Skip to content →

আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকান্ড এবং মৃত্যু প্রসঙ্গে শামস তাবরেজি ও রুমির সংলাপ

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি (বুয়েট) এ আববার ফাহাদ যে বিভাগের ছাত্র ছিল, সেই বিভাগের শিক্ষক রুহুল আমিনের প্রিয়ভাজন ছিলাম। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তার অফিস, বাসায় যেতাম। হলের খাবারে অরুচি হলে তার বাসায় চলে যেতাম। রুহুল আমিন স্যারের ছোট দুই ভাই তার সাথেই থাকতো। স্কুল পড়–য়া খায়রুল আমি আমার ভক্ত হয়ে উঠেছিল এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিকে খায়রুল ইন্টারমিডিয়েট পড়তে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলে আমি ওকে দেখার জন্য সেখানেও গেছি। পরে খায়রুল আমি বুয়েটেই ভর্তি হয়েছিল এবং সম্ভবত ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়েই (তখন বিভাগটির এই নাম ছিল)। আবরার এর ঘটনা জানার সাথে সাথে রুহুল আমিন স্যার এবং তার ভাই খায়রুলের কথাই আগে মনে পড়েছে। আমার এই নিবিড়তার কারণে আবরারকে বুয়েটে তারই হলে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হত্যা করবে তা ভেবে শিহরিত হয়েছি। তার মায়ের বিলাপ ও বাবা’র কাতরোক্তি আমার চোখেও পানি এনেছে।

সেশন জটের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চার বছরের অধ্যয়নকাল সাত বছরে গড়িয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে বেশুমার সংঘর্ষের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এসব ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও কম ছিল না। কোনো ছাত্র নিহত হলে বা সংঘর্ষ আরো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হলে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে আবাসিক হলগুলো থেকে ছাত্রছাত্রীদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতো। কিন্তু আমার ঢাকা ছাড়ার উপায় ছিল না। কারণ অনার্স সেকেন্ড ইয়ার থেকেই আমি ফুলটাইম সাংবাদিকতা করতাম। হলেও থাকার উপায় ছিল না। অতএব. আমি বুয়েট এর নজরুল ইসলাম হলে আমার বন্ধু আকরাম এর রুমে থাকতাম। আমাকে বেড ছেড়ে দিয়ে আকরাম অন্য কোনো রুমে গিয়ে রাত কাটাতো। আকরাম এর দুই রুমমেট ছাড়াও ওর ব্যাচমেট এবং হলের সিনিয়র, জুনিয়র সবাই মোটামুটি আমাকে জানতো। বুয়েট ক্যাম্পাসে আমার পদচারনা এতোটাই নিয়মিত ছিল যে, অনেকে ভাবতো আমি বুয়েটের ছাত্র। অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।

আমার সাত বছরের বাসস্থান ছিল সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। বুয়েট ক্যাম্পাস এবং আমার হলের মধ্যে ব্যবধান রেইন ট্রি’র ছায়াঘেরা রাস্তার এক পাশে আমার হল, আরেক পাশে বুয়েট ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জট থাকলেও তখন বুয়েটে কোনো সেশন জট ছিল না। বুয়েটে ছাত্র লীগ (আওয়ামী), ছাত্রলীগ (জাসদ), ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র শিবির সবই ছিল। ওই সময় বুয়েটে দাপুটে ছিল জাসদ ছাত্রলীগ। তা সত্ত্বেও বুয়েটে টেন্ডারবাজির কথা শোনা যেত না। ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটতো না; বড়জোর হাতাহাতি এবং গালিগালাজ পর্যন্ত। নজরুল ইসলাম হলের পাশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফজলে রাব্বি হল। সন্ধ্যার পর কখনো বিদ্যুৎ চলে গেলে নজরুল ইসলাম হলের ছাত্ররা ফজলে রাব্বি হলের ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করতো, “এই যে, কম্পাউন্ডাররা, তোদের কম্পাউন্ডারি শিখতে এতো লম্বা সময় লাগে কেন?” ফজলে রাব্বি হলের ছাত্ররা একইভাবে চিৎকার করতো, “কী রে মিস্ত্রিরা, মাঠেঘাটে মেরামত কাজ ছেড়ে ঢাকায় তোদের কী?” এ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। রাজনৈতিক ধরনের মারামারি, কাটাকাটির জন্য ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল এবং ঘটনা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছিল।

সেই বুয়েটে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সমর্থক হতে পারে সন্দেহ থেকে একজন মেধাবী ছাত্রকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা থেকে যে কারো বোঝা উচিত মানুষের একটি শ্রেনী আসলে মনুষ্য পদবাচ্য নেই। যার মৃত্যু ঘটেছে, সেই আববার এখন সকল যন্ত্রণা ও বোধের বাইরে। যারা বেঁচে আছে তাদের বোধ এবং স্পর্শেন্দ্রিয় আছে। যা কিছু ভোগ করার বোধগতভাবে তাদেরকেই ভুগতে হবে।

জালালউদ্দীন রুমির মাঝে আমি আমার সান্তনা খুঁজে পেতে চেষ্টা করি। সান্তনা পেয়েও যাই। আমার বন্ধুদেরকেও বলি একই ধরনের সান্তনা পেতে।
“যারা দর্শন জানার ভান করে তারা মৃত্যুর পর “কবরের শাস্তি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন।” তারা বুদ্ধিবৃত্তিক সত্যের পথ দেখাতে চেষ্টা করেন এবং সে প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। তারা বলেন; ‘আত্মা এখানে আসে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য। নিজের পরিশুদ্ধির জন্য পৃথিবী থেকে উত্তম আহরণ করার পর আত্মা এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে। আত্মার নিজের কোনো অনুশোচনা নেই। ঠিক এ মুহূর্তেই কোনো মানুষ তার অবয়ব থেকে বের হয়ে আসে এবং একটি বোধের মধ্যে প্রবেশ করে এবং দেহকে আত্মার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়। আত্মা যদি নিজেকে দেহের সাথেই আবিষ্ট রাখে এবং দেহের সাথে সম্পৃক্ত করে নেয়, তা হলে ওপরের দরজা অবরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং আত্মার জন্য আর কোনো বিস্তার এবং উন্মুক্ত আলোকোজ্জ্বল স্থান থাকবে না।

আত্মা তার এক পাশে প্রাচুর্য, নারী এবং মর্যাদা দেখতে পায়। এই পাশে পরিচিত পরিবেশ, সঙ্গীসাথী এবং বিভিন্ন ধরনের আমোদ-প্রমোদের উপায় উপকরণ ও সুবিধা দেখে। এরপর আত্মা আরেক পাশে ঝুঁকে; এবং কেউ যদি তার কাছে ‘মৃত্যু’ শব্দটি উচ্চারণ করে, তা হলে আত্মা হাজারটি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে।
আত্মা যদি দেখতে পায় যে, তার আকাঙ্খাগুলো পৃথিবী থেকে আসছে, তা হলে সেখানে যাওয়ার জন্য আত্মা ব্যগ্রতা প্রকাশ করবে। তখন সেই মৃত্যু আর মৃত্যু নয়। এটি জীবন। এজন্য মহানবী বলেছেন; “বিশ্বাসীরা (মুমিন) কখনো মৃত্যুবরণ করে না। বরং তাদেরকে স্থানান্তরিত করা হয়।” অতএব, ‘স্থানান্তর’ একটি বিষয়, এবং ‘মৃত্যু’ আরেক বিষয়।
দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, তোমাকে যদি একটি ক্ষুদ্র অন্ধকার কক্ষে রাখা হয়, তা হলে তুমি সেখানে আলো উপভোগ করার আশা করতে পারো না, এমনকি তোমার পা ছড়িয়ে বসতেও পারো না। এরপর তোমাকে সেই সংকীর্ণ কক্ষ থেকে একটি বড় কক্ষে, বড় বাড়িতে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে উদ্যান ও প্রবাহমান ঝর্ণা রয়েছে। সেটিকে ‘মৃত্যু’ বলা যেতে পারে না।
অতএব, এই শব্দগুলো একটি উজ্জ্বল আয়নার মতো। তোমার যদি কোনো আলো ও স্বাদ থাকে, তা হলে তুমি মৃত্যুর জন্য আকাঙ্খা করবে। আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহশীল হোন! তোমার জন্য এটি আশির্বাদ হোক। এবং তোমার সিজদায় আমাকে ভুলে যেয়ো না।

আর, তোমার যদি এ ধরনের কোনো আলো বা এমন কোনো স্বাদ না থাকে, তা হলে তুমি তা আহরণ করার চেষ্টায় বেরিয়ে পড়ো। অনুসন্ধান করো এবং সেজন্য পরিশ্রম করো; কারণ কোরআন আমাদেরকে বলেছে, যদি তুমি এমন একটি অবস্থা খুঁজে পেতে সচেষ্ট হও, তা হলে অবশ্যই তা পাবে। অতএব অনুসন্ধান করো! তুমি যদি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাসী (মুমিন) হও, তা হলে মৃত্যু কামনা করো (২:৯৪)। ঠিক মানুষের মধ্যে যেমন নিষ্ঠাবান থাকে এবং তাদেরকে বিশ্বাস করা যায়, যারা মৃত্যু কামনা করে; অনুরূপ নারীদের মধ্যেও নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাস করার মতো কেউ বিদ্যমান।
এটি উজ্জ্বল এক আয়না, যার মধ্যে তুমি নিজের অবস্থার ব্যাখ্যা খুঁজে পাবে। যখনই এমন কোনো একটি অবস্থার সৃষ্টি হয় অথবা কাজ থাকে, যার মধ্যে তুমি মৃত্যুকে দেখতে পাও, সেটিই উত্তম অবস্থা বা উত্তম কাজ। অতএব, যখনই তুমি দুটি কাজের মধ্যে একটি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হও, তা হলে তুমি এই আয়নার পানে তাকাও। এই দুটি কাজের মধ্যে মৃত্যু তোমার জন্য অধিকতর উপযুক্ত? তোমাকে অবশ্যই স্বচ্ছ আলোর মতো স্থির হয়ে বসে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে প্রতীক্ষা করতে হবে।

তুমি কী কল্পনা করতে পারো, যে ব্যক্তি পরিপূর্ণ আনন্দ উপভোগ করে তার মাঝে অনুশোচনা কম থাকবে? কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তার অনুশোচনা হবে অনেক বেশি, কারণ সে নিজেকে এই পৃথিবীর সাথে অধিক অভ্যস্ত করে ফেলেছে। কবরের শাস্তির ধরন ও প্রকরণ সম্পর্কে তারা যা বলেছেন, তার মর্মার্থ আমি তোমার কাছে ব্যাখ্যা করেছি।”

Published in শিক্ষাঙ্গন

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *