তিনি আবার যাবেন। দিল্লির স্মৃতি এবং দিল্লিতে অনেকের আতিথেয়তার কথা তিনি ভোলেননি। আমরা প্রায় চার ঘন্টা কাটিয়েছি তাঁর সাথে। অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমরা বিদায় নিলাম। আসলাম আবদুল্লাহ বড় মাপের সাংবাদিক ছিলেন বলা যায় না। তবে কৌতুহলী ছিলেন। তিনি শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আগ্রহী না হলে হয়তো আমার পক্ষে কখনো শেখ হাসিনাকে কাছে থেকে দেখার ও কথা বলার সুযোগ হতো না। পরবর্তী জীবনে আসলাম আবদুল্লাহ সাংবাদিকতায় ছিলেন না। তিনি বর্তমানে লাস ভেগাস ভিত্তিক একটি সেবা সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন।

জহিরুলঃ গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার নেবার সময় কি একাত্তরে তাঁর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন? যদি করে থাকেন সেইসব প্রশ্নের জবাব তিনি কিভাবে দিয়েছেন? ভাষা আন্দোলনের সময় গোলাম আযম ডাকসুর জিএস ছিলেন, ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তাকে ভাষা সৈনিক বলা হয় কিন্তু ভাষাসৈনিক আব্দুল মতিন ব্যাঙ্গ করে বলেছেন, তাঁর ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে আমি পোস্টার লাগিয়েছিলাম, তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল না, তবে তাঁর ঘাড়ের ভূমিকা ছিল। এসব প্রসঙ্গে কি গোলাম আযমের সাথে আপনার কথা হয়েছে? তার সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ উল্লেখ করুন।

মঞ্জুঃ আমি একাধিকবার গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং প্রতিটি সাক্ষাৎকারে একাত্তরে তাঁর ও তাঁর দলের ভূমিকা, ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা এসব বিষয়ে প্রশ্ন করেছি। তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকার নেই দৈনিক সংগ্রামের পক্ষ থেকে সম্ভবত ১৯৮০ সালে। লণ্ডন থেকে বাংলাদেশে তার ফিরে আসার দুই বছর পর। জাতীয় সংসদে তাঁকে নিয়ে প্রায় প্রতিদিন প্রশ্ন তুলছিলেন আওয়ামী লীগের সদস্যরা। কারণ বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার পর একাত্তরে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করেছে, যা তখনো বহাল করা হয়নি। অসুস্থ মাকে দেখার জন্য তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে তিন মাসের ভিসায় ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে এসেছেন। ভিসার মেয়াদ বহু আগেই শেষ হয়েছে। এখনো তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করছেন ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছিল। ওই সময় জাতীয় সংসদে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের নামে জামায়াতে ইসলামীর ছয় জন সদস্য ছিলেন এবং তাদের নেতা ছিলেন মাওলানা আবদুর রহিম। গোলাম আযমের বাংলাদেশে অবস্থান, বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য তাঁর আবেদন এসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এই পর্যায়ে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। আমার জন্য একটু গুরু দায়িত্ব ছিল। তখনও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পেশায় একেবারেই জুনিয়র। সিনিয়র কাউকে দায়িত্বটা দিলেই হয়তো ভালো হতো। আবার পেশাগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার আগ্রহের কারণে হালকা ওজর-আপত্তি করে আমি গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে যাই। এর আগে আমি দু’বার গোলাম আযমকে দেখেছি। একবার ১৯৭০ সালে, এক জনসভায় বক্তৃতা করতে শেরপুর গিয়েছিলেন তখন, দ্বিতীয়বার তিনি ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে যেদিন লণ্ডন থেকে ঢাকায় আসেন, সেদিন ঢাকার পুরনো বিমানবন্দরে। আমাকে সেদিনও দৈনিক সংগ্রামের পক্ষ থেকে এয়ারপোর্টে এসাইনমেন্ট দেয়া হয়েছিল। কিন্তু খবরটি প্রকাশ করার জন্য নয়। তাঁর ঢাকায় আসার খবর সংগ্রামে প্রকাশ করা হয়নি।

তৃতীয় সাক্ষাতের ঘটনা ঘটে তাঁর মগবাজার কাজী অফিস লেনের বাসায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ উপলক্ষে। সৌজন্য কথাবার্তার পর প্রশ্ন করতে শুরু করি। প্রথমেই পাকিস্তানি পাসপোর্টে তার বাংলাদেশে এসে অবস্থানের প্রশ্ন, বিশেষত তার নাগরিকত্ব পুনর্বহাল না হওয়ায় তার অবস্থান যে অবৈধ, তবু তিনি কেন অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। তিনি সবসময় হেসে কথা বলেন। তার উত্তর ছিল, বাংলাদেশে তিনি তাঁর ইচ্ছায় জন্মগ্রহণ করেননি। আল্লাহ একজন মানুষকে তার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম দিয়েছেন। এদেশ আগেও তাঁর ছিল, এখনো তাঁর। এ জন্মগ্ত অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তিনি তো অন্য কোথাও যেতে পারেন না। অন্য কোনো দেশ কেন তাঁকে গ্রহণ করবে। তিনি আরো জানান যে, একাত্তরে তিনি যখন তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে যান তখন তাঁর পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিল। সেই পাসপোর্টে তিনি যুক্তরাজ্যে গেছেন। সেখানে বাংলাদেশ হাই কমিশনে বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু হাই কমিশন তাঁকে পাসপোর্ট দেয়নি এবং কোনোকিছু বলেনি। অতএব তিনি পাকিস্তানের পাসপোর্টে বাংলাদেশের ভিসা নিয়ে এসেছেন। একাত্তরে তাঁর ও জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে গোলাম আযম বলেছেন, আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। কারণ ‘আমরা ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের আশঙ্কা করেছিলাম। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের প্রতিবাদ আমরা করেছি। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটে যে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, আমরা ওই সময়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নূরুল আমিনের নেতৃত্বে গভর্নর ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রতিবাদ করেছি এবং তাকে বলেছি যে, বিদ্রোহ দমনের নামে হত্যাকাণ্ড চালালে জনগণ আপনাদেরকে সমর্থন করবে না এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাবে।’ রাজাকার, আল-বদর বাহিনী গঠন করায় তার ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা তো সরকারে ছিলাম না। কোনো বাহিনী গঠন করার ব্যাপারে ভূমিকা সম্পূর্ণ সরকারের। তারা গেজেট নোটিফিকেশন দিয়ে এসব বাহিনী গঠন করেছে, লোকজনকে রিক্রুট করেছে, ট্রেনিং দিয়েছে। আমাদের দলের পক্ষ থেকেও কাউকে এসব বাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য বলা হয়নি। যারা যোগ দিয়েছে তারা তাদের নিজ ইচ্ছায় গেছে।’

ভাষা আন্দোলনের সূচনা মূলত ১৯৪৭ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে এবং তা চাঙ্গা হয়ে ওঠে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত বিশেষ কনভোকেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে জিন্নাহর ভাষণের পর থেকে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত। গোলাম আযম ১৯৪৮ সালে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এ সময়ে নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মানপত্র দেয়া হয়। মানপত্রে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের দাবীসহ অন্যান্য দাবীর সঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়েও কিছু দাবি জানানো হয়। মানপত্রটির খসড়া তৈরি করেন আবদুর রহমান চৌধুরী, যিনি পরবর্তী সময়ে বিচারপতি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মানপত্র পাঠ করেন ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক গোলাম আযম। পদাধিকার বলে মানপত্র পাঠ করার কথা ছিল ডাকসুর সহ-সভাপতি অরবিন্দ বোসের। কিন্তু ভাষাসহ বিভিন্ন দাবীদাওয়া সম্বলিত মানপত্র একজন হিন্দু ছাত্রকে দিয়ে পাঠ করানোর ঘটনা এড়ানো হয় কৌশলগত কারণে। একথা গোলাম আযম নিজেও তাঁর সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে মানপত্র নিয়ে এতো কথা সেই মানপত্রে ভাষা আন্দোলনের মূল সূর খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাকে যেখানে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবীতে সোচ্চার ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে দেয়া মানপত্রে তাঁর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। সে কারণে বহুল আলোচিত সেই মানপত্রে ভাষা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বক্তব্যটুকু তুলে ধরলে পাঠকরা উপলব্ধি করতে পারবেন। ওতে বলা হয়েছিল:

“ডব ধৎব যধঢ়ঢ়ু ঃড় হড়ঃব ঃযধঃ ড়ঁঃ ঈবহঃৎধষ এড়াবৎহসবহঃ, ঁহফবৎ ুড়ঁৎ রিংব মঁরফধহপব, যধং মরাবহ ইবহমধষর ধহ যড়হড়ঁৎবফ ঢ়ষধপব. ঞযরং রং ধ ংঃবঢ় রহ ঃযব ৎরমযঃ ফরৎবপঃরড়হ যিরপয ংযধষষ মড় ধ ষড়হম ধিু ঃড় ভঁৎঃযবৎ ংঃৎবহমঃযবহ ড়ঁৎ পঁষঃঁৎধষ ঃরবং, রিঃয ড়ঁৎ নৎবঃযৎবহ রহ ডবংঃ চধশরংঃধহ. ওহঃবৎপযধহমব ড়ভ ঃযড়ঁমযঃং ধহফ রফবধং ধহফ সঁঃঁধষ ঁহফবৎংঃধহফরহম ধৎব বংংবহঃরধষ রভ বি যধাব ঃড় ফবাবষড়ঢ় ধ যড়সড়মবহবড়ঁং ধহফ যবধষঃযু হধঃরড়হধষ ড়ঁঃষড়ড়শ. ডব যধাব ধপপবঢ়ঃবফ টৎফঁ ধং ড়ঁৎ খরহমঁধ ঋৎধহপধ নঁঃ বি ধষংড় ভববষ াবৎু ংঃৎড়হমষু ঃযধঃ, ইবহমধষর নু ারৎঃঁব ড়ভ রঃং নবরহম ঃযব ড়ভভরপরধষ ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঢ়ৎবসরবৎ ঢ়ৎড়ারহপব ধহফ ধষংড় ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ৬২% ড়ভ ঃযব ঢ়ড়ঢ়ঁষধঃরড়হ ড়ভ ঃযব ংঃধঃব ংযড়ঁষফ নব মরাবহ রঃং ৎরমযঃভঁষ ঢ়ষধপব ধং ড়হব ড়ভ ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমবং ঃড়মবঃযবৎ রিঃয টৎফঁ.”

বাংলাকে ওই মানপত্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিই জানানো হয়নি! দাবী করা করা হয়েছিল বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার।

গোলাম আযম তাঁর সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলনের দাবীতে গঠিত কমিটির সাথে কখনো তাঁর সংশ্লিষ্টতা দাবী করেননি। ভাষার দাবী তুলে ধরার সূচনাকারী প্রতিষ্ঠান তমুদ্দুন মজলিশের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন যে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে চকবাজারে লিফলেট বিতরণ করতে গিয়ে জনতার ক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের নেতা কমরেড তোয়াহা এক সাক্ষাৎকার এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে তিনিও একই সাথে লিফলেট বিতরণে অংশ নিয়েছিলেন। গোলাম আযম বলেছেন যে ১৯৫২ সালে তিনি যখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে শিক্ষকতা করছিলেন তখন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সাবেক সংশ্লিষ্টতার কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন কী বলেছেন তা আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। কাউকে খাটো করে দেখানোর প্রবণতা কিছু মানুষের সহজাত। একজনকে দেখতে পারি না, অতএব তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে হবে। বাংলাদেশের কোথাও কোনো প্রবীণ ও মোটামুটি শিক্ষিত লোক মারা গেলেও আপনি দেখতে পাবেন তার নামের সঙ্গে যে বিশেষণগুলো যোগ করা হয় তাতে প্রায় অনিবার্যভাবে ‘ভাষা সৈনিক’ শব্দ দুটি থাকে। এটি দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার যে আপনি কাকে কী বলতে চান; কাকে আপনি ওপরে তুলতে চান, আর কাকে টেনে নিচে নামাতে চান।

জহিরুলঃ ঢাকা ডাইজেস্টের জন্য ও তো তাঁর সাক্ষাৎকার নেন?

মঞ্জুঃ জি, গোলাম আযমের সবচেয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক নতুন ঢাকা ডাইজেস্টের জন্য। আমরা তখন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একটু ব্যতিক্রমী ধরনের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেছিলাম। এই সিরিজে ইতোমধ্যে কবি আল মাহমুদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিয়া, প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি এবং এগুলো বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। সাক্ষাৎকারগুলো আমরা নিতাম দলবদ্ধভাবে। বেশ ক’জন সাংবাদিক প্রশ্ন করতো, পুরো সময়ের জন্য একজন ফটোগ্রাফার থাকতো ছবি তোলার জন্য এবং সাক্ষাৎকার শেষে যার সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাকে ভোজে আপ্যায়ন করা হত। এসময় আরো ক’জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকেও আমন্ত্রণ জানাতাম। কাজী জাফরের ক্ষেত্রে এটি সম্ভব হয়নি, কারণ তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী, গোলাম আযমের ক্ষেত্রেও সম্ভব হয়নি তাঁর নিরাপত্তাজনিত কারণে। গোলাম আযমকে নিয়ে তখন দেশজুড়ে আরেক দফা তুলকালাম কাণ্ড চলছিল। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০ আসনে জয়ী হয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার পর। আওয়ামী লীগ জয়ী হয় ৮৮ আসনে, জাতীয় পার্টি ৩৫ ও জামায়াতে ইসলামী ১৮ আসনে জয়লাভ করে। এসময় আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছিল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে। কারণ জাতীয় পার্টি, অন্যান্য ছোট দল আওয়ামী লীগকে সমর্থন করবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতের সমর্থন পেলে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে কোনো সমস্যা হতো না। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ জোর প্রচেষ্টা চালায় তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীর পক্ষে জামায়াত সংসদ সদস্যদের ভোট নিশ্চিত করার জন্য। বদরুল হায়দার চৌধুরী স্বয়ং গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার দোয়া কামনা করেন। শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাকে উপহার পাঠানো হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি। জামায়াত সরকার গঠনে এবং বিএনপির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাসকে সমর্থন করে। বিনিময়ে জামায়াত সরকারে অংশগ্রহণ করেনি। তবে দুটি সংরক্ষিত মহিলা আসন গ্রহণ করেছিল। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ জামায়াতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। অন্যদিকে জামায়াত আশা করেছিল, বিএনপিকে নি:শর্ত সমর্থন করলে তারা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করবে। কিন্তু বিএনপি তা করেনি। বরং বিএনপি সরকার গোলাম আযমের বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা দায়ের করে এবং ১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠায়। দুইদিন পর ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করা হয়। এসব কারণে জামায়াত বিএনপির উপর ক্ষুব্ধ ছিল। প্রায় তিন বছর পর ১৯৯৪ সালে উচ্চ আদালত গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের পক্ষে রায় দেয়। জামায়াত বিএনপি সরকারের কাছে যে আশা করেছিল তা পূরণ না হওয়ায় তারা বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সাথে তাল মিলিয়ে যুগপৎ কেয়ারটেকার সরকারের আন্দোলন শুরু করে। সে আন্দোলন সফল হয় এবং ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নের উত্তরে বিস্তারিত বলেছি। ঘটনার পূর্বাপর বোঝার জন্য আমি কথাগুলো আবারও বললাম। আমরা গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার নিয়েছি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণআদালতে তার বিচার ইস্যুতে আন্দোলন চাঙ্গা হয়ে ওঠার পর এবং বিএনপি সরকার তাঁকে গ্রেফতারের আগে। সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ আমার সঠিক মনে নেই। তবে ১৯৯২ সালের শুরুতে এবং তিনি গ্রেফতার হওয়ার আগে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী টিমে আমি ছাড়াও ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সালাহউদ্দিন বাবর, আজম মীর, ফখরুল আলম কাঞ্চন এবং ফটোগ্রাফার হিসেবে ছিলেন নবিউল হাসান। এ সাক্ষাৎকার ছিল দীর্ঘ। গোলাম আযমের রাজনৈতিক জীবনের পুরো ইতিহাস তুলে আনার চেষ্টা করেছি আমরা। ভাষা আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামীতে তার যোগদান, একাত্তরে তার ও জামায়াতে ভূমিকা, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত বিদেশে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা করার অভিযোগ সব প্রশ্ন তুলি আমরা। তার সাক্ষাৎকার ঢাকা ডাইজেস্টে কভার ষ্টোরি করি এবং সংখ্যাটি এতো জনপ্রিয়তা লাভ করে যে আমাদেরকে দ্বিতীয় মুদ্রণ করতে হয়েছিল।

জহিরুলঃ এরশাদকে আমরা রাজনৈতিক নেতা মনে করি না, তিনি ছিলেন স্বৈরাচার। ক্ষমতা দখল করে রাজনীতিতে এসেছেন। জেল খাটার পরে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠার সুযোগ ছিল কিন্তু পুনরায় জেলে যাবার ভয়ে তিনি ক্রমাগত আপোষ করে গেছেন, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। কেমন ছিল তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহন?

মঞ্জুঃ আমরা তাঁকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে স্বীকার না করলেও তিনি নিজেকে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে যে, এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালে প্রচণ্ড গণআন্দোলন শুরু হয় ১৯৯০ সালে এবং এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুরের ৫টি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি ২০০১ সালে, তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে পদত্যাগ করার দশ বছর পর। আমি তখন সাময়িক বেকার ছিলাম। ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে দৈনিক বাংলার বাণী হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায়। কেউ ধারণা করেনি যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলার বাণী বন্ধ হতে পারে। অতএব অন্য কোথাও আগে যোগ দেব এমন প্রস্তুতিও ছিল না। এসময় এশিয়া ডাইজেস্ট নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ নেন বেলায়েত হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী। তার সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তার ছোটভাই কবি ইশারফ হোসেন ঢাকা ডাইজেস্টে লিখতেন। তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করে এশিয়া ডাইজেস্টের দায়িত্ব নিতে বলেন। একটি মাসিক ম্যগাজিনে চাকুরি করার ইচ্ছা ছিল না। তাছাড়া ইতোমধ্যেই আমাকে এটিএন বাংলায় যোগ দিতে বলছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম। নিয়োগ চূড়ান্ত হয়ে ছিল। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) যোগ দেয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে বলেও আভাস পেয়েছিলাম। ইশারফ তার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য নিয়ে যান। আমি আমার অবস্থা বলার পর দুই ভাই সম্মত হন যে, আমি কোথাও যোগ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত যাতে তাদের সাথে থাকি। নিশ্চিত হওয়ার পর আমি এশিয়া ডাইজেস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করি। ঢাকা ডাইজেস্টের পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে এশিয়া ডাইজেস্টের কাজ কঠিন কিছু ছিল না। নিয়মিত বিষয়গুলোর বাইরে আমি সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দেই। প্রতিটি সংখ্যায় খ্যাতিমান কারো সাক্ষাৎকার থাকতে হবে। কবি আল-মাহমুদের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম এশিয়া ডাইজেস্টের পক্ষ থেকে। কয়েক সংখ্যা পর এরশাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় পার্টির প্রচার সম্পাদক সুনীল শুভ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে এরশাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করি। পরদিন তিনি দিনক্ষণ ঠিক করে আমাকে জানান। তখন বিএনপি ক্ষমতায়। সংসদে জাতীয় পার্টির সদস্য সংখ্যা ছিল ১৪টি। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের অফিস বারিধারায়। যথাসময়ে আমি যাই। আমার সাথে ছিলেন কবি তৌফিক জহুর। একজন ফটোগ্রাফারও ছিলেন, যার নাম স্মরণ করতে পারছি না।

এরশাদ সম্পর্কে আপনার মতো আমারও নেতিবাচক ধারণা ছিল। কারণ ১৯৮২ সালের মার্চে ক্ষমতা দখলের বেশ আগে থেকেই তিনি এই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন বিএনপির অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সুযোগ নিয়ে। আমার মনে আছে ১৯৮১ সালের নভেম্বরের শেষ দিকে সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি সম্পাদকদের তার অফিসে আমন্ত্রণ জানান, যা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। দেশে এমন কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি যে তিনি প্রটোকল ভেঙে সরাসরি সম্পাদকদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ ব্যক্ত করবেন। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি। কারণ তখন বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বে সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্বল সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় ছিল। আমরা অফিসে বসেই আঁচ করছিলাম এরশাদের উদ্দেশ্য শুভ নয়। কিন্তু আমাদের সম্পাদক আবুল আসাদ সেনা প্রধানের সাথে সম্পাদকদের বৈঠক থেকে বললেন যে এরশাদের ক্ষমতা দখলের কোন ইচ্ছা নেই। সেনা প্রধান হিসেবেই তিনি সন্তুষ্ট এবং তার রাজনৈতিক কোনো অভিলাষ নেই ইত্যাদি। তবে এরশাদের বক্তব্যের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ যে কথাটি ছিল, তা হলো সরকারে সশস্ত্র বাহিনীর অবদান রাখার আবশ্যকীয়তা। সম্পাদকদের সাথে বৈঠকের চার মাস পর এরশাদ বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। দেশে সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ, সংবাদপত্রের ওপর সেন্সরশিপ আরোপ এবং দেশের সর্বত্র সামরিক আইন আদালত চালু করে সংক্ষিপ্ত বিচারে দুর্নীতিবাজদের বিচার শুরু করেন। বিস্তারিত আলোচনা অনাবশ্যক। রাজনীতি সচেতন সকলে কমবেশি এসব জানেন।

বিভিন্ন উপলক্ষে এরশাদের অনেক সভা, সাংবাদিক সম্মেলন কভার করেছি। তাঁকে কখনো কঠোর মনে হয়নি। ক্ষমতা দখলকারী যে কোনো সামরিক শাসকের প্রথম কাজ রাজনীতিকে কলুষিত করা। জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধেও এই অভিযোগ রয়েছে। জিয়াউর রহমান যেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতাদের ছুটিয়ে এনে তার দল গঠন করেছিলেন, এরশাদও একইভাবে বিভিন্ন দলের নেতাদের জাতীয় পার্টিতে সমবেত করেছিলেন। তবে ব্যক্তিগত সততার কারণে জিয়াউর রহমান এখনো শ্রদ্ধাভাজন হয়ে আছেন, এরশাদ তার দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে নিন্দিত হয়েছেন। জিয়াউর রহমান আপোষ না করে মারা গেছেন, এরশাদ একের পর এক আপোষ করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন। সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি বহু ধরনের অভিজ্ঞতার অধিকারী। তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম তিনি রাজনীতিতে আসবেন না বলে সম্পাদকদের আশ্বস্ত করার পরও কেন রাজনীতিতে এলেন। ‘এসব পুরোনো কথা’ বলে তিনি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করলেও আমি তাঁর উত্তর জানার জন্য মোটামুটি চেপে ধরি। তিনি মৃদু হাসেন। আমাকে নাছোড়বান্দা বলেন এবং আমার কাছেই জানতে চান যে একজন মন্ত্রীর বাড়িতে খুনীর অবস্থান করার ঘটনায় আপনার প্রতিক্রিয়া কী হতো। তিনি বলেন শুধু একজন খুনীর আশ্রয়ের বিষয় নয়, বিএনপি সরকার দেশকে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল তাতে হস্তক্ষেপ না করলে দেশের আরো দুর্গতি হতো। বেসামরিক প্রশাসনের পক্ষে দেশ সামলানো অসম্ভব হয়ে পড়তো। মেরি সম্পর্কেও প্রশ্ন করেছিলাম। কিন্তু সে বিষয়ে তিনি মুখ খুলতেই রাজি হননি। নারীর প্রতি আসক্তির কারণে আমি তার জন্য আমার অনুবাদ করা খুশবন্ত সিংয়ে ‘দ্য কম্প্যানি অফ ওম্যান” উপন্যাসটি নিয়ে যাই। বইটির কভারে এক নগ্ন নারীর ছবি আছে। তিনি হাতে নিয়ে মুচকি হাসেন এবং বইটি টেবিলে উল্টে রাখেন। এছাড়া উনার সাথে রাজনৈতিক বিষয়েই কথা হয়েছে। তিনি কথা বলতে পছন্দ করেন এবং কথা বলার সময় উচ্ছসিতভাবে বলেছেন।

জহিরুলঃ কাজী জাফর আহমেদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী। কেমন ছিল একজন ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার গ্রহনের অভিজ্ঞতা?

মঞ্জুঃ কাজী জাফর আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেও বিভিন্ন উপলক্ষে আমি বেশ ক’বার দেখা হয়েছে। তাঁর সাথে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। তাঁর বাসায়, তাঁর অফিসে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে হলে যেসব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষ পর্যন্ত যেতে হয়, এর বাইরে তাঁর সাথে আলাপচারিতায় নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি। আমার ঘনিষ্ট রাজনীতিবিদদের মধ্যে একমাত্র তিনিই যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, সেজন্য কিছু ভিন্নতা ছিল। আগে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের পক্ষে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমাকে সাক্ষাৎকার দেয়ার আগে তাঁর সাথে সরাসরি সম্পর্কের কথা বলে নেয়া উচিত। কাজী জাফর আহমেদের সাথে আমার সরাসরি আলাপচারিতা ১৯৮৩ সালে শীতের এক সকালে। তখন জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন চলছে। মগবাজার কাজী অফিস লেন এর শেষ প্রান্তে মসজিদের ঠিক উল্টো দিকের একটি একতলা বাড়ির ভাড়াটে তিনি। নানা কারণেই মগবাজার কাজী অফিস লেন বিখ্যাত। মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব পাশের বাড়িটি খ্যাতিমান ইসলামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা আলাউদ্দিন আল-আজহারীর, পশ্চিম পাশে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অঘোষিত আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমের, এরপর মগবাজার কাজী অফিস, এবং এর পাশেই পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের তিনটি বৃহৎ গ্রুপের কোন একটির ভাইস প্রেসিডেন্ট একিউএম শফিকুল ইসলামের। বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগে যাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল তাদের মধ্যে অধ্যাপক গোলাম আজম ও শফিকুল ইসলাম ছিলেন। এসব সুপরিচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বাড়ি ঘেঁষেই বিশাল জায়গা জুড়ে উঁচু প্রাচীরের উপর কাঁটাতার বেষ্টিত দুর্গ সদৃশ আমেরিকান দূতাবাসের ওয়্যারহাউজ। কাজী জাফর আহমেদ যে বাড়িটিতে থাকেন সেটির মালিকও কোন এক রাজনীতিবিদ, যার নাম এতোদিনে আমার মনে নেই। তার একটি বা দু’টি বাড়ি পর মুসলিম লীগ নেত্রী দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের সদস্য রাজিয়া ফয়েজের। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সভাপতি খান এ সবুর তিনটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন। দু’টি আসন ছেড়ে দেয়ার পর সাতক্ষীরার আসনটিতে উপনির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হন। রাজিয়া ফয়েজের স্বামী আবুল ফয়েজ ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ব খাতের প্রতিষ্ঠান ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার চেয়ারম্যান। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থার এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি দেশের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের উপস্থিতিতে আবুল ফয়েজ তার বক্তব্য শেষ করেন ভুলবশত: “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” উচ্চারণ করে। এর ফলে তার চাকুরি চলে যায় এবং রাজনৈতিক বিড়ম্বনার শিকার হন তিনি। আরো কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির বসবাস ছিল ওই গলিতে।

কাজী জাফর আহমদের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ আগেই নির্ধারিত ছিল। তিনি বলেছিলেন সকালটাই তার জন্য সুবিধাজনক। রাজনৈতিক কর্মীরা তখন ভিড় করে না, সামরিক আইন থাকার কারণে প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতার অনুপস্থিতিতে বাড়িতেই বেশির ভাগ সময় কাটান। তাঁর সাথে আমাকে নাশতা করতে বলেছিলেন। কলিং বেল টিপতেই কাজী জাফর আহমেদ নিজেই দরজা খুললেন। যেহেতু আমার সাথে তার প্রথম সাক্ষাৎ তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার খোঁজখবর নিলেন। বাড়ি কোথায়, কোথায় কি পড়াশুনা করেছি. কতোদিন যাবত সাংবাদিকতা করছি ইত্যাদি। কেউ নাশতা দিয়ে গেল। খুবই সাধারণ খাবার। রুটি, সব্জি, ওমলেট। নিজ হাতে খাবার তুলে দিলেন। খেতে খেতে নিজের কথা বললেন। তার শিক্ষাজীবন, পারিবারিক জীবন, শ্রমিক আন্দোলন। ভালোই হলো। কারণ তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে পরবর্তী সময়ে এ বিষয়গুলো জানার প্রয়োজন পড়তো না আমার। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিকট থেকে জানা যে পাকিস্তান আমলে আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন জারীর ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতার পরও স্বাধীন বাংলাদেশে অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’বার সামরিক শাসন অনিবার্য হয়ে উঠলো কেন? একটি মাত্র মূল প্রশ্নের উত্তর পেতে আমি ইতোমধ্যে সিপিবি প্রধান কমরেড মনি সিং, জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান, জাসদ সভাপতি মেজর (অব:) এমএ জলিল, ওয়ার্কাস পার্টির রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বিষয়টির উপর কাজী জাফর আহমেদ রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, মনে হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ তুলে ধরছেন। শিক্ষকের মতো স্থিরতায় তার পর্যবেক্ষণ আমি টুকে নিচ্ছি নিউজপ্রিন্টের প্যাডে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে দেশে দেশে সামরিক শাসনের পক্ষের প্রবক্তাদের অনেক যুক্তিই আমার জানা। কিন্তু কাজী জাফরের দেয়া সামরিক শাসনের বিপক্ষের যুক্তিগুলো অধিকতর শানিত। তবে তাঁর চোখেমুখে হতাশার অভিব্যক্তি। তিনি বললেন, “কে জানতো শেখ মুজিবের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী দেশের প্রথম সংসদের মেয়াদকালেই সংসদীয় পদ্ধতির অসারতার ঘোষণা দিয়ে একদলীয় প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু করবেন, বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করবেন। সামরিক শাসন কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু শেখ মুজিব সামরিক শাসনের চেয়েও কঠোর, বর্বর শাসন কায়েম করেছিলেন, যা থেকে দেশকে, গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার কোন পথই রাজনীতিবিদদের কাছে খোলা ছিল না।” মাঝে মাঝে আমার কিছু সম্পুরক প্রশ্ন ছাড়া তাঁর কথায় আমি খুব একটা বাঁধা দেইনি। ঘন্টা দু’য়েক আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনেছি। কাজী জাফর আহমেদ ছিলেন শিক্ষক, আমি তাঁর গুণমুগ্ধ ছাত্র। বিদায় নেয়ার সময় তিনি কথা বলতে বলতে রাস্তা পর্যন্ত নেমে এলেন আমার সাথে, বললেন, লিখতে গিয়ে কোথাও সমস্যা মনে হলে আমাকে ফোন করবেন। কিন্তু সেই প্রয়োজন হয়নি।

জহিরুলঃ যতদূর জানি সামনা-সামনি কাজী জাফরের কোনো এক বক্তৃতা শুনে আপনি খুব মুগ্ধ হন, প্রভাবিতও হন হয়ত।

মঞ্জুঃ শেখ মুজিব জীবিত থাকতেই আমি কাজী জাফর আহমেদের একটি দীর্ঘ বক্তৃতা শুনেছিলাম। ১৯৭৪ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে। অনুষ্ঠানটি কি উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল তা সঠিক মনে নেই। সেখানে তিনি ছিলেন একক বক্তা। আমি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরনো হয়ে উঠিনি। মফস্বলের হাবভাব, বেশভূষা, কৌতুহল সবই বিদ্যমান। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ দোর্দন্ড প্রতাপে। এপ্রিল মাসে মহসীন হলে সংঘটিত ‘সেভেন মার্ডার’ এর রেশ কাটলেও ছাত্রলীগের দাপট কমেনি। এ পরিস্থিতিতে কাজী জাফর আহমেদ টিএসসিতে আসছেন খবরটি আওয়ামী বিরোধী শিবিরে উচ্ছাসের সৃষ্টি করেছিল। আমিও তাঁর বক্তৃতা শুনতে গেলাম। এর আগে আমি তাঁকে সামনাসামনি দেখিনি, বক্তৃতাও শুনিনি, শুধু সংবাদপত্রে তাঁর বক্তব্য পড়েছি। তবে এটুকু জানতাম, তাঁর কথায় টঙ্গি শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকরা ওঠে ও বসে। সূচনা বক্তব্যের পর কাজী জাফর আহমেদ উঠলেন এবং টানা দেড় ঘন্টা বক্তৃতা দিলেন। মাঝে মাঝে দর্শকশ্রোতাদের তুমুল করতালি টিএসসি মিলনায়তনের পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গেছিল মাত্র। সম্ভবত এর আগে আমি ঢাকায় সরাসরি কোন জাতীয় নেতার বক্তৃতা শুনিনি। অতএব আমার উপর তাঁর সেদিনের বক্তব্যের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী ছিল।

কাজী জাফর আহমেদ তখন প্রধানমন্ত্রী। এরশাদের অধীনে মন্ত্রীত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মধ্যে পড়েন এবং নিস্কলুষ রাজনৈতিক জীবন কাটিয়ে আসা কাজী জাফরের মন্ত্রণালয়ে সামান্য ত্রুটি ধরা পড়লেই সমালোচকরা উঠেপড়ে লাগতো তাঁর পিছনে এবং চিনি আমদানি নিয়ে তার বিরুদ্ধে নানাভাবে বিষোদগার চলতে থাকে। পত্রপত্রিকাগুলো তাঁর উপর নির্দয় হয়ে উঠে। তাঁর বিরুদ্ধে নেতিবাচক সমালোচনা শুনে বা পাঠ করেও আমার মধ্যে তার সম্পর্কে হীন ধারণা পোষণ করিনি, অভিযোগ বিশ্বাসও করিনি। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন আমার সম্পাদনায় প্রকাশিত ম্যাগাজিন মাসিক ‘নতুন ঢাকা ডাইজেষ্ট’ এর পক্ষ থেকে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেই। একটি মাসিক ম্যাগাজিনকে দেশের প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎকার দেবেন এটা ধারণা করা একটু কঠিণ মনে হলেও, ঢাকা ডাইজেষ্টের জনপ্রিয়তার কারণে তা সম্ভব হয়েছিল। দিনক্ষণ চূড়ান্ত হলো। তার ব্যস্ত সময়সূচির মাঝেও দুই ঘন্টা দিতে সম্মত হলেন। এ ব্যাপারে তাঁর একান্ত সচিব ও তথ্য কর্মকর্তা আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। মূল সাক্ষাৎকার নেবেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সালাহউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, আমি সাথে থাকবো এবং ফটোগ্রাফার হিসেবে থাকবেন নবিউল হাসান (মরহুম)। প্রধানমন্ত্রীর অফিস তখন গণভবনে। সিকিউরিটি চেকআপের আনুষ্ঠানিকতা সেরে তাঁর অফিসে পৌছার পর একান্ত সচিবের রুমে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আমাদেরকে উদারভাবে স্বাগত জানালেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই বলে মনে করা হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। প্রধানমন্ত্রী মানেই ব্যস্ততা, তিনি রাজনৈতিক প্রধানমন্ত্রী বলে ব্যস্ততা আরো বেশি। সময় নষ্ট না করে আমরা তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করতে শুরু করলাম। এক ঘন্টার মতো তিনি প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন । এরপর তাঁর কথার বাঁধ ভেঙ্গে গেল। তিনি একা বলে যাচ্ছেন আবেগে। মনে হচ্ছিল, না বলা অনেক কথা বলে যাচ্ছেন। তাঁর কথার মাঝখানে কোন প্রশ্ন করে আমরা তাঁকে বাঁধা দিতে চাইনি। এভাবে আরো প্রায় এক ঘন্টা পর একান্ত সচিব তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি থামলেন। তাঁর পরবর্তী কর্মসূচির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব তাকে অসহায় করে ফেলেছে বলে ব্যক্ত করলেন এবং বললেন, “আমার কথা শেষ হয়নি। কাল আবার আসুন, বাকি কথা কাল বলবো।” একান্ত সচিবকে বলে দিলেন আমাদেরকে সময় ঠিক করে দিতে। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি তো একদিনেই তাঁর কথা শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি কথা বলতে চান, মানুষকে তাঁর কথা, তাঁর স্বপ্ন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে কি করবেন তা জানাতে চান। পরদিন যথাসময়ে আমরা গেলাম। তিনি আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর না বলা কথাগুলো ধীরে ধীরে বলে গেলেন। আমরা একজন নিরহঙ্কারী জাতীয় নেতা, একজন প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনছিলাম, তিনি মাটি ও মানুষকে ভালোবাসার কথা বলছিলেন।

জহিরুলঃ আপনি একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা?

মঞ্জুঃ আমি যখন মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার নেই তখন তিনি আওয়ামী লীগের একাংশের সভাপতি। তার গুলশানের বাড়িতে সাক্ষাৎকার নেই। আমি যখন তার বাড়িতে যাই কোনো উপলক্ষে সেখানে তার দলীয় নেতাকর্মীদের ভিড় ছিল। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের তথ্যমন্ত্রী। এরপর নিয়মিত দেখা হতে থাকে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে। ওই সময় মূল আওয়ামী লীগের ৩৯ জন সদস্য সংসদে ছিলেন এবং মিজান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন দু’জন। তিনি ছাড়া অপর একজন ছিলেন প্রফেসর মফিজুল ইসলাম। মিজান চৌধুরী হাসি-পরিহাসের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলে ফেলতেন। পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তিনি উদারভাবে আমাকে স্বাগত জানান। নেতাকর্মীদের অপেক্ষা করতে বলে আমাকে ভেতরে নিয়ে যান। তাড়া দেন সাক্ষাৎকার শেষকরতে। তাঁর দলের জরুরী একটা বৈঠক আছে। সারা দেশ থেকে নেতারা এসেছেন। আমার উৎসাহে ভাটা পড়ে। অতএব জরুরী কিছু প্রশ্ন করার পর তাঁর কাছ থেকে ছকবাঁধা রাজনৈতিক উত্তর পাই। মাত্র আধা ঘন্টা স্থায়ী ছিল এ সাক্ষাৎকার।

জহিরুলঃ দৈনিক বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক থাকার সময় একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী মুরগী মিলনের সাথে আপনার দেখা হয়। কি কথা বার্তা হয় তার সাথে? কেমন দেখলেন একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে?

মঞ্জুঃ ২০০০ সালের মার্চ-এপ্রিলের ঘটনা। বাংলার বাণীতে নিউজ রুমে আমার টেবিলের পরই নির্বাহী সম্পাদক শফিকুল আজিজ মুকুলের রুম। যখন তখন তাঁর রুমে যাই। একদিন রুমে ঢুকে দেখলাম টেলিফোনে কাকে ধমক দিচ্ছেন। মৃদু ধমকের সুরে বলছেন, কতোবার বলেছি এসব ছেড়ে দে। এখন কান্নাকাটি করে কী লাভ। কখনো সান্তনা দিচ্ছেন, ঠিক আছে আমি শেখ সেলিমকে বলবো। ফোন ছেড়ে বললেন, মিলন কথা বলছিল। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কাল আদালতে তুলবে। আদালত পর্যন্ত যাতে না নেয় সেজন্য শেখ সেলিমকে তদবির করতে বলছে। আমি জানতে চাই, কোন মিলন। তিনি বলেন, আরে বুঝলেন না। মুরগী মিলন। যুবলীগের নেতা। এভাবেই মুরগী মিলনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে এমন কারো কাছ থেকে তাঁর কথা শুনলাম। মুরগী মিলনের নাম জানি ঢাকা নগরীর একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে। কেউ যুবলীগ নেতা হিসেবে জানে না। আমিও জানতাম না। বাংলার বাণীতে তিনজন ক্রাইম রিপোর্টার ছিলেন- আবুল হোসেন, খালেদ মাহমুদ ও মাহমুদুর রহমান। আস্তে আস্তে তাদের কাছেও মুরগী মিলন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারি। তার নাম হুমায়ুন কবীর মিলন। হাতিরপুল বাজারে তাদের পারিবারিক মুরগির ব্যবসা ছিল এবং মিলন দীর্ঘদিন সেই ব্যবসা করতেন। পরবর্তীতে ‘মুরগী’ নামটি তার নামের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে জড়িয়ে যায়। এক পর্যায়ে তিনি যুবলীগের এলিফ্যান্ট রোড ও আশপাশের এলাকার নেতা হন। বিমানবন্দরে সোনা চোরাচালান তার প্রধান ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও জুতার দোকানসহ অন্যান্য ব্যবসা ছিল তার। তার প্রতিপক্ষও ছিল, যারা তার মতোই সন্ত্রাসী। ২০০০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের এক রাতে তিন ক্রাইম রিপোর্টারকে কয়েকজন অচেনা লোকের সাথে কথা বলতে দেখলাম। চিফ ক্রাইম রিপোর্টার আবুল হোসেন আমার কাছে এসে বললেন, মিলন ভাই আপনার সাথে একটু কথা বললেন। কোন মিলন জানতে চাইলে তিনি ঝুঁকে নিচু কণ্ঠে বলেন, মুরগী মিলন। অবাক হলাম, মুরগী মিলন আমার সাথে কী কথা বলতে চায়? ক’মাস আগেই পুলিশ ধরেছিল, কবে ছাড়া পেল। মুরগী মিলন টেবিলের কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভীতি উদ্রেক করার মতো চেহারা নয়। মুখজুড়ে গুটি বসন্তের দাগ। আমি হাত মিলিয়ে বসতে বললাম। তিনি বসে বললেন, বাংলার বাণীতেও যদি আমাকে ‘মুরগী মিলন’ নাম দিয়ে আমার বিরুদ্ধে লেখে, তাহলে আমি যাই কোথায়? আবুলরা বললো, ওরা কিছু জানে না। নিউজ এডিটর জানবেন। আমি তো দেখতে পাচ্ছি, আপনি আমাকে চেনেন না, জানেন না, আপনার তো জানার কথা নয়। ওরাই কেউ করেছে, এখন আপনার ওপর দোষ চাপাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আপনি কিছু মনে না করলে আপনাদের জন্য কিছু খাবার আনার ব্যবস্থা করি। আমি মানা করলাম, এটা হতে পারে না। আপনি আমাদের অফিসে এসেছেন, বসুন, আমি শুধু চা খাওয়াতে পারবো। চায়ের জন্য পিয়ন নজরুলকে ডাকলাম। তিনি আপত্তি করলেন। ওঠে হাত বাড়ালেন এবং হাত মিলিয়ে চলে গেলেন। তার সাথে আমাদের তিন ক্রাইম রিপোর্টারও গেলেন। আধঘন্টা পর দেখলাম ক্রাইম রিপোর্টাররা প্রচুর খাবার এনেছে। বললেন, মিলন ভাই জোর করে গছিয়ে দিলেন। তাদেরকে বললাম, আমি খাবো না। যারা খেতে চায় তাদের দিন। এ ঘটনার দেড়-দু’মাস পর খবর এলো আদালতে হাজিরা দিতে গিয়ে ফেরার সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মুরগী মিলন নিহত হয়েছে। মুরগি মিলন আদালত থেকে বের হওয়ার পর প্রথমে ককটেল বিস্ফোরিত হয়। মুরগী মিলন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য দৌড়াতে থাকেন। জানা গেছে যে বেশ ক’টি আগ্নেয়াস্ত্র থেকে একযোগে তার ওপর গুলি নিক্ষেপ করা হয়। মোট ১৪টি গুলি লেগেছিল তার শরীরে এবং ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। সন্ত্রাসীরা এভাবেই মারা যায়। প্রতিপক্ষের হাতে অথবা পুলিশের এনকাউন্টারে। ভারতের এক পুলিশ অফিসারের বক্তব্য মনে পড়লো, যিনি বলেছিলেন, কোনো সন্ত্রাসী বা দস্যু তাদের জীবনের পঞ্চাশ বছরে পৌঁছাতে পারে না। মুরগী মিলনের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছিল। আবুল, খালেদ ও মাহমুদ আফসোস করলো, এলিফ্যান্ট রোডে গেলে তাদেরকে কেউ আর ফ্রি জুতা-স্যাণ্ডেল দেবে না।

জহিরুলঃ সাংবাদিকতা জীবনে আপনি সংসদ কভার করেছেন, কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? কখনো কি মনে হয়েছে অন্য দায়িত্ব পেলে ভালো হতো? একজন ভালো সাংবাদিকের কি কি কমিটমেন্টের কথা মাথায় রাখতে হয়?

মঞ্জুঃ ছোট সংবাদপত্রে কাজ করার একটা সুবিধা হচ্ছে বড় দায়িত্ব পাওয়া যায়। আমার ক্ষেত্রেও তা হয়েছিল। আমি জাতীয় সংসদ অধিবেশন কভার করতে শুরু করি ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ কভার করার মধ্য দিয়ে। তখনো আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়নি। তবুও রিপোর্টার সংকটের কারণে আমাকে এসাইন করা হয় সংসদে। আমার সাথে আরেকজন সহকর্মী ছিলেন সালাহউদ্দিন বাবর। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। নির্বাচনও কভার করেছি। কিন্তু সংসদ অধিবেশন কভার করা সহজ কাজ নয়। রিপোটিংয়ের মধ্য সবচেয়ে টেকনিক্যাল সাংবাদিকতা। সংবিধান, কার্যপ্রণালী বিধি, আইন জানতে হয়। সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালী ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া সম্পর্কিত তুলনামূলক আলোচনা পড়তে হয়েছে। কিন্তু পুথিগত বিদ্যা ও বাস্তবের মধ্যে অনেক ফারাক। আমাদের সিনিয়র সাংবাদিক, যারা তখন সংসদ কভার করতেন, দৈনিক বাংলার ফজলুল করিম, দৈনিক বার্তার সলিমুল্লাহ ভাই, টাইমসের নাফা ভাইসহ সকলে সহায়তা করেছেন, যাতে কোনোকিছু ভুল না করি। সংসদ রিপোটিংয়ে ভুল করার খেসারত চরম। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে ঝানু পার্লামেন্টারিয়ানরা ছিলেন। শাহ আজিজ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা। বিরোধী দলের নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক পাটমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। খান এ সবুর, আতাউর রহমান খান, মিজানুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মহীউদ্দিন আহমেদ, সুধাংশু শেখর হালদার, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, রাশেদ খান মেনন, কমরেড তোয়াহা, মাওলানা আবদুর রহিম, এমএ মতিনসহ আরো অনেক রাজনীতিবিদ এ সংসদ অলঙ্কৃত করেছেন। পার্লামেন্ট কভার করার অভিজ্ঞতা যে কোনো সাংবাদিককে তার পেশাজীবনকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যারা দেশ পরিচালনা করে, যারা আইন প্রণয়ন করে তাদের সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার জন্য এর চেয়ে বড় সুযোগ আর নেই। এমনকি আপনি কোনো প্রটোকল মেইনটেন না করেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। যে কোনো জটিল ইস্যুতে সরকারি দল ও বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ সহজে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন। সাংবাদিকরা তাদের খুব কাছের হয়ে যান। এখন সংসদ অনুষ্ঠান টেলিভিশনে সরাসরি দেখালেও যখন দেখানো হতো না তখন সংবাদপত্রের রিপোর্টারের ওপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। সাংবাদিকরা ছাড়া সংসদে তারা যে কথা বলেন তা তাদের এলাকাবাসীর কাছে পৌছানোর সুযোগ ছিল না। সংসদ কভার করা রিপোর্টারদের মন্ত্রীদের কাছে বলতে গেলে অবাধ প্রবেশাধিকার থাকে। এমনকি কারো যদি কোনো ব্যক্তিগত কাজ, এলাকার কোনো সমস্যা থাকে লালফিতার জটিলতায় না পড়ে তা সহজে করিয়ে নেয়া যায়। অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার পূর্ণ করার জন্য সংসদ এক অপূর্ব স্থান।

তবে সংসদ রিপোটিংয়ে সতর্ক না থাকলে আপনাকে চরম বিপদে পড়তে হয়, সে অভিজ্ঞতাও হয়েছে আমার। একটু বিস্তারিতভাবেই সে বিপদের কথা উল্লেখ করতে চাই। পার্লামেন্টের ‘ইন-ক্যামেরা সেশন’ এর সরল অর্থ হলো, “যে বৈঠকে পার্লামেন্ট বা পার্লামেন্টারি কোন বহিরাগত, এমনকি গণমাধ্যমেরও প্রবেশাধিকার নেই, এবং যে বৈঠকের কোন বিষয়বস্তু কোনভাবেই প্রচার করা যাবে না। বৈঠকের কার্যক্রমের কোন অংশ কারও দ্বারা বাইরে প্রকাশ পেলে স্পিকার বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।” এই উদ্ধৃতি অথবা ‘ইন-ক্যামেরা সেশন’ এর সংজ্ঞাটি উল্লেখ করতে হলো পার্লামেন্ট রিপোটিং করতে গিয়ে প্রায় চার দশক আগে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে আমার চরম বিপদে পড়ার ঘটনায়। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের অভিজ্ঞতা যেমন সূখকর নয়, আমার সংসদ সূচনাও তেমন প্রীতিকর ছিল না। স্বাধীনতার পর প্রথম থেকে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের কোনটিই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। কোনো না কোনো কারণে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম মেয়াদ ছিল ষষ্ঠ সংসদের। মাত্র ১২দিন। সংসদ কভার করতে গিয়ে অনভিজ্ঞতাজনিত অসতর্কতার কারণে উদ্ভুত পরিস্থিতি স্মরণ করাই আমার উদ্দেশ্য। সে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বিতীয় পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে নবম সংসদ পর্যন্ত টানা পার্লামেন্ট কভার করেছি। পার্লামেন্ট রিপোর্টিং এ আর কখনো ভুল করিনি বা অসতর্ক হইনি, বরং নবীশ পার্লামেন্ট রিপোর্টারদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে পেরেছি।

আমি আগেও বলেছি যে আমার নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু ১৯৭৭ সাল থেকে। তখন ঢাকায় দৈনিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। শুরু করেছিলাম দৈনিক সংগ্রামের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার হিসেবে। আমার সাংবাদিকতার বয়স হয়েছে মাত্র দুই বছর। সালাহউদ্দিন বাবর এবং আমার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সংসদের যাবতীয় বিষয় আমাদের দু’জনকে কভার করার। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে পার্লামেন্ট ভবনে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দফতর) যাতায়াত শুরু করি। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উত্তেজনায়। আমাদেরকে ধরিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশের সংবিধান, জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। যারা আগে জাতীয় সংসদ কভার করেছেন সেইসব বড় ভাই রিপোর্টারদের প্রশ্ন করে নিয়মকানুন জেনে নেই। একজন পেশাজীবী সাংবাদিকের জন্য দেশের প্রতি, জনগণের প্রতি কমিটমেন্ট থাকা জরুরী। কমিটমেন্ট না থাকলে এটি অন্য যে কোনো পেশার মতো শুধু রুটিরুজি অর্জন করায় পেশায় পরিণত হতো। একজন সাংবাদিকের কমিটমেন্ট থাকে বলেই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে পারেন। সে ঝুঁকি যুদ্ধক্ষেত্রে হোক, প্রাকৃতিক বা মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে হোক, কারও হুমকির মধ্যে হোক। তাদের এই কমিটমেন্টের কারণেই জনগণ অপেক্ষা করে তারা কি খবর পরিবেশন করেন তা জানার জন্য। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা বেছে নিয়ে আমি ভুল করেছি, কখনো এমন মনে হয়নি।

জহিরুলঃ অজ্ঞতার কারণে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছিল বোধ হয় শুরুর দিকেই?

মঞ্জুঃ হ্যাঁ, একদিন হঠাৎ করেই একটি ঘটনা ঘটে গেল। দিন তারিখ খেয়াল নেই। সংসদ বৈঠকের বিরতির সময় লবিতে চরম হট্টগোল। আমরা ক্যাফেটেরিয়ায় ছিলাম। দৌড়ে লবিতে এলাম। জানা গেল, বিএনপির তরুণ এমপি রুহুল আমিন হাওলাদার পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী, মুসলিম লীগের সংসদ সদস্য কাজী কাদেরের গালে কষে চড় মেরেছেন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিএনপির সিনিয়র এমপি’রা বিরোধী দলীয় নেতাদের সামলাতে চেষ্টা করছেন। বিরোধী দলের সদস্য সংখ্যা কম থাকলেও প্রায় সকলেই জাঁদরেল নেতা। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজ, সংসদ উপনেতা ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ মন্ত্রীরা কলহ থামাতে সাধ্যমত চেষ্টা করছেন। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। পুরো অচলাবস্থা। আমরা উৎকন্ঠার সাথে অপেক্ষা করছি, শেষ পর্যন্ত কি হয় তা দেখার জন্য। শাহ আজিজ কোনোমতে বিরোধী দলের নেতাদের তার রুমে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। আধা ঘন্টা বা পৌনে এক ঘন্টা পর তারা গেলেন স্পিকার মির্জা গোলাম হাফিজের রুমে। সাংবাদিক গ্যালারির ফোন থেকে অফিসে জানিয়ে দিয়েছি কলহের ঘটনা। আমাদেরও উৎকন্ঠা বাড়ছে। সংসদের ক্যাফেটেরিয়া থেকে সিঙ্গারা ছাড়া সারাদিন আর কিছু খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বেড়ে চলেছে। রাত দশটার পর আমাদেরকে জানানো হলো, সংসদ ক্যামেরা সেশনে বসবে। ক্যামেরা সেশন কি, তাও জানতাম না তখন। সিনিয়ররা ব্যাখ্যা করলেন, অধিবেশন চলাকালে সংসদ সদস্যরা ছাড়া আর কেউ এসেম্বলি চেম্বারে থাকতে পারবে না। কৌতুহলী হয়ে আমরা কয়েকজন রিপোর্টার তড়িঘড়ি সাংবাদিক গ্যালারিতে গিয়ে বসলাম। দেখি শেষ পর্যন্ত কি হয়। যখন ঘন্টা বাজতে শুরু করলো তখন সিকিউরিটির লোকজন এসে আমাদেরকে বের করে নিয়ে গেল। বলে দেয়া হলো, আমরা এমনকি লবিতেও থাকতে পারবো না। অনন্যোপায় হয়ে আমরা কখনো ক্যাফেটরিয়ায়, কখনো সামনের লনে ঘোরাফেরা করে সময় কাটাচ্ছিলাম। রাত বেড়ে চলেছে। অফিস বংশালে, বাবর ভাই থাকেন গেণ্ডারিয়ায়, আমি থাকি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। তখনকার সংবাদপত্রে মধ্যরাতের পরও রিপোর্ট দেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু কখন শেষ হবে এই ক্যামেরা সেশন। সংসদ ক্যামেরা সেশনে বসার পূর্ব পর্যন্ত কি ঘটেছে তা ফাঁকে ফাঁকে লিখে ফেলেছিলাম। কাজী কাদেরকে চড় মারার ঘটনার পুরো বিবরণ ছিল এতে। রাত ১টা বাজার পর আমি ও বাবর ভাই সিদ্ধান্ত নিলাম, আর নয়, যতোটুকু লিখেছি, সেটাই অফিসে পাঠাব। বাবর ভাই এর বাসা যেহেতু গেন্ডারিয়ায়, তিনি অফিসে রিপোর্ট দিয়ে চলে যাবেন।

সকালে সাধারণত অফিসে যাওয়া হয়না। কিন্তু রাতে সংসদে কি ঘটলো তা জানার আগ্রহে সকালে অফিসে গিয়েই শুনলাম, সংসদের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক জনাব মুহাম্মদ উল্লাহ আমাকে তলব করেছেন। আমার অপরাধ, সংসদের ‘ক্যামেরা সেশন’ এর কারণ এবং আনুষঙ্গিক ঘটনা, যা প্রকাশ আইনত নিষিদ্ধ, তা সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে, যা অন্য কোন সংবাদপত্র প্রকাশ করেনি। সংগ্রামের সম্পাদকসহ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষও উদ্বিগ্ন যে, সংসদ শুধু আমার বিরুদ্ধেই নয়, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে তাদের পরিচিত সিনিয়র সংসদ সদস্য, আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। সবার পরামর্শ, নিস্কৃতির উপায় একটাই, নি:শর্ত ক্ষমা প্রার্থনা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের রিপোর্টিং না করার মুচলেকা দেয়া। তথ্য অধিদফতরের উপ প্রধান তথ্য অফিসার দেওয়ান সাহেব রাজশাহীর লোক বলে সম্পাদকের পরিচিত, আমাদের সাথেও বেশ ঘনিষ্ট। ওই সময়ে তিনি সংসদের জনসংযোগ বিভাগের উপ-পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি সংসদে গিয়েই যাতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। কি করতে হবে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবেন তিনি। কম্পিত বক্ষে দেওয়ান সাহেবের অফিসে গেলাম। সাথে বাবর ভাইও আছেন। তিনি নিয়ে গেলেন জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ উল্লাহ’র অফিসে এবং বললেন, ‘আসামী হাজির।’ একবার চোখ উঠিয়ে আমাকে দেখে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলেন। ফাইল শেষ করে আমার দিকে ফিরে বললেন, “তুমি তো সর্বনাশ করেছো। নিজের বিপদ ডেকে এনেছো, আর আমাদের জন্যও ঝামেলা বাঁধিয়েছো। সকালে সংবাদটি দেখার পর থেকেই স্পিকার সাহেব ক্ষেপে আছেন।” তিনি কাগজ এগিয়ে দিলেন। কি লিখতে হবে তা একটি একটি করে লাইন বললেন। আমি লিখছি, আর ঘামছি। লেখা শেষে তিনি পড়লেন, কাটাকুটি করলেন। এভাবে মুচলেকা পত্রের কয়েকটি খসড়া লেখার পর একটি চূড়ান্ত হলো। টাইপিষ্টকে বললেন টাইপ করতে। টাইপ করার পর আমি স্বাক্ষর করলাম। মুহাম্মদ উল্লাহ সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন জাতীয় সংসদের সচিব জালাল উদ্দিনের অফিস রুমে। জালাল উদ্দিন অত্যন্ত সজ্জন লোক। মুহাম্মদ উল্লাহ আমার পরিচয় জানালেন তাঁকে এবং তাঁর হাতে আমার মুচলেকাপত্রটি তুলে দিলেন। তিনি সেটিতে চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘ইয়ং ম্যান, পার্লামেন্ট রিপোর্টিং করতে হলে ম্যাচিউরড হতে হবে।’ স্পিকারের অসীম ক্ষমতা। আপনার কাগজে যা ছাপা হয়েছে, তার উপর তিনি যদি কোন রুলিং দেন, তাহলে সেই রুলিং প্রত্যাহার না পর্যন্ত সেটিই বহাল থাকবে।’ তিনি আশ্বস্ত করলেন, স্পিকারকে তিনি আমার মুচলেকা পত্রটি দেবেন এবং পরদিন যেন আমি তাঁর অফিসে গিয়ে সিদ্ধান্ত জেনে নেই।

আমার দিন কাটে না। সেদিন সংসদ কভার করলেও মন বসাতে পারিনি। গ্যালারিতে দেওয়ান সাহেব দু’একবার এসে পিঠ চাপড়ে গেছেন, “ডোন্ট ওরি।” পরদিন আবার গেলাম মোহাম্মদ উল্লাহ সাহেবের অফিসে। তিনি নিয়ে গেলেন সচিব জালাল উদ্দিনের অফিসে। তিনি বললেন যে, স্পিকার মহোদয় আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং ভবিষ্যতে সতর্কতার সাথে যাতে রিপোর্টিং করি সেজন্য আপনাকে বলতে বলেছেন। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। এমন একটি শিক্ষার পর শুধু পার্লামেন্ট রিপোর্টিং নয়, যে কোন রিপোর্টিং এর ক্ষেত্রে ‘চেক,’ ‘রি-চেক’, ‘ডাবল চেক’ শব্দগুলো মাথায় রেখে কাজ করেছি। সম্ভবত রিপোর্টিং এ গুরুতর কোন ভুলও আর করিনি।

জহিরুলঃ কখনো কি মালিক পক্ষের চাপে নীতির সাথে আপোষ করেছেন? আপোষ করা বা না করার দুয়েকটি অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

মঞ্জুঃ সংবাদপত্রে নীতির বিষয়টি দেখেন সম্পাদক। সংবাদপত্রের নীতির সাথে আমার ব্যক্তিগত নীতির কোনো সম্পর্ক নেই। সংবাদপত্রের মালিকদের নীতি সম্পাদকের মাধ্যমে অনুসরণ করা অন্য সকলের দায়িত্ব। তবে ব্যক্তিগত ও পেশাগত বিরোধের মোকাবিলা অবশ্যই করতে হয়েছে এবং সেক্ষেত্রে আমি কখনোই আপোষ করিনি। এ কারণে দৈনিক সংগ্রামেই আমাকে বেশি দুর্ভোগ পোাহাতে হয়েছে। ১৯৯২ সালে মালিকপক্ষের ইচ্ছায় আমি সংগ্রামের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সম্পাদক সাহেব আমাকে এই পদে পছন্দ করতে পারেননি। আমার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি, বরং পদে পদে আমাকে বাধাগ্রস্থ করেছেন। আমি দায়িত্বটি এড়ানোর চেষ্টা করছিলাম এবং কোনো প্রোগ্রামের অজুহাতে দেশের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা চাালিয়ে যাচ্ছিলাম। কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিষ্ট্যান্সের আওতায় দিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টের সাথে সংশ্লিষ্ট ইন্সটিটিউট অফ কন্সটিটিউশনাল এণ্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজ এ ছয় মাসের একটি ফেলোশিপ করার সুযোগ পেয়ে ১৯৯২ সালের নভেম্বর মাসে আমি ভারতে চলে যাই। সেখানে অবস্থানের ওপর আমি কমবেশি আগেই বলেছি। ফেলোশিপ শেষে ফিরে আসার পর দেখতে পাই কর্মস্থলে আমার জন্য এক বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন সম্পাদক সাহেব। আমাকে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দিতে বলা হয়। আমার ইগোতে লাগে। আমি অনড় অবস্থান গ্রহণ করি। আমি তো বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেয়ার উদ্দেশ্যেই ভারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু অব্যাহতি বিধিসম্মতভাবে হতে হবে। মালিক পক্ষ আইনি বৈধতা উপলব্ধি করে এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আমাকে বার্তা সম্পাদক পদে বহাল করেন। আমি ৭ দিন দায়িত্ব পালন করে পদত্যাগ করি এবং পূর্ব পদ বিশেষ সংবাদদাতা পদে ফিরে যাই। কিন্তু সম্পাদকের বৈরী আচরণের কারণে পরবর্তী প্রায় চার বছর আমার কোনো একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি। অফিসে গেছি, মাস শেষে বেতন পেয়েছি। আমার জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিল। কিন্তু আমি অপেক্ষা করছিলাম, এই ভালো মানুষগুলো কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তা দেখার জন্য। বলতে পারেন সুনীলের কবিতায় ‘কারো ভেতরের কুকুর দেখার জন্য’ আমি অপেক্ষা করছিলাম। আমার কুকুর দেখা হয়। ১৯৯৬ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। দ্বিতীয় একটি ঘটনা ঘটেছিল দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে। ওই সময় পত্রিকাটির চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন কবি শামসুদ্দিন হারুন। রিপোর্টার হিসেবে নির্ভরযোগ্য ও সজ্জন। একবার তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর একটি রিপোর্ট করেন। আপত্তিকর কিছু ছিল না রিপোর্টে। কিন্তু কেউ মালিক সম্পাদক জাকারিয়া খানকে রিপোর্টের দোষনীয় দিক বের করে দেখান। জাকারিয়া খান সাংবাদিক নন। কানকথা শুনতে পছন্দ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চতর ডিগ্রি নিলেও সেই শিক্ষিত মানুষের কোনো শালীনতা ছিল না তাঁর মধ্যে। সাংবাদিকতার রীতিনীতি বোঝেন না। মানুষকে মর্যাদা দিতে জানেন না। প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। অর্থ দিয়ে সবকিছু বিচার করতেন। যেহেতু তিনি শ্রমিক নির্ভর কলকারখানা চালাতেন, মনমানসিকতার দিক থেকেও ওপরে ওঠতে পারেননি। তিনি সাত-পাঁচ না ভেবে আমাকে একটি কারণ দর্শাও নোটিশ দেন। কারণ দর্শানোর নোটিশ আমার হাতে আসার সাথে সাথে পদত্যাগপত্র লিখে জেনারেল ম্যানেজারের হাতে দিয়ে চলে আসি।

জহিরুলঃ ভাষা আন্দোলন থেকে নব্বুইয়ের গণআন্দোলন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে, গণমানুষের দাবী আদায়ের সংগ্রামে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) যারা নেতা ছিলেন, বিশেষ করে ভিপি, জিএস এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। রাশেদ খান মেননও এই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া একজন নেতা। বাম ধারার ওয়ার্কাস পার্টির প্রধান ব্যক্তি। কিন্তু পরবর্তি সময়ে আমরা দেখি মন্ত্রী হওয়ার জন্য অন্য অনেক স্খলিত নেতার মতো তিনিও নীতিভ্রষ্ট হন, রাজনীতির ক্লাউনে পরিণত হয়েছেন। আপনি তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। কাছে থেকে দেখা এবং সাংবাদিকের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখা রাশেদ খান মেনন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?

মঞ্জুঃ দেশে গণআন্দোলন বলতে যে ক’টি আন্দোলন হয়েছে, সব ক’টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাই নয়, বরং যখন যে আন্দোলন হয়েছে সেই আন্দোলনকে নির্দিষ্ট আকার দিয়েছে, গতি সৃষ্টি করেছে এবং আন্দোলনকে সফলতার পথে এগিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং গণআন্দোলন যেন সমার্থক ছিল। সারা দেশ, সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা তাকিয়ে থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কী কর্মসূচি দেয়া হয় তা দেখতে। ভাষা আন্দোলনকে উত্তুঙ্গে তোলার ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দিয়েছিলেন ওই সময় ডাকসুতে নির্বাচিত ছাত্র নেতারাই। অবশ্য তারা তখন কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব করতেন না বা এখনকার মতো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য সৃষ্ট ছাত্র সংগঠনের নেতাও ছিলেন না। দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া ১৯৬৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত ডাকসুতে যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হয়েছেন। পরবর্তীতে তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দলীয়ভাবে ডাকসুতে নির্বাচনের ধারা যখন শুরু হয় তখন, ১৯৬৩-৬৪ সালে, ডাকসুর ভিপি ও জিএস পদে নির্বাচিত হন যথাক্রমে রাশেদ খান মেনন ও বেগম মতিয়া চৌধুরী। তারা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিনিধি ছিলেন। এরপর ডাকসুর সব নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু দু:খজনক হলো, বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে বেশির ভাগ সময়েই নানা জটিলতার অজুহাতে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ’ বছর পূর্ণ হয়েছে। ডাকসু’র মেয়াদ এক বছরের। সে হিসেবে ডাকসু’র একশ’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র ২৬ বার। নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় নেতৃত্বের সুষ্ঠু বিকাশ ঘটার ক্ষেত্রেও বাঁধা সৃষ্টি হয়েছে।

রাশেদ খান মেনন রাজনৈতিকভাবে আলোকিত এক পরিবারের সন্তান। তাঁর পিতা আবদুল জব্বার খান মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন এবং ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ভাইবোনদের অনেকই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর ভাই এজেডএম ওবায়দুল্লাহ খান, এজেডএম এনায়েতুল্লাহ খান ও বোন সেলিমা রহমান বিভিন্ন সরকারের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস তাঁর জ্ঞাতি বোনের স্বামী ছিলেন। মেনন নিজেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের মন্ত্রী ছিলেন। দেশের রাজনীতির সাথে, বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতির সাথে এভাবে জড়িত থাকা পরিবারের সংখ্যা খুব কম। রাশেদ খান মেনন ছাত্রজীবনেই বাম ধারা বেছে নেন। এক পর্যায়ে বাম ধারায় চীন ও সোভিয়েত ব্লকের পক্ষাবলম্বনের প্রশ্নে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে যায় এবং দুটি অংশের মধ্যে রাশেদ খান মেনন চীনা কমিউনিজম এবং বেগম মতিয়া চৌধুরী সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডা তুলে ধরে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) নামে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমে পড়েন। কিন্তু মেননের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ছিল যে তিনি তাঁর ছাত্র সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পারেননি। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) বেশ শক্তিশালী ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। মেনন মাওলানা ভাসনীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দিয়ে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু জয়ী হতে পারেননি। এরপর তিনি কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে (ইউপিপি), এবং এক পর্যায়ে ইউপিপি থেকে সরে এসে ওয়াকার্স পার্টি গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন। এভাবে দল বদলের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক অবস্থান নির্ণয়ে তাঁর অস্থিরতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাঁর স্বৈরশাসনকে বৈধ রূপ দিতে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘোষণা করেন। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য ছোট দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টিও নির্বাচনে অংশ নেয়। ওই সময়ে গুজব ছিল যে বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে আনার জন্য এরশাদ দলগুলোর নেতাদের প্রচুর অর্থ প্রদান করেন এবং এ অর্থ বিতরণের দায়িত্ব ছিল ওই সময় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নাজিউর রহমান মঞ্জুর এর ওপর। অর্থ গ্রহণকারীদের মধ্যে রাশেদ খান মেননও ছিলেন। তার দল ওই সংসদে তিনটি আসন পেয়েছিল। এরপর তার রাজনীতির পুরোটাই স্খলনের রাজনীতি। ক্ষমতার জন্য বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য আদর্শ ত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হননি। আদর্শের প্রশ্নে যে মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে ছাত্র ইউনিয়নকে বিভক্ত করেছিলেন, এরশাদ ও বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে সেই মতিয়া চৌধুরীর সাথে রাজপথে আন্দোলন করেছেন এবং একই মন্ত্রীসভায় বসেছেন। তারা প্রমাণ করেছেন রাজনীতি আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা জনগণের কল্যাণের জন্য নয়, মন্ত্রী হওয়ার জন্য।

আমি এই পরিবারের চার ভাইয়ের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি। এনায়েতুল্লাহ খান, এজেডএম ওবায়দুল্লাহ খান, সাদেক খান ও রাশেদ খান মেননের। মেননের সাক্ষাৎকার নেয়ার আগেই তাঁকে কাছে থেকে জানার সুযোগ হয়েছে ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথমবার জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর। তরুণ রিপোর্টার হিসেবে সংসদ কভার করার জন্য আমাকে যেমন অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল, নতুন সংসদ সদস্যদেরও অনেক কিছু শিখতে হতো। সংসদে কথা বলতে হলে কার্যপ্রণালী বিধির কোনো না কোনো ধারা অনুযায়ী বলতে হবে। এর বাইরে কিছু বলার সুযোগ দেবেন না স্পিকার। সংসদে শেখার শেষ নেই। মেননও শিখছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে প্রায়ই মতবিনিময় হতো তাঁর। ১৯৮২ সালের মার্চে এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করেন। রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ ছিল। এক বছর পর ১৯৮৩ সালে আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় রাজনৈতিক নেতাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য। আমি যাদের নেতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি তাদের মধ্যে রাশেদ খান মেননও ছিলেন। সাংবাদিকদের সাথে তিনি খুব স্বচ্ছন্দ। এক সকালে তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টির অফিসে গেলাম। তিনি অপেক্ষা করছিলেন। সংবাদপত্রে ছোট দলগুলোর কথা কমই প্রকাশিত হয়। এমনকি প্রেস রিলিজ পাঠানো হলেও অনেক সময় তা অগ্রাহ্য করা হয়। অতএব সামরিক শাসনের সময় কোনো সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে তাঁর ও তাঁর দলের লাভ। রাশেদ খান মেননের মুখে স্মিত হাসি থাকে, কিন্তু তিনি বিনয়ী নন। যেহেতু রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ, অফিসে দু’একজন লোক ছাড়া নেতাকর্মীর ভিড় নেই। তিনি চা দিতে বলে আমাকে তাঁর রুমে যান। দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার কাছেই তিনি জানতে চাইলেন। যতোটা জানি বললাম, পরিস্থিতির ওপর তাঁর মূল্যায়ন জানতে চাইলাম। তিনি বার বার বলছিলেন, এগুলো কিন্তু অফ দ্য রেকর্ড। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি। সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ বহাল, এসব কথা এমনিতেই প্রকাশ করা যাবে না। আনুষ্ঠানিক প্রশ্নোত্তর পর্বে তাঁর রাজনীতিতে আগমণ, বাম ধারার রাজনীতিতে দীক্ষা গ্রহণ, পিতার মুসলিম লীগের রাজনীতির পটভূমিতে তাঁর বাম রাজনীতির কারণে কোনো দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয়েছিল কিনা, ছাত্র ইউনিয়নের ভাঙন এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বেশ খোলামেলা আলোচনা হয়। বামপন্থীদের সঙ্গে আলোচনার বড় সমস্যা হলো তারা কথায় কথায় তত্ত্ব জাহির করেন। অংকের ফর্মূলার মতো অথবা গেরিলা যুদ্ধের কৌশলের মতো রাজনীতি করতে চান, বাস্তবের সাথে মিল থাকুক আর না থাকুক। তিনি চীনের মাওবাদের মোক্ষম প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রেনি-বিভক্ত সমাজকে ভেঙে শ্রেনিহীন সমাজ গড়ে তোলার সংকল্প ব্যক্ত করেন এবং সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ত্রুটিগুলো প্রদর্শন করেন। পিতার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল, পিতার রাজনীতি নিয়ে তাঁর আপত্তি নেই। মেননের রাজনীতি আইয়ুব খানের দলন, পীড়ন, শোষণ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে। পিতার সাথে রাজনীতি নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। তিনি তাঁর সন্তানদের ওপর কোনোকিছু আরোপ করতে চাননি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেহেতু তাঁর ভাষায় বুর্জোয়া ও ধনীক শ্রেনির হাতে, তাঁর দলের মতো ছোট দলের পক্ষে বুর্জোয়া নেতৃত্ব খতম করে শ্রেনিহীন সমাজ গড়ার স্বপ্ন সফল করতে পারবে কিনা জানতে চাইলে বলেন যে, তাদের রাজনীতিতে স্বপ্ন দেখার স্থান নেই। কাজের মধ্য দিয়ে সবকিছু বাস্তবায়ন করাই তার দলের লক্ষ্য এবং তিনি আশাবাদী যে তিনি বাংলাদেশে শ্রেনিহীন সমাজ ও কৃষক শ্রমিকের প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব দেখে যাবেন। রাশেদ খান মেননের বয়স এখন ৭৭ বছর। তার দল বা সমমনা দলগুলো মিলেও শ্রেনিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার ধারে কাছে পৌছুঁতে পারেনি। তিনি যাদেরকে বুর্জোয়া বলতেন তাদের সাথে হাত মিলিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন এবং মন্ত্রীত্ব হারানোর ভয়ে সরকারের আপত্তিকর কাজেও তার সমর্থন দিয়ে বাম রাজনীতির আদর্শকে কলঙ্কিত করেছেন। আমাদের দেশে বলা হয়ে থাকে, মাছের পচন শুরু হয় মাছের মাথা থেকে, বাম নেতাদের পচনও মাথা থেকেই শুরু হয়। রাশেদ খান মেনন, বেগম মতিয়া চৌধুরীরা তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

জহিরুলঃ সফল সিনেমায় যেমন খলনায়কের চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ, ইতিহাসেও খলনায়কদের ভূমিকা বারবারই আলোচনায় আসে। আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন খলনায়ক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তিনি রাষ্ট্রপতি হন, অনুগতদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। তার চেয়েও খারাপ কাজ যেটি করেন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে এই অপরাধের বিচার প্রক্রিয়াকে আটকে রাখেন। আপনি এক পর্যায়ে তার ইন্টারভিউ করেন, কেমন দেখেছেন তাকে?

মঞ্জুঃ খন্দকার মোশতাক আহমেদ সম্পর্কে আমার সবসময় কৌতুহল ছিল। ছোটখাট আকৃতির মানুষটি নাকি রাজনীতিতে তুখোড় ছিলেন। আওয়ামী লীগেও সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। এমনকি তাঁর সম্পর্কে বলা হতো, শেখ মুজিবুর রহমান দলের সকল শীর্ষ নেতাকে ‘তুই’ এবং কিছু সংখ্যককে ‘তুমি’ সম্বোধন করলেও খন্দকার মোশতাক ও অবাঙালী আওয়ামী লীগার জহিরউদ্দিন খানকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতেন। এর সত্য মিথ্যা জানি না। রাজনীতিতে তিনি সবসময় লাইমলাইটে ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তাঁর তৎপরতার খবর বেশি প্রচারিত হতো। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য সবসময় ব্যস্ত থাকতেন, ওই সময় যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুদ্ধ যখন শেষ পর্যায়ে তখন পাকিস্তান নিজেদের শোচনীয় অবস্থা দেখে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালায়। পাকিস্তানের এ চেষ্টা সফল হয় খন্দকার মোশতাক ও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক প্রতিনিধির সাথে আলোচনার পর চাষী পাকিস্তানের সাথে আলোচনা শুরু করার জন্য মোশতাকের সঙ্গে একমত হন; অর্থ্যাৎ আওয়ামী লীগৈর ৬ দফার আলোকে পাকিস্তানের সাথে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান। তা না হলেও অন্তত পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার মতো একটি উপায় উদ্ভাবন। যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে জানা গেছে এবং অনেক বইয়ে এ ধরনের তথ্য রয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে এমন বার্তা আসে যে মোশতাক পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। মোশতাকের ভূমিকা বিতর্কিত হয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রবাসী সরকার বাংলাদেশে আসার পর বিতর্কিত ভূমিকার অভিযোগে খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী করা হয়। এর প্রতিবাদে মোশতাক মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। কয়েক বছর আগে ডেইলি স্টারের এক রিপোর্টে পড়েছিলাম যে, মোশতাক পদত্যাগ করার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া হাসপাতালে মোশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরাও অস্ত্র হাতে ঘুরছে, এসব বিবেচনা করে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করলে তিনি এই শর্তে পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন যে শেখ মুজিব পাকিস্তান থেকে ফিরে এলে ওয়াজেদ মিয়া তাঁর মন্ত্রীত্বের জন্য তদবির করবেন। কিন্তু মোশতাকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ শেষ পর্যন্ত ছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম সরকারেও খন্দকার মোশতাক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এমনকি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদকে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয় খন্দকার মোশতাকের হাতে। এ নিয়ে ওই সময়েই অনেক কানাঘুষা ও বিতর্ক ছিল। আমার কাছে এখনো বিস্ময়ের ব্যাপার যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোশতাকের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সঙ্গে ঐক্য প্রচেষ্টায় যোগসূত্র থাকার অভিযোগ, কিছু প্রমাণ থাকা এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ে মোশতাকের ব্যাপারে আপত্তি থাকা সত্বেও তিনি মন্ত্রীসভায় ফিরে এলেন কীভাবে?

খন্দকার মোশতাক প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেকে খলনায়ক হিসেবে প্রমাণ করেন কিছু সংখ্যক সেনা অফিসারের দ্বারা ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে। তিনি ঘাতক সেনা অফিসারদের সূর্যসন্তান হিসেবে প্রশংসা করেছিলেন। তখনো জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়নি। সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মৃত্যু বা অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা জাতীয় সংসদের স্পিকারের। ওই সময় স্পিকার ছিলেন আবদুল মালেক উকিল। এ নিয়ে সংসদে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু পরিস্থিতি কারো নিয়ন্ত্রণে ছিল না। ফলে সংসদ ভেঙে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর ৮৩ দিনের দায়িত্ব পালনকালে তিনি যে অপকর্মগুলো করেন তার মধ্যে “ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ” আদেশ জারি করে শেখ মুজিবের হত্যার সাথে জড়িত সেনা অফিসারদের অপরাধ থেকে দায়মুক্তি দেয়া এবং তাদেরকে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে নিয়োগ দিয়ে নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া, প্রচলিত বিষয়গুলোর মধ্যে “জয় বাংলা’র বদলে “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ” স্লোগান চালু করা, কারাগারে আটক চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটানো, এসব কারণে ধরেই নেয়া হয় যে, খন্দকার মোশতাক শেখ মুজিবসহ প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে নীরবে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি সেনা কর্মকর্তাদের হাতের পুতুল ছিলেন তা খুব কম লোকই বিশ্বাস করে। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর তিনি পাল্টা এক সেনাবিদ্রোহের পর ৬ই নভেম্বর রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অপসারিত হন এবং বিচারপতি আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়ে দেশে সামরিক আইন জারি ও তাঁকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করা হয়।

খন্দকার মোশতাক ডেমোক্রেটিক লীগ নামে একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার আগেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বেশ কিছু দুর্নীতির মামলাও হয় তাঁর বিরুদ্ধে, বিচারে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাগার থেকে বের হয়ে ১৯৮১ সালের কোনো এক সময়ে তাঁর দলের পক্ষ থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে এক জনসমাবেশের আয়োজন করেন। সেদিন আমি ও বাবর ভাই সংসদে ছিলাম। আমাদের চিফ রিপোর্টার মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, যিনি পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংকের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি সেদিন সংসদে না এসে খন্দকার মোশতাকের সমাবেশ কভার করতে যান। সন্ধ্যার আগে খবর এলো, মোশতাকের সমাবেশে বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে এবং সভায় সাপ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিস্ফোরণে এবং সাপের আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে গিয়ে সাংবাদিকসহ বহু লোক হতাহত হয়েছে। আহত সাংবাদিকদের মধ্যে আমাদের চিফ রিপোর্টার মোহাম্মদ আবদুল মান্নানও আছে। বাবর ভাইকে বললাম, আপনি হাসপাতালে যান। আমি সংসদ সামলাই। যাহোক, এ ঘটনার পর থেকে খন্দকার মোশতাক আর জনসমক্ষে বের হননি। তার দলের তৎপরতাও তেমন দেখা যায়নি।

এরশাদ ক্ষমতা দখল করে প্রথমে রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। এরপর ঘরোয়া রাজনীতি বা সীমিত রাজনৈতিক তৎপরতার অনুমতি দেন। রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার পর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হতে বেশি সময় লাগেনি। আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশের তৎপরতা ছিল নারকীয়। মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দেয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটে। দু’জন ছাত্র নিহত হয় দ্রুতগামী ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে। দমন যতো বাড়ে আন্দোলনের তীব্রতাও বেড়ে চলে। এমনি এক সময়ে আমরা বেশ ক’জন রিপোর্টার ও ফটো সংবাদিক নিমতলী, সিদ্দিক বাজার এলাকায় বিক্ষোভ ও পুলিশী তৎপরতা দেখার জন্য কর্তব্যরত ছিলাম। অবস্থা একটু শান্ত হলে সম্ভবত দৈনিক বাংলার সিনিয়র ফটো সাংবাদিক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রস্তাব করলেন কাছেই আগামসিহ লেনে খন্দকার মোশতাকের বাড়িতে যাওয়ার। জামান ভাই ওই এলাকার বাসিন্দা। আমরা দশ-বারোজন সাংবাদিক সম্মত হলাম। আগামসিহ লেনের খন্দকার মোশতাকের বাড়ি আগে থেকেই পরিচিত। সবসময় গেটের সামনে দু’জন পুলিশ সদস্য প্রহরারত থাকে। আমরা গেটে উপস্থিত হলে পুলিশ জেরা করলো। অনুমতি আনতে একজন ভেতরে গেল। খন্দকার মোশতাক অনুমতি দিয়েছেন। আমরা দোতলায় গেলাম। খন্দকার মোশতাক এগিয়ে এসে স্বাগত জানালেন। কয়েকজন সাংবাদিক তাঁর পরিচিত। তাদেরকে বললেন, আপনারা তো ভুলেই গেছেন যে, আমি দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। তাঁর বাড়িটি পুরনো। এত বেশি সংখ্যক লোকের একসাথে বসার সুযোগ নেই ড্রয়িং রুমে। আমাদেরকে একতলার ছাদে নিয়ে গেলেন। সেই প্রথম খন্দকার মোশতাককে সামনাসামনি দেখি। তিনি কাউকে ডেকে চা দিতে বলেন। সিনিয়ররা আপত্তি করে বলেন, আমরা শুধু আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি। এদিকেই দায়িত্ব পালন করছিলাম, তাই আসা হলো। আলাদাভাবে আসা হয়ে উঠতো না। অনেকে তাঁর সাথে ছবি তোলার আগ্রহ দেখালে তিনি ছবি তুলতেও সাড়া দেন। আমিও তাঁর সাথে ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু জামান ভাইয়ের কাছ থেকে ছবি নেয়া হয়নি। হালকা কথাবার্তার পর আমরা বিদায় নিয়ে চলে আসি।

জহিরুলঃ কখন তাঁর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন?

মঞ্জুঃ এর প্রায় তিন বছর পর এরশাদের পতনের আগে আমার ওপর দায়িত্ব পড়ে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাক্ষাৎকার নেয়ার। তার নাম্বারে ফোন করি। কেউ ফোন ধরে আমার পরিচয় ও ফোন করার উদ্দেশ্য জানতে চায়। আমি আমার পরিচয় দেই ও উদ্দেশ্য বলি। খন্দকার মোশতাক ফোনে আসেন। তাঁর কাছেও পরিচয় দিয়ে উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলি। আমাকে লাইনে রেখে তিনি একটু সময় নেন। দুই-তিন মিনিট পর ফিরে এসে একটা তারিখ ও সময় ঠিক করে দেন। নির্ধারিত দিনে যথাসময়ে তাঁর বাড়ির গেটে উপস্থিত হয়ে প্রহরারত পুলিশকে আগমনের কারণ বলি, আমার কার্ড দেই। পুলিশ কার্ড নিয়ে দোতলায় যায়। একটু পর ফিরে এসে আমাকে ওপরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে। ভেতরে প্রবেশ করে একটি রুমের বাঁক ঘুরে বামে ড্রয়িং রুমে ঢুকি। রুমে ঝুলানো একটি দোলনায় খন্দকার মোশতাক দুলছেন। এর আগে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে এসেছিলাম, সেদিন আমরা ড্রয়িং রুমে প্রবেশ না করায় দোলনাটি চোখে পড়েনি। আমাকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি দোলনা থেকে ওঠলেন। আমার মুখোমুখি বসে জানতে চাইলেন, “তা আপনি এবং আপনারা কেমন আছেন-টাছেন? সব খবর ভালো-টালো তো? আপনি জানেন-টানেন তো আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলাম?” তাঁর প্রতিটি বাক্যে এমন দ্বিরুক্তিসূচক শব্দ। আমি ভালো থাকার কথা বলি। তাঁর খবর জানতে চাই। এসময় একজন লোক প্রবেশ করেন। তাঁর এলাকা দাউদকান্দি থেকে এসেছেন। সাধারণ গ্রামীণ চেহারা। খুব প্রয়োজনে এসেছেন। কথা বলতে চান। তিনি সহসাই আনুষ্ঠানিক হয়ে যান। তাকে বলেন,“আপনি আসলেই তো হবে-টবে না। আমি এখন কী করে আপনার সাথে কথা-টথা বলি। উনি আমার কাছে সময় নিয়ে এসেছেন। আমাকে যদি আপনার সাথে কথা বলতে হয় তাহলে আপনি উনার অনুমতি নিন। উনি আপনাকে সময় দিলেই আমি আপনার সাথে কথা বলতে পারি।” আমি বিনয়ের সাথে সময় দেই। লোকটি তাঁর কথা বলেন। এলাকায় জমি নিয়ে পারিবারিক কী সমস্যা। তিনি বলে দিলেই সমস্যা থেকে তিনি মুক্ত হতে পারেন। খন্দকার মোশতাকের পা ধরতে আসেন। মোশতাক পা সরিয়ে নিয়ে তাকে আশ্বাস দেন। লোকটি চলে যান। এবার আমার সাথে কথা। তিনি তার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিন মাসের কৃতিত্বের কথা বলে যান, “আমিই আপনার পত্রিকাটি বের করার অনুমতি দিয়েছি, একথা কী আপনারা মনে রেখেছেন-টেখেছেন? আমি জাতীয় পোশাক চালু করেছিলাম। আমিই মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়ের ব্যবস্থা করেছিলাম। আমার সময়েই চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।” আমি বিরক্ত বোধ করি। সবকিছুতে নিজের কৃতিত্ব জাহির করা লোকজন আমার খুব অপছন্দ। আমি প্রশ্ন করার সুযোগ পাই না। এরপর তিনি বলেন, “আপনি যে আমার সাক্ষাৎকার নেবেন তা কি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হবে। মনে রাখবেন আমি দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলাম। আমার অধিকার আছে আপনার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পাওয়ার।” আমি তাঁকে আশ্বস্ত করি। আমি প্রশ্ন করি, আপনি একটি দল করেছেন। আপনার সাথে অনেক বড় বড় নেতাও আছে। ১৯৮১ সালে আপনার সভায় গোলযোগ হওয়ার পর আপনি আর কোনো সমাবেশ করেননি। সব দলই তো মাঠে। এ সময় আপনি ঘরে কেন? তিনি জবাব দেন যে, তাঁর দল মাঠে সক্রিয় রয়েছে। দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয়। তিনি সব খবর রাখছেন। যেহেতু তাঁর অনেক শত্রু আছে। দলের নেতারাই চান না যে তাঁর ওপর কোনো আঘাত আসুক। তিনি সবসময় তাদেরকে নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা ও পরামর্শ অনুসারেই তারা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, ইত্যাদি। আমি ইনডেমনিটি আইন নিয়ে প্রশ্ন করি, তিনি আমাকে থামিয়ে দেন। জেলখানায় চার নেতার হত্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করলেও থামিয়ে দেন। তবে এটুকু বলেন,“আমার হাত পা বাঁধা ছিল। আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নেয়া হয়েছে। জেলখানায় যা ঘটেছে তা আমি পরে জানতে পেরেছি। এরপর তো আমাকে সরিয়েই দেয়া হয়েছে।” কি বিচিত্র লোক। তাঁর আদেশেই তাঁর সাবেক রাজনৈতিক সহকর্মী, একই মন্ত্রীসভার সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, অথচ তিনি কিছুই জানেন না।

সব মিলিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে রাজনৈতিক ক্যারিকেচার মনে হয়েছে। এমন একজন ব্যক্তি কী করে আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের সূচনা থেকে গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব পালন করেছেন। শেখ মুজিবের সাথে ছায়ার মতো ছিলেন, তাঁকে চিনতে আওয়ামী লীগের ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে! তাঁর ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার তিন মাস আগে তিনি মারা গেছেন।

জহিরুলঃ অপরূপ ভৌগোলিক সৌন্দর্যের কারণে কাশ্মীরকে আমরা ভূস্বর্গ বলি, অন্যদিকে কাশ্মীর ভারত উপমহাদেশের একটি অগ্নিকুণ্ড। ভারত ও পাকিস্তানের মাঝখানে পড়ে কাশ্মীরের মানুষ যুগ যুগ ধরে অত্যাচারিত, নির্যাতিত এবং ভীতিকর এক জীবন যাপন করে। আপনি কাশ্মীর ভ্রমণ করার সুযোগ পেয়েছেন। কাশ্মীরের রাজনৈতিক ডাইনামিক্স, তখন এবং এখন, যদি আমাদের জানান।

মঞ্জুঃ কাশ্মীরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং কাশ্মীরকে বেহেশত-তূল্য বলে বিখ্যাত কবিরা যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার কারণে কাশ্মীর মানুষের কল্পনায় বেহেশতে পরিণত হয়েছে। সম্ভবত এক্ষেত্রে কবি আমীর খসরুর অবদান সবচেয়ে বেশি। তিনি লিখেছেন:

“গর ফিরদৌস বাররু-এ-জমিনাস্ত.

হামিনাস্তো হামিনাস্তো হামিনাস্ত।”

([পৃথিবীতে যদি বেহেশত হতো,

তাহলে এই সেই স্থান, এই সেই স্থান, এই সেই স্থান)।

চির সৌহার্দ্যের ভূখণ্ড কাশ্মীরের অগ্নিকুণ্ড হয়ে ওঠার ইতিহাস শুরু হয়েছে উপমহাদেশ বিভাজন প্রক্রিয়ার সময় থেকে। কাশ্মীর ঐতিহাসিকভাবে মুসলিম প্রধান এলাকা। কিন্তু একটি পর্যায় থেকে হিন্দু রাজার অধীনে শাসিত হচ্ছিল এবং বিভাজনের প্রক্রিয়ার সময় শাসক ছিলেন মাহরাজা হরি সিং। কাশ্মীরের প্রধান রাজনৈতিক দল মুসলিম কনফারেন্স ১৯৪৬ সালে সিদ্ধান্ত নেয় “আজাদ কাশ্মীর” এ পরিণত করার। অর্থ্যাৎ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ দেশীয় রাজ্যগুলোকে পাকিস্তান অথবা ভারতে যোগ দেয়া অথবা স্বাধীন থাকার যে এখতিয়ার দিয়েছিল সেই আলোকে মুসলিম কনফারেন্স পাকিস্তান বা ভারতে যোগ না দিয়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে থাকার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে। তারা মহারাজা হরি সিং এর কাছে দাবী জানায় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণপরিষদ গঠনের। মহারাজা নিজেও কাশ্মীরকে স্বাধীন রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের আগে সিদ্ধান্ত পাল্টে তারা মহারাজার প্রতি দাবী জানায় পাকিস্তানে যোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু কাশ্মীরের একটি এলাকায়, যেটি বর্তমানে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের অংশ, সেখানে মহারাজার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয় উচ্চহারে কর বৃদ্ধির কারণে এবং তা দমন করতে মহারাজা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বহু মুসলিম নিহত হয় এবং উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক মাস পর রাওয়ালপিণ্ডিতে অস্থায়ী আজাদ জম্মু ও কাশ্মীর সরকার গঠিত হয় এবং আজাদ কাশ্মীরের বর্তমান রাজধানী মুজাফফরাবাদের চলে আসে। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কয়েক হাজার সশস্ত্র উপজাতীয় লোক, যারা মূলত পাশতুন, তারা জম্মু ও কাশ্মীরকে মহারাজা হরি সিংয়ের শাসনমুক্ত করার উদ্দেশে কাশ্মীরে আসে। মহারাজার বাহিনী তাদের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয় এবং হামলাকারীরা রাজধানী শ্রীনগরের কাছাকাছি পৌঁছে গেলে মহারাজা হরি সিং ভারতের সামরিক সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু মহারাজা ভারতে যোগদানের সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর না দিলে ভারতের পক্ষে সামরিক সহযোগিতা করা সম্ভব নয় মর্মে জানানোর পর হরি সিং সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করেন। ভারত অবিলম্বে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। পাকিস্তানও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। দ্বন্দ্ব নিস্পত্তির জন্য ভারত জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয় এবং জাতিসংঘে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের পক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত উভয় কাশ্মীরে কোনো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে দুই পক্ষের যুদ্ধ বিরতি রেখা “লাইন অফ কন্ট্রোল’ হিসেবে কাশ্মীরকে বিভক্ত করে রেখেছে। ভারত কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবী করে এবং ভারতীয় পার্লামেন্টে তাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। অন্যদিকে আজাদ কাশ্মীর বা পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ নিজস্ব সরকার রয়েছে এবং পাকিস্তানের পার্লামেন্টে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। ১৯৯০ সালের শীত মওসুমের পর কাশ্মীরকে ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত চলছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে নিয়মিত ও আধা-সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি এতো ব্যাপক যে পৃথিবীর আর কোথাও এতো সৈন্য সমাবেশের ঘটনা ঘটেনি বা নেই।

আমি কাশ্মীরের একটি অংশ, অর্থ্যাৎ আজাদ কাশ্মীরের মুজাফফরাবাদ ও আশপাশের এলাকা দেখার সুযোগ পেয়েছি। যেটুকু দেখেছি, তাতে কাশ্মীরের অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। কাশ্মীরের মূল অংশ, যা ভারত নিয়ন্ত্রিত সেখানে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ১৯৯০ সালের মে মাসে আমি পাকিস্তান ভ্রমণে গেছি; কিন্তু আমার ভ্রমণ পরিকল্পনায় কাশ্মীর ছিল না, হঠাৎ করেই আমার ভ্রমণ কর্মসূচিতে কাশ্মীর যুক্ত হয়েছিল। আমার গন্তব্য ছিল ইসলামাবাদ। সময় ও পরিস্থিতি কোনোটাই পাকিস্তান ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। ১৯৯০ সালের মে মাস। পাকিস্তানে প্রচন্ড গরমের মওসুমের সূচনার সময়। প্রকৃতির দাবদাহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল সিন্ধু প্রদেশে চলমান মুহাজির-সিন্ধী দাঙ্গা এবং প্রবল হয়ে উঠা কাশ্মীরের স্বাধীনতা অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম। দাঙ্গায় করাচিতে প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ নিহত হচ্ছিল। সাত বছর আগে জার্মানি থেকে দেশে ফেরার সময় করাচি বিমান বন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত গিয়ে পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করে কাউকে না পেয়ে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। সে কারণে পাকিস্তান ভ্রমণ করতে না পারার অতৃপ্তি ছিল। স্কুলের ক্লাস শুরুর আগে এসেম্বলিতে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন’ গেয়ে পাকিস্তানের চাঁদতারা খচিত পতাকাকে স্যালিউট করেছি। ১৪ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস, ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করেছি। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহর, জিলা, ঐতিহাসিক নিদর্শন, খ্যাতিমান ব্যক্তি, নদী ইত্যাদির নাম পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। পাটিগনিতের অংক কষতে পাকিস্তানের নামী ক্রিকেট খেলোযাড়দের রান সংখ্যা নিয়েও অংকের ফল মিলাতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিকে পাকিস্তান হকিতে স্বর্ণপদক লাভ করায় স্কুলে ছুটি পেয়েছি। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের দু’জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, ছুটিতে তারা বাড়িতে এলে তাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের গল্প শুনেছি। দেশ বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হলেও পাকিস্তান ভ্রমণের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটেনি।

বাংলাদেশ বিমানের করাচি ষ্টেশন ম্যানেজার আনোয়ারুল হক এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করে বিমানের গাড়ি দিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিলেন আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। জনমানবশূন্য রাস্তা, প্যারামিলিটারী সৈন্যদের টহল এবং যানবাহনের স্বল্পতা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। গুরুমন্দির রোডের এক রেষ্টহাউজে পৌঁছে দিল ড্রাইভার। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি ফরেন মিনিষ্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় উর্দু দৈনিক জং এর চিফ রিপোর্টার আরিফুল হক আরিফ এবং জং এর সাপ্তাহিক প্রকাশনা আখবার-এ-জাঁহা’র সম্পাদক ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের প্রফেসর ড. নিসার জুবেরী। ঢাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা ও দেখভাল করা এবং আপ্যায়ন করার কারণে তাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিসার জুবেরীকে পাওয়া গেল না। আরিফুল হক দৈনিক জং অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন। করাচির পরিস্থিতি ভালো নয় বলে আমি বের হবো না, এবং যেদিন বের হবো সেদিন সোজা ষ্টেশনে গিয়ে রাওয়ালপিণ্ডির ট্রেনে ওঠবো জানার জানার পর তিনি আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের নাম, ফোন নম্বর দিয়ে বললেন ইসলামাবাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রেষ্টহাউজে লাহোরের এক পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। আমিরুল আজিম। তিনি আমাকে বললেন ইসলামাবাদের আগে লাহোর হয়ে যেতে। উর্দুতে একটি ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন লাহোর ষ্টেশনে নেমে কোনো ট্যাক্সি বা স্কুটার ড্রাইভারকে ঠিকানাটি দিলেই জায়গামত পৌঁছে দেবে। সেখানে তিনি থাকবেন। তিনদিন করাচিতে কাটিয়ে লাহোরগামী ট্রেনে উঠলাম। পরদিন সকালে ট্রেন লাহোর পৌঁছলে একটি স্কুটারে ওঠে আমিরুল আজিমের দেয়া ঠিকানায় পৌছে গেলাম। সেটিও একটি রেষ্টহাউজ। আমিরুল আজিম অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে বললেন আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ যেতে। সাংবাদিক হিসেবে কাশ্মীর পরিস্থিতি দেখার জন্য আমার যাওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বললেন তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ছাত্র আবদুল্লাহ ফারুক ভাট্টিকে ডেকে তাঁর গাড়ির চাবি দিয়ে বললেন আমাকে লাহোর নগরী ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় সেজান রেষ্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। ভাট্টি আমাকে শাহী কিল্লা, শাহী মসজিদ, কবি ইকবালের মাজার, লাহোর প্রস্তাবের স্মৃতি বিজড়িত মাঠে মিনার-ই-পাকিস্তান, বিশাল বুকষ্টোর ফিরোজ এন্ড সন্সসহ আরো কিছু ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন।

সন্ধ্যায় ভাট্টি এসে আমাকে নিয়ে গেল সেজান রেষ্টুরেন্টে। আমিরুল আজিম আমার সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং তার ঘনিষ্ট নবীন প্রবীণ জনা বিশেক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি রীতিমতো বিব্রত। বাংলাদেশ সম্পর্কে সবার অনেক কৌতুহল। অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য দিতে হলো, কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে হলো। ইংরেজিতে না বলে উর্দুতেই কথা বললাম। আমার উর্দু জানা তাদের কাছে বিস্ময়। পূর্ব পাকিস্তানিরা উর্দুকে ঘৃণা করে, তাদের ধারণায় এটাই বদ্ধমূল ছিল। আমি বললাম, ভাষার সাথে বিরোধ ছিল না, চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাই বিরোধের কারণ। ভাষার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য হলো, আমরা পাঞ্জাবী, উর্দু আমাদেরও ভাষা নয়। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আমরা উর্দু গ্রহণ করেছি। আমি বলি, ভাষার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। ব্যক্তিগতভাবে উর্দু কবিতা-গান আমাকে মুগ্ধ করে এবং সেই মুগ্ধতা থেকেই সামান্য উর্দু চর্চা করতে চেষ্টা করেছি। পরদিন আমার আপ্যায়নকারী আমার হাতে লাহোর-রাওয়ালপিন্ডির বিমানের টিকেট ধরিয়ে জোর করে পকেটে বেশকিছু রুপি গুঁজে দিলেন। রাওয়ালপিন্ডির কয়েকজনের নাম ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, যে কাউকে ফোন করলেই তারা আমাকে মুজাফফরাবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দরের নাম কতো শুনেছি। সেই বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ওআইসি পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্র ফজলু বিমানবন্দরে আমাকে রিসিভ করে দশ মাইল দূরে ইসলামাবাদে তার ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। দু’দিন ইসলামাবাদে কাটিয়ে আমাকে দেয়া একটি নম্বরে ফোন করলে রাতে এক যুবক এসে মোটর সাইকেলে তুলে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক বহুতল ভবনের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিল। এটি কাশ্মীরি সশস্ত্র গ্রুপের রাজনৈতিক সদর দফতর। নেতাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। শীর্ষ নেতা প্রফেসর আশরাফ শরফ। শ্রীনগরের এক সরকারি কলেজের শিক্ষক। ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে রাজনৈতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। রাতে আরো বেশ ক’জন নেতার সাথে খেতে বসে তারা কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। তারা আমাকে অনেক জেরা করলেন। আমি যে যথার্থই একজন সাংবাদিক এবং সন্দেহভাজন কেউ নই তা নিশ্চিত হতে চাইছিলেন। তাদের সাথেই রাত কাটালাম। সকালে নাশতা সেরে প্রফেসর আশরাফ শরফের সাক্ষা]কার নিলাম। দশটার দিকে একজন আমাকে চাকলালা বিমানবন্দরে নিয়ে মুজাফফরাবাদের টিকেট হাতে দিল। চৌদ্দ আসনের ছোট বিমান। আধা ঘন্টা পর মুজাফফরাবাদে পৌছলাম। ছোট্ট বিমানবন্দরের অল্প দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা এক নদী। সেখানে একটি গাড়ি নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিল তিনজন। প্রথমে তারা আমাকে একটি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে আরো কয়েকজন কাশ্মীরি যুবক। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন তার বন্ধুর বিয়েতে রাজশাহী গিয়েছিল। বাংলাদেশের আতিথেয়তায় সে মুগ্ধ। তারা পাহাড়ি পথে চারদিকে উঁচু পর্বতশ্রেনীর মাঝে খোলা প্রান্তরে বড় ধরনের একটি তাবুতে নিয়ে গেল আমাকে। তাবুতে শ’খানেক যুবক। তাদের কাছে আমার পরিচয় দেয়া হলো। এসব যুবক ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে আজাদ কাশ্মীরে এসেছে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিতে এবং প্রশিক্ষণ শেষে কাশ্মীরে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ইতোমধ্যে বেশ ক’টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন ক’জন যুবকও ছিল সেখানে। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তুলতেই তারা ঘাড়ে ঝুলানো স্কার্ফে মুখ ঢাকলো। তারা যা বলার জন্য নির্দেশিত এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে মুখ খুললো না। আমাকে বললো তাদের সাথে যুদ্ধে গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। এবার তাদের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে দু:খ প্রকাশ করলাম। তাবুতে বিশাল ডেকচি ভর্তি চা। আমাকে চায়ে আপ্যায়ন করলো। মশলা ও লবন মিশ্রিত চা, ওরা বলে ‘কাওয়া’। প্রচন্ড গরমে পানিশূন্যতা কাটাতে ওরা দিনভর এই চা পান করে। সেখান থেকে আরেকটি ক্যাম্পে গেলাম। অসংখ্য কাশ্মীরি যুবক। তারাও ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে জয়ী হওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করলো। মুজাফফরাবাদে কাশ্মীরি নেতাদের মূল অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নেতৃস্থানীয় কাশ্মীরিদের সাথে সাক্ষাৎ হলো। তারা জিহাদে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। সন্ধ্যায় আমি একটি বাসে উঠে বেশ রাতে ইসলামাবাদে ফিরে এলাম।

আমার পাকিস্তান অবস্থানকালেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি হলো কাশ্মীরের প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং অল পার্টি হুররিয়াত কমিটির চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ মৌলভি ফারুককে শ্রীনগরে তাঁর প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপ গুলি করে হত্যা করে। তাঁর শবযাত্রায় অংশগ্রহকারীরা তাদের ধর্মীয় নেতার হত্যাকান্ডে উত্তেজিত ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে চার মহিলাসহ ৭২ জন লোক নিহত হয়। মিরওয়াইজ বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং নিহত মৌলভি ফারুক ছিলেন ক্রয়োদশ মিরওয়াইজ। তাঁর সতের বছর বয়স্ক পুত্র ওমর ফারুক নতুন মিরওয়াইজ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপর ঘটনাটি ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (র) এর সাবেক পরিচালক গিরিশ চন্দ্র সাকসেনাকে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান। আমি রাওয়ালপিন্ডিতে বিদ্রোহী নেতাদের সাথে অবস্থানের সময়ই সাকসেনার নিয়োগে তাদের মধ্যে অস্বস্থির ভাব লক্ষ্য করেছি।

পাকিস্তানে আমার অবশিষ্ট দিনগুলোতে আমি কাশ্মীর পরিস্থিতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। কাশ্মীরিদের সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য এক ছিল না। দল-উপদলে বিভক্ত কাশ্মীরিরা অভিন্ন লক্ষ্য স্থির করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কাশ্মীরের এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে। শেখ আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কংগ্রেস বরাবর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মিত্র, আর পিডিপি ভারতীয় জনতা পার্টির মিত্র। কারণ তিনি ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি। কাশ্মীরে সরকার গঠনকারী বড় দুটি দলই যদি ভারতভূক্ত থাকতে চায়, সেক্ষেত্রে কাশ্মীরের স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধ কতোটা সফল হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ছোট ছোট বিদ্রোহী দলগুলোর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তাদের মধ্যেও ছিল নানামুখী স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা। একটি গ্রুপ লড়াই করছিল কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য। আরেকটি গ্রুপ চাইছিল কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে। ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে ভারতভূক্ত হওয়ার পক্ষে ছিল কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিতরা ছাড়াও অনেক কাশ্মীরি এবং ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তারা গোপনে কাজ করতো। এ-ধরনের বিপরীতমুখী ও পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং পরবর্তী বছরগুলোতে হয়েছিল তাই। বহুধা-বিভক্ত কাশ্মীরিদের অনৈক্য ও চিন্তাধারার বৈপরীত্যকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েক বছরের ব্যবধানেই কাশ্মীরিদের মধ্য থেকে প্রতি-বিপ্লবী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোকে অকার্যকর করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি পরিস্থিতির অপেক্ষায় ছিল। অন্যান্য দলের সরকার ক্ষমতায় এসে কাশ্মীর প্রশ্নকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভাবলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি – বিজেপি’র কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের ব্যাপারে আপোষহীন ছিল। ২০১৯ সালের ৫ই আগস্ট তারা কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার গ্যারান্টি দানকারী সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫ ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেছে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে উপমহাদেশ হয়তো আরো বেশি সংঘাত, আরো বেশি রক্তপাত দেখবে।

জহিরুলঃ কাশ্মীরের মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান, যতদূর জানি ওদের জীবনাচার ও সংস্কৃতিতে সুফি চর্চার বেশ প্রভাব রয়েছে। এপার-ওপার দু’পারের মানুষের সংস্কৃতিতেই কি সুফি চর্চার প্রভাব আছে? কি ধরণের সাংস্কৃতিক চর্চা আপনি প্রত্যক্ষ করেছেন?

মঞ্জুঃ আমার ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্ম বিশ্বাসের উর্ধে ওঠে দুটি ভূখন্ডগত ও ভাষাগত জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী নিজেদের পরিচয়ের ব্যাপারে প্রচণ্ড আত্মাভিমানী Ñ পাঞ্জাবী ও কাশ্মিরী। তাদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয় বা পাকিস্তানি নয়, পাঞ্জাবিয়াত ও কাশ্মিরিয়াত। এই দুটি ভূখণ্ডেই মুসলিম, হিন্দু ও শিখদের ওপর সুফিবাদের প্রভাব সার্বজনীন। এখনো কাশ্মীরে মানুষের জীবনে সুফি ঐতিহ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তারা পৃথিবীকে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করে আধ্যাত্মিকতা দিয়ে: “আমরা একই বাবা-মা’র সন্তান/ আমাদের মাঝে এই ভিন্নতা কেন/ হিন্দু ও মুসলিমদের একত্রে ইশ্বরের আরাধনা করতে দাও/ আমরা পৃথিবীতে সঙ্গীর মতো এসেছি/ আমাদের আনন্দ ও বিষাদ একত্রে ভাগ করে নেয়া উচিত।” ইতিহাসের নানা উত্থান-পতন, যুদ্ধ-সংঘাত সত্বেও সুফিবাদ কাশ্মিরী সমাজের ভিত্তি। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান সুফি ঐতিহ্য থেকে কাশ্মিরী সুফি ঐতিহ্য একটু ভিন্ন। কাশ্মীরে প্রথম দিকের সুফিদের অধিকাংশ এসেছেন মধ্য এশিয়া থেকে এবং তারা এর বিকাশ ঘটিয়েছেন স্থানীয় ঐতিহ্য ও দর্শনকে সম্পৃক্ত করে, যার মধ্যে ইসলামী দর্শন ছাড়াও কাশ্মিরী বৌদ্ধ দর্শন, কাশ্মিরী শিব ভক্তি, তান্ত্রিক ঐতিহ্যকেও বাদ দেয়া হয়নি। যে কারণে অনেক সুফি সাধকের নামের সাথে যুক্ত হয়েছে “ঋষি”। যেমন: কাশ্মীরের চারার-ই-শরীফ এ বিখ্যাত সুফি শেখ নূর-উদ-দীনের মাজার রয়েছে। কাশ্মিরীরা তাকে জানে “নন্দ ঋষি” নামে। কাশ্মীরে সুফিরা ঋষি এবং ঋষিরা সুফি। মনোরম কাশ্মীরের পর্বত শীর্ষে ও উপত্যকায় অসংখ্য সুফির মাজার ও দরগাহ’র উপস্থিতির কারণে কাশ্মীরকে ঋষি ও পীরদের উপত্যকাও বলা হয়। কাশ্মীরে আমার অবস্থান যেহেতু অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল, অতএব আমার পক্ষে কাশ্মীরের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চর্চা সম্পর্কে দেখার সুযোগ হয়নি। তবে কাশ্মীরের সুফিবাদ সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি নব্বইয়ের দশকে পরিবেশ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে। সাড়ে পাঁচশ’ বছরের বেশি সময় আগে নন্দ ঋষি কর্তৃক তাঁর ভক্তদের বন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন: “আ’ন পশ তেলিহ ইয়েলিহ ওয়ান পশ” [যতোদিন বন থাকবে ততোদিন খাদ্যের নিশ্চয়তা থাকবে।] এরপর থেকে শুধু নন্দ ঋষি নয়, আরো অনেক কাশ্মিরী সুফি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। কাশ্মিরী সুফিরা ধর্মনিরপেক্ষ কাশ্মিরী সমাজের জন্য সার্বজনীন প্রেমের বাণী ছড়িয়েছেন, যা ঐক্য ও ধর্মীয় উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। উভয় কাশ্মীরের সুফি ভক্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অভিন্ন এবং ভারত ও পাকিস্তানের অবশিষ্ট অংশের সুফি দর্শন ও সাংস্কৃতি চর্চা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

জহিরুলঃ কাশ্মীরের লেখক বাশারাত পীরের “কারফিউড নাইট” বইটি আপনি অনুবাদ করেছেন। বইটি সম্পর্কে খুশবন্ত সিং বলেছেন, “চমৎকার লেখা, নির্মম সত্য এবং নিদারুণ মর্মস্পর্শী” – কি আছে এই গ্রন্থে?

মঞ্জুঃ জি, ২০১৯ এ ভারতের বিজেপি সরকার সংবিধান থেকে কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ সংক্রান্ত বিধান বাতিল করার পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে আমি কাশ্মিরী সাংবাদিক ও লেখক বাশারাত পীরের “কারফিউড নাইট” নামে আত্মজৈবনিক উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন অনুভব করি। একজন কাশ্মিরী সেখানে ৭০ বছর ধরে চলে আসা সংকটকে কিভাবে দেখছেন, ভারতের বিরুদ্ধে সাধারণভাবে কাশ্মিরীদের মনোভাব কী, কেন তরুণরা অস্ত্রধারণ করতে গিয়ে অকাতরে জীবন দিচ্ছেন তা তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসটিতে। শৈশব থেকে আমরা কাশ্মীরকে ভূস্বর্গ হিসেবে জানি। কিন্তু সৌন্দর্যের সাথেই জড়িয়ে আছে কাশ্মিরীদের চরম দূর্ভোগ ও নিপীড়নের সত্তরটি বছর। উপন্যাসে তুলে আনা হয়েছে সার্বক্ষণিক ভীতিকর পরিবেশে, নিয়মিত ক্রাফিউয়ের মধ্যে কাশ্মীরিদের জীবনযাপনের কাহিনি। কাশ্মীরের স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের জন্যে কিভাবে সাধারণ যুবকরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, হাসিমুখে প্রাণ দেয় তারও বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে কাশ্মীর যেন এক মৃত্যু উপত্যকা, যেখানে মৃত্যুর নিশ্চয়তা যতটা সুনিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা ততটাই অনিশ্চিত, বাশারাত পীর সে কথাগুলোই তুলে ধরেছেন তার হৃদয় নিঙড়ানো ভাষায়। কাশ্মীরের ইতিহাসের প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করে বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন। তিনি শুধু মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের বিবরণ দিয়েই তাঁর দায়িত্ব শেষ করেননি, যেসব কাশ্মিরী পণ্ডিত তাদের জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাদের মানবেতর জীবনের কাহিনিও তার উপন্যাসে উপস্থাপন করেছেন। কাশ্মীরকে বিভক্তকারী ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘‘এই সীমান্ত রেখা টেনে নেওয়া হয়েছে আমাদের আত্মা, আমাদের হৃদয় এবং আমাদের মনের মধ্য দিয়ে। একজন কাাশ্মিরী, একজন ভারতীয় এবং একজন পাকিস্তানি যা বলে, লিখে এবং করে তার সবকিছুর মধ্য দিয়ে টানা হয়েছে এই রেখা।’’ বর্ণনার অভিনবত্ব ও বিস্তৃত পরিসরে মানুষের জীবন ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের যে আবেগময় বর্ণনা গ্রন্থটিতে দেয়া হয়েছে তা এটিকে সুখপাঠ্য করেছে।

জহিরুলঃ আপনি হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন সম্প্রতি কাশ্মীরের কবিরা “মিয়া কবিতা” নামে এক ধরণের কবিতা লিখছেন। অনেকে মিলে ক্রমাগত মানুষের জীবনের গল্প বুনে যায় এই কবিতায়। কষ্টের গল্প, নির্যাতনের গল্প, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অত্যাচারের গল্প। আপনার দেখা কাশ্মীরে এইসব গল্প কি খুঁজে পেয়েছেন, যদিও আপনি শ্রীনগরে যেতে পারেননি, গিয়েছেন মুজাফফরাবাদে, তবুও দুই পাড়ের মানুষের গল্প নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন।

মঞ্জুঃ কাশ্মীরের ‘মিয়া কবিতা’ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমি মূলত কাশ্মিরী সূফিদের কবিতা এবং কয়েকজন কাশ্মিরী কবির কিছু আধুনিক কবিতা পড়েছি। তার মধ্যে আগা শহীদের কবিতাই বেশি পড়েছি। উনিশ শতকের একজন খ্যাতিমান কাশ্মিরী কবি মিয়া মোহাম্মদ বখশ এর দীর্ঘ কবিতা ‘সফর-উল-ইশক’ এর বঙ্গানুবাদ পড়েছি। এই দীর্ঘ মহাকাব্যিক ধরনের কবিতার কারণে তাঁকে ‘কাশ্মীরের রুমি’ বলা হয়। আপনি নিজেও হয়তো এই কবিতার কাহিনি সম্পর্কে শুনে থাকবেন, যেটি ‘সয়ফুল মুলক বদিউজ্জামাল’ নামে পরিচিতি। বাংলাদেশে এই কাহিনি ভিত্তিক একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছিল পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে। এটি পাঞ্জাবি ভাষায় লেখা একটি লোককাহিনি এবং সমগ্র উপমহাদেশে জনপ্রিয়। কাহিনির মূল কথা মানুষের প্রতি ভালোবাসা: “হে প্রভু, আমার হৃদয়ে প্রেমের আলো জ্বালিয়ে আমাকে আলোকিত করো, আমার হৃদয়ের আলো সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক।” আমি আগা শহীদ আলীর অনেক কবিতা এবং তাঁর কবিতার ওপর আলোচনা পড়েছি। তিনি রাজনৈতিক কবিতা লিখতেন এবং সবই কাশ্মীরের ওপর। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাশ্মীরের পোষ্ট অফিসগুলো সাত মাসের জন্য বন্ধ করে রেখেছিল, সেই প্রেক্ষাপটে লেখা তাঁর একটি কবিতা “দ্য কান্ট্রি উইদাউট এ পোষ্ট অফিস” অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে।

“নিখোঁজদের পুরো মানচিত্র আলোকিত হবে,

মুয়াযযিনের মৃত্যুতে আমি মিনারের রক্ষাকারী।

শিগগির এসো, আমি এখনো বেঁচে আছি,

আলোর বিপরীতে রাখা বস্ত্র কখনো সাদা

এরপর কালো/…তার হাতে ডাকটিকেট বাতিল করার মোহর

এটি একটি সংগ্রহশালা, যেখানে আমি খুঁজে পেয়েছি,

তার কণ্ঠের অবশেষ, সেই আকাঙ্খার মানচিত্র,

যার কোনো সীমা পরিসীমা নেই।”

তাঁর কবিতাগুলো আমার কাছে সঙ্গীতের মতো কানে বাজে:

“আল্লাহর ফেরেশতারা আবারও শয়তানকে খুঁজছে! পরিত্যক্ত,

মুক্তি কেনা হলেও যথাসময়ে বিক্রয় হয়েছে পাপ,

এবং কে সন্ত্রাসী, কে সন্ত্রাসের শিকার?

দেশে যথাসময়ে ভোট হলেই আমরা জানতে পারবো।”

কাশ্মীরের পরিস্থিতি আগা শহীদ আলীকে যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে থাকতে বাধ্য করে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০১ সালে তিনি মারা যান। এছাড়া ফারুক নাজুকি ও রশীদ নাজুকির কিছু কবিতা পড়েছি। কাশ্মীর ও পাকিস্তান ঘুরে আসার আগে কাশ্মিরী কবিতা বা সাহিত্য সম্পর্কে আমার পড়াশোনা কম ছিল। ঘুরে আসার পর যখনই কাশ্মীরের বড় কোনো অঘটন ঘটেছে তখন কাশ্মীর সম্পর্কে জানার আগ্রহ আরো বেশি অনুভব করেছি। দুই কাশ্মীরের মানুষ বলতে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মানুষের সাথে কথা হয়েছে শুধু কাশ্মিরী মুজাহিদদের সঙ্গে। যেখানে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ, মৃত্যুর ঘটনা ঘটে সেখানে মানুষের কথার মধ্যে কষ্ট ও আবেগ বেশি থাকে। আমি তাদের সেই আবেগ অনুভব করেছি।

জহিরুলঃ কাশ্মীরের মানুষের শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্প-সাহিত্যের চর্চা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। উল্লেখ করার মতো লেখক, কবি, শিল্পী এবং তাদের কাজ।

মঞ্জুঃ দুই কাশ্মীরের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আজাদ কাশ্মীরে পাকিস্তানি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব শতভাগ। অথবা বলা যায় নিয়ন্ত্রণকারী দুই দেশের শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। কারণ উচ্চতর শিক্ষা ও চাকুরির জন্য কাশ্মীরের ছাত্রছাত্রীদের ভারত ও পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই। তবে ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, অতএব তারা কিছু নিয়ন্ত্রণ রাখে শিক্ষাকে রাজ্যের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূণ করে কারিকুলাম তৈরি করার ক্ষেত্রে। আজাদ কাশ্মীরেও হয়তো তাই করা হয়, কারণ তাদের সম্পূর্ণ পৃথক সরকার ব্যবস্থা রয়েছে। ইতোমধ্যে আমি যেসব কবির কথা উল্লেখ করেছি, যাদের কিছু কবিতা আমি পড়েছি। এর বাইরেও কাশ্মীরে অনেক বিদগ্ধ কবি, শিল্পী রয়েছেন। এ মুহূর্তে আমি মুখস্থ বলতে পারবো না। এখন সবকিছু উন্মুক্ত। আগ্রহীরা অনলাইন ঘেঁটে অনয়াসে জানতে পারবেন।

জহিরুলঃ দিল্লিতে অবস্থান কালে কেমন দেখেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সৌহার্দ্য ও সহাবস্থান?

মঞ্জুঃ দিল্লিকে আমি ভারতের অনেক স্থানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে অনেক শান্তিপূর্ণ নগরী হিসেবে দেখেছি। মানুষের মাঝে সৌহার্দ্য যথেষ্ট। যে কারণে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারতে চরম এক উত্তেজনাপূর্ণ ও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার ঘটনা ঘটলেও দিল্লিতে তেমন কিছু হয়নি। দাঙ্গার সময়ে আমি মুসলিম অধ্যূষিত নিজামুদ্দীন, পুরনো দিল্লি, আজাদ মার্কেট এলাকায় গিয়ে সবকিছু স্বাভাবিক দেখতে পেয়েছি। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দিল্লিতে দাঙ্গার প্রভাব পড়েনি। আমি যে মহল্লায় ছিলাম, সেখানে একটি মাঠে পাশাপাশি এক সারিতে একটি মসজিদ, একটি মন্দির ও একটি গুরুদুয়ারা ছিল। মসজিদে কোনো ওয়াক্তের নামাজ বাদ পড়েনি। তবে বিভিন্ন রাজ্যের অঞ্চলগত বিরোধ ছিল ঐতিহাসিকভাবেই। বিরোধ বলা ঠিক হবে না, মানসিক দূরত্ব বলা যেতে পারে। যেমন যেখানে বাঙালিরা আছে সেই এলাকা বাঙালি প্রধান। পাঞ্জাবিদের এলাকায় পাঞ্জাবিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, মাদ্রাজিদের পৃথক এলাকা Ñ বিভাজনগুলো রাজ্য ও ভাষা ভিত্তিক। মুসলমানদের ব্যাপারে সার্বজনীন নেতিবাচক মনোভাব চাকুরির ক্ষেত্রে ব্যাপক। এমন কি কোনো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে কোনো মুসলিম অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে বা ভাড়া নিতে পারবে না, তা প্রায় স্বত:সিদ্ধ। ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে। হিন্দুরা মুসলমানদের হত্যা করেছে, তাদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করেছে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর শিখ রক্ষীদের দ্বারা নিহত হওয়ায় শিখদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে।

জহিরুলঃ ভারত-পাকিস্থানের কিছু উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের কথা বলুন, সেই সব জায়গা ভ্রমণ করে আপনার কি উপকার হয়েছে? কি শিখেছেন, কেমন আনন্দ পেয়েছেন?

মঞ্জুঃ আমার ভারত ভ্রমণ প্রধানত দিল্লি কেন্দ্রিক। ১৫/১৬ বার আমি দিল্লিতে গেছি। দিল্লির বাইরে দু’বার চেন্নাই, একবার পণ্ডিচেরি এবং সম্ভবত চার বার কলকাতা গেছি। দিল্লিতে আমাকে একটি ফেলোশিপের জন্য ছয় মাস থাকতে হয়েছে এবং তখন মোগলপূর্ব নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার, কুতুব মিনার এবং মোগলদের লালকিল্লা, পুরানা কিল্লা, হুমায়ুনের সমাধি, জামে মসজিদসহ অধিকাংশ মোগল ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শন ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছি। আধুনিক স্থাপনাও পরিদর্শন করেছি। ওই সময়েই আমি আগ্রায় তাজমহল, ফতেপুর সিক্রিতে আকবরের কিল্লা, সেকেন্দ্রা দেখি। প্রতিটি ঐতিহাসিক সৌধ পরিদর্শনের মধ্যে শুধু দেখা নয়, শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। বিশেষ করে যারা মোগল ইতিহাস জানতে আগ্রহী ও ইতিহাস চর্চা করেন ও লিখেন এসব বিষয়ে তাদের লেখা শুরুর আগে নিদর্শনগুলো দেখে নেয়া উচিত বলে মনে করি। দিল্লি আমাকে সবসময় টানে এবং পৃথিবীর অন্য কোনো জায়গার চেয়ে আমি আবারও দিল্লি ভ্রমণ করাকে প্রাধান্য দেব। পাকিস্তান ভ্রমণের সময় করাচির বাণিজ্যিক এলাকা, ক্লিফটন বিচ, জিন্নাহর বাড়ি ও মাজার, লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়, শাহী কিল্লা, শাহী মসজিদ, কবি ইকবালের মাজার, লাহোর প্রস্তাবের স্মৃতি বিজড়িত মাঠে মিনার-ই-পাকিস্তান, আনারকলি, বিশাল বুকষ্টোর ফিরোজ এন্ড সন্সসহ আরো কিছু ঐতিহাসিক জায়গা দেখি। ইসলামাবাদ নতুন সিটি, পাশ্চাত্যের নগর পরিকল্পনা অনুসারে তৈরি। গাছপালার সবুজে ভরা। এক পাশে পর্বতমালা, আরেক প্রান্তে রাওয়াল লেক। সেখানে দর্শনীয় বলতে মালগালা হিলস, যেটিকে বলা হয় ‘দামান-এ-কোহ’ অর্থ্যাৎ পর্বতের আঁচল, ওই পাহাড়ের ওপর থেকে সন্ধ্যায় ইসলামাবাদের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়া দেখেছি ৩৩ একর জায়গার উপর বেদুইনদের তাবু সদৃশ বিশাল ফয়সল মসজিদ। মসজিদের পাশেই মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মাজার। আমি তাঁর মৃত্যুর দু’বছর পর গেছি। জিয়াউল হকের জন্য তখনও মানুষের আবেগ ছিল। পাকিস্তানের দূর অঞ্চল থেকে দিনরাত হাজার হাজার লোক ভিড় করছে। ফয়সল মসজিদ ইসলামাবাদের প্রধান ল্যান্ডমার্ক। মসজিদের মূল ইবাদত কক্ষ, আশপাশের চত্তর মিলে দুই লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। আমার ভ্রমণের সময় ওআইসি পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ছিল মসজিদ কমপ্লেক্সেই। এছাড়াও মসজিদে আরো দু’তিনটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল তখন। প্রতিটি স্থান পরিদর্শনের সাথে ইতিহাস জানা, বিশেষ করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাতাদের ভাগ্যের বিড়ম্বনার দিকটি আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে। ইতিহাস বইয়ে পাঠ করে যা জানা যায় পরিদর্শনে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। এছাড়া সেইসব এলাকার মানুষের জীবনপদ্ধতি, আচরণ ও সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়াও বড় অর্জন।

জহিরুলঃ ভারত বা পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎ লাভ করার সুযোগ হয়েছে কি? সেই অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

মঞ্জুঃ ভারতে আমার অবস্থান যেহেতু দীর্ঘ ছিল এবং আমি ভারতীয় পার্লামেন্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি ইন্সটিটিউটে ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলাম, সেজন্য বেশ ক’জন ভারতীয় নেতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে; তবে আমাদের পাঠক্রমের সাথে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, আইনবিদ ও আমলাদের সাথেই বেশি দেখা ও কথাবার্তা হযেছে। আমি কোনো নেতার আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার গ্রহণ করিনি। আমার পাকিস্তান সফরের সময় বেনজীর ভূটো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। লাহোর অবস্থানকালে জানতে পারলাম বেনজীর ভূটো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ছয় সদস্যের এক পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছেন। প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর আমীর সিনেটর কাজী হোসেন আহমদের কাছে দূত পাঠিয়েছেন তাঁকে সম্মত করানোর জন্য। আমি কাছেই এক রেষ্ট হাউজে ছিলাম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ ফারুক ভাট্টি, যে আমাকে আগের দিন লাহোর শহর ঘুরিয়েছে, সে খবরটি জানতো। আমাকে বললো, আমি পিপলস পার্টির কারো সাথে কথা বলতে চাইলৈ সুযোগ নিতে পারি। আমি আগ্রহী হলাম। পিপলস পার্টির দূত, সম্ভবত কোন মন্ত্রী ছিলেন, তিনি রুম থেকে বের হলে ভাট্টি তাঁকে ধরলো। আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে আমি কয়েক মিনিট সময় চাইলাম, তিনি কিছুতেই সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হলেন না। তাঁর অফিসে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। সিনেটর কাজী হোসেন আহমদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য প্রবেশ করলাম। তাঁর কাছে আধা ঘন্টা সময় চাইলে তিনি সম্মত হলেন। আমি তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। তিনি একজন পাঠান এবং পেশায় আইনজীবী। একজন রাজনৈতিক নেতার মৌলিক যেসব যোগ্যতা ও গুণাবলী থাকা উচিত সবগুলোর সমাহার তার মধ্যে ছিল। পাকিস্তান পার্লামেন্টের সিনেটর হিসেবে তার ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া রাওয়ালপিণ্ডিতে কাশ্মিরী মুজাহিদদের প্রধান মুখপাত্র প্রফেসর আশরাফ শরফের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তার চোখে একজন শিক্ষকের বিপ্লবী হয়ে ওঠার এবং বিজয়ের আকাঙ্খার প্রদীপ জ্বলতে দেখেছি।

জহিরুলঃ আপনার সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছেন জাতীয় সংসদ কভার করে। এই সংসদে আমাদের সংবিধানের অনেকগুলো সংশোধনী পাশ হয়েছে। আমাদের নেতারা সব সময় বলেন, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড় কিন্তু প্রকৃত চিত্র হচ্ছে দেশের চেয়ে দলের স্বার্থ বড় হয়ে ওঠে এবং দলের চেয়ে ব্যক্তির/পরিবারের স্বার্থই বেশি গুরুত্ব পায়। প্রধান প্রধান সংশোধনীগুলোর আলোকে যদি বিশ্লেষণ করেন কতোটা জাতীয় স্বার্থে আর কতটা ব্যক্তি বা পরিবারের স্বার্থে এইসব সংশোধনীগুলো করা হয়েছে।

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, এযাবত বাংলাদেশে ১১টি জাতীয় সংসদ গঠিত হয়েছে এবং এর মধ্যে দ্বিতীয় সংসদ থেকে নবম সংসদ পর্যন্ত মোট আটটি সংসদের অধিবেশন কভার করা সুযোগ হয়েছে আমার। আমার সংসদ কভারের সময়ে আমাদের সংবিধানের ১০টি সংশোধনী অনুমোদিত হয়েছে এবং সংশোধনী প্রক্রিয়া কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এখন পর্যন্ত সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে ১৭ বার। যে কোনো দেশে সংবিধান হচ্ছে সর্বোচ্চ আইন, সেজন্য সংবিধান প্রণয়নে চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কারণ সংবিধান প্রণয়ন যেমন কঠিন, সংশোধন আনাও তেমন জটিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার কারণে এবং কিছুটা রাজনৈতিক সচেতনতার কারণে আমার মনে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে যে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে অনুরূপ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছিল কিনা। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার শুরু থেকে লক্ষ্য করলে আপনি এক ধরনের অস্থিরতা দেখতে পাবেন, যা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্টের অংশ। ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র অনুমোদন করে সেখানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের বিধান রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে সংবিধানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বিধান রাখা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, পুনরায় সংসদীয় পদ্ধতি ফিরিয়ে আনা হয় ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।

জহিরুলঃ এসবের মধ্য দিয়েই আমাদের জাতীয় অস্থিরতা প্রমাণিত হয়?

মঞ্জুঃ বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর গণপরিষদ আদেশ জারি করা হয় সংবিধান প্রণয়নের জন্য এবং গণপরিষদের সদস্য হিসেবে গন্য করা হয় পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯জন সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত ৩০০ জন সদস্যকে। মৃত্যুজনিত এবং কিছু সদস্য ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পক্ষে ভূমিকা নেয়ার কারণে তাদেরকে বাদ দিয়ে মোট ৪০৪ জনকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উপমহাদেশের যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ভারতের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা প্রথমে ৩৮৯ জন থাকলেও মুসলিম সদস্যরা সদস্যপদ প্রত্যাহার করায় ২৯৯ জন সদস্য নিয়ে ভারতীয় গণপরিষদ পুণর্গঠিত হয়। পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তানসহ) গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। ভারতের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল ২বছর ১১ মাস ১৮ দিন। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন করতে সময় লেগেছিল ৯ বছরের বেশি, এবং সেটিও বাতিল করা হয়। পাকিস্তান একটি সংবিধান পেয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার ২৬ বছর পর; এজন্য তারা তিনটি গণপরিষদ গঠন করেছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ারও পরে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। এর আগে দেশটি চলেছে গোঁজামিল দিয়ে অথবা বলা যেতে পারে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৫৮ সালে বাতিল করা সংবিধান এবং ১৯৬২ সালে আইয়ুব খানের নির্বাহী আদেশে তৈরি সংবিধান দ্বারা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল মাত্র ৬ মাস ২৪ দিন, রীতিমতো একটি রেকর্ড। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখার ব্যাপারে ভারতীয় দাবীও রয়েছে। আমি যখন দিল্লিতে আইন ও সংসদ বিষয়ক ফেলোশিপ করছিলাম তখন আমার রিসার্চ পেপারের জন্য গাইড ছিলেন ভারতের বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইন্ডিয়ান ল’ ইন্সটিটিউটের ওই সময়ের ডাইরেক্টর পি, এম বকশী। ‘দ্য কন্সটিটিউশন অফ ইণ্ডিয়া’ নামে তাঁর একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থও রয়েছে। আমাদের ইন্সটিটিউটে প্রথম দিন বক্তৃতা করতে এসে পরিচয় পর্বে বাংলাদেশের দু’জন ফেলোর (আমি ও জাতীয় সংসদের ওই সময়ের প্রটোকল অফিসার রুহুল আমিন) পরিচয় জানার পর বলেন যে তারা শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনেই সহযোগিতা করেননি, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পেরেও গর্বিত। তিনি জনৈক মি: সরকারের কথা বলেছিলেন, যিনি বাংলাদেশের সংবিধান ড্রাফটিং কমিটিকে সার্বক্ষণিক সহায়তা দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। মি: সরকারের পুরো নাম আমার মনে নেই।

জহিরুলঃ একটি নতুন দেশ, ছোটো দেশ, বৃহৎ প্রতিবেশীর অভিজ্ঞতা নেবে, সাহায্য নেবে এটা খুবই স্বাভাবিক, যখন দুদেশের সম্পর্কটি বন্ধুত্বপূর্ণ।

মঞ্জুঃ হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু সাহায্য-সহযোগিতার আড়ালে যদি বিগবাদ্রারসুলভ চাপিয়ে দেয়ার মনোভাব প্রচ্ছন্ন থাকে তাহলে বিপদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভারতের সে মনোভাব প্রকট এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যতো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার চুক্তি সম্পন্ন হয়ে থাকুক না কেন, জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধিতার দিকটিও আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। কারণ জনগণই সরকার গঠন করে। সরকারের কর্মকাণ্ডে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন থাকতে হবে। দু:খজনকভাবে কখনো সে আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। ভারতের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার পেছনে যদি সত্যিই সদুদ্দেশ্য থাকত, তাহলে ‘৭২ সালে তাদের সহযোগিতায় প্রণীত সংবিধানের অপমৃত্যু মাত্র আড়াই বছরের ব্যবধানে ঘটতো না। বাংলাদেশের গণপরিষদের গঠন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। প্রথমত: জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত ১৬৯ জন সদস্য ইয়াহিয়া খানের জারি করা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে ১২০ দিনের মধ্যে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি করার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের জন্য নির্বাচিত সদস্যদের সংবিধান প্রণয়নে কোনো ভূমিকা থাকার কারণ ছিল না। জনগণ তো তাদেরকে এই ম্যান্ডেট দেয়নি। ১৯৭২ সালে গণপরিষদ আদেশ জারি করে দুটি ভিন্ন উদ্দেশে নির্বাচিত দুটি ভিন্ন পরিষদের সদস্যদের গণপরিষদ হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের বৈধতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলসহ সকল মহলে একাডেমিক বিতর্ক তখনও ছিল, এখনও রয়েছে। আমার মনে আছে, আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেত্রী আমেনা বেগম, যিনি একসময় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন, আমার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। অবশ্য তখন তিনি আওয়ামী লীগে ছিলেন না। জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় যে আশাই পোষণ করে থাকুন না কেন নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিনিধিরা জনগণের নামে তাদের ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। আমাদের মত অনগ্রসর দেশে সবসময় তা-ই ঘটে।

আপনি সংবিধানের প্রধান প্রধান সংশোধনীর ওপর আলোকপাত করেছেন। আগেই উল্লেখ করেছি যে সংবিধান সংশোধন করা বেশ জটিল এবং যখন সংশোধন করা হয় তখন জরুরী প্রয়োজনেই করা হয়, তা দেশের প্রয়োজনে হোক, ব্যক্তি বা দলের প্রয়োজনেই হোক। যখনই কোনো রাজনৈতিক দল সংসদে সংবিধান সংশোধনীর জন্য প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তখন সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় ছুরি-কাঁচি চালায়, যা কখনো কখনো জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনে। আওয়ামী লীগ সংবিধান তৈরি করেছিল, সেই সংবিধানের অধীনে ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩ আসনে জয়ী হয়ে যে সংসদ গঠন করে, সেই সংসদ আড়াই বছরে চার বার সংবিধান সংশোধন করেছে, যা এযাবত বাংলাদেশের যে কোন সংসদের পাস করা সংশোধনীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যাহোক, পাকিস্তানের শাসনামলে বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইনের কারণে নিপীড়িত হয়েছে, এদেশের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল বিরোধী দলীয় রাজনীতিক পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময়ে কারাগারে কাটিয়েছেন সেজন্য সম্ভবত দমননীতিমূলক কোনোকিছু আরোপ না করার সদুদ্দেশেই মূল সংবিধানে জরুরী অবস্থার বিধান রাখা হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতার পর সরকারের পক্ষে দেশ সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল, নাশকতা চলছিল সর্বত্র, এমনকি রক্ষী বাহিনীর মতো শক্তিশালী বিশেষ বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার,’ বা ‘এনকাউন্টার’ এ বিরোধী দলের বহু নেতাকর্মীদের হত্যা ও গুম করেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের বিরুদ্ধে জনমত ক্রমেই প্রবল হচ্ছিল। এ পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান সংযোজন করা হয় এবং ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট পাঁচবার জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকার ১৯৭৪ সালের ২৮শে ডিসেম্বর জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এবং দেশের সর্বত্র সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ছড়িয়ে দিয়ে জনগণের ওপর চরম নির্যাতন চালায়, যা আমি নিজেও আমার এলাকায় প্রত্যক্ষ করেছি। সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর, যার উদ্দেশ ছিল ভারত ও বাংলাদেশের ভূমি বিনিময় এবং এ সংশোধনীর পর বাংলাদেশ বেরুবাড়ি নামে একটি এলাকা ভারতকে দিয়ে দেয়। বিনিময়ে ভারতীয় ভূখন্ডের মধ্যে অবস্থিত দহগ্রাম ও আঙ্গরপোতা ছিটমহলে যাতায়াতের জন্য করিডোর সমস্যা সমাধান না করায় তখন বেশ প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ ঘটেছিল।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটানো হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে, যখন সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। যে আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলে জনগণকে প্রলুব্ধ করেছে, তাদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি প্রবর্তন সকলকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করে। শুধু তাই নয় এ সংশোধনীতে বহুদলীয় ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার বিধান করা হয়, সংসদকে ক্ষমতাহীন করা; মৌলিক অধিকার বাতিল করা; বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করা এবং চারটি দৈনিক সংবাদপত্র চালু রেখে সকল সংবাদপত্রের প্রকাশনা বাতিল করা হয়। সংবিধানের খোলনলচে এভাবে বদলে ফেলায় বিদেশি সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এটিকে বর্ণনা করেছেন “সাংবিধানিক ক্যু” হিসেবে। চতুর্থ সংশোধনী যে দেশকে অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আরো মজার ব্যাপার হলো এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবিধান সংশোধনী বিল সংসদে পাস হয় মাত্র ১৩ মিনিট সময়ে এবং যেদিন সংসদ এ বিল পাস করে সেদিনই প্রেসিডেন্ট এটিতে স্বাক্ষর করেন।

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ছিল আমার সংসদ রিপোর্টিং শুরু করার পর প্রথম সংশোধনী। ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল আনীত এই সংশোধনীতে আসলে সংবিধানের কোনো বিধান সংশোধন করা হয়নি। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সামরিক শাসন জারির পর থেকে ১৯৭৯ এর ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনামলের সকল আদেশ, ঘোষণা ও দণ্ডাদেশ বৈধ বলে অনুমোদন করা হয়। ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় ১৯৮১ সালের ৮ জুলাই এবং এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে তার পদে বহাল থেকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধান নিশ্চিত করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। সপ্তম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর এবং এর মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসনামলে জারি করা সব আদেশ, আইন ও দণ্ডকে বৈধতা দেয়া হয়। এছাড়া এ সংশোধনীতে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬২ থেকে ৬৫ বছরে উন্নীত করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৯ জুন পাসকৃত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়; ঢাকার বাইরে হাই কোর্ট বিভাগের ৬টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা হয়, জাতীয়তা হিসেবে ‘বাংলাদেশী’ এবং ঢাকার ইংরেজি বানান পরিবর্তন করা হয়। নবম সংশোধনী আনা হয় ১৯৮৯ সালের ১১ জুলাই, যার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে যতবার খুশি নির্বাচন করার বিধান পরিবর্তন করা হয়।

জহিরুলঃ ক্ষমতাসীনরা নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকার জন্য বারবার সংবিধান সংশোধন করেছে। সংরক্ষিত নারী আসন রেখেছে, তা দুই দফায় বৃদ্ধিও করেছে।

মঞ্জুঃ সংশোধনীগুলোর ধরন দেখলে যে কোনো সচেতন মানুষের মনে সংশোধনীর উদ্দেশ নিয়ে খটকা লাগবে। আপনি শুধু একটির পর একটি সংশোধনী দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান দুই দফায় নয়, তিন দফা বৃদ্ধি করে মূল সংবিধানের ১৫টি সংরক্ষিত আসন থেকে ৫০টিতে উন্নীত করা হয়েছে। ১৯৯০ সালের ১২ জুন পাস করা দশম সংশোধনীতে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ এ বৃদ্ধি করে সংরক্ষিত আসনের মেয়াদ দশ বছর বাড়ানো হয়। একাদশ সংশোধনী পাস করা হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট প্রেসিডেন্ট এরশাদের পতনের পর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের দায়িত্ব গ্রহণ নিয়ে; যে সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগদানকে বৈধ ঘোষণা, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ভাইস প্রেসিডেন্ট পুনরায় প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করতে পারবেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার কর্মকাল বিচারপতি হিসেবে গণ্য হবে বলে বিধান সংবিধানে সন্নিবেশিত হয়। এ সংশোধনীতেও স্পষ্ট যে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের একগুয়েমির কারণে তাঁকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন শেষে পুনরায় প্রধান বিচারপতি পদে ফিরিয়ে আনার সুযোগ সৃষ্টি ও তার অনুপস্থিতকালীন সময়কেও বিচারপতি হিসেবে তার কার্যকাল হিসেবে গন্য করার জন্য এ সংশোধনী আনা হয়েছিল। একজন প্রধান বিচারপতি যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে রাষ্ট্রকে পণবন্দী বানিয়ে ফেলেন সেখানে আপনি কার কাছে কি আশা করতে পারেন?

দেশের সাংবিধানিক বিকাশের ক্ষেত্রে দ্বাদশ সংশোধনী একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী। ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছিল দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তা পুনর্বহাল করা হয় এবং এ সংশোধনীও পাস করা হয় ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান রেখে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাহী প্রধান করা হয়, যেখানে মন্ত্রী পরিষদের নেতৃত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীরা তাদের কাজের জবাবদিহিতার জন্য দায়ী থাকবেন জাতীয় সংসদের কাছে। এ সংশোধনীতে ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং বিধান করা হয় যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা। অদৃষ্টের পরিহাস বলতে হয় যে, আজন্ম গণতন্ত্রের প্রবক্তা, দেশের স্বাধীনতার মূল নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে সংসদীয় গণতন্ত্রকে কবরস্থ করেছিলেন, সেই গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনে একজন সামরিক শাসকের নেতৃত্বে গঠিত দল বিএনপি। এর চেয়ে পরিহাসের বিষয় আর কী হতে পারে!

ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ এবং এর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার বিধান সংযুক্ত হয়। এক্ষেত্রেও আপনি একটি বৈপরীত্য লক্ষ্য করতে পারবেন। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে আওয়ামী লীগ আন্দোলন করেছিল, সেই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০১১ সালের ২৫ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপ করে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে আরেকটি পরিবর্তন আনা হয়েছে, তা হলো সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০ এ উন্নীত করা হয়। চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় ২০০৪ সালের ১৬ মে এবং এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে ৪৫ করা হয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ থেকে ৬৭ বছর করা হয়। এই সংশোধনী আনার পেছনে বিএনপি’র অসদুদ্দেশ্য ছিল। তারা চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান পরবর্তী তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন। তাঁর অবসর নেয়ার কথা ২০০৪ সালে। বিচারপতিদের বয়স ৬৭ বছর করা হলে তিনি বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হলে সেই দায়িত্ব লাভ করবেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে তারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবেন। বিচারপতি কেএম হাসান বিএনপির সুবিধাভোগী ছিলেন। দু’জন সিনিয়র বিচারপতিকে ডিঙিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, বিএনপি সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছিল; এমনকি তিনি একটি নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন পর্যন্ত চেয়েছিলেন। অতএব স্বাভাবিক কারণেই এই সংশোধনীর ব্যাপারে প্রশ্ন উঠে এবং আওয়ামী লীগের নেতত্বাধীন মহাজোট প্রবল আপত্তি উত্থাপন করে। শেষ পর্যন্ত তিনি তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হবেন না বলে ঘোষণা দিয়ে বিএনপির আশার গুড়ে বালি ছুঁড়ে দেন। আমার সংসদ রিপোর্টিংয়ের সময়ে আমি চতুর্দশ সংশোধনী পর্যন্ত প্রক্রিয়াগুলো কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। পরবর্তী তিনটি সংশোধনীর মধ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী প্রসঙ্গ আমি চতুর্দশ সংশোধনীর সূত্রে উল্লেখ করেছি। ষোড়শ সংশোধনী আনা হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এবং এ সংশোধনীতে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করা হয়। ২০১৮ সালের ৮ই জুলাই সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে সংসদের ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আরও ২৫ বছরের জন্য শুধুমাত্র নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত রাখার জন্য। নারীদের এই সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা ১৯৭২ সালের সংবিধানেই রাখা হয়েছিল এবং তখন দশ বছরের জন্য আসন সংখ্যা ছিল ১৫টি। সংবিধান প্রণেতারা আশা করেছিলেন যে দশ বছরের মধ্যে নারীদের আরও বিকাশ ঘটবে ও সামর্থ বৃদ্ধি পাবে। দশ বছর পর নারীরাও পুরুষের মতো নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হবেন। যদিও অনেক নারী সরাসরি নির্বাচন করে সংসদে আসছেন, কিন্তু জনসংখ্যায় নারীর অনুপাতের চেয়ে তা নগন্য। নারীরা কাঙ্খিত অগ্রগতি সাধন করতে না পারায় এ-যাবত সংবিধানে শুধু সংরক্ষিত নারী আসন সংক্রান্ত ৫টি সংশোধনী আনা হয়েছে, কোনোটায় সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে, কোনোটায় সংরক্ষণের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

সংক্ষিপ্ত আকারে হলেও কোন সংশোধনী ব্যক্তি স্বার্থে এবং কোনটি দলীয় স্বার্থে আনা হয়েছে আশা করি তা বুঝতে সমস্যা হবে না।

জহিরুলঃ আপনি কমরেড মনি সিংয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, কেমন দেখেছেন এতো বড় একজন কমরেডকে?

মঞ্জুঃ কমরেড মনি সিংকে নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল শৈশব থেকেই। সবসময় শুনতাম যে তিনি কারাগারে আছেন, অথবা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে আছেন। তখন জানতাম না যে আণ্ডারগ্রাউণ্ড বলতে কী বোঝায়। আহম্মক ভাবতে পারে মনে করে কারো কাছে জানতেও চেষ্টা করিনি যে আণ্ডার গ্রাউণ্ডে থাকার মানে কী। আমাদের এলাকায়ও একজন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ছিলেন রবি নিয়োগী। তার ছেলে কাজল নিয়োগী স্কুলে আমার সহপাঠি ছিল। ওদের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম, যা আমি আগেও এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছি। রবি নিয়োগী ব্রিটিশ আমলে কালাপানি বা দ্বীপান্তরের দণ্ড পেয়ে আন্দামানে ছিলেন। স্কুলের একেবারে শেষের দিকে রবি নিয়োগীকে প্রথম দেখি। আগে না দেখার কারণ তিনিও সবসময় কারাগারেই থাকতেন। কাজলদের বাড়িতেই সম্ভবত মনি সিং এর নাম শুনি। প্রথম তাকে দেখি ১৯৭৩ বা ৭৪ সালে। তখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কমিউনিষ্ট পার্টির বড় কোনো সম্মেলন হয়েছিল এবং কাজল নিয়োগীর সাথে দেখতে গিয়েছিলাম। বক্তৃতাও শুনেছিলাম। আমি তার কণ্ঠে জ্বালাময়ী বক্তব্য শুনবো বলে আশা করেছিলাম, কিন্তু তিনি শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে কথা বললেন। অবাক হয়েছিলাম, এমন শান্ত একজন মানুষ এতো জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন কীভাবে। বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা তাকে দেবতাতূল্য শ্রদ্ধা করেন। আমি তার জীবনী জানার চেষ্টা করি। আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহেরই মানুষ। নেত্রকোনায়। মায়ের দিক থেকে তিনি সুসং দুর্গাপুরের বড় জমিদার পরিবারের সন্তান। ব্রিটিশ আমলে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিলেন এবং তার নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও শেরপুর এলাকার বিভিন্ন স্থানে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। টঙ্ক মানে জমিদারদের দ্বারা তাদের অধীনস্থ চাষীদের উৎপাদিত ফসলের ওপর খাজনা আদায়, যার পরিমাণ প্রচলিত খাজনার কয়েক গুনেরও বেশি, যা চাষীদের পক্ষে বহন করা সম্ভব ছিলো না। তার টঙ্ক বিরোধী আন্দোলনের কারণে মামাদের সাথেও তার বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে এই নির্মম প্রথার বিলুপ্তি ঘটে। ব্রিটিশ আমলেই তিনি ত্রিশের দশকে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক হন। পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ সময় তাকে কারাগারে বা আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। ১৯৭১ সালেও তিনি রাজশাহী কারাগারে ছিলেন। তখন বিভিন্ন কারাগার ভাঙার পর্যায়ে রাজশাহী কারাগারও ভাঙা হয় এবং তিনি কারাগার থেকে ভারতে চলে যান। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পরেও প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। পাকিস্তান আমলে কমিউনিস্ট নেতাদের ওপর যেহেতু ‘হুলিয়া’ বা গ্রেফতারি পরোয়ানা ঝুলেই থাকতো সেজন্য অধিকাংশ কমিউনিস্ট নেতা ছদ্মনাম ধারণ করতেন। মনি সিংয়ের নাম ছিল কমরেড আজাদ।

সাংবাদিকতা শুরু করার পর পর তার আরও বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়। সেই একই রকম অতি সাধারণ মানুষের আলাপচারিতার মতো বক্তব্য। লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। ১৯৮৩ সালে আমি যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের ধারাবাহিকতায় কমরেড মনি সিংয়ের সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলাম। আমি তখন শান্তিবাগে থাকতাম। মনি সিংও শান্তিবাগে থাকতেন। অনেক সময় তাকে রিকশায় বাসায় ফিরতে বা বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠতে দেখেছি। তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য সিপিবি’র পল্টনের অফিসে গেলে তাকে ব্যস্ত পাই। আমি অপেক্ষা করি। ব্যস্ততা শেষ হলে আমাকে ডেকে পাঠান। আমি তাঁকে আমার উদ্দেশ্যের কথা বলি। কিন্তু সেদিন তিনি সময় দিতে পারেন না, দু’দিন পর সময় দিতে চান। তাঁকে বলি যে আমি তার বাসার কাছেই থাকি, সময় দিলে আমি বাসায় আসতে পারি। তিনি আগ্রহে সাড়া দেন, আমাকে পরদিন সকাল ১০টায় যেতে বলেন। যতদূর মনে পড়ে শান্তিবাগে তিনি তার ছেলের ভাড়া বাসায় থাকতেন। যথাসময়ে আমি তাঁর বাসায় গিয়ে হাজির হই। বাসা মানে একতলা টিনের বাড়ি, ইটের দেয়াল। বেল বাজানোর পর তিনি নিজেই দরজা খুলে দেন। পরনে ধুতি ও গায়ে গেঞ্জি। আমাকে বসতে বলে তিনি ভেতরে গিয়ে একটি লম্বা সাদা কুর্তা পরে আসেন। বাইরেও সম্ভবত তাঁকে কখনো প্যান্ট বা ধুতি পরা অবস্থায় দেখিনি। সাদা পাজামা ও লম্বা কুর্তা পরনে থাকতো। সারাক্ষণ মুখে স্মিত হাসি। বলেন, আপনাকে ভালোভাবে আপ্যায়নও করতে পারবো না। আমিও বিনয়ের সাথে কথা বলি যে আমি শুধু তার জীবন ও আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাই। রুশ বিপ্লবের প্রায় সাত দশক কেটে গেলেও বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাবের মধ্যে তার দলের পক্ষে কীভাবে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সে সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য জানতে চাই। তিনি বলেন, মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ আমাদের আদর্শ। ক্ষমতা অর্জনের সঙ্কীর্ণতার মধ্যে আমাদের সংগ্রাম সীমাবদ্ধ নয়। মেহনতি মানুষের মুক্তির মধ্য দিয়ে মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করাই আমাদের কাজ। আমাদের পার্টি শ্রমিকের পার্টি, গরিবের পার্টি, ইনসাফের পার্টি। আমরা মানুষের মাঝে থাকবো। তিনি চীনের মাওবাদকে বামপন্থার বিচ্যুতি বলে উল্লেখ করেন এবং পার্টিতে বিভেদের বিরুদ্ধে সবসময় দৃঢ় অবস্থানের কথা বলেন।

জহিরুলঃ তার নিজের জীবনাচারের মধ্যেও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের প্রতিফলন ছিল।

মঞ্জুঃ কমরেড মণি সিং কথার এক পর্যায়ে তিনি থামেন এবং ভেতরে গিয়ে একটি ট্রেতে চা ও বিস্কুট নিয়ে আসেন। আমি নিজেকে ক্ষুদ্র বিবেচনা করতে শুরু করি। আমি কমিউনিজমের পক্ষের লোক নই। কিন্তু তাঁর নেতৃত্ব ও বিনয়ের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল থাকবো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম। তিনিও কমিউনিস্ট ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ১১ বছর কারাগারে কেটেছে। কারাগারে থাকাকালে যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তাঁর বয়স ত্রিশ বছর। তিনি আমাদেরকে রাজনৈতিক দর্শন পড়াতেন। এতো জ্ঞানী, পড়াশোনায় এতো গভীরতা, এবং এতো সরলভাবে বোঝাতেন যে দর্শনের কঠিন বিষয়গুলোও গল্প হয়ে ওঠতো। ছোটখাট আকৃতির এই মহান শিক্ষক এতো বিনয়ী ছিলেন যে, সালাম দিলে তিনি হেসে মাথা প্রায় বুক পর্যন্ত ঝুঁকিয়ে সালামের উত্তর দিতেন, তখন নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতো। আমার বন্ধুর পিতা কমরেড রবি নিয়োগীও ঠিক এমন বিনয়ী ছিলেন। তিনি অনেক সময় সাইকেলে চলাফেরা করতেন। খুব সাধারণ মানুষও যদি তাঁকে আদাব জানাতো, তিনি পাল্টা আদাব দিয়ে সাইকেল থেকে নেমে তার সাথে কথা বলতেন। মানুষের কাছে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণযোগ্য হয়নি, কিন্তু তারা ব্যক্তিগত সততা, বিনয়, মানুষের প্রতি নি:স্বার্থ ভালোবাসার কারণে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। মনি সিং এর সাধনা ছিল মানুষ এবং এক ঘন্টার সাক্ষাৎকারে তিনি একবারও রাজনীতির কথা বলেননি। কে কী ভুল করেছে তাদের সমালোচনা করেননি। মানবতাবাদের কথা বলেছেন। মানুষের জন্য তাঁর ও তাঁর দলের ভালোবাসা ও মানবপ্রেমকেই বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু বলেছেন। তিনি রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলেননি। শিক্ষকের মতো কথা বলেছেন। এমন শিক্ষক আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন। আমি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে আসি।

জহিরুলঃ আপনি পৃথিবীর অনেক দেশ ও শহর ভ্রমণ করেছেন, প্রায়শই বলেন, যদি আবারও কোনো দেশ বা শহর ভ্রমণের সুযোগ আসে পছন্দের তালিকায় প্রথমেই থাকবে দিল্লি। দিল্লির প্রতি এই প্রেম কেন?

মঞ্জুঃ দিল্লিকে সবসময় আমার আপন মনে হয়েছে বলে আমি বার বার দিল্লিতে ফিরে গেছি। দিল্লিকে কখনো ভিন্ন একটি দেশের রাজধানী বলে মনে হয়নি। এখনো দিল্লিতে যেতে চাই। দিল্লির উজিরপুরায় যেখানে ছিলাম সেখানে অল্পদিনেই সেখানকার লোকজন আপন হয়ে গিয়েছিল। আমি এবং আমার সঙ্গে অপর যে বাংলাদেশী ফেলো ছিলেন জাতীয় সংসদের প্রটোকল অফিসার রুহুল আমিন, আমরা এক শিখ ভদ্রলোক মনোহর লাল দং এর বাড়ির তিনতলার একটা রুম ভাড়া নিয়েছিলাম তা আগেও বলেছি। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের পর পাকিস্তান থেকে যখন ভারতে আসেন তখন তার বয়স ছিল চার বছর। যখন আমার সাথে দেখা তখন তিন ছেলে, দুই মেয়ের পিতা। শিখদের মতো তার দীর্ঘ দাড়ি ও মাথায় পাগড়ি ছিল না, কিন্তু হাতে কঙ্গন পরা ছিল। আমরা ভাড়াটের মত ছিলাম না। তার পরিবারের সদস্যের মতো ছিলাম। তার বাসায় ভালো কিছু রান্না হলে ছেলে বা মেয়েদের দিয়ে পাঠাতেন, কখনো নিজেই নিয়ে আসতেন। আমরা যেহেতু সাময়িক বাসিন্দা, আমাদের গ্যাস সিলিণ্ডারের বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব ছিল না। কেরোসিনের স্টোভে রান্না করতাম। কেরোসিনকে হিন্দি ও উর্দুতে বলা হয় ‘মিট্টি কা তেল।’ যখন যেখান থেকে সুবিধা হতো মিট্টি কা তেল কিনতাম। একদিন এক বয়স্কা মহিলার দোকান থেকে মিট্টি কা তেল কিনেছি, যে দোকানে প্রথমবার গিয়েছিলাম। বিশ রুপির নোট দেয়ার পর তিনি অবশিষ্ট ফেরত দিয়েছেন। আমি গুনে দেখিনি উনি কত ফেরত দিয়েছেন। দুই তিন সপ্তাহ সেই দোকানে যাইনি। একদিন একটা দিয়াশলাই কিনতে গেলাম, মহিলা দাম না নিয়ে আমাকে উল্টো বেশ কয়েকটি টাকা দিচ্ছেন। আমি কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, বেশ ক’দিন আগে তুমি মিট্টি কা তেল নিয়ে গেছিলে, আমি ভুলে বেশি টাকা রেখেছিলাম। দোকানে যারা আসে তাদেরকে তোমার হুলিয়া বর্ণনা করে জানতে চেয়েছি, কেউ বলতে পারেনি। তিনি দু:খ প্রকাশ করলেন এবং বার বার ক্ষমা চাইলেন। আমি একজন দরিদ্র দোকানি মহিলার এই সততায় কুণ্ঠিত বোধ করেছি। এরপর ইচ্ছা অনিচ্ছায় তার দোকানে গিয়ে তাকে নমস্কার জানিয়ে এসেছি। দিল্লি থেকে চলে আসার আগেও তার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি। আমাদের বাড়ির সামনের বাড়ির এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে আমরা থাকতেই। তারা আমাদেরকে বিয়েতে দাওয়াত করেছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যদিও দিল্লিতে তেমন আঁচ পড়েনি, তবুও তারা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরদেশে এমন সহানভূতির ছোাঁয়া শুধু সেই মহল্লায় নয়, প্রায় সর্বত্র পেয়েছি। এসব ছাড়াও দিল্লির মোগল ঐতিহ্যের কারণে দিল্লিকে হৃদয়ের কাছাকাছি মনে হয়। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নির্বাসনের মধ্য দিয়ে মোগল রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হওয়া থেকে ১৯৯২ সালে দিল্লিতে আমার অবস্থানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১৩৫ বছর। সময়ের সাথে দিল্লিতে এতো পরিবর্তন সত্বেও দিল্লি মোগল দিল্লিই ছিল। মোগল ঐতিহ্যের প্রতি আমার ভালোবাসার কারণেই দিল্লির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করি।

জহিরুলঃ পড়াশোনার জন্য দিল্লি, বার্লিন, ক্যালিফোর্নিয়ায় গেছেন। পৃথিবীর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ডে পড়াশোনা করেছেন। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের সাথে স্ট্যানফোর্ডের পার্থক্যগুলো কিছু তুলে ধরুন। শিক্ষাদান পদ্ধতি, কারিকুলাম, গবেষণা পদ্ধতি, শিক্ষকদের যোগ্যতা, সততা এবং আন্তরিকতা, শিক্ষার্থীদের ডাইভার্সিটি ইত্যাদির আলোকে বিশ্লেষণ করুন, যা থেকে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু শিখতে পারে।

মঞ্জুঃ কোনো দেশে বেড়ানোর জন্য যাওয়ার চেয়ে পড়াশোনা করতে গেলেই সেই দেশ, মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানা সম্ভব হয় বলে আমি বিশ্বাস করি। অন্যান্য স্থানে শিক্ষা লাভের জন্য যে সময়ের জন্য গেছি, তার চেয়ে স্ট্যানফোর্ডে কাটানোর সময় তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ছিল। আমার সাথে আমার পরিবারও ছিল, সে কারণে পরিবার বিচ্ছিন্ন অবস্থায় যে মানসিক টানাপোড়েন থাকে, আমার তা ছিল না। আমার সতীর্থ দু’একজন ছাড়া সবার পরিবারই ছিল সেখানে। এসব পরিবার ছাড়াও আমাদের প্রোগ্রামের শিক্ষকদের পরিবারের সাথে আমরা একাত্ম ছিলাম। ঘন ঘন পারিবারিক অনুষ্ঠান হতো। বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু পড়াশোনার স্থান বলে মনে হয়নি, নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ একটি সমাজ বলে মনে হয়েছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে অহঙ্কার করি। যারা এ অভিধা দিয়েছেন, তারা নিশ্চয়ই এর পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পেয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যা ব্রিটিশ যুগের পূর্ব-বাংলার ওই সময়ের মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টা ও সংগ্রামের পর প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। কলকাতার বাবুরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে হাসিঠাট্টাও করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টি শেষ পর্যন্ত ভালোভাবে টিকে গেছে, দেশের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে এবং সব মিলিয়ে এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশে বিদেশে বাংলাদেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানেই রয়েছে। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন দেশে আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও অনেক সময় ভাবি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে আমি কী উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেতাম। আমার মনে হয় না যে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম বা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যেতাম। স্ট্যানফোর্ডের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলনা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে হেয় করা হবে, যা আমি করতে চাই না। সম্প্রতি একটি প্রতিষ্ঠান বিশ্বের ৯০টি দেশের ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং করেছে, সেখানে স্ট্যানফোর্ডের অবস্থান দ্বিতীয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১০০১ এ। স্ট্যানফোর্ড যে অর্থ ব্যয় করতে পারে, যতোজন শিক্ষক নিয়োগ করতে পারে, ছাত্রদের যে সুযোগ দিতে পারে তা শুধু বাংলাদেশ নয়, তৃতীয় বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপের দেশগুলো শিক্ষক অনুসন্ধানের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করে, কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন সেরা শিক্ষককে কত বেতনে, কী কী সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে পারবে সেজন্য প্রতিযোগিতা করে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় রাজনৈতিক বিচারে। যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান তারা যে দলের সুপারিশে নিয়োগ লাভ করেন, সেই দলের প্রতি অনুগত থাকেন। অতএব কারিকুলাম যাই হোক, তারা তা অনুসরণ করে পাঠদান করেন না। মাসের পর মাস ক্লাস নেন না। শিক্ষকের সাথে ছাত্রের সম্পর্ক কেমন তার উপর নির্ভর করে ছাত্রের ভালো গ্রেড পাওয়া। তারা পছন্দের খারাপ ছাত্র-ছাত্রীকে ভালো গ্রেড দেন, অপছন্দের ছাত্র-ছাত্রীদের মন্দ গ্রেড দিয়ে জীবন ধ্বংস করে দেন। এ ধরনের প্রবণতার কারণে শিক্ষার মান, শিক্ষকের মান কমেছে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার কাজ নেই বললেই চলে। গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ এতো কম থাকে যা দিয়ে কোনো গবেষণা চলে না। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রের বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গবেষণার কাজ পরিচালনা করতে অর্থ বরাদ্দ দেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাধ্যমে শিক্ষকরা সরাসরি এই অর্থ গবেষণার কাজে ব্যয় করেন ছাত্রদের নিয়োগ করার মাধ্যমে। বাংলাদেশেও এ ধরনের গবেষণার কিছু কাজ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এক শ্রেনির শিক্ষকের নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আমাদের শিক্ষকরা নিজেদের লাভ খোঁজেন আগে। আমাদের শিক্ষকরা যে যোগ্যতার বিচারে পিছিয়ে আছেন তা বলবো না, তারা সে যোগ্যতাকে সততার সাথে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগান না। অতএব পার্থক্য মানসিকতার। স্ট্যানফোর্ডে যারা আমার শিক্ষক ছিলেন তারা বলতেন উইকএণ্ডসেও যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে যাতে আমি ফোন করি, তা পড়াশোনার প্রয়োজনে হোক বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে হোক। আমাদের দেশের ছাত্রশিক্ষকরাও উন্নত দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করেন। অনেকে দেশে ফিরে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন, কিন্তু কিতাবি শিক্ষার বাইরে যা শিখেন তা চর্চা করেন না অথবা করার মতো পরিবেশ পান না। এজন্য শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরাই দায়ী নন, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দায়ী।

জহিরুলঃ যখন বার্লিনে পড়তে যান, ১৯৮৩ সালে, দুই জার্মানি ছিল ভিন্ন দুটি দেশ, একটি সমাজতান্ত্রিক, অন্যটি ধনতান্ত্রিক। বার্লিন তখন বিভক্ত ছিল বার্লিন প্রাচীর দ্বারা। সেই সময়ে আপনার দেখা বার্লিন তথা দুই জার্মানি, এমন কি, টু সাম এক্সটেন্ট ইউরোপের, একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরুন।

মঞ্জুঃ জি, আমি বার্লিনে গেছি ১৯৮৩ সালে। তখন বার্লিন ছিল বিভক্ত নগরী এবং পশ্চিম বার্লিন সম্পূর্ণ প্রাচীরবেষ্টিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এক জার্মানি, ১৯৪৫ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নামে দুটি পৃথক দেশে পরিণত হয়। পূর্ব জার্মানির রাজধানী ছিল পূর্ব বার্লিন এবং পশ্চিম জার্মানি রাজধানী ছিল বন। আমি পশ্চিম বার্লিনের ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর জার্নালিজম এ তিন মাসের একটি ডিপ্লোমা প্রোগ্রামে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৮৩ সালের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পশ্চিম বার্লিনে পশ্চিম জার্মানির মুদ্রা চালু থাকলেও এই নগরী পশ্চিম জার্মানির অংশ ছিল না। বলা হতো ফোর পাওয়ার স্ট্যাটাস। চারটি দেশের পতাকা ওড়তো পশ্চিম বার্লিনে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফ্রান্স। মিত্র বাহিনীর বার্লিনমুখী অভিযানে ১৯৪৫ সালে মিত্রপক্ষের যে দেশের বাহিনী নগরীর যেখানে আগে পৌছেছে তখন থেকে সেখানেই অবস্থান নিয়ে ছিল ১৯৯০ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। সোভিয়েত বাহিনী নগরীর বেশির ভাগ এলাকা দখল করেছিল, যা পূর্ব বালিন। তবে পশ্চিম বার্লিনেও তাদের কিছু কিছু পকেট ছিল, বিশেষ করে দুটি ওয়ার মেমোরিয়াল। একটির প্রহরায় নিয়োজিত থাকতো সোভিয়েত সৈন্যরা। পশ্চিম বার্লিনে অন্য তিনটি রাষ্ট্র যেখানে দখল কায়েম করে রেখেছিল সেদিকে যাওয়ায় কোনো বাধা ছিল না, কিন্তু ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকতো, “ইউ আর ক্রসিং ইউএস সেক্টর”, “ইউ আর ক্রসিং ব্রিটিশ সেক্টর” বা “ইউ আর ক্রসিং ফ্রেঞ্চ সেক্টর।” তিন দেশের ইউনিফর্ম পরিহিত সৈন্যরা নগরীতে ঘুরতো। বিদেশিরা পূর্ব বার্লিন থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিনে ২৪ ঘন্টার জন্য আসতে পারতো চেক পয়েন্ট চার্লি নামে একটি গেট দিয়ে। পশ্চিম বার্লিনে যে সাবওয়ে চলতো তার কয়েকটি লাইন পূর্ব বার্লিনের নিচ দিয়ে ছিল। কয়েকটি স্টেশনে ট্রেন থামতো। সেদিক দিয়ে ওপরে ওঠে পূর্ব বার্লিন ঘুরে আসার সুযোগ ছিল বিদেশিদের। স্টেশনে দু’একটি গিফট শপও ছিল। গিফট কিনতো কেউ কেউ। সস্তায় সিগারেট কিনতো অনেকে। পূর্ব বার্লিনে যেহেতু সবকিছু সাবসিডাইজড ছিল সেজন্য কম দামে পাওয়া যেত সিগারেটসহ অনেক কিছু। ওই স্টেশনগুলো পার হলে অনেক সময় পশ্চিম বার্লিনের কাষ্টমস পুলিশ যাত্রীদের তল্লাশী করতো এবং সিগারেট পেলে ট্যাক্স আদায় করতো। আমার অবস্থানকালে আমি একদিন গাইডেড ট্যুরে পূর্ব বার্লিন গিয়েছিলাম। চেকপয়েন্ট চার্লিতে গাড়ি তল্লাশী করা হলেও যাত্রীদের তল্লাশী করা হয়নি। আমরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়, একটি যাদুঘর, একটি পার্ক ও পূর্ব বার্লিনের ডাউনটাউন ঘুরে একটি রেষ্টুরেন্টে যাই। খাবারের দাম পশ্চিম বার্লিনের দামের অর্ধেকেরও কম। বার্লিনের বাইরে পশ্চিম জার্মানির বেশ কিছু শহর ও উল্লেখযোগ্য স্থান পরিদর্শনের জন্য দুই সপ্তাহের ট্যুর প্রোগ্রাম ছিল। এসময় আমাদেরকে রাজধানী বন এ বিভিন্ন সরকারী দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বত্র তারা বন’কে প্রভিশনাল ক্যাপিট্যাল বা অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, জার্মানি আবারও এক হবে এবং রাজধানী আবারও হবে বার্লিন, যা আমি চলে আসার সাত বছর পর সত্যে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের রাজনীতি ও সামাজিক চিত্র সম্পর্কে ওই সময়ে খুব একটা স্বচ্ছ ধারণা হয়নি। তবে জার্মানিতে একটি বিষয় লক্ষ্য করেছি যে জার্মান প্রবাসী তুর্কিদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য তারা উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে বিভিন্ন প্রনোদনা ঘোষণা করার মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কি শ্রমিকরাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত পশ্চিম জার্মানিকে পুনরায় গড়ে তুলেছে এবং কোনো কোনো সিটিতে ১৯৮৩ সালে তুর্কি নাগরিকের সংখ্যা ৩০ শতাংশ বলেও শুনেছি। তাদেরকে জার্মান নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি। এ সময় পশ্চিম বার্লিনে একটি ঘটনা ঘটে। কামাল আলতুন নামে এক তুর্কির কোনো অপরাধের বিচারে তাকে তুরস্কে ডিপোর্ট করার রায় দেয়ার পর তিনি আদালত ভবনের ছয় তলার এজলাস কক্ষের জানালা দিয়ে লাফ দেন এবং তার মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনার পর তুর্কিদের দেশে পাঠানোর প্রচারণা কিছুটা কমে এসেছিল।

জহিরুলঃ স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কন্ডোলিজা রাইসকে। পরবর্তিতে তিনি বুশ প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান এবং তার সময়ের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়, বিশেষ করে ইরাক যুদ্ধ, নাইন-এলেভেন ইস্যুকে যেভাবে হ্যান্ডেল করা হয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে। আপনার শিক্ষক কন্ডিকে আপনি কেমন দেখেছেন? কতটা ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলেন তার সাথে?

মঞ্জুঃ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় ও প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী সেক্রেটারী অফ ষ্টেট ছিলেন কন্ডোলিজা রাইস। তিনি প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের প্রশাসনে ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত সেক্রেটারী অফ ষ্টেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় ৩৩ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসে সাংবাদিক ছাড়া অন্যান্য পেশার যাদের সাথে কিছু বেশি সময়ের জন্য সম্পর্ক টিকে ছিল তাদের একজন প্রফেসর কন্ডোলিজা রাইস। ষ্ট্যানফোর্ডে আমার ফেলোশিপের মেয়াদে পলিটিক্যাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে তার একটি কোর্স নিয়েছিলাম, ‘মিলিটারি ইন পলিটিকস’। ক্যালিফোর্নিয়ার উত্তরাঞ্চলে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ হলেও শীতের সকালগুলো বেশ ঠাণ্ডা। আমি জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ক্লাসে গেছি। বহু ছাত্রছাত্রী সর্টস পরে এসেছে। ডেস্কের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসেছে। ছেলেমেয়ে জড়াজড়ি করে চুমু খাচ্ছে। কেউ স্যাণ্ডউইচে কামড় দিতে দিতে ক্লাসে ঢুকেছে। কারো হাতে কফির গ্লাস। কণ্ডোলিজা রাইস ক্লাসে এলেন, কেউ উঠে দাঁড়ালো না। ডেস্কের ওপর পা তুলে যারা বসেছিল তারা পা পর্যন্ত নামালো না, বরং যা করছিল তাই করতে থাকলো। কণ্ডি সামনের দিকের একজনকে ডাকলেন লেকচার ডেস্ক ঠিক করে দিতে। যখন তার মনে হলো সবাই তার উপস্থিতি জেনে গেছে, তখন ডেস্কে চাপড় দিয়ে শুরু করলেন, “গুড মর্নিং এভরিবডি, লেটস গেট স্টার্টেড।” সঙ্গে আনা কোর্স আউটলাইনের কপিগুলো একজনকে দিলেন পাস অন করার জন্য। কোয়ার্টারের প্রথম ক্লাস। তিনি শৈশব থেকে তার পরিচয় দিয়ে কোর্স সংক্রান্ত প্রয়োজনে যখন যার প্রয়োজন যোগাযোগ করার জন্য তার ফোন নম্বর, অ্যাপার্টমেন্টের ঠিকানা বলে দিলেন। একহারা গড়নের কৃষ্ণাঙ্গ অবিবাহিতা মহিলা, আমার সমবয়সী হবেন। যখন লেকচার শুরু করলেন তখন মনে হলো আমি কি একজন শিক্ষকের লেকচার শুনছি না, মার্কিন সেক্রেটারি অফ ষ্টেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক ঘোষণা শুনছি। পঞ্চাশ মিনিটের ক্লাস যেন মুহূর্তে শেষ হয়ে গেল। প্রতি সপ্তাহে তার একটি ক্লাসে শ’খানেক নিয়মিত ছাত্রছাত্রীর সাথে উপস্থিত হই আমরা পাঁচ সাংবাদিক। আমি ছাড়া টেক্সাসের অষ্টিন-আমেরিকান নিউজের জন সি হেনরি (পরবর্তীতে এসোসিয়েটেড প্রেন এর ওয়াশিংটন ব্যুরোর নিউজ এডিটর), ফরচুন ম্যাগাজিনের ষ্টুয়ার্ট গেনেস (বর্তমানে ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রয়টার্স ডিজিটাল ভিশনের ডাইরেক্টর), অষ্ট্রেলিয়ার দি এইজের ষ্টিভ হ্যারিস (সর্বশেষ মেলবোর্নের দ্য হেরাল্ডের প্রধান সম্পাদক ছিলেন) এবং তুরস্কের সাবাহ নিউজের এরগুন বাবাহান (পরবর্তীতে সাবাহ ডেইলির সম্পাদক হন) ছিলেন।

পরবর্তী তিনটি মাস সপ্তাহে তার চারটি ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি। গ্রুপ স্টাডির পর রিপোর্ট জমা দিয়েছি। আমাদের লাউঞ্জে বক্তব্য দিতে এসেছেন। তার বক্তব্যে ঘুরে ফিরে এসেছে ভিয়েতনাম প্রসঙ্গ। তিনি বলেছেন, আমেরিকান সিভিল ওয়ারের অভিজ্ঞতা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বহি:শত্রুর আক্রমণের একমাত্র অভিজ্ঞতা ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানি বিমান হামলা। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার মূল ভূখণ্ডে কখনো যুদ্ধ দেখতে হয়নি। বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলো থেকে যে যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়েছে তা মূলত প্রক্সি ওয়ার এবং এসব যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে, ভিয়েতনামেও তাই ঘটেছিল। তিনি ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ের কথা স্বীকার করেননি। তার মতে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরাজয় ঘটেছিল ওয়াশিংটনে। ভিয়েতনাম পরিস্থিতি সামলাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতাকে দায়ী করে বলেন, দেশে যুদ্ধ বিরোধী বিক্ষোভ সাফল্যের সঙ্গে দমন করা হলে ভিয়েতনাম কখনোই আমেরিকার দু:স্বপ্নে পরিণত হতো না। দেখতে দেখতে এক কোয়ার্টার কেটে গেল। এর মধ্যে আমরা কন্ডোলিজা রাইসের সাথে কিছুটা ঘনিষ্ট হয়েছি। সেকেন্ড কোয়ার্টারেও তার একটা কোর্স নেব ঠিক করেছি। কিন্তু প্রফেসর রাইস কোর্সটি ক্যান্সেল করে দিয়েছেন। ষ্ট্যানফোর্ড ডেইলিতে খবর বের হলো, কন্ডোলিজা রাইস বুশ (সিনিয়র) প্রশাসনে জয়েন করতে যাচ্ছেন। সে কারণে কোর্স ক্যান্সেল করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেবেন।

আমাদের প্রোগ্রামের যে পাঁচজন সাংবাদিক কন্ডোলিজা রাইসের ক্লাসে এটেন্ড করেছি, তারা দশ পনের ডলার করে চাঁদা দিয়ে তাকে ফ্যাকাল্টি ক্লাবে লাঞ্চে ইনভাইট করলাম তার সাথে নিবিড়ভাবে আলাপ করার জন্য যে প্রকাশিত খবর সঠিক কিনা। এ সম্পর্কে তাকে প্রশ্ন করলে তিনি জানালেন যে, বুশ এডমিনিষ্ট্র্রেশন থেকে তাকে অফার দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতো কম বয়সে তিনি সরাসরি মিনিষ্ট্রিতে যোগ দিতে চান না। তবে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে কাজ করার সুযোগ এলে তিনি বিবেচনা করবেন। তার মতে, ‘ওটাই আমার কাজের জন্য ভাইটাল প্লেস্’। যাহোক, কয়েকদিন পরই ষ্ট্যানফোর্ড ডেইলিতে আবার সংবাদ প্রকাশিত হলো, প্রফেসর কন্ডোলিজা রাইস ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ন্যাশনাল সিকিউরিটি এডভাইজার প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের প্রশাসনে ২০০১-২০০৪ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে রিগ্যান প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্রের সোভিয়েত নীতি নির্ধারণে তার বড় ভূমিকা ছিল। ইউএস আর্মির জয়েন্ট চিফ অফ স্টাফের সোভিয়েত এডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ প্রভোষ্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে অবস্থিত হার্বার্ট হুভার ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শৈশব থেকে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন সর্বত্র। শিক্ষক বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান কণ্ডোলিজা রাইস তিন বছর বয়সে পিয়ানো শিখতে শুরু করেন এবং তার পা পিয়ানোর পা-দানি স্পর্শ করার মতো উচ্চতা সম্পন্ন হওয়ার আগেই বাখ ও বেটোফেন বাজাতে শিখেন। তিনি স্কেটিং রপ্ত করেন, ফ্রেঞ্চ ও স্পেনিশ ভাষা আয়ত্ব করেন। এগার বছর বয়সে এইটথ গ্রেডে ভর্তি হন এবং পনেরো বছর বয়সে হাইস্কুল শেষ করেন। ডেনভার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেন। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন ১৯৮১ সালে।

তিনি সেক্রেটারী অফ স্টেট হওয়ার পর আমি ও আমার স্ত্রী ২০০৭ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে আসি। ওয়াশিংটনে আমার ষ্ট্যানফোর্ডের সতীর্থ এসোসিয়েটেড প্রেসের নিউজ এডিটর জন হেনরির বাড়িতে থাকি। তিনি আমাকে বলেন যে আমি কণ্ডোলিজা রাইসের সাথে দেখা করতে চাই কিনা। তাৎক্ষণিক দেখা করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বলেন, অন্তত দু’দিন লাগবে। তবে দেখা দিতে অস্বীকার করবেন না। কিন্তু আমার পক্ষে দু’দিন ওয়াশিংটনে থাকা সম্ভব ছিল না, নিউইয়র্কে নির্ধারিত কিছু কাজ থাকায়।

জহিরুলঃ সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়তেই ফেলোশিপ নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে গেছেন, পৃথিবীর বহু নামকরা সাংবাদিককে সতীর্থ হিসেবে পেয়েছে, আপনার একজন সহপাঠি হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান রিচার্ড হারশিলার এর সঙ্গে আমার বুদাপেস্টে দেখা হয়। এক দুপুর তার সঙ্গে আড্ডা দেবারও সুযোগ পাই। সেইসব বিখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিদের সম্পর্কে কিছু বলুন।

মঞ্জুঃ ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিখ্যাত কিছু ব্যক্তিত্ত্বের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। কিছু লোকের সাথে চকিতে পরিচয়, আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ হয়েছে, এরপর আর কখনো কোনো কারণেই তাদের সাথে যোগাযোগ ঘটেনি। এই তালিকার মধ্যে মধ্যে ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ শুলজ, ওয়াশিংটন পোস্টের খ্যাতনামা কলামিস্ট ডেভিড ব্রোডার, রয়টার্সের ট্রাস্টি ও অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির কুইন এলিজাবেথ ইন্সটিটিউটের পরিচালক নেভিল ম্যাক্সওয়েল, রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পরিচালক ডেভিড চিপ এবং আরো কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি। সাক্ষাতের আগেই শেষোক্ত দু’জনের সাথে চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিল। নেভিল ম্যাক্সওয়েল লন্ডনের দি টাইমসের প্রতিনিধি হিসেবে ষাটের দশকের উল্লেখযোগ্য সময় দিল্লিতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয় নেভিল ম্যাক্সওয়েল তার উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটির নাম “ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার”। গ্রন্থটিতে চীনের মতো একটি দেশের সাথে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া ভারতের মূর্খতা ছিল বলে সমালোচনা করা হয় এবং এতে ভারত সরকারের যুদ্ধ সংক্রান্ত গোপন দলিলের যেসব উদ্ধৃতি দেয়া হয় তা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে। কারণ যুদ্ধে অপমানজনক পরাজয়ের কারণে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন পদত্যাগ করেন, তদানীন্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল কারিয়াপ্পা পদত্যাগ পত্র পেশ করলেও প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অনুরোধে তা প্রত্যাহার করে নেন।

ভারতের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী সরকারী গোপন দলিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ছাড়া কারো স্পর্শ পড়ার সুযোগ না থাকলেও কি করে একজন বিদেশি সাংবাদিকের হাতে সেসব দলিল পৌঁছুলো তা প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। মেজর জেনারেল বিএম কাউল, যাকে ম্যাক্সওয়েল তার গ্রন্থে সামরিক প্রস্তুতিহীনতার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন, তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ খণ্ডানোর সুযোগ পান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পর একটি গ্রন্থ রচনা করে। গ্রন্থটির নাম “দি আনটোল্ড স্টোরি”। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার যুক্তি ও ব্যাখ্যা নীতি নির্ধারকদের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। নেভিল ম্যাক্সওয়েল বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথেও ঘনিষ্ট ছিলেন এবং আমাকে লিখা এক পত্রে তিনি তার বন্ধু অর্থনীতিবিদ ড. রেহমান সোবহানের সাথে সাক্ষাৎ করতে বলেন। কিন্তু আমি তার সাথে সাক্ষাৎ করিনি। কারণ, এই মহাপণ্ডিত অর্থনীতিবিদ, যিনি ভালোভাবে বাংলা ভাষাও বলতে পারেন না, বাংলার মানুষের সাথে যার সম্পর্ক অতি ক্ষীণ, ১৯৬৬ সালে যখন তার বয়স ত্রিশ বছরও পেরোয়নি, সেই অপরিণত বয়সে তিনি এবং তার কিছু সহযোগী আওয়ামী লীগকে ৬ দফা উপহার দিয়ে বলেন যে, দফাগুলো আদায় করতে পারলেই দেশ “সোনার বাংলা” হয়ে যাবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৬ দফা বাস্তবায়নে আর বাঁধা ছিল না, কিন্তু দেশ সোনার বাংলায় পরিণত হওয়া দূরে থাক, দারিদ্র আরো বিস্তার লাভ করায় ভূমিহীনের সংখ্যা আরো বেড়েছে। অতএব ৬ দফার অন্যতম এই তাত্ত্বিককে আমি পছন্দ করতে পারিনি। কথাটি আমি ম্যাক্সওয়েলকে বলেছিলাম তিনি যখন ১৯৮৯ সালের মে মাসে লন্ডন থেকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এসেছিলেন নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের বার্ষিক ডিনারে যোগ দিতে। তার গ্রন্থ এবং জেনারেল বিএম কাউলের গ্রন্থ নিয়ে আমাদের আলোচনার সুযোগ হয় এবং তিনি আমাকে অক্সফোর্ডের প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু অক্সফোর্ডের প্রোগ্রামের তহবিলদাতাও যেহেতু রয়টার্স, অতএব সেখানে আমার যাওয়া হয়নি।

ডেভিড চিপ দীর্ঘদিন রয়টার্সের রিপোর্টার ছিলেন এবং ভারত বিভাগের উপর অনেক রিপোর্ট করেছেন। পরবতীতে তিনি এডিটোরিয়াল বিভাগে যোগ দেন। আমি রয়টার্সের ফেলো নির্বাচিত হলে ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পরিচালক হিসেবে এবং তাতে ঢাকা ও বগুড়া সফর সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন। পাকিস্তান স্বাধীন হবার কয়েক বছর পর ১৯৫৩ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর আমন্ত্রণে। প্রধানমন্ত্রী তাকে বগুড়ার কি একটি ‘সুইট’ (সম্ভবত বগুড়ার দই) নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন, তা তার স্মরণে আছে। তবে তাঁর সফরকালের ‘উধপপধ’ সিটি কেন উযধশধ হলো তা তিনি মেনে নিতে পারেননি। এক বছর পর যখন ক্যালিফোর্নিয়ায় তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হলো তখনওা তিনি প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছিলেন।

ষ্ট্যানফোর্ডে সাংবাদিকতা বিভাগে জন এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগামের সূচনা হয়েছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর জন লাইলের হাতে। আমি যখন প্রোগ্রামে যোগ দেই তখন তিনি এমিরেটাস প্রফেসর এবং প্রোগ্রামের সঙ্গে তিনি ও তার স্ত্রী দু’জনই নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যারা প্রোগ্রামে আসতেন দু’জনই তাদেরকে সন্তানতূল্য ভালোবাসা দিতেন এবং কার কী প্রয়োজন তা সরবরাহ করতেন। তাদের সান্নিধ্য আমাকে আপ্লুত করেছে। পরিচালক হিসেবে পেয়েছিলাম ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে সাংবাদিকতায় পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী জেমস ভি রিসারকে। স্ট্যানফোর্ডে আমাদের প্রোগ্রামের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যারি এন প্রেস স্যান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকলে কাজ করার সময় স্ট্যানফোর্ডের জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টে যোগ দেন এবং ১৯৮৯ সালে অবসর নেয়ার সময় পর্যন্ত দুই যুগ এই প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বিশ্বের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে তার পরিচিত সাংবাদিক ছিল না। ২০১১ সালে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকাকে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের আরেক ফেলো ডেনভার পোষ্টের এডিটোরিয়াল কার্টুনিষ্ট মাইকেল কিফি। টেক্সাসের জন হেনরি এসোসিয়েটেড প্রেস এর ওয়াশিংটন ব্যুরোতে নিউজ এডিটরের দায়িত্ব পালন করেছেন। বারবারা আয়ারল্যাণ্ড নিউইয়র্ক টাইমসের ট্রাভেল এণ্ড ফ্যাশন সেকশনের এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অবসরে গেছেন। এই সব বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে একসাথে কাটাবার সুযোগ পেয়েছি এবং এখনো যে তাদের অনেকে আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তা ভেবে আনন্দিত হই। দীর্ঘ তিন দশক অতিক্রান্ত হলেও মনে হয়, এই তো সেদিনের ব্যাপার। ২০১৩ সালে আমি ও আমার স্ত্রী স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে গিয়ে সাবেক ডাইরেক্টর জেমস রিসার ও তার স্ত্রী স্যান্ডিকে ছাড়া আমার পাঁচজন সতীর্থকে পাই। দীর্ঘ ব্যবধানেও কারো মাঝে আন্তরিকতার ঘাটতি ছিল না।

আপনার সাথে আমার সতীর্থ হাঙ্গেরিয়ান সাংবাদিক রিচার্ড হারশিলারে সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার ঘটনা আমার জন্য আনন্দদায়ক। রিচার্ড আমার সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ সতীর্থ। বাণিজ্যিক ব্যাংকে তাঁর কর্মজীবন শুরু হলেও সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৬৯ সালে একটি দৈনিক সংবাদপত্রে যোগদানের মধ্য দিয়ে। তিনি যখন স্ট্যানফোর্ডে আসেন তখন বুদাপেস্ট থেকে প্রকাশিত ‘হেতি ভিলাগগাজ দাসাগ’ (ওয়ার্ল্ড ইকনমিক উইকলি) নামে একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭৯ থেকে তিনি ম্যাগাজিনটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করছিলেন। অত্যন্ত রসিক এবং সজ্জন লোক। তার সাথে আমার সম্পর্ক শুরু থেকেই আন্তরিকতাপূর্ণ ছিল। আমি যেহেতু গাড়ি চালাই না সেজন্য রিচার্ড বলতেন শপিং এর প্রয়োজন হলে জানিও আমার ওয়াইফ নিয়ে যাবে। তিনিও গাড়ি চালাতেন না। যেহেতু আমরা দু’জনই ক্যাম্পাসের হাউজিং এ ছিলাম, তার স্ত্রী কেনাকাটার জন্য বের হলে আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে হর্ন বাজাতেন, আমি অথবা আমার স্ত্রী তার সাথে যেতাম। পুরো সময়টাই এভাবে কাটে। সর্বশেষ তিনি এইচভিজি অনলাইন নিউজ পোর্টালের চিফ এডিটর ছিলেন। গত বছর অবসর নিয়েছেন। গতবছর (২০১৯) মার্চ মাসে তার হার্ট সার্জারি হয়েছে। তার স্ত্রী কাটালিনা, যিনি আমাদের কেনাকাটায় রাইড দিতেন ১০ বছর আগে তার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়েছে। কাটালিনা এবং তার মেয়ে পেট্টা যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছেন।

জহিরুলঃ একসঙ্গে ভ্রমণ করলে, এক ছাদের নিচে রাত কাটালে পরস্পরকে চেনা যায়, জানা যায় অনেক বেশি। আপনি বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত মানুষের সাথে দেশে-বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর আতিউর রহমান, কবি সৈয়দ শামসুল হক প্রমূখ। মানুষ হিসেবে কেমন দেখেছেন সেইসব বিখ্যাত মানুষকে?

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, কোনো মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মিশলেই তার সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা সম্ভব হয়। শুধু ভ্রমণ বা একত্রে রাত কাটানো নয় ছাত্রজীবনে সহপাঠি ও শিক্ষক, কর্মজীবনে সহকর্মীদের চেনা যায় ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা ও চলাফেরার মধ্য দিয়েই। দেশে ও বিদেশে খ্যাত ও অখ্যাত অনেক ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্টভাবে মেশার এবং এক ছাদের নিচে, কখনো বা একই কক্ষে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্কে সাধারণভাবে জানার চেয়েও বেশি জানতে পেরেছি। আমার বিদেশে অবস্থানকালীন দুটি ঘটনার কথা বলি। ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার থাকার স্থায়ী জায়গা ঠিক হওয়ার আগে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস উইলবার হলে আমাকে দিন দশেক থাকতে হয়েছিল। আমার সাথে একই রুমে ছিল আমার সতীর্থ নাইজিরিয়ার ওলাতুনজি লার্ডনার। তিনদিন পর সে তার বরাদ্দকৃত জায়গায় চলে গেলে রুমে এলো সামান নামে শ্রীলঙ্কার এক ছেলে। আমেরিকার অন্য এক ইউনিভার্সিটিতে আণ্ডারগ্র্যাড শেষ করে স্ট্যানফোর্ডে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্রাজুয়েট কোর্স করতে এসেছে। ভাবলাম ভালোই হলো, কাছাকাছি দেশের ছেলে। বছর চারেক যাবত সে আমেরিকায়। আচার আচরণে আমেরিকান প্রভাব সুস্পষ্ট। একদিন সে গোসল করে রুমে ফিরেই কোমরে প্যাচানো টাওয়েল খুলে আমার সামনেই ন্যাংটা হয়ে সর্বাঙ্গে ক্রিম মাখতে লাগলো। বয়সে অন্তত বছর দশেক বড় হওয়ায় উপমহাদেশীয় রীতি অনুযায়ী ওর কাছে যে সমীহ আমার প্রাপ্য ছিল সে এভাবেই তা শোধ করলো। এটা ওভারলুক করলেই হয়তো আমার গ্লানিবোধ হতো না। এর আগে বার্লিনে থাকাকালে এ ধরনের বিষয়গুলোকে আমল দেইনি। গ্রুপের মধ্যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট ছিল ঘানা স্কুল অফ জার্নালিজমের শিক্ষক কুজো অ্যান্টনি বাতসি। আমার বয়সী। একই ফ্লোরের দুই প্রান্তে আমাদের রুম। ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া আমরা দু’জন একসাথেই কাটাতাম। বাতসি গোসল করে এসে আমার সামনেই উদোম হয়ে শরীর মুছতো। কী একটা তেল মেখে মিশমিশে কালো রঙ আরও চিকচিকে করে তুলতো। আমি যে ওর সামনেই বসা তাতে সে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করতো না। তেল মাখতে মাখতে আমার সাথে কথা বলতো। অথচ গ্রুপের মধ্যে একমাত্র সে অন্য কালো সতীর্থদের মতো বারে গিয়ে বা রুমে মদ পান করতো না। কেনিয়ার গ্রে ফোম্বে বা জাম্বিয়ার রিচার্ড থিউ এর মতো জার্মান মেয়েদের পটিয়ে রুমে আনতো না। ফোম্বে আমাদের দু’জনকে বলতো “ইয়োগী এণ্ড ভেজিটারিয়ান।” কুজো বাতসি নিয়মিত জিসাসের নামে প্রার্থনা করতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শ্রীলঙ্কার সেই তরুণের আচরণ আমার কাছে অশিষ্ট মনে হয়েছে। আপনি দু’জন খ্যাতিমান ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন তাদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের সাথে দিল্লির দুটি হোটেলে একই রুমে পাঁচদিন কাটানো, একসাথে চলাফেরার অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটি ওয়ার্কশপে বাংলাদেশ থেকে আমরা দু’জনই প্রতিনিধিত্ব করেছি। আমি তাকে চিনলেও ঢাকায় কখনো তার সাথে কথা হয়নি। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ এবং রমজান মাস। আমি রোজা ছিলাম। যাওয়ার সময় ঢাকা এয়ারপোর্টেই ড. আতিউরকে দেখেছি। আমি জানতাম না যে তিনিও দিল্লিতে একই প্রোগ্রামে যাচ্ছেন। বিমানে উঠে তাকে দেখলাম। কলকাতা এয়ারপোর্টে ইন্টারন্যাশনাল এরাইভ্যাল থেকে একই জিপে উঠে ডমেস্টিক ডেপারচার লাউঞ্জে গেলাম। একই বিমানে দিল্লিতে গেলাম। তবুও কথা হয়নি। দিল্লি যেহেতু আমার পরিচিত শহর, এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা আনন্দনগরে নির্ধরিত হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে শুয়ে পড়েছি। ঘন্টাখানেক পর দরজায় টোকা পড়লো। খুলে দেখি ড. আতিউর। দু’জনই অবাক হলাম। ঢাকা থেকে একসাথে আসার পর তখনই বোঝা গেল আমরা একই প্রোগ্রামে এসেছি। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। রাতে আর কথা হয়নি। সেহরির জন্য আমি সামান্য খাবার রুমে এনে রেখেছিলাম, খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে উঠে উনি নাশতা সেরে এলেন। ড. আতিউর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বছরের সিনিয়র। তার সাবজেক্ট অর্থনীতি, আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের কখনো দেখা হয়নি। পরিবেশ বিষয়ক একটি সংগঠন ছিল তার, সেই সুবাদে নাম জানতাম। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ড. আতিউরকে জনতা অথবা অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করেছিল। তখন তার পরিচিতি আরো বাড়ে। বিএনপি এসে তাকে সরিয়ে অন্য কাউকে চেয়ারম্যান করেছে। রাতেই তিনি বলেছিলেন যে বিএনপি তাকেই চেয়ারম্যান রাখতে পারতো। তিনি চলবেন সরকারের নীতি অনুযায়ী। আমি বলি আপনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ট না হলে তারা আপনাকে চেয়ারম্যান করতো না। আপনি কী করে আশা করতে পারেন যে বিএনপি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিয়োগ মেনে নেবে।

জহিরুলঃ অনেক মেধাবী মানুষ আছেন যারা দলীয় নিয়োগ পাওয়া সত্বেও প্রকৃতপক্ষে দেশ ও গণমানুষের জন্য কাজ করেন কিন্তু আমাদের রাজনীতি এতোটাই অন্ধ তারা দলের বাইরে আর কিছু ভাবতে পারেন না। তাই ক্ষমতা বদল হওয়ার সাথে সাথে খোল-নলচে পাল্টে ফেলতে তৎপর হয়ে উঠেন।

মঞ্জুঃ ওয়ার্কশপের আয়োজক প্রতিষ্ঠান ভারতের প্রখ্যাত পরিবেশবিদ অনীল আগরওয়ালের প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর সায়েন্স এণ্ড এনভায়রনমেন্ট বা সিএসই। দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে লড়ে যখন আমাদের ওয়ার্কশপ হচ্ছিল তার এক মাস আগে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। ১৯৯৯ সালেও সিএসই’র এক কর্মসূচিতে দিল্লি গিয়ে তাঁর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কথা শুনেছি। ব্যতিক্রমী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন অনীল আগরওয়াল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি নিলেও পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাংবাদিকতা। হিন্দুস্থান টাইমসের সায়েন্স রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার সময় পরিবেশ আন্দোলনে ঝুঁকে পড়েন এবং প্রতিষ্ঠা করেন সিএসই। তাঁর পরিবেশ বিষয়ক লেখা প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি তাকে আমন্ত্রণ জানান তার মন্ত্রীসভায় বক্তব্য দেয়ার জন্য, যা এক নজীরবিহীন ঘটনা। অনীল আগরওয়াল তার অবদানের জন্য ভারতের রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পদ্মভূষণ ও পদ্ম বিভূষণে ভূষিত হয়েছিলেন। তার মৃত্যুতে সিএসই’র পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তূখোড় নারী পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণ। ওয়ার্কশপের স্থান হ্যাবিট্যাট সেন্টার। আমাদেরকে বলা হয়েছিল নিজেদের টাকায় টিকেট করে যেতে, যা দিল্লিতে গেলেই রিইমবার্স করা হবে। এটা নতুন কিছু নয়, এর আগেও তা করেছি। অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার পরই সবাইকে ফরম দেয়া হলো তা পূরণ করে এয়ারটিকেটের সাথে জমা দিতে। টিকেটের দাম ডলারের হিসেবে ২৪ হাজার রুপির কিছু বেশি, তার সাথে দিল্লি এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া ১২০ রুপি। ড. আতিউর এগিয়ে এসে আমার ফরম দেখতে চাইলেন। দেখে বললেন, এতো কম কেন? উনার ফরম দেখালেন, ২৮ হাজার রুপির বেশি। আমি বললাম টিকেটের দাম তো একই, আপনার এমাউন্ট এতো বেশি কেন? উনি বললেন, আপনি তো দেখছি ঢাকায় এয়ারপোর্টে আসা, ফেরার সময় এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় যাওয়া, হোটেল থেকে আবার যে এয়ারপোর্টে যাবেন সেই ট্যাক্সি ভাড়াও লিখেননি। ফরম পাল্টে আরেকটা নিন। বাসা থেকে আমার এয়ারপোর্টে আসা আরেক কাহিনি। হাসি চাপলাম। ফ্লাইটের সময় ছিল ইফতারের কাছাকাছি সময়ে। এয়ারপোর্টের কাছেই বনানীতে থাকি। তবুও তো ঘন্টা দেড়েক আগে পৌঁছানো প্রয়োজন। ইফতারের আগে ঢাকায় যানজট স্বাভাবিক সময়ের যানজটের চেয়েও বেড়ে যায়। রফিককে গাড়ি নিয়ে আসতে বলেছিলাম, সে জানালো পল্টনে আটকা পড়ে আছে। আমার ছেলে সাদকে বললাম ক্যাব, স্কুটার য্ াপায় নিয়ে আসতে। সে যে কাকলি মোড়ে গেছে, আর ফিরে আসে না। আমার উৎকণ্ঠা বাড়ছে। আধা ঘন্টা পর সে নিয়ে এলো একটা মিশুক, আর কোনকিছু পায়নি। ভাবার সময় ছিল না। মিশুক চালাচ্ছে এক বাচ্চা ছেলে। বললো রাস্তায় ক্যাব বা স্কুটার পেলে আমাকে উঠিয়ে দেবে। কিছুই পাওয়া যায়নি। সে বললো, স্যার, চিন্তা কইরেন না, ফার্স্ট গিয়ারে এমুন টান দিমু, ওপরে উইঠা যাইবো। এয়ারপোর্টের প্রবেশ পথে সিকিউরিটি আটকালো। কিছুতেই মিশুক যেতে দেবে না। তাদেরেকে অন্য যান না পাওয়ার কাহিনি, ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে আসার কথা বলি। তাদের দিল নরম হয়। মিশুক চালক ফাষ্ট গিয়ারে দিয়ে টান দেয়, খুব এগুতে পারে না। ভয় হচ্ছিল পেছনে ছুটতে শুরু করবে কিনা। শেষ পর্যন্ত সে ওঠতে সক্ষম হয়। ওর ভাড়া ছিল ষাট টাকা, আমি ওকে একশ টাকা দেই। এই টাকাও আামাকে যোগ করতে হবে। আমার চেয়ে তার তিন হাজার রুপি বেশি হওয়ার কারণ ঢাকা ও দিল্লির ট্যাক্সি ভাড়া বাড়িয়ে লেখা। আমি প্রকৃত ভাড়া যোগ করতে পারতাম, কিছুতেই বাড়িয়ে লিখতাম না। দিল্লিতে তিন হাজার রুপি অনেক রুপি। আমি তার পরামর্শ না শুনে ২৪ হাজার প্লাস রুপি নিলাম। তিনি ২৮ হাজার প্লাস নিলেন।

জহিরুলঃ বড় মানুষের কাছ থেকে বড় নৈতিকতা আমরা আশা করি কিন্তু তাদের ক্ষুদ্রতাগুলো আমাদের স্বপ্নকে আহত করে।

মঞ্জুঃ জি, আমরা অনেক সময় সামান্য লোভের উর্ধে ওঠতে পারি না। তবে সমাজে ভালো মানুষও আছে। যাদের কারণে সমাজ এখনো টিকে আছে এবং তাদেরকে দেখে মানুষ হতাশার মধ্যেও আশায় বুক বাঁধে। আশির দশকের শেষ দিকে তথ্য সচিব ছিলেন আবদুস সোবহান। অত্যন্ত সজ্জন ও সৎ মানুষ হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি যখন ডেপুটি সেক্রেটারী ছিলেন তখন প্রায়ই সচিবালয়ে তার অফিসে যেতাম। তার অফিসের হেড করণিক রেজাউল করীম আমাদের বিজ্ঞাপন বিভাগে রাতের বেলায় পার্টটাইম কাজ করতেন। যিনিই ওই সেকশনে ডেপুটি সেক্রেটারী হিসেবে যান, রেজাউল করীম তার ট্যুরের টিএ/ডিএ বিল তৈরি করে ডেপুটি সেক্রেটারীর স্বাক্ষর নেন। সোবহান সাহেব ওই সেকশনে বদলি হয়ে আসার পর রাজশাহী রেডিও ষ্টেশনে ট্যুরে গেছেন। রেজাউল করীম টিএ/ডিএ বিল করে স্বাক্ষর নিতে এসেছেন। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন এবং বলেন, রাজশাহী যাওয়ার সময় আমি আমার এক বন্ধুর গাড়িতে গেছি, আরিচা থেকে ফেরিতে পার হওয়ার সময় লাঞ্চ করিয়েছে আমার বন্ধু। রাজশাহীতে রেডিও অফিস খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বন্ধুর বাড়িতে ছিলাম। হোটেল ভাড়া লাগেনি। আপনি নতুন করে লিখে আনুন শুধু রাজশাহী থেকে ঢাকায় ফেরার ভাড়া। ফেরার পথে খাওয়ার খরচও লেখার প্রয়োজন নেই। বাড়িতে থাকলেও তো আমাকে নিজের খরচেই খেতে হতো। সোবহান সাহেবের সাথে ড. আতিউরকে মেলানোর চেষ্টা করি।

তিনদিনের ওয়ার্কশপ শেষে আমি আরও কয়েকদিন দিল্লিতে থাকবো। তিনিও দু’দিন থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। আমার সাথে দিল্লি ঘুরে দেখতে চান। সিএসসি’র দেয়া হোটেলে থাকা যাবে না। অনেক ভাড়া। আমি সাধারণত সিআর পার্কের এক রেস্ট হাউজে থাকি। দিল্লির প্রধান বাঙালি এলাকা এবং অধিকাংশই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে যাওয়া প্রায় তিন হাজার বাঙালি পরিবারকে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয় ষাটের দশকে, যার নাম ছিল “ইস্ট পাকিস্তান ডিসপ্লেসড পারসনস কলোনি” বা ইপিডিপি কলোনি। আশির দশকে জায়গাটির নামকরণ করা হয় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস কলোনি। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রেষ্ট হাউজে উঠি। হোটেলের মতো নয়। বাড়ির মতো পরিবেশ। জনৈক নাগ বাবু এই রেস্ট হাউজ চালান। তার কর্মচারি সবাই বাঙালি। আমরা যা খেতে চাই তারা তেমন রান্না করে দেয়। আমরা আগে যখন গেছি তখন মাছ সব্জি কিনে এনে দিলেও তারা রান্না করে দিয়েছে। ড. আতিউরকে নিয়ে কাঁচা বাজারে যাই। বড় সাইজের পাবদা মাছ কিনি। ছোটু, গোপাল রান্না করে দেয়। ইফতারের পর তৃপ্তি সহকারে খাই। পরদিন কোথায় ঘুরতে চান জেনে ওদেরকে বলি পরদিন সারাদিনের জন্য একটি ট্যাক্সি ঠিক করে রাখতে। আমি তাকে কুতুব মিনার, চাঁদনি চক, হুমায়ুনের মাজার ঘুরিয়ে দিল্লি হাটে নিয়ে যাই। এখানে ভারতের সব রাজ্যের হস্তশিল্পজাত পন্যের অনেক দোকান, খোলামেলা বিশাল জায়গা। ড. আতিউরের ভালো লাগে। তিনি কিছু কেনাকাটা করতে চান। তাকে সেন্ট্রাল মার্কেটে নিয়ে যাই, তিনি কিছু কেনাকাটা করেন। পরদিন তিনি চলে যাবেন। আমি আরও ক’দিন থাকবো। চলে যাবার আগে তিনি শুধু রেস্ট হাউজের ভাড়াটুকু শেয়ার করেন, দিল্লিতে ঘোরার ট্যাক্সি ভাড়া ও খাওয়ার মূল্য শেয়ার করেননি, যার পরিমাণ রেস্ট হাউজের রুম ভাড়ার চেয়ে বেশি ছিল। আমি অবাক হই। কিছু বলতে পারি না। সাধারণত আমরা বাইরে ট্যুরে গেলে একজনই খরচ করে। পরে মোট খরচ সমান ভাগ করে প্রত্যেকে দিয়ে দেয়। ড. আতিউর তাতে রাজি হননি। যাহোক, তিনি পরদিন চলে আসেন। আমি আরও দু’দিন থাকি।

সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশের সেরা লেখকদের একজন বলে বিবেচিত। কোনো ক্ষেত্রে কেউ সেরা হলে মানুষ হিসেবে সেরা হবেন এমন গ্যারান্টি নেই। তার কিছু গল্প-কবিতা পড়া থাকলেও প্রথম পুরো একটি বই পড়ি তার উপন্যাস ‘খেলারাম খেলে যা’। এটা পড়ে সৈয়দ শামসুল হককে উপন্যাসের মূল চরিত্র বাবর বলে মনে হয়েছে, যে বাবরকে দিয়ে তিনি রাতের বেলায় রেস্টহাউজে তার পিরিয়ড চলা ভ্রমণসঙ্গিনীকে প্যাড খোলার জন্য টানাটানি করেছেন। আমি এর চেয়েও রগরগে বর্ণনার অনেক উপন্যাস পড়েছি এবং অনুবাদ করেছি। কিন্তু সৈয়দ হকের বাবরের কথা ভুলিনি। বাবর ও সৈয়দ হককে এক করে ভেবেছি। ঢাকায় ‘আলুর দোষ’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে। যৌনলিপ্সু লোকজনের বর্ণনা দিতে কথাটি ব্যবহার করা হয়। অনেকে বলতেন সৈয়দ হকের আলুর দোষ ছিল। এমনকি তাঁর পুত্রবধুকে আদর করতে গিয়ে ঠোঁটে চুম্বন করেছিলেন এমন কথাও শুনেছি। এসবের সত্য মিথ্যা যাচাই করার উপায় নেই। তবে শুরু থেকে তার ব্যাপারে একটা নেতিবাচক মনোভাব ছিল আমার, যা প্রায় সত্য হয়েছে তসলিমা নাসরিনের লেখায়, তার পিঠে হাত বুলানোর সময় ব্রা’র ফিতা অনুভব করার চেষ্টাসহ সৈয়দ হকের অবাঞ্ছিত আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। অবশ্য সৈয়দ হক এর প্রতিবাদ করেছিলেন। যাহোক, ১৯৯৭ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর একটি আমন্ত্রণ পেলাম সাত দিনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরের জন্য। নির্ধারিত দিনে এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে অভ্যর্থনা জানালেন সম্ভবত মেজর হামিদ নামে একজন অফিসার। দেখা গেল আমার সফরসঙ্গীরাও এয়ারপোর্টে উপস্থিত: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন অধ্যাপক এরশাদুল বারী, নিউ নেশন সম্পাদক আলমগীর মহীউদ্দিন, সৈয়দ শামসুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। বিমানে উঠার পর দেখা গেল প্রথম সারিতে চট্টগ্রামের মেয়র এবিএম মহীউদ্দিন চৌধুরী। আমাদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক তার পরিচিত এবং তিনি দুই হাত যুক্ত করে জয় বাংলা বলে মেয়র সাহেবকে শুভেচ্ছা জানালেন। মেয়রও জয় বাংলা উচ্চারণ করলেন। সালামের পরিবর্তে জয় বাংলা কেন! পাশ্ববর্তী দেশে ইউনিফরমড বাহিনীগুলোতে শুভেচ্ছা জানাতে ‘জয় হিন্দ’ ব্যবহৃত হলেও সাধারণভাবে ‘নমস্কার’, ‘আদাব’, ‘রাম রাম’ এবং দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে ‘মানক্কম’ প্রচলিত। চট্টগ্রাম পৌছার পর আমাদেরকে হেলিকপ্টারে তুলে নেয়া হলো চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে ব্রিফিং ও লাঞ্চ শেষে হেলিকপ্টারে নেয়া হলো খাগড়াছড়িতে। সেখানেও আরেক দফা ব্রিফিং দেয়া হলো, শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে কী অবস্থা বিরাজ করছে তার ওপর। বিপদের মধ্যে থাকলে সবাই ধর্মের আশ্রয় নেয়। সশস্ত্র বাহিনীতে এমনিতে ধর্মচর্চার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা নিয়োজিত স্বাভাবিক কারণেই তারা ধর্মানুরাগী। যারা ব্রিফিং দিচ্ছিলেন তাদের মুখে আল্লাহ রাসুলের কথা শুনে সৈয়দ হকের যে ভালো লাগছিল না, তার মন্তব্যে তা বোঝা যাচ্ছিল। তাঁর প্রশ্নে খোঁচার সুর ছিল। পরদিন সকালে আমাদেরকে একটি দুর্গম জায়গায় বেশ উঁচু এক টিলায় স্থাপিত ছাউনিতে নেয়া হলো। হেলিকপ্টার ছাড়া সেখানে যাওয়া কঠিন। সেখানে সৈনিক ও অফিসার মিলে প্রায় পঞ্চাশ জন। একজন ক্যাপ্টেন বলছিলেন বাজার করে আনতে হয় ৫ মাইল দূরের বাজার থেকে। পাহাড়ি পথে পাঁচ মাইল মানে পনের মাইল। তার ওপর কোথায় বিপদ লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। সপ্তাহে একদিন দশ জনের একটি দল সকল প্রস্তুতি নিয়ে বাজারে যান, সব্জি, মাছ মাংস যা পান কিনে আনেন। পানি আনতে হয় ঢালু বেয়ে প্রায় আধ মাইল দূরের ঝরনা থেকে। সহজে যাওয়া যায়, কিন্তু পানিভর্তি জ্যারিক্যান নিয়ে ওঠতে পঞ্চাশ-ষাট গজ পর থেমে দম নিতে হয়, পানি পান করতে হয়। এভাবে জেরিক্যানের অর্ধেক খালি হয়ে যায়। তার ওপর আছে মশার যন্ত্রণা। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক প্রজাতির মশা আছে, কামড়ালে একেবারে সেরিব্রাল ম্যালেরিয়া। বেশ কয়েকজন সেনা সদস্যকে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম সিএমএইচে পাঠিয়েও রক্ষা করা যায়নি। খোলা জায়গাগুলোতে তারা এক ধরনের তেল মালিশ করেন। এক পাশে একটি ছনে ছাওয়া ঘর। সৈয়দ হক জানতে চাইলেন, ‘ওখানে কি হয়?’ এক সৈনিক বললেন, ‘স্যার, ওটা মসজিদ।’ তাঁর গায়ে যেন বিছুটির ছোঁয়া লেগেছে। বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘এখানেও মসজিদ?’ সৈনিক উত্তর দিলেন,‘ডিউটি, ঘুম ও ভলিবল খেলার সময়ের বাইরে সৈনিকরা মসজিদেই বেশি সময় কাটায়। আল্লাহর ওপর ভরসা করেই আমরা এখানে আছি।’ সৈয়দ হকের একটু পেছনে আমি এবং ড. এরশাদুল বারী। তিনি আমাকে খোঁচা দেন। নিচু কণ্ঠে বলেন, প্রশ্ন করার ধরন ও উদ্দেশ্য খেয়াল করুন। আমি খেয়াল করি। সৈনিককে সৈয়দ হকের প্রশ্ন, ‘সবাই নামাজ পড়ে?’ সৈনিকের উত্তর,‘জি স্যার, প্রায় সবাই নামাজ পড়েন।’ সৈয়দ হক, ‘নামাজ পড়ানোর জন্য ইমাম আছে?’ সৈনিক, ‘নির্ধরিত কোনো ইমাম নেই স্যার। আমাদের মধ্য থেকেই কেউ না কেউ ইমামতি করেন। সবাই মুসলমানের ছেলে, কমবেশি সবাই কোরআন পড়তে পারেন। কেউ কেউ ভালো পারেন। দু’একজন আছেন, যারা সেনাবাহিনীর বার্ষিক কিরাত, আজান, হামদ-নাত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আমরা তাদেরকেই ইমামতির দায়িত্ব দেই। তারা ডিউটিতে থাকলে আমরা উপস্থিভাবে ইমাম ঠিক করে নেই।’ সৈনিক আরও বলেন, ‘এখানে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজানও দেই। তাতে কাছাকাছি যেসব বাঙালি বসবাস করেন তাদের মনোবল বাড়ে।’ সৈয়দ হক হতাশ হন। সৈনিক স্যালিউট দিয়ে চলে যান। সৈয়দ হক অন্যদিকে মনোযোগ দিলে এরশাদুল বারী আমাকে বলেন, ‘সৈয়দ শামসুল হকের মতো লোকেরা যে কী চায় তারা নিজেরাও তা জানে না। ব্যাটা তুই নামাজ না পড়িস, ঠিক আছে। আরেকজন পড়লে তোর কষ্ট লাগবে কেন। আমরা যে এখানে এসেছি কেউ তো নামাজ পড়ছি না। সৈনিকটি যখন নামাজ পড়ার কথা বলছিল তখন তো লজ্জা পাচ্ছিলাম যে আমার ছেলের বয়সী একটা ছেলে নামাজ পড়ছে, আমি পড়ছি না।’

জহিরুলঃ আপনার সাংবাদিকতা জীবনে অগ্রজ হিসেবে যাদেরকে পেয়েছেন তাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছেন যাদেরকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করেছেন? বাংলাদেশের এবং বিশ্বের আদর্শ দু/চারজন সাংবাদিকের কথা বলেন যাদের এথিক্স, কর্মকৌশল, দক্ষতা অন্যদের জন্য অনুকরণীয়।

মঞ্জুঃ সাংবাদিকতায় অগ্রজ হিসেবে পেয়েছি অনেককে। অনেকের কাছে সাংবাদিকতার কলাকৌশলও শিখেছি। অনেক সাংবাদিকের লেখার ধরন অনুসরণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আদর্শ হিসেবে কাউকে গ্রহণ করিনি। কারও মাঝে যদি ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকে, প্রয়োজনীয় পড়াশোনা না থাকে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি মাথায় না থাকে, ধারণাশক্তি না থাকে, সব শ্রেনির মানুষের সাথে মেলামেশার স্বত:স্ফূর্ততা বা উদারতা না থাকে অথবা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হয় তাহলে সাংবাদিকতার মতো সৃজনশীল একটি পেশায় তার বা তাদের আসা উচিত নয়। বাংলাদেশে কোনো সাংবাদিককে যদি অনুসরণ করতে হয় তাহলে একসময়ের তুখোড় রিপোর্টার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে অনুসরণ করতে পারেন। এথিক্সের দিক থেকে হয়তো তাঁকেও অনেক সময় আপোষ করতে হয়েছে, তবুও কর্মকৌশল ও দক্ষতার দিক থেকে বাংলাদেশের নবীন সাংবাদিকদের পরামর্শ দেব, তাকে অনুসরণ করতে। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামও অনুসরণযোগ্য একজন সাংবাদিক। তিনি সাহসী, পড়াশোনা করেন, যোগ্য এবং সকল মহলের সাথে তিনি যোগাযোগ রাখেন, যা একজন সাংবাদিকের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আমি একটা কথা বলে রাখি, যা ইতিপূর্বে কখনো প্রকাশ করিনি, তা হলো ১৯৯৮ সালে আমি এশিয়ার নোবেল খ্যাত ফিলিপাইনের ‘র‌্যামন ম্যাগসেসে’ পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির একজন মনোনয়নকারী বা নমিনেটর ছিলাম এবং আমি মতিউর রহমান চৌধুরীকে নমিনেট করেছিলাম। কিন্তু আমার বা মতিউর রহমান চৌধুরীর জানা ছিল না যে এসব পুরস্কারের জন্য নমিনেট করাই আসল কথা নয়, বেশ তদবিরও করতে হয়। আমার নমিনেশন কাজে না লাগলেও তাঁকে নমিনেট করে আমি পরিতৃপ্তি লাভ করেছি। বিদেশি সাংবাদিকদের মধ্যে আমার সাথে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব আমেরিকান সাংবাদিক ছিলেন তাদের একজন ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারারের রিপোর্টার জন ওয়েস্টেনডিক, সকল বিচারে একজন আদর্শ রিপোর্টার। ১৯৮৮ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন ভুল বিচারে সাজা ভোগকারী এক বন্দীর ওপর রিপোর্ট করে তাকে কারামুক্ত করায় ভূমিকা রাখার কারণে। পরে তিনি বাল্টিমোর সান এ যোগ দেন। ২০১০ সালে সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়ে কুকুরের ওপর অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করেন, এর ওপর বই লিখেন। এ বছরের (২০২০) মে মাসে তিনি মারা গেছেন। ভারতের বিশিষ্ট সাংবাদিক এম জে আকবর যদিও রাজনীতিতে যোগ দিয়ে এবং দল বদল করে বিতর্কিত হয়েছেন, তবুও তাঁর সাংবাদিকতার দিকটি এখনো অনুসরণযোগ্য।

জহিরুলঃ আপনি ফেলোশিপ নিয়ে দিল্লিতে ছয়মাস ছিলেন, ব্যক্তিগত আগ্রহ এবং পেশাগত অভ্যাসের কারণে কাছে থেকে দেখার/বোঝার চেষ্টা করেছেন ভারতের এবং উপমহাদেশের রাজনীতি। আমরা দেখি ভারতের রাজনীতিতে গায়ক, নায়ক, লেখক, সাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটে সব সময়ই এবং তারা রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রাখেন। বাংলাদেশে এই ধারা খুব সম্প্রতি শুরু হলেও আমাদের জনপ্রিয় খেলোয়াড়, শিল্পীরা নিজেদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ করা ছাড়া রাজনীতিতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন না। এমন কি ধর্ষণ, অন্যদেশকে ট্রানজিট প্রদান, উপর্যুপরি সড়ক দূর্ঘটনা, পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প ইত্যাদি ইস্যুতেও তারা নীরব। অথচ তাদের জনপ্রিয়তা এবং রাজনীতি সম্পৃক্ততা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত, যা ভারতে দেখা যায়। বিষয়টি যদি আপনার মতো করে ব্যাখ্যা করেন।

মঞ্জুঃ দিল্লিতে আমার অবস্থানকালকে আমি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। প্রথমত উপমহাদেশের রাজনীতি এবং বিশেষ করে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ও সাংবিধানিক বিকাশের ওপর নিবিড় পড়াশোনা করা এবং দ্বিতীয়ত এসব বিষয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের লোকজনের সাথে ঘনিষ্টভাবে মেলামেশা ও মতবিনিময়ের সুযোগ লাভ। এ সময়ে ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। ক্লাস ও পেপার তৈরির কাজে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়েছে। আমাদের ক্লাস নিতেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চতর আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংবিধান ও আইন বিভাগের শিক্ষক, ভারতীয় পার্লামেন্টের উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ। অনেক সময় লোকসভা ও রাজ্যসভার সেক্রেটারী জেনারেলদ্বয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথেও আমাদেরকে মতবিনিময় করতে হয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ জটিল ছিল এবং সকল প্রধান দলের রাজনীতিবিদরা তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ভারত বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ ও বৈপরত্যে ভরা একটি দেশ। রাজনীতিতে এই বৈচিত্রের সমন্বয় সাধনের জন্যও নিরন্তর চেষ্টা চালাতে হয় এবং এজন্য দেশটির সংবিধান প্রনেতারা শুরু থেকেই সে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন। ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ, যা ‘রাজ্যসভা’ নামে পরিচিত, সেই রাজ্যসভার সদস্য সংখ্যা ২৫০ জন। কোনো সময়ে এই সংখ্যা কম হলেও ২৫০ এর বেশি হওয়ার সুযোগ নেই। রাজ্য বিধান সভাগুলো রাজ্যসভার সদস্যদের নির্বাচন করে পাঠান। রাজ্যসভার ১২ জন সদস্য মনোনয়নের এখতিয়ার সম্পূর্ণভাকে রাষ্ট্রপতির উপর। শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সমাজসেবাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এমন জনপ্রিয় ব্যক্তিদের তিনি রাজ্যসভায় মনোনয়ন প্রদান করেন, যারা ৬ বছর পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য থাকেন। যে নামগুলো আমাদের অতি পরিচিত পৃত্থিরাজ কাপুর, লতা মঙ্গেশকর, তারাশঙ্কর ব্যানার্জি, মৃণাল সেন, শাবানা আজমী, জাভেদ আখতার, নার্গিস, বৈজয়ন্তীমালা, হেমামালিনী, খুশবন্ত সিং, কুলদীপ নায়ার, রেখা, হরিবংশ বচ্চন, এম এফ হোসেন, স্যাম বেনেগাল, শচীন টেন্ডুলকরসহ আরো অনেকে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পেয়ে রাজ্যসভায় প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এর বাইরে নির্বাচনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও অনেক চলচ্চিত্রাভিনেতা, সাংবাদিক, লেখক লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, গোবিন্দা হার্টথ্রব অভিনেতা ছিলেন। অভিনেত্রীরাও পিছিয়ে নেই, হেমামালিনী, জয়াপ্রদা, স্মৃতি ইরানি, মুনমুন সেন, উর্মিলা, মৌসুমী, শতাব্দী রায় সরাসরি নির্বাচন করেছেন। কখনো জয়ী হয়েছেন, কখনো হননি। কিন্তু তারা রাজনীতিতে সক্রিয়। দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রী এমজি রামাচন্দ্রণ ও জয়াললিতা তামিলনাড়ুর এবং এনটি রামা রাও অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সাংবাদিকদের মধ্যে এমজে আকবর, অরুণ সুরি, শশী থারুরসহ আরো অনেকে নির্বাচিত হয়েছেন, মন্ত্রীত্ব করেছেন কেউ কেউ। আরো অনেক খ্যাতিমান ভারতীয়, যারা রাজনীতিবিদ নন, কিন্তু পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন সে তালিকা দীর্ঘ। এক কথায় ভারতে প্রায় সকল পেশার মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছেন এবং জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

দিল্লিতে আমি প্রথমে উঠি নিজামুদ্দিন এলাকায়। এটি শুধু মুসলিম প্রধান এলাকাই নয়, এই এলাকায় রয়েছে নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার, বিশ্ব তবলীগ জামাতের হেড কোয়ার্টার, সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি, মির্জা গালিব একাডেমী ইত্যাদি। কংগ্রেস প্রধান এলাকা এবং এই এলাকার লোকসভা সদস্য অভিনেতা রাজেশ খান্না। মুসলিম ভোটারদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তাঁর নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাও উল্লেখ করার মত। ১৯৯১ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিজেপির এলকে আদভানি। ফলাফলে দেখা গেল রাজেশ খান্না দেড় হাজারের কিছু বেশি ভোটে আদভানির কাছে হেরেছেন। তিনি বেঁকে বসেন। আদভানির বিরুদ্ধে ভোট জালিয়াতি ও কারচুপির অভিযোগ আনেন। আদভানিকে এ অভিযোগ নিয়ে পদত্যাগ করতে হয়। ১৯৯২ সালে শূন্য আসনে উপনির্বাচন ঘোষণা করা হলে আবারও রাজেশ খান্না কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে লড়েন। এবার আদভানি প্রার্থী হননি। তাঁর পরিবর্তে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা। রাজেশ খান্না ২৫ হাজারের বেশি ভোটে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদের বাইরে ভিন্ন পেশার খ্যাতিমানদের জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার দৃষ্টান্ত রয়েছে, কিন্তু তা একেবারেই নগন্য। বর্তমান জাতীয় সংসদে একজন সেরা ক্রিকেটার মাশরাফি, পেশাদার সাংবাদিক শফিকুর রহমান নির্বাচিত হয়েছেন। প্রথম জাতীয় সংসদে সাংবাদিক এবিএম মুসা, মইনুল হোসেন, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে খন্দকার আবদুল হামিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এভাবে আপনি সব সংসদেই ভিন্ন পেশার দু’একজন পাবেন, যারা সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, মন্ত্রীত্ব করেছেন। বাংলাদেশের পার্লামেন্ট এক কক্ষ বিশিষ্ট এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ছাড়া সংসদের সদস্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যতিক্রম রয়েছে শুধু সংরক্ষিত নারী আসন, সেক্ষেত্রেও দলীয় বিবেচনাই প্রধান। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো এমন কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয় না, যার হেরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে অথবা উদয়াস্ত রাজনীতিতে সক্রিয়, ছাত্রজীবনে দলের পক্ষে মাস্তানি করে প্রতিপক্ষ দলের নেতাকর্মীদের মারধোর করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করেছেন, মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, জেলে গেছেন, পুলিশের লাঠিপেটা খেয়েছেন এমন ব্যক্তিরাও তাদের এলাকায় হুট করে দলের পক্ষ থেকে নবাগত কাউকে মনোনয়ন দিলে তা মেনে নিতে পারেন না। অতএব অন্য কোনো পেশার লোক যদি রাজনীতিতে সক্রিয় না থাকেন তাহলে তাদের পক্ষে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ কম। কিন্তু পেশাজীবীদেরও প্রয়োজন হয় রাজনীতিবিদদের এবং সেজন্য দলীয় সরকারগুলো তাদের চামচা পেশাজীবীদের ছোট ছোট দেশের রাষ্ট্রদূত এবং অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস মিনিষ্টার, কালচারাল মিনিষ্টার, বিভিন্ন সংস্থার চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে মনোনয়ন দেয়। প্রায় প্রতিটি পেশার কিছু লোক এ কারণে বড় বড় দলের শীর্ষ নেতাদের সুনজরে থাকার চেষ্টা করেন।

বাংলাদেশে কখনো গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। গণতন্ত্রের নামে বরাবর একনায়কতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বলবৎ ছিল এখনো আছে। এককভাবে ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগ বাংলাদেশে নেই। এমনকি আপনি যদি নিজের উদ্যোগে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, দেশে বিদেশে আপনার ব্যক্তিগত যোগাযোগের কারণে তহবিল সংস্থান করে সকল আইন অনুসরণ করে জনগণের সেবায় কিছু করতে চেষ্টা করেন, অল্পদিনের মধ্যে আপনার সেবাকর্মের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় পোষণ করা হবে, আপনার প্রতিষ্ঠানে প্রভাবশালী দলের লোক নিয়োগের জন্য চাপ দেয়া হবে এবং আপনি তাদের কথামত না চললে আপনার কাজে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করা হবে। অতএব যাদের দেশ হিতকর জনকল্যাণের আগ্রহও থাকে তারা পিছিয়ে থাকেন। ভারতকে ট্রানজিট প্রদান, বেপরোয়া সড়ক দূর্ঘটনা, কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের বিনাশ হওয়া আশঙ্কা, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কণ্ঠের চেয়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বেশি সোচ্চার। ক্ষমতাসীন দল সবসময় এ ধরনের সংস্থাকে তাদের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত বলে বিবেচনা করে। যেহেতু তারা রাজনৈতিক সমর্থন লাভ করেন না, অতএব তাদের কণ্ঠ রাজপথ পর্যন্তই সীমিত থাকে।

জহিরুলঃ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বেশ ক’জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আপনি, মালয়েশিয়ার সাবেক উপপ্রধান ও ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী এবং বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহীম, সৌদি সামাজিক সংস্থা মুতামার আলম আল ইসলাম এর প্রধান মোহাম্মদ আলী আল হারাকান ও ড. আবদুল্লাহ ওমর নাসিফসহ আরো অনেকের ইন্টারভিউ করেছেন। এইসব সাক্ষাৎকার গ্রহনের সময় ভাষা কি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে? নানা দেশের ক্ষমতাধর মানুষের সান্নিধ্য কেমন উপভোগ করেছেন? আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে তাদের উল্লেখযোগ্য কোনো গুণগত পার্থক্য চোখে পড়েছে?

মঞ্জুঃ মালয়েশিয়ার বর্তমান বিরোধী দলীয় নেতা, পিপলস জাস্টিস পার্টির প্রেসিডেন্ট আনোয়ার ইব্রাহিম আশির দশকের প্রথম দিকে যখন তাঁর দেশে একজন জনপ্রিয় যুব নেতা তখন আমি দু’বার তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। ওই সময়ে বাংলাদেশের ইসলামী সংগঠনগুলোর আমন্ত্রণে তিনি প্রায়ই ঢাকায় আসতেন এবং বিভিন্ন ইসলামী সভা-সমাবেশে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতেন। ‘আবিম’ নামে পরিচিতি মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট অফ মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এর আগে তিনি ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মালয়েশিয়ান মুসলিম স্টুডেন্টস এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তরুণ বয়সেই তিনি আরও কয়েকটি জাতীয় ও আঞ্চলিক সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। আপনার হয়তো মনে আছে হংকং থেকে ‘এশিয়া উইক’ ও ‘ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ’ নামে আন্তর্জাতিক মানের দুটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতো। দুটি ম্যাগাজিনের প্রকাশনাই এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আশির দশকে দুটি ম্যাগাজিনে কিছুদিন পরপরই আনোয়ার ইব্রাহিমের ওপর কভার স্টোরি প্রকাশ করা হত। আমি বিস্ময় বোধ করতাম। কিন্তু ঢাকায় তাঁর একাধিক বক্তৃতা শোনার পর ও তার সাক্ষাৎকার নেয়ার পর মনে হয়েছে যে তিনি হ্যামিলনের বংশীবাদকের বাঁশীর সুরের মত তার কথার যাদুতে মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট করার মত প্রতিভাধর। ১৯৭৫ সালের পর সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ঢাকায় সৌদি দূতাবাস চালু করা হয় এবং সৌদি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ইসলামী তৎপরতা গতি লাভ করে। সম্ভবত ১৯৮০ সালে গাজীপুরের মৌচাকে ন্যাশনাল স্কাউট ট্রেনিং সেন্টারে সৌদি আরব ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অফ মুসলিম ইয়ুথ এর একটি আঞ্চলিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সম্মেলন উদ্বোধন করেন। আনোয়ার ইব্রাহিম ওই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনস্থলেই আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করি এবং পরদিন সকালে তিনি আমাকে তাঁর হোটেলে যেতে বলেন। তিনি হোটেল পূর্বাণীতে ওঠেছিলেন। পরদিন সকালে আমি হোটেলে তাঁর রুমে যাই, একসাথে নাশতা করি। আমার নির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন ছিল। তিনি সবগুলো প্রশ্ন একসাথে করতে বলেন। তিনি একটানা উত্তর দেবেন। উত্তরের প্রেক্ষিতে যদি কোনো সম্পুরক প্রশ্ন আসে সেগুলো তাঁর উত্তরের পর জানাতে বলেন। আমি প্রশ্নগুলো করি, তিনি দু’একটা পয়েন্ট কাগজে টুকে নিয়ে বলতে শুরু করেন। আগে তাঁর যে কয়েকটি বক্তৃতা শুনেছি, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা, ছন্দময় কথামালা। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন শিক্ষকের মত। মালয়েশিয়াকে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার ব্যাপারে তার স্বপ্ন, মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য দূর করার জন্য তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, মুসলিম বিশ্বের প্রতি পাশ্চাত্যের বৈরী মনোভাব দূর করার কৌশল নির্ধারণে মুসলিম দেশগুলোর করণীয় সম্পর্কে তিনি বলে যাচ্ছিলেন। খেই হারিয়ে ফেলতে পারি বলে কথার মাঝে প্রশ্ন করতে চেষ্টা করলে হাতের ইশারায় তিনি আমাকে থামিয়ে দেন। এভাবে প্রায় এক ঘন্টা কথা বললেন তিনি। আমি টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলাম, কাজেই কথা ধারণ করতে অসুবিধা হয়নি। তিনি থামলে আমি কয়েকটি সম্পুরক প্রশ্ন করি। তিনি সেগুলোরও উত্তর দেন। আমার দৃঢ় ধারণা জন্মে আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা হতে যাচ্ছেন। পরের বছর তিনি ঢাকায় এলে আমি আবারও তার সাক্ষাৎকার নেই।

জহিরুলঃ এশিয়া উইক এবং ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ আনোয়ার ইব্রাহিমকে একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে শনাক্ত করেছিল বেশ আগেভাগেই।

মঞ্জুঃ আমারও তাই ধারণা। তাঁর নেতৃত্ব বিকাশের সূচনা থেকেই মালয়েশিয়ার জাতীয় গণমাধ্যম ছাড়াও ওই অঞ্চলের গণমাধ্যম অচিরেই তাঁর জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা আঁচ করেছিল। তার প্রমাণও পাই তাঁর দেশের শীর্ষস্থানীয় এক সাংবাদিকের কথায়। সাংবাদিকতার ওপর একটি প্রশিক্ষণে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়ে ১৯৮৩ সালে আমি তিন মাসের জন্য পশ্চিম বার্লিনে যাই। জার্মানির প্রবীণ সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান সাংবাদিকরা আমাদের প্রশিক্ষক হিসেবে আসতেন। মালয়েশিয়া থেকে এলেন ‘এশিয়া উইক’ এর ডেভিড লেজারাস। এক সপ্তাহ আমাদের ক্লাস নিয়েছেন তিনি। এসময় আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম যে এশিয়া উইক ও ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ আনোয়ার ইব্রাহিমকে এতটা কভারেজ দেয় কেন। তিনি তখন মালয়েশিয়ার মূল ধারার রাজনীতিতে পা রেখেছেন। আমি যে আনোয়ার ইব্রাহিমের সাক্ষাৎকার নিয়েছি সেকথাও তাঁকে বলি। ডেভিড লেজারাস বলেন, তুমি দেখে নিয়ো, আনোয়ার ইব্রাহিম মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হবেন। এই বয়সেই তিনি ক্যারিশম্যাটিক নেতা হয়ে উঠেছেন। মালয়েশিয়া আমাদের সবচেয়ে বড় মার্কেট। তাঁর ওপর কভার স্টোরি করলে ম্যাগাজিনের কাটতি বেড়ে যায়, যা অন্য কারো কভারেজ দিয়ে হয় না। তাছাড়া তিনি যে জনপ্রিয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুনে আমার ভালো লাগে। আনোয়ার ইব্রাহিমের সাথে পরিচয় থাকার কারণে আমি সবসময় তাঁর খবর রাখার চেষ্টা করেছি।

প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের আহবানে ১৯৮২ সালে আনোয়ার ইব্রাহিম ক্ষমতাসীন দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে যোগ দেন। তাকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী করা হয়। এরপর তিনি যুব ও ক্রীড়া, কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮৬ সালে তাকে শিক্ষা মন্ত্রী করা হয়। পরবর্তী ধাপ উপ-প্রধানমন্ত্রী বলে ধারণা করা হচ্ছিল। ১৯৯১ সালে তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয় এবং ১৯৯৩ সালে মাহাথির মোহাম্মদ তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। ১৯৯৭ সালে তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ন্যস্ত করে মাহাথির দুই মাসের ছুটি কাটান। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে মাহাথিরের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে। ১৯৯৮ সালে মাহাথির তাকে মন্ত্রীত্ব থেকে অপসারণ করেন। তার বিরুদ্ধে সমকামের অভিযোগ এনে ১৯৯৯ সালে গ্রেফতার ও বিচারে তাকে কারাদন্ড প্রদান ও নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। কারামুক্তি ও নির্বাচনে অযোগ্যতার মেয়াদ শেষে তিনি নির্বাচিত ও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। দ্বিতীয় সমকামের অভিযোগে পুনরায় তাকে পাঁচ বছরের দণ্ড দেয়া হয় এবং রাজকীয় ক্ষমায় তিনি কারামুক্ত হওয়ার পর পুনরায় নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমি এখনো বিশ্বাস করি আনোয়ার ইব্রাহিম একসময় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করবেন।

১৯৮০ সালের শেষ দিকে আমি সৌদি আরবের একজন প্রবীণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। তিনি ছিলেন মুতামার আলম আল ইসলামী বা ওয়ার্ল্ড মুসলিম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আলী আল হারাকান। তিনি সৌদি রাজ পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। মুতামার আলম আল ইসলামী এটি একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা, যে সংস্থার সৃষ্টি হয়েছিল ১৯২৬ সালে ওই সময়ের সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজের উদ্যোগে। মক্কায় বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলনে এটির গোড়াপত্তন হয় এবং মুতামার এর দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জেরুসালেমে ১৯৩১ সালে। এরপর দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংস্থাটির কার্যক্রম স্থিমিত বা বন্ধ ছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুতামার আলম আল ইসলামীকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং তাঁর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সংস্থাটিকে কার্যকর করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন এবং ১৯৪৯ সালে দেশটির তখনকার রাজধানী করাচিতে বিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলনে সংস্থাটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এ সংস্থাই পরবর্তী অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি) গঠনে অবদান রাখে। ১৯৭৮ সালে তখনকার বার্মা, আজকের মিয়ানমার সরকার, রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতন শুরু করলে প্রথমবারের মত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মুসলিম নাফ নদী পেরিয়ে টেকনাফে চলে আসে। তাদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ করা বাংলাদেশ সরকারের জন্য খুব সহজ ছিল না। অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। তবে সবচেয়ে বড় আকারে সহায়তা আসে মুতামার আলম আল ইসলামীর সহযোগী মক্কাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রাবিতাত আলম আল ইসলামী (ওয়ার্ল্ড মুসলিম লীগ) থেকে। এই সংস্থাটি বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব পালন করে। এছাড়া আটকে পড়া পাকিস্তানিদের চিকিৎসা সেবা দানেও তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ক্লিনিক ও হাসপাতাল স্থাপন করে। এই সূত্রেই মুতামার আলম আল ইসলামী প্রধান ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সফর ছিল। তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দিয়ে রাখা হয়েছিল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায়। আমাকে তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের দায়িত্ব দেয়া হলে আমি তাঁর প্রটোকলের দায়িত্ব পালনকারী অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। সৌদি দূতাবাসে যোগাযোগ করলে আমাকে জানানো হয় জনাব হারাকান আরবি ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না। আমি সাক্ষাৎকার গ্রহণের আশা ছেড়ে দেই। এদিকে হারাকানের ঢাকা ত্যাগ করার সময় ঘনিয়ে এসেছে, তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন, সৌদি দূতাবাসে তাঁর সম্মানে আয়োজিত ফেয়ারওয়েল রিসেপশন হয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল এমন এক ব্যক্তি আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেন। তিনি সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলার পর রাষ্ট্রদূত দোভাষি হিসেবে সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকতে সম্মত হন। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ি। দোভাষির মাধ্যমে কখনো কথা বলিনি। আমার নিয়মিত সাংবাদিকতার মাত্র তিন বছর কেটেছে। তখনো ইংরেজি খুব ভালো বলতে পারি না। একজন রাষ্ট্রদূতের সামনে ভুল ও ভাঙা ইংরেজি বলবো ভেবে সংকোচ বোধ করছিলাম। সৌদি রাষ্ট্রদূতের কূটনৈতিক জীবন সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল। তাঁর পিতা শেখ আবদুর হামিদ খতিব পাকিস্তানে প্রথম সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং তাঁর দাদা ছিলেন মিশরে সৌদি রাষ্ট্রদূত। কূটনৈতিক ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব বাংলাদেশে আসার আগে পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়া ও তুরস্কে রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এক কথায় তিনি ডাকসাইটে একজন কূটনীতিক। বিব্রতভাব ও দ্বিধা সংকোচ সত্বেও নির্ধারিত সময়ে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় উপস্থিত হলাম। রাষ্ট্রদূত আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন। আমাকে স্বাগত জানালেন। রাষ্ট্রদূত মিশুক, খোলামেলা স্বভাবের মানুষ। আগেও অনেক অনুষ্ঠানে দেখেছি মানুষের সাথে সহজে মিশতে। তাঁকে অনুসরণ করে দোতলায় উঠলাম। ড্রয়িং রুমে বসে ছিলেন মোহাম্মদ হারাকান। বেশ বয়স তাঁর। মেদবহুল শরীরের কারণে হয়তো প্রকৃত বয়সের চেয়ে আরও বেশি বয়স্ক মনে হয়। সৌদিদের চেহারায় সাধারণত যেমন গাম্ভীর্য ও বিষন্নতা থাকে, হারাকানও তাঁর ব্যতিক্রম নন। সালাম দিলাম। উত্তর দিলেন কিনা বোঝা গেল না। রাষ্ট্রদূতের সাথে আরবিতে কিছু কথা বলার পর রাষ্ট্রদূত বসলেন হারাকানের পাশে, আমি রাষ্ট্রদূতের পাশে। টেবিলে টেপরেকর্ডার রেখে প্রস্তুত হলাম। এক এক করে প্রশ্নগুলো করছিলাম। আমি ইংরেজিতে বলি, রাষ্ট্রদূত খতিব তা আরবিতে তরজমা করে হারাকানকে বলেন, হারাকান আরবিতে উত্তর দেয়ার পর রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ইংরজিতে আমার কাছে উত্তর আসে। তাঁর বাংলাদেশ সফরের প্রাথমিক উদ্দেশ্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। রোহিঙ্গাদের সমস্যা তিনি আগে থেকেই অবহিত। কারণ পাকিস্তান আমলে অনেক রোহিঙ্গা মুসলিম সৌদি আরবে গিয়ে বার্মায় তাদের প্রতি সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ সম্পর্কে অভিযোগ করেছে এবং মক্কায় বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবার স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। এবার সংকট শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক ও মুসলিম বিশ্বের উদ্যোগের পাশাপাশি মক্কায় বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলিমরা মোতামার আলম আল ইসলামীর কাছে আবেদন করেছেন রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংকট নিরসনে সহায়তা করার জন্য। তিনি দেশে ফিরে গিয়ে সৌদি সরকারের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন এবং মুতামার এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ পুনর্বাসনে যথাসাধ্য সাহায্য করা ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের কাছে এ ব্যাপারে সহযোগিতার আহবান জানাবেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে তাঁর আন্তরিকতাপূর্ণ ও ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য উদ্যোগ নিতে মোতামার আলম আল ইসলামীকে ভূমিকা রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে অনুরোধ জানিয়েছেন এবং হারাকান প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এ ব্যাপারে তাঁর অবস্থান থেকে মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের কাছে আহবান জানানোর। আনুষ্ঠানিক কথাবার্তার বাইরে একটি শব্দও তিনি উচ্চারণ করেননি।

জহিরুলঃ সৌদি রাজ পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ কারো সাক্ষাৎকার নেবারও সুযোগ হয়েছিল সম্ভবত?

মঞ্জুঃ সম্ভবত ১৯৮৩ সালে আমি মুতামার আলম আল ইসলামীর আরেকজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। সৌদি শিক্ষাবিদ, ফিলানথ্রপিষ্ট ড. আবদুল্লাহ ওমর নাসিফ। বর্তমানে তিনি মুতামার এর প্রেসিডেন্ট। আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় তিনি ছিলেন বাদশাহ আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটির ভূতত্ব ও রসায়ন বিভাগের প্রফেসর ও সেবা সংস্থা রাবিতাত আলম আল ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থী ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার উদ্দেশ্যে রাবিতাতের পক্ষ থেকে উখিয়া, ঢাকা ও পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থাপিত হাসপাতালগুলোর কার্যক্রম পরিদর্শন করতে এবং ঢাকায় মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে তিনি এসেছিলেন। তার সম্পর্কে আমাকে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে তিনি সৌদি রাজ পরিবারের অতি ঘনিষ্ট, সৌদি সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকে। তাঁর সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ নির্ধারণের জন্যও সৌদি দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে তাঁর রুমে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হই। উদারভাবে স্বাগত জানান। প্রচলিত সৌদি পোশাকেই ছিলেন তিনি। ওই সময় তাঁর বয়স পঞ্চাশের নিচে। বয়সের কারণেই বোধ হয় মোহাম্মদ হারাকানের মতো গাম্ভীর্য নেই তাঁর। হেসে হেসে খোলামেলা কথা বলেন।

প্রথমে তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি হাইস্কুল পর্যন্ত জেদ্দায় পড়াশোনা করেছেন। রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ব ও রসায়নের ব্যাচেলর ও মাষ্টার্স করার পর যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটি থেকে ভূতত্বে পিএইচডি করে রিয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাসিষ্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তার নিজ শহর জেদ্দায় অবস্থিত বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং বাংলাদেশ সফরে আসার কিছুদিন আগেই প্রফেসর পদে উন্নীত হয়েছেন। আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি স্কাউন্ট আন্দোলন, শিক্ষা বিস্তার ও মানব সেবামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং খাতেও তিনি অবদান রাখার চেষ্টা করবেন বলে জানান। সাক্ষাৎকারে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, তা হলো, সৌদি আরব উন্মুক্ত দেশ নয়, রক্ষণশীল দেশ। মুসলিম, অমুসলিম সকল দেশ সৌদি আরবকে একটি কট্টর দেশ মনে করে। আমরা রক্ষণশীল, একথা সত্য। আমরা আমাদের সমাজব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা এই গণ্ডি থেকে বের হতে চেষ্টা করলেও সহজে বের হতে পারবো না। কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে যে শিক্ষা কাঠামো গড়ে তুলেছি তা আমাদের জাতীয় চাহিদার তুলনায় বেশি এবং বাংলাদেশসহ মুসলিম দেশসমূহ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ বিষয় ছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর পড়াশোনা করার জন্য আসতে পারে। কিন্তু দু:খজনক হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোর ছাত্ররা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করতে যায় পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, এবং তারা সৌদি আরবে প্রধানত ধর্মীয় বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করতে যায়। তিনি এ দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার জন্য উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রতি আহবান জানান।

আবদুল্লাহ ওমর নাসিফ পরবর্তী সময়েও প্রায়ই বাংলাদেশে এসেছেন ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু, কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা প্রদান ও তহবিল সংস্থানের ব্যবস্থা করতে। সৌদি আরবে তিনি প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন, রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত সৌদি শুরা কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের অন্যতম নেতা। তিনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, সত্তরের দশকের শেষ দিকে ওসামা বিন লাদেনও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি রাবিতা ট্রাষ্ট নামে একটি সেবা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন, যে সংস্থার মাধ্যমে বিশ্বে ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে অর্থায়ন করা হতো বলে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন এবং ৯/১১ এ যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার জন্য এই ট্রাষ্ট সন্ত্রাসীদের তহবিল যোগান দিয়েছে বলে তাদের একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে এবং প্রতিটিতে ড. আবদুল্লাহ ওমর নাসিফের নাম রয়েছে।

এছাড়াও আমি ওয়ার্ল্ড এসেম্বলি অব মুসলিম ইউথের প্রধান, তুরস্কের একজন শিক্ষামন্ত্রীসহ আরো অনেক বিদেশি ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছি। সবার সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র সৌদি আরবের মোহাম্মদ আলী আল হারাকান ছাড়া আর কারো সাক্ষাৎকার গ্রহণে ভাষা কোনো অন্তরায় হয়নি। অন্য সবাই ইংরেজিতে বলেছেন। বিদেশি তা প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর বা সাধারণ মানুষ যে কেউ হোন না কেন যদি মন খুলে কথা না বলেন তাহলে আলোচনা উপভোগ্য হয়ে ওঠে না। এক্ষেত্রে শুধু হারাকান ব্যতিক্রম ছিলেন। অন্য সবাই আন্তরিকতার সাথে কথা বলেছেন। তাদের দেশে আমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু সাক্ষাৎকারের পর আমি কখনো কারো সাথে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে বিদেশিদের মধ্যে পার্থক্য ছিল, আমাদের নেতারা বাগাড়ম্বর করেন, যা বিশ্বাস করেন না তাই বলেন, বিদেশিরা যা বিশ্বাস করেন তা বলেন।

জহিরুলঃ বাসস- এর নিয়োগ সব সময়ই দলীয় বিবেচনায় হয়ে থাকে। আপনি বিএনপির আমলে নিয়োগ পেয়েছেন, আওয়ামী লীগের আমলে চাকরী হারিয়েছেন, এর মানে হচ্ছে আপনি বিএনপির লোক, এটা কি একজন সাংবাদিকের জন্য অপবাদ নয়?

মঞ্জুঃ আপনি ঠিকই বলেছেন, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থায় (বাসস) সবসময় রাজনৈতিক বিবেচনায় লোকজনকে নিয়োগ করা হয়ে থাকে। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম ঘটেছে, দেশ যখন সামরিক শাসনের অধীনে ছিল, বিশেষ করে সামরিক শাসকরা তাদের নিজস্ব দল গঠন করার আগের কিছু সময়ে। কিন্তু তখনো সামরিক শাসকের বা তাদের মন্ত্রীদের সুপারিশ অনুযায়ী তাদের পছন্দের সাংবাদিকদের নিয়োগ করা হয়েছে। তবে সে সংখ্যা নিতান্তই কম। স্বাধীনতার পর থেকেই বাসস-এ মূখ্যত আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিক কর্মচারিদের প্রাধান্য ছিল। যখন যে সরকার ক্ষমতায় ছিল তারা এখানে প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে তাদের পছন্দের কাউকে চুক্তিভিক্তিক রাজনৈতিক নিয়োগ প্রদান করেছেন। তবে তার অবশ্যই সাংবাদিকতায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চেয়ারম্যানের পদটি আলঙ্কারিক এবং সে নিয়োগও সরকার দিয়ে থাকে। চেয়ারম্যান হিসেবে অধিকাংশ সময় বরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনেক সময় ব্যতিক্রম ঘটিয়ে রাজনৈতিক নেতাকেও চেয়ারম্যান করা হয়েছে। প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদটি বাসস এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ, বাসস এর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজের আত্মীয় স্বজনকে নিয়োগ দিয়ে পদটিকে কলঙ্কিত করেছেন। একবার প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে রাজনৈতিক নিয়োগ বিলম্বত হয়েছিল। অন্তবর্তী সময়ের জন্য সাধারণত তথ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো যুগ্ম সচিবকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে সাময়িক দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু কোনো কারণে একবার সরকার যুগ্ন সচিবকে দায়িত্বটি না দিয়ে বাসসের একজন সিনিয়র বার্তা সম্পাদককে প্রেষণে ভারপ্রাপ্ত প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তিনি নোয়াখালি জেলার লোক ছিলেন। কয়েক মাসের জন্য বাসস এর সর্বোচ্চ পদটি পেয়ে তিনি তাঁর সন্তানসহ পাঁচজন আত্মীয়কে বাসস এ সাংবাদিক কর্মচারি হিসেবে নিয়োগ দেন। এর বাইরে আগে থেকে তাঁর জামাতা বাসস এ নিয়োজিত ছিলেন। তার আগেও একজন বাসস এর প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং একাধিক দৈনিক সংবাদপত্রের সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সরকারের মনোনয়নে জাতিসংঘের একটি সংস্থায় উর্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে বিদেশে কাটিয়েছেন। দেশে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। বাসস ও সেই সরকারি প্রতিষ্ঠানে তার সন্তানসহ আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তার বাড়িও ছিল বৃহত্তর নোয়াখালীতে। বাসস একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। নিয়োগ করতে হলে একাধিক সংবাদপত্রে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। প্রায়শই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়, কিন্তু তা নিয়োগ দেয়ার পর। নামকাওয়াস্তে ইন্টারভিউ হয়। ইন্টারভিউ বোর্ডে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি থাকেন। প্রশ্ন করেন। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত কারো নিয়োগ ইন্টারভিউয়ের কারণে বাতিল হয়েছে এমন ঘটে না। আমাকে নিয়োগ দেয়ার ছয় মাস পর ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

চেয়ারম্যান এবং প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ বাসস বোর্ড অফ ডাইরেক্টর ১৩ সদস্যের। এর মধ্যে ঢাকার সংবাদপত্রগুলোর ৩ জন ও ঢাকার বাইরের ১ জন সম্পাদকসহ মোট ৪ জন সম্পাদক, বাসস এর সাংবাদিক কর্মচারিদের মধ্য থেকে ১ জন, চারটি মন্ত্রণালয় তথ্য, অর্থ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার ৫ জন ও তথ্য অধিদফতরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।

বাসস এর প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যদি বলতে হয়, তাহলে আপনাকে একটু পেছনের দিকে যেতে হবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস অফ পাকিস্তান (এপিপি) এর পূর্ব পাকিস্তানে দুটি শাখা অফিস ছিল, একটি ঢাকায় এবং অপরটি চট্টগ্রামে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারী মাসে এক সরকারী আদেশে এ সংস্থার নতুন যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি নামে। পরে পাকিস্তানের একটি বেসরকারী বার্তা সংস্থা পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই) এর ঢাকা অফিস, যা বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল বা বিপিআই নামে চলছিল, সেটিকেও বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সি বা বর্তমান বাসস এর সাথে একীভূত করা হয়। ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সময়ে এক অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ নিউজ এজেন্সির নতুন নামকরণ হয় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠিান হিসেবে বাসস এর পূর্ণাঙ্গ কাঠামোগত রূপ দেয়া হয়। দিনে দিনে এটি আরো বিকশিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৮ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাসস এর বাংলা বিভাগ চালু করা হয়। বাংলাদেশের প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে সম্ভবত এখনও বাসস এ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিক নিয়োজিত। প্রশাসনিক বিভাগ প্রায় সমসংখ্যক জনবল দ্বারা সমৃদ্ধ। বিশ্বের অনেক দেশের ছোট-বড় বহু সংখ্যক বার্তা সংস্থার সঙ্গে বাসস এর সংবাদ বিনিময় চুক্তি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় বাসস এর প্রতিনিধি এবং ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর, বগুড়া ও বরিশালে ব্যুরো অফিস ছাড়াও দিল্লিতে একটি অফিস রয়েছে। এত জনবল ও কাঠামোগত সুযোগ সুবিধা সত্বেও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাসস যে ভূমিকা পালন করতে পারত, শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণেই বাসস সেই কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারেনি বা পারছে না। প্রধান কারণ রাজনৈতিক বিবেচনায় লোক নিয়োগ। যখন যে দলের সরকার থাকে তখন সেই দলের সমর্থক সাংবাদিকরা কাজের ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রদর্শন করেন এবং বিরোধী দলের সমর্থক সাংবাদিকরা চাকুরিচ্যুতির সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন। সরকারী দলের সাংবাদিকরা বিরোধী দলের সমর্থক সিনিয়র সাংবাদিকদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি ও সুযোগ সুবিধা লাভ করেন। ফলে বঞ্চিতরা কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন এবং নিতান্ত চাকরি রক্ষার জন্য মুখ বুজে কাজ করে যান। বাসস এ অনেক দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিক থাকা সত্বেও এই রাজনৈতিক ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে কখনো প্রতিষ্ঠানটির কাজে গতি আসেনি।

জহিরুলঃ রাজনৈতিক নিয়োগ একটি প্রতিষ্ঠানকে কতটা নির্জীব করে দেয় বাসস তার একটি দৃষ্টান্ত।

মঞ্জুঃ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাÑবাসস এ আমার নিয়োগও রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছিল, আমি তা অস্বীকার করবো না। বাসস এ যোগ দেয়ার আগে আমি দৈনিক বাংলার বাণীর বার্তা সম্পাদক ছিলাম। বাংলার বাণী ২০০১ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং সবার সাথে আমিও বেকার হয়ে পড়ি। এসময় টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলার হেড অফ নিউজ, বর্তমানে বসুন্ধরা গ্রুপের দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম আমাকে প্রস্তাব দেন এটিএন বাংলায় যোগ দেয়ার জন্য। প্রসঙ্গটি আমি আগের এক প্রশ্নের উত্তরেও বলেছি। নঈম নিজামের সঙ্গে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি আমাকে বেকার দেখতে চাননি। বয়সে ও পেশায় আমার জুনিয়র হওয়া সত্বেও আমার প্রতি তার আন্তরিকতার কারণে আমি তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করি না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী একজন সাংবাদিক এবং সকল মহলে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এটিএন বাংলায় নিয়োগ চূড়ান্ত হলেও একই সময়ে তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ঘনিষ্ট এক সাংবাদিক আমাকে বলেন বাসস এর নিউজ এডিটর পদের জন্য আবেদন করতে। আমি এটিএন বাংলার কথা বলে প্রথমে অনীহা প্রকাশ করলেও তিনি আমাকে বলেন যে স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী আমাকে বাসস এ দেখতে চান। বিএনপির নেতাদের মধ্যে একমাত্র তথ্যমন্ত্রী তরিকুল ইসলামের সঙ্গেই আমার ঘনিষ্টতা ছিল। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। অতএব আমাকে বাসস এ আবেদন করতে হলো। বিএনপি সরকার বাসস এর প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল সাংবাদিক নেতা আমানুল্লাহ কবীরকে। তিনি একতরফাভাবে আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩৭ জন সাংবাদিক-কর্মচারিকে বরখাস্ত করেন, যা একজন সাংবাদিক নেতার উচিত হয়নি। তিনি শুধু ৩৭ জনকে বরখাস্ত করাই নয়, নিজের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দিতে শুরু করেন। আমাকেসহ তথ্যমন্ত্রীর সুপারিশকৃত সাংবাদিকদের নিয়োগ দিতে টালবাহানা করছিলেন। আমি অত্যন্ত বিব্রত বোধ করি। এক পর্যায়ে তথ্যমন্ত্রী তাঁকে ধমকের সুরে বলেন আমাদের নিয়োগ চূড়ান্ত করে তাকে জানাতে। ধমকে কাজ হয়, আমাকেসহ আটজনকে তলব করে নিয়োগ দেয়া হয়। আমাকে নিয়োগ করা হয়েছিল ইংরেজি বিভাগের বার্তা সম্পাদক হিসেবে। আগে ইংরেজি সাংবাদিকতা করিনি। একটু দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। বাসস এর বন্ধুরা সাহস দিলেন। আমানুল্লাহ কবীরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে নতুন প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন গাজীউল হাসান খান। আমাকে পদোন্নতি দেয়া হলো ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর হিসেবে। চিফ রিপোর্টার জহুরুল আলমকে চিফ নিউজ এডিটর পদে উন্নীত করায় চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়া হলো কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে কামরুলকে দু’এক মাস পরই পরিবেশ বিষয়ক সেমিনার, কনফারেন্সে অংশ নেয়ার জন্য বিদেশে যেতে হতো। কাজে বিঘ্ন ঘটছিল। গাজীউল হাসান খান আমাকে ডেকে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। ব্যাপারটি আমার জন্য অস্বস্তিকর ছিল। কামরুল যে পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান, আমি সেই ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান। তদুপরি কামরুল তখন বিদেশে। কিন্তু গাজীউল হাসান খান নাছোড়বান্দা। চিফ রিপোর্টার হিসেবে আমাকে বাংলা ও ইংরেজি বিভাগের প্রায় ৪০ জনের অধিক রিপোর্টারের প্রতিদিনের দায়িত্ব বন্টন, ঢাকার বাইরে বাসসের ৬টি ব্যুরো অফিস এবং প্রতিটি জেলার সংবাদদাতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা, রিপোর্টারদের ছুটি মঞ্জুর ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন তৈরির মতো বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হতো। প্রধান সম্পাদক হিসেবে গাজীউল হাসান খান মারদাঙ্গা গোছের ছিলেন। তিনি এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে তার সুবিধা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তী নির্বাচনে তাঁর এলাকা থেকে বিএনপির নমিনেশন আশা করছিলেন। ছুটির দিনগুলোতে বাসস এর গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে এলাকায় চলে যাচ্ছিলেন। এলাকা থেকে আওয়ামী পরিবারের দু’চার জনকে নিয়োগও দেন বাসস এ, যাতে এলাকায় তার সুনাম ও তার ওপর ভোটারদের আস্থা বাড়ে। তবে তার দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে সাজ্জাদ নামে একজন রিপোর্টার অত্যন্ত যোগ্য ও নিণ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতো। গাজীউল হাসান খান কিছু জঞ্জাল পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তা সম্ভব ছিল না। ১৯৯৮ সালে বাংলা বিভাগ চালু করার আগে বাসস পুরোপুরি একটি ইংরেজি বার্তা সংস্থা ছিল। কিন্তু ইংরেজি না জানা লোকজনও বাসস এ তিন দশকের বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতা করেছে এবং সরকারি বেতন-ভাতার সুযোগ নিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরেছে। এর শেষ নিদর্শন ছিল হাবিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। বাসস এ যোগ না দিলে জানাই হতো না যে তিনি বাংলা ইংরেজি কিছুই জানেন না। তিনি পিপিআই এর ঢাকা অফিসের টাইপিষ্ট বা এ ধরনের কোনো কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বিপিআই যখন বাসস এর সাথে একীভূত হয় তখন এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতরা সাংবাদিকদের সাথে অসাংবাদিকদেরও সাংবাদিক হিসেবে দেখিয়েছিলেন। এই অসাধুতা আমাদের জাতীয় চরিত্রের বৈশিষ্ট। গাজীউল হাসান খান তাকে পদত্যাগ করতে বলেন। তার পদত্যাগ করার কোনো ইচ্ছে নেই। তাকে বাংলায় বিভাগে বদলী করেন। বাংলা বিভাগের দায়িত্বশীলরা অভিযোগ করেন তিনি শুদ্ধ বাংলাও লিখতে পারেন না। শুদ্ধ বাক্য অশুদ্ধ করেন। গাজীউল হাসান খান তাকে তলব করে কৈফিয়ত চান, হাবিবুর রহমান খান উত্তর দেন যে সারাজীবন তিনি ইংরেজি বিভাগে কাজ করেছেন, তাই বাংলাটা ঠিকমত পারেন না। গাজীউল হাসান খান বলেন, ঠিক আছে আমি তিন লাইন বাংলা লিখছি, আপনি ৩৩ বছরের বেশি সময় বাসস এর ইংরেজি বিভাগে আছেন; এই তিন লাইনের ইংরেজি করুন, এরপর ইংরেজি বিভাগেই থাকুন। তার তিনটি লাইন ছিল: ১. আমার নাম হাবিবুর রহমান, ২. আমি বাসস এর একজন সাংবাদিক; ৩. আমার বাড়ি মীরপুর। এই বাক্যগুলোর ইংরেজি করাও হাবিবুর রহমানের সাধ্যের বাইরে ছিল। আমি বাসস এ যোগ দেয়ার আগে অবসর নিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বেদু নামে এক বার্তা সম্পাদক। তিনি নাকি বছরের পর বছর কাজই করতেন না। আরেকজন বার্তা সম্পাদক এরশাদুল হককে পেয়েছিলাম; সময়ের ব্যাপারে তার হিসাব ছিল টনটনে। তিনি ঠিক কাঁটায় কাঁটায় তার ডিউটি আওয়ার শুরু হওয়ার সময় বাড়ি থেকে বের হতেন, এক ঘন্টা পর অফিসে পৌছতেন; লবিতে বসে বিশ্রাম নিয়ে, সিগারেট টেনে আরো আধা ঘন্টা পর ডেস্কে বসতেন। সময় নিয়ে নিউজ এডিট করতেন। ঘন্টাখানেক পর আবার সিগারেট টানতে লবিতে। এভাবে ঘন্টা তিনেক অফিসে থাকতেন তিনি। একটু বেশি থাকলে সর্বোচ্চ চার ঘন্টা। এরপর চলে যেতেন। তাকে কখনো সঠিক সময়ে অফিসে আসতে বা ডিউটি আওয়ার শেষ করে যেতে দেখিনি। তার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ ছিল ময়মনসিংহে বাসস এর নামে বরাদ্দ দেয়া বাড়ি আত্মসাতের। ১৯৭৫ এর আগস্ট মাসের পর কাদের সিদ্দিকী, বীর উত্তমের নেতৃত্বে গঠিত বাহিনীর ছোট ছোট গ্রুপ মেঘালয় সীমান্ত পেরিয়ে এসে অনেক স্থানে এলাকায় চোরাগুপ্তা হামলা চালাতো এবং এসব ঘটনা প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই বাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপর ছিল। এসময় তাকে ময়মনসিংহে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সেখানে যান। কিছুদিন পর তিনি ময়মনসিংহে বাসস এর একটি অফিসের প্রয়োজনীয়তা দেখিয়ে বাসস এর পক্ষ থেকে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ নেয়ার জন্য বাসসকে উদ্যোগ নিতে বলেন। জেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে সুবিধাজনক স্থানে পরিত্যক্ত বাড়ি খুঁজে বের করেন। বাসস ব্যবস্থাপনা তাকেই বাসস এর পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন বরাবর আবেদন করতে বলার পর তিনি আবেদন করেন এবং একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য জেলা প্রশাসনের হেফাজতে থাকা বাড়ি বরাদ্দ পাওয়া কঠিন ছিল না। বাড়ি বরাদ্দ হয়, কিন্তু বাসস এর নামে নয়, তার ব্যক্তিগত নামে। ময়মনসিংহে তার অবস্থানের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বাসসকে না জানিয়ে তিনি বাড়িটি বিক্রয় করে দেন। এ ধরনের কিছু লোক ছাড়া বাসস এ অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিককে পেয়েছি এবং তাদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি বলে অহঙ্কার বোধ করি। মোফাখখারুল আনাম, সফিকুল করিম সাবু, ইহসানুল করিম হেলাল, আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, শাহরিয়ার শহীদ, আনিসুর রহমান, গোলাম আহাদসহ আরও অনেকের নাম বলা যায়।

জহিরুলঃ ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে গেলে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই সম্ভবত আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

মঞ্জুঃ ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর বিএনপির ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার দিনে ও পরবর্তীতে উদ্ভুত পরিস্থিতি পুরোপুরি আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল। বিএনপি আমলে বিভিন্ন সরকারী, আধা সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তাদের জন্য নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো বাসসে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ জলিল প্রায় প্রতিদিন বিএনপি নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নামের তালিকা সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে পাঠাতেন অবিলম্বে নিয়োগ বাতিল করার জন্য, যার একটি কপি বাসসেও আসতো। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় বিলম্ব না করে নিয়োগগুলো বাতিল করে নামের তালিকা ফ্যাক্সে বাসসে পাঠাতো। আমাদেরকে এমএ জলিলের নিয়োগ বাতিল দাবীর তালিকা ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ বাতিল আদেশের তালিকা দু’টিই ইংরেজিতে অনুবাদ করে গণমাধ্যমে পাঠাতে হচ্ছিল। বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে গাজীউল হাসান খানের দু’বছরের চুক্তির মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছিল। প্রধান সম্পাদক না থাকায় ম্যানেজিং এডিটর হিসেবে রবি ভাই নিয়মিত কাজগুলো করে যাচ্ছিলেন। চিফ রিপোর্টার হিসেবে এ সময় আমাকে প্রচুর খাটতে হচ্ছিল। কিন্তু সকলেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২০০৭ এর জানুয়ারীর এক সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ব্যস্তভাবে বাসস এর বিশেষ সংবাদদাতা জগলুল আহমেদ চৌধুরী নিউজ রুমে প্রবেশ করেই সোজা আমার রুমে এসে আমার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “মঞ্জু, এটি একটু জলদি ছেড়ে দিন। ভেরি আরজেন্ট।” পড়ে দেখি বাসসের প্রধান সম্পাদক হিসেবে তাঁর নিয়োগ আদেশ। সে রাতেই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। সেনা সমর্থিত সরকারের কর্মকান্ড ও হম্বিতম্বিতেই বুঝা যাচ্ছিল যে, এ সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে। অন্তবর্তী সময়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় দলের সমর্থক সাংবাদিকরা আমাকে চিফ রিপোর্টার হিসেবে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেও আমি পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। জগলু ভাইকে বলার পর তিনি বললেন, ‘ইউ ক্যারী অন। আই অ্যাম বিহাইন্ড ইউ।’ আমি আমতা আমতা করছিলাম। তিনি আবার বরলেন, ‘ইফ ইউ রিজাইন, ইট উইল বি কনসিডারড অ্যাজ ট্যান্টামাউন্ট টু ভায়োলেশন অফ মাই অর্ডার।’ আরো কয়েকদিন পর আমি চিফ রিপোর্টাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে পদত্যাগপত্র জমা দিলাম। দিন তিনেক পর জগলু ভাই ডাকলেন। জগলু ভাই বললেন, ‘আই বিলং নেইদার টু আওয়ামী লীগ নর টু বিএনপি এন্ড আই বিলিভ ইউ ডু নট হ্যাভ এনি প্রবলেম ওয়ার্কিং উইথ মি। ইফ ইউ ডু নট উইথড্র ইওর রেজিগনেশন লেটার, দ্যান আই হ্যাভ টু অ্যাকসেপ্ট ইট। বাট বিফোর দ্যাট, সাজেষ্ট মি, হু শ্যাল বি ইওর সাকসেসর?’ কাউকে প্রেফারেন্স দিয়ে নাম বলাটা সঠিক বিবেচনা করিনি জগলু ভাই নিজেই আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া ও সফিকুল করিম সাবুর মধ্যে কাকে চিফ রিপোর্টার করা ঠিক হবে, নিজেই ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন। এরপর তিনি বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ ফর বিইং উইথ মি এন্ড কোঅপারেটিং মি ইন মাই ব্যাটল এগেনইষ্ট দ্য টাইড। ইউ উইল গেট অ্যান এপ্রিসিয়েশন লেটার ফ্রম ইওর চিফ এডিটর এন্ড আই থিঙ্ক ইউ ডিজার্ভ ইট।’ (জগলুল আহমেদ চৌধুরী ২০১১ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান)।

জহিরুলঃ আপনি চিফ রিপোর্টারের পদ থেকে অব্যাহতি নিলেন কিন্তু বাসসে পূর্বপদে ভাল থাকলেন।

মঞ্জুঃ জ্বি। জগলু ভাই প্রধান সম্পাদক থাকাকালেই আমি চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমার আগের দায়িত্ব ডেপুটি চিফ নিউজ এডিটর পদে ফিরে আসি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসে। প্রধান সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন বাসস এর বিশেষ সংবাদদাতা ইহসানুল করিম হেলাল। আমানুল্লাহ কবীর যে ৩৭ জন সাংবাদিক কর্মচারিকে বরখাস্ত করেছিলেন তারা মামলায় জিতে আট বছরের বকেয়া বেতনসহ পুনরায় বাসস এ যোগ দেন। বিএনপি সমর্থক সাংবাদিকদের মধ্যে যাদের কাগজপত্রে ত্রুটি ছিল তাদেরকে ডেকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। অনেকে পদত্যাগ করেন। অনেককে বরখাস্ত করা হয়। আমিও চাকুরিচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করছিলাম। মানসিক চাপের মধ্যে থাকলেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার প্রথম বছর ২০০৯ সাল নির্বিবাদে কাটালাম। ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আমি দুই সপ্তাহের ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসি। মে মাসে দেশে ফিরে যাই। আমার ভোকাল কর্ডে একটি সিষ্ট ডেভেলপ করেছিল। ২০০৫ সালে পাঁচ মাসের ব্যবধানে কলকাতার এক হাসপাতালে দু’বার সার্জারির পরও সমস্যাটি আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করানোর ব্যাপারে আলাপ করে গিয়েছিলাম। তাছাড়া আমার মেয়ে পেনসিলভেনিয়ায় এক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে একা কাটাচ্ছিল। আমি জুলাই মাসের শেষে ছুটি নিয়ে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রে আসি। ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আমি ছুটি বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করি। কিন্তু ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি না করে আমাকে বরখাস্ত করা হয়। আমার দীর্ঘ বক্তব্য থেকে নিশ্চয়ই আপনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে সাংবাদিকতার মতো একটি পেশায় দলীয় পরিচিতি সাংবাদিকতার মান ক্ষুন্ন করে এবং যোগ্য সাংবাদিকরা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী দায়িত্ব পালনের সুযোগ পান না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিএনপির এক্টিভিষ্ট সাংবাদিক নই, বিএনপির কট্টর সমর্থক বলতে পারেন। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি পেশাগত সততা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে। সকল মহলের সাথে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করেছি। সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কোনো দল বা নেতার প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন করিনি, বস্তুনিষ্ঠতাকেই বরাবর প্রাধান্য দিয়েছি। সে কারণে পেশাজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিপরীত রাজনৈতিক ধারার সংবাদপত্রে সুনামের সাথে কাজ করতে সক্ষম হয়েছি।

জহিরুলঃ দেশ ছাড়ার মূল কারণ কি? কখন দেশ ছাড়েন, কেমন আছেন ভিন দেশে?

মঞ্জুঃ দেশ ত্যাগ করে ভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতই প্রাচীন। ইতিহাসের সকল পর্যায়ে আপনি রাজা, বাদশাহ থেকে শুরু করে ধর্ম প্রচারক, সাধারণ মানুষকে তাদের জন্মভূমি ত্যাগ করার ঘটনা আপনি জানেন। কেউ দেশ জয় করার জন্য নিজ দেশ ত্যাগ করে দখল করা দেশকে নিজ আবাসে পরিণত করেছেন। কেউ জীবন রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করেছেন। কেউ বা নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ভিন্ন দেশে চলে গেছেন। উন্নত জীবন যাপনের আশায় অনেকে দেশ ত্যাগ করেন। এই অভিবাসন প্রক্রিয়া আপনি আদম-হাওয়া থেকে শুরু করতে পারেন। আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করে অনাবিল সুখের বেহেশত থেকে তারা বিতাড়িত হয়ে পঙ্কিল পৃথিবীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। এমনকি আমাদের শেষনবী মুহাম্মদের জীবন যখন তাঁর জন্মভূমি মক্কায় বিপন্ন হয়ে ওঠেছিল তখন তিনি জীবনের নিরপত্তার জন্য মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগেও এটি সহজ ছিল না। প্রথমে তিনি তায়েফ গিয়েছিলেন, তায়েফের লোকজন তাঁকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করায় তিনি মদিনায় যান। তাদের মধ্যবর্তী আরো অনেক নবীকে জন্মভূমি ত্যাগ করতে হয়েছিল। ইব্রাহিমের কাছে আল্লাহর আদেশ আসে, “তোমার দেশ, তোমার জনগণ, তোমার পিতার বাসস্থান ত্যাগ করো এবং আমি তোমাকে যে ভূখণ্ড দেখাবো সেখানে যাও।” পঁচাত্তর বছর বয়সে তিনি জন্মভূমি ত্যাগ করে কেনান, বেথেল ও নেগেভে যান। ফারাও এর অত্যাচারে মূসাকে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে মিশর ত্যাগ করতে হয়েছিল। যিশু খ্রিষ্ট বা ঈসা যে নাজারেথ এ বেড়ে ওঠছিলেন সেখান থেকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদের উপমহাদেশের রাজা বাদশাহদের নিজ নিজ রাজ্য ত্যাগ করার বহু ঘটনা রয়েছে; সেগুলো বাদ দিলেও জন্মভূমি ত্যাগের বড় ঘটনা পাবেন গৌতম বুদ্ধের ও পরবর্তীতে তাঁর অনুসারী বৌদ্ধদের। ভারতে অত্যাচরিত হয়ে তাদেরকে দূর-প্রাচ্যের দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আধুনিক যুগে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দেশ ত্যাগের ঘটনা ঘটেছে ১৯৪৭ সালে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় এক কোটি লোককে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছে। কাজেই মানুষের দেশ ত্যাগ করার ঘটনা নতুন কিছু নয়।

জহিরুলঃ মাইগ্রেশন আদি ঘটনা, শুধু মানুষ না, পশু পাখিরাও মাইগ্রেট করে। আরও বৃহৎ অর্থে পৃথিবীকালও তো একটা মাইগ্রেশন।

মঞ্জুঃ জি, সে কথা আমি আগের প্রশ্নের উত্তরে বলেছি। আমার নিজের কথা বলতে হলে বলবো যে, আমি দেশ ত্যাগ করেছি বলা ঠিক হবে না। বাধ্য হয়ে বিদেশে দীর্ঘদিন যাবত অবস্থান করছি। আত্ম-নির্বাসিত বলতে পারেন। ২০১০ সাল থেকে একটানা বিদেশে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমি আরও অনেকবার বিদেশে এসেছি, অধিকাংশই পাশ্চাত্যের দেশে। কিন্তু উন্নত জীবন আমাকে আটকে রাখতে পারেনি। প্রথমত মায়ের কারণে, দ্বিতীয়ত দেশের কারণে। আমার মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, বিদেশে এসে সারাক্ষণ মনে হয়েছে কবে দেশে ফিরে খাওয়ার পর হাত ধুয়ে মায়ের শাড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুখ মুছবো। সেজন্য আমার কর্মসূচি শেষ হওয়ার সাথে সাথে দেশে চলে গেছি মায়ের আশ্রয়ে। ১৯৮৮ সালে যখন প্রথম বার যুক্তরাষ্ট্রে আসি, তখন একা আসি। আমার পরিবার আমার সাথে যোগ দেয় এক মাস পর। ওই এক মাসে আমার ছয় বছর বয়সী মেয়ের একটি চিঠি পাই। চিঠিতে সে লিখেছিল, ‘আকাশে প্লেনের শব্দ শুনতে পেলেই দাদু বারান্দায় গিয়ে প্লেনের দিকে তাকিয়ে থাকে আর কাঁদে।’ আমি ভাত-পাগল ছিলাম, তিন বেলা ভাত খেতে হতো। আমার স্ত্রীর কাছে মা বার বার জানতে চায়, আমেরিকায় ভাত পাওয়া যায় কিনা। আমার পক্ষে মা’কে ছেড়ে থাকা প্রায় অসম্ভব ছিল। ২০০২ সালে মা মারা যান। এরপর দেশ-বিদেশ কোনো পার্থক্য ছিল না। তবুও পেশার টানে দেশেই ছিলাম। বিদেশে অড জব করার কথা চিন্তা করতে পারতাম না। বাংলাদেশে আমার সর্বশেষ কর্মস্থল বাসস এ থাকাকালে ২০১০ সালে ছুটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে চাকুরিচ্যুত করা হলে আমি দেশে না ফিরে যুক্তরাষ্ট্রে রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এ সম্পর্কে আমি আগের এক প্রশ্নের উত্তরে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি।

আমার মেয়ে ২০০৯ থেকেই পাশ্ববর্তী সিটি ফিলাডেলফিয়ায় ছিল। আমি নিউইয়র্কে আসার পর সে ফিলাডেলফিয়া থেকে নিউইয়র্ক চলে আসে। আমরা একটি বাসা ভাড়া নেই। আমার ছেলে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ করছিল। ওর কোর্স শেষ না হলে আমার স্ত্রীর পক্ষে ঢাকা ছেড়ে আসা সম্ভব ছিল না। তবুও সে ছ’মাস পর পর নিউইয়র্ক এসে আমাদের সাথে দেখা করে গেছে। আমার ছেলের বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষার পর সে ২০১৩ সালে ছেলেকে নিয়ে নিউইয়র্ক চলে আসে। অতএব আমাকে একা বিদেশে কাটানোর কষ্ট পোহাতে হয়নি। তবে দেশ ছেড়ে থাকার কষ্ট তো আছেই। মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে পারি না। আপন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয় না। কারো দু:খে শরীক হতে পারি না। দেশে যেসব ঘটনা ঘটছে তা প্রত্যক্ষ করতে পারি না। এসব দু:খবোধ ছাড়া আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।

জহিরুলঃ নিউইয়র্ক হচ্ছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের একটি বড় জনপদ, এখানে বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের পর সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। বেশ কিছু বাংলা সংবাদপত্র, টেলিভিশন আছে। আপনি নিজেও একটি সংবাদপত্রের সাথে জড়িত আছেন। বাংলাদেশিদের দ্বারা পরিচালিত মিডিয়াগুলো কতটা পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করছে?

মঞ্জুঃ নি:সন্দেহে নিউইয়র্ক সিটি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের বড় জনপদ এবং বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাও এখানে বেশি হয়। আমার মনে হয়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের চেয়েও বাংলাদেশিরা দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা বেশিই করে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা আমাদের চেয়ে একটু সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারা বৃহত্তর ভারতীয় পরিচিতির মধ্যে নিজেদেরকে খুঁজে পায়। তাছাড়া ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রে সেকেণ্ড জেনারেশনে প্রবেশ করেছে এবং সেকেণ্ড জেনারেশনের বড় অংশ মূলধারার সাথে মিশে গেছে। মূলধারার রাজনীতি করছে, কর্পোরেট হাউজে, হাইটেক ইন্ড্রাষ্ট্রিতে কাজ করছে। তারা ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা নিয়ে মাথা ঘামায় না। এসব বিচারে বাংলাদেশিরা অনেক পিছিয়ে আছে। তিন দশক আগে প্রথম বার নিউইয়র্ক সিটিতে এসে দেখেছি এই সিটিতে ভারতীয় ট্যাক্সিচালকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এখন বাংলাদেশি ট্যাক্সিচালকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আগে সাইডওয়াক ও সাবওয়ে ষ্টেশনগুলোর নিউজষ্ট্যান্ডগুলোর মালিক ছিল ভারতীয়, এখন অধিকাংশ নিউজষ্ট্যাণ্ডের মালিক বাংলাদেশি। ভারতীয়রা এই পর্যায় থেকে ওপরে ওঠে গেছে। বাংলাদেশিরা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিরা মূলধারায় সম্পৃক্ত হচ্ছে। তা সত্বেও আমাদের মধ্যে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ রয়েছে। সেজন্য আমরা শেকড় আঁকড়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা নিউইয়র্কে কোনো বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করে না। তাদের দ্বারা কোনো টেলিভিশন পরিচালিত হয় বলেও জানি না। বাংলাদেশিরা নিউইয়র্ক থেকে এক ডজনের বেশি বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করছে। দুটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল চালু রয়েছে। আমি নিজেও গত দশ বছর যাবত একটি সংবাদপত্রের সাথে জড়িত। এখানে মিডিয়ার পক্ষে পেশাদারিত্ব বজায় রাখা কঠিন ব্যাপার। বাংলাদেশী প্রবাসীর তুলনায় সংবাদপত্রের সংখ্যা বেশি। বিজ্ঞাপনের বাজার আরও ছোট। বাংলাদেশিদের বড় কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এতোগুলো সংবাদপত্রকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব এখানে কোনো বাংলাদেশির পক্ষে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা গ্রহণ করে জীবিকার সংস্থান করা অসম্ভব ব্যাপার। যারা কাজ করেন তাদের অধিকাংশ সামান্য লোকবল নিয়ে কাজ করেন, সামান্য বেতন দেন। অতএব যারা কাজ করেন, তাদেরকে জীবিকার জন্য অন্য কোনো কাজ করতে হয়। যারা সংবাদপত্রগুলো পরিচালনা করেন, তাদেরকেও নানাভাবে কম্প্রোমাইজ করে চলতে হয়। এসব সীমাবদ্ধতা সত্বেও সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যে যোগাযোগ ও সেতুবন্ধনের কাজ করে যাচ্ছে।

জহিরুলঃ আমরা প্রায়শই বলি প্রবাসীরা খুব আত্মপরিচয়ের সমস্যায় ভোগেন, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বিষয়টি ব্যাখা করবেন কি?

মঞ্জুঃ আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরে আমি এ সম্পর্কে আলোকপাত করেছি। একজন মানুষ কেন বা কখন তার আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগেন Ñ যখন তিনি তার মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় ভুলে যান এবং নিজেকে কীভাবে তুলে ধরবেন তা বুঝে ওঠতে পারেন না অথবা আত্ম-অহঙ্কারের মধ্যে থাকেন। আমরা বৃহত্তর সমাজে মিশতে চাই, কিন্তু অবচেতন মনে অহঙ্কারকে ধরে রাখি। কেউ যদি তার জ্ঞান, দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে নিজের পরিচয় খুঁজে পায়, তাহলে তিনি আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগেন না। কারণ এসব গুণ বা বৈশিষ্ট হারিয়ে যাওয়ার নয়। আমরা যে শুধু বিদেশে এসে আত্মপরিচয়ের সমস্যার মধ্যে থাকি তা নয়, আমরা যখন দেশে থাকি তখনও আমরা আত্মপরিচয়ে সমস্যার মধ্যে থাকি। দেশে অবস্থানকালে আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, ঢাকায় প্রতিটি জেলার পৃথক পৃথক সমিতি আছে। পাকিস্তান আমলে ঢাকায় একটি-দুটি জেলাভিত্তিক সমিতি ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে প্রতিটি বিভাগ ও জেলার সমিতি ছাড়াও অনেকগুলো উপজেলা সমিতি পর্যন্ত আছে। বিভিন্ন পেশাজীবীদেরও জেলাওয়ারী সমিতি আছে। এর কারণ, আমরা সর্বত্র আত্মপরিচয়ের সংকটে ভুগি এবং কোনো সংগঠনের আশ্রয় নিয়ে সে সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। বিদেশে আত্মপরিচয়ের সংকট আরও বেশি। আমরা সহজে মূলধারায় প্রবেশ করতে পারি না। সে চেষ্টাও করি কম। অতএব প্রবাসীরা নিজেদের মধ্যেই নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন সমিতি, সোসাইটির আশ্রয় গ্রহণ করেন। নিউইয়র্ক সিটিতে অন্তত আড়াইশ অঞ্চল-ভিত্তিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে। কোনো কোনো জেলার একটি সমিতি ভেঙে চারটি হয়েছে; দুটি করে সমিতি প্রায় প্রতি জেলার। ব্রুকলিনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত একটি এলাকায় মসজিদের কমিটি নিয়ে কলহের জের ধরে কাছাকাছি দূরত্বে চারটি মসজিদ হয়েছে। বাংলাদেশী হিন্দুদের মন্দিরের কমিটি নিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি হওয়ায় এক মন্দির থেকে দুটি মন্দির হয়েছে। পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন সাংবাদিকসহ নিউইয়র্কে ৫০ থেকে ৬০ জন সাংবাদিক আছেন, প্রেস ক্লাব আছে তিনটি। এর কারণ একটাই, কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারী হওয়া; অর্থ্যাৎ ছোট্ট একটি কমিউনিটিতে একটি পরিচয় নিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা।

আমি প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাস হাউজিংয়ে থাকতাম। পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ছোট্ট শহর। ছাত্রদের মধ্যে বিদেশি ছাত্র অনেক। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারি ও সিটির লোকজন সবই আমেরিকান। বাংলাদেশী একজনকেও পাইনি, এমনকি ভারতীয় খুব বেশি ছিল না। আমাকে আমেরিকানদের সাথে মিশতে হয়েছে এবং আমি তো কখনো হীনমন্যতায় ভুগিনি। আমেরিকানদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব দেখতে পাইনি। স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস শুরু করার পর আমি কখনো কোনো সংগঠনের আশ্রয় নিয়ে আত্মপরিচয় খুঁজতে চেষ্টা করিনি। কমিউনিটিতেও যে খুব মেলামেশা করি তাও নয়। একটি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে প্রেস ক্লাবের সদস্য হতে হয়েছিল, সেটিতেও ভাঙাভাঙি দেখে মন খারাপ হয়েছে। মনে হয় বিচ্ছিন্ন থাকাই ভালো ছিল।

জহিরুলঃ দেশের রাজনীতি প্রবাসে, এর ভালো-মন্দ দিকগুলো যদি একটু ব্যাখ্যা করেন।

মঞ্জুঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিদেশে বসবাসকারী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা, বিশেষ করে যারা যুক্তরাজ্যে ও যুক্তরাষ্ট্রের বড় সিটিগুলোতে ছিলেন এবং যাদের অধিকাংশই ছিলেন ছাত্র, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত ও তহবিল সংগ্রহে অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তারা দলীয়ভাবে তা করেননি। অভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে তারা নিজেদেরকে সংগঠিত করেছিলেন। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মূলধারার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন। কিন্তু যখন থেকে বাংলাদেশিরা বিপুল সংখ্যায় বিদেশে যেতে শুরু করেছে তখন থেকে বিদেশে, তা যুক্তরাষ্ট্র হোক, যুক্তরাজ্য বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশ হোক, বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজার হিসেবে পরিচিত মালয়েশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ হোক – প্রতিটি দেশে বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ প্রধান দলগুলোর শাখা-প্রশাখা রয়েছে। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সংবিধান অনুযায়ী বিদেশে দলের শাখার অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া গেলেও প্রতিটি দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিদেশে দলের কমিটিগুলোকে অনুমোদন দেয়া হয়। যারা বিদেশে দলগুলোর শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পেতে চান তাদের নিকট থেকে অর্থও নেয়া হয়, এমন অভিযোগও আছে। তারা দলের নির্বাচনী তহবিলে মোটা অংকের অর্থ প্রদান করেন। দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা সফরে এলে দলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। বিনিময়ে সরকারি দলের বিদেশি শাখার দায়িত্বশীলরা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করাসহ বিনিয়োগ সুবিধা লাভ করেন।

আমার মনে হয়, মূলধারায় যুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর পদ লাভের জন্য প্রতিযোগিতা করেন। তারা যদি তা না করে যিনি যে দেশে স্থায়ীভাবে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেই দেশের মূলধারার রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করতেন তাহলে বাংলাদেশি কমিউনিটির এবং ব্যাপক অর্থে বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি অবদান রাখতে পারতেন।

জহিরুলঃ প্রথম প্রজন্মের বাঙালি লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীদের মূলধারার সাথে খুব একটা যুক্ত হতে দেখা যায় না, এর কারণ কি ভাষার অন্তরায়, না দেশের মাটি ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান?

মঞ্জুঃ পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ে অধিক সংখ্যক বাংলাদেশির সমাবেশ ঘটেছে। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ বৈধভাবে অবস্থান করলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রয়েছেন অবৈধভাবে। বৈধ ও অবৈধ নির্বিশেষে সবার মধ্যেই এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারদর্শী। লেখক, সাংবাদিক ও শিল্প প্রতিভাসম্পন্ন। এদেশে যারাই আসেন, তাদের প্রথম জীবনের ধকল কাটাতেই কয়েক বছর কেটে যায়। এসময়ের মধ্যে একটি অংশ যখন থিতু হন তখন তারা আগের প্রতিভা হয় হারিয়ে ফেলেন, অথবা অর্থের পেছনে ছুটে সৃজনশীল কিছু করার সময় পান না। শুধু যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করেছেন, তারা ছাড়া প্রথম প্রজন্মের আর কাউকে আপনি লেখক হিসেবে পাবেন না। তাদের লেখা মূখ্যত গবেষণাধর্মী, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণমূলক। প্রথম প্রজন্মের কেউ মূলধারার সাংবাদিকতায় যুক্ত হননি। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সম্পর্কে যেহেতু আমি তেমন খোঁজখবর রাখি না, সেজন্য আমার জানা নেই যে কোনো বাংলাদেশি শিল্পী বা সাংস্কৃতিক কর্মী কেউ মূলধারায় জড়িত হয়েছেন কিনা। ভাষা অবশ্যই একটি অন্তরায়। আপনি লক্ষ্য করে থাকবেন যে, পঁচিশ-ত্রিশ বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর-মাষ্টার্স করেছেন; কিন্তু তারা কাজ চালানোর মত ইংরেজি বলতে পারলেও শুদ্ধ করে ইংরেজিতে একটি বাক্য বলতে পারেন না। আমি কাউকে ছোট করার জন্য একথা বলছি না। আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আপনি তো জানেন, জীবিকার তাগিদে সাংবাদিকতার পাশাপাশি আমাকে ইমিগ্রেশন অফিসে অথবা কোর্টে বা দুর্ঘটনার ঘটনায় বাংলাদেশিদের জন্য ইন্টারপ্রেটের বা দোভাষির কাজ করতে হয়। আমি অবাক হয়ে ভাবি, যারা বাংলাদেশের ষ্ট্যান্ডার্ডে যথেষ্ট শিক্ষিত, বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন, দীর্ঘদিন যাবত আমেরিকায় বসবাস করছেন, তারা কেন তাদের প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে ইংরেজি শিখেননি। ভাষার এই অন্তরায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের সৃষ্টি করা। এ অন্তরায় কাটিয়ে ওঠতে পারলে প্রথম প্রজন্মের মাটি ও সংস্কৃতির টান এখন যেমন আছে, তেমন থাকতো না বলেই আমার বিশ্বাস।

জহিরুলঃ দেশের বাইরে থেকে লেখালেখি করেন উল্লেখ করার মতো এমন বাঙালি লেখক কে কে আছেন, তাদের সম্পর্কে যদি কিছুটা মূল্যায়ন করেন।

মঞ্জুঃ প্রবাসে যারা বাংলা সাহিত্য চর্চা করছেন তাদের সংখ্যা অনেক। আমি ব্যাপক অর্থে বাঙালি লেখকদের সম্পর্কে বলতে পারবো না। তবে বাংলাদেশি লেখকদের বোঝাতে চাইলে আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাজ্যে প্রবাসী লেখক সংখ্যা বেশি। আমি সবার নাম জানি না। অতএব অনুমান করে বললে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আপনার বই ছাড়া অন্য কোনো প্রবাসী লেখকের বাংলা বই আমি পড়িনি। অতএব তাদের লেখার মূল্যায়ন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সাহিত্য চর্চায় আমার আগ্রহের ক্ষেত্র যেহেতু অনুবাদ, সেজন্য আমি প্রধানত ইংরেজি ভাষায় প্রাচ্যের সাহিত্যকর্ম পাঠ করার চেষ্টা করি। আপনার সাথে সখ্য, নৈকট্য ও আপনার বইয়ের প্রাপ্যতার কারণে আপনার প্রায় সব লেখাই পড়েছি। আপনি ভালো কাজ করছেন। সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি অবদান রেখে চলেছেন। প্রবাস জীবন আপনার সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি।

জহিরুলঃ আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে কি দিয়েছে আর কি কেড়ে নিয়েছে এই প্রবাস জীবন?

মঞ্জুঃ প্রবাস জীবন আমাকে নিরাপত্তা দিয়েছে; কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমার মায়ের কবর।

জহিরুলঃ আপনার বর্ণাঢ্য জীবনের নানা দিক এবং আপনার অভিজ্ঞতাপ্রসূত নানান মতামত এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জানতে পারলাম। আমি নিজে সমৃদ্ধ হয়েছি এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যারা এই সাক্ষাৎকারটি পাঠ্য করেছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন তারা সকলেই সমৃদ্ধ হয়েছেন এবং হবেন। আরও হাজারো বিষয় মস্তিষ্কের জানালায় উকি দিচ্ছে, কিন্তু যেহেতু কোনো এক জায়গায় শেষ করতেই হবে, তাই এবারের মতো এখানেই শেষ করছি। এতো লম্বা সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মঞ্জু: আমার জীবন কতটা বর্ণাঢ্য বা আমার অভিজ্ঞতা ভাণ্ডার কতটা সমৃদ্ধ সে ব্যাপারে আমার সংশয় রয়েছে। আমি প্রতিটি মানুষের জীবনকে বর্ণাঢ্য মনে করি। আপনি উদ্যোগ নেয়ার কারণেই হয়তো আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা বলতে পেরেছি। এর ফলে প্রায় ভুলে যাওয়া অনেক স্মৃতি নতুন করে মনের পর্দায় ভেসে ওঠেছে। আমাকে কথাগুলো বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

Published in সাক্ষাৎকার

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *