Skip to content →

পঁচিশ বছর পর ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে

পঁচিশ বছর পর ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসা অসাধারণ এক অভিজ্ঞতা। আড়াই দশক আগের মধুর স্মৃতিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল চার দিনের মিলন মেলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের জন. এস. নাইট প্রফেশনাল জার্নালিজম ফেলোশিপ প্রোগ্রামে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত যেসব পেশাদ্রা সাংবাদিক অংশগ্রহন করেছেন তাদের মধ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের প্রায় দু’শ সাংবাদিক অংশ নিয়েছিলেন চারদিনব্যাপী এই রিইউনিয়নে। প্রতি চার চার বছর পর পর রিইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হলেও আমি এবারই প্রথম অংশ নিয়েছি। এটি ছিল নাইট ফেলোশিপ প্রোগামের নবম রিইউনিয়ন। শেষ দিনের রিসেপশন ডিনারে প্রোগ্রামের বর্তমান ডাইরেক্টর জিম বেটিঙ্গার তার সূচনা বক্তব্যে জানালেন যে, ১৯৬৮ সালে নাইট ফেলোশিপে অংশ নিয়েছিলেন এমন দু’জন ফেলো নবম রিইউনিয়নে যোগ দিয়েছেন। নাম ঘোষণা করার পর তারা উঠে দাঁড়ালে দীর্ঘ সময় ধরে করতালি ও হর্ষধ্বনিতে হলরুম মুখর হয়ে উঠেলো। ন’টি রিইউনিয়নে অংশগ্রহণ করেছেন, এমন ফেলো ছিলেন মাত্র একজন, জেমস ভি রিসার।

জিম বেটিঙ্গারের আগে জিম রিসারই ছিলেন প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি আইওয়ার ডেস ময়নেস রেজিষ্টার নামে একটি সংবাদপত্রে যোগ দেন এবং ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটির ওয়াশিংটন ব্যুরো চীফের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালেই তিনি ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়ে ২০০০ সাল পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। তিনি নিজেও এ প্রোগ্রামের একজন ফেলো ছিলেন ১৯৭৩-৭৪ একাডেমিক ইয়ারে। বর্নাঢ্য পেশাদারী জীবন জিম রিসারের। ১৯৭৬ ও ১৯৭৯ সালে সাংবাদিকতায় ন্যাশনাল পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন ইনভেষ্টিগেটিভ রিপোর্টিং এর জন্য। নাইট প্রোগ্রামের পাশাপাশি ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি পুলিৎজার বোর্ডের সদস্য ছিলেন। অবসর নেয়ার পর তিনি তার নিজ বাড়ি ওরিগনে কাটাচ্ছেন। তার অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তার নামে ফেলোশিপ প্রোগ্রামের পক্ষ থেকে প্রতিবছর আমেরিকান সাংবাদিকদের জন্য আমেরিকান ওয়েষ্টের পরিবেশ সাংবাদিকতার উপর একটি বিশেষ ফেলোশিপ চালু করা হয়েছে। এ বিষয়ের উপর একটি বার্ষিক লেকচার প্রোগ্রামও অনুষ্ঠিত হয় প্রতিবছর। জিম রিসারকেই আমি ডাইরেক্টর হিসেবে পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন ম্যানেজিং ডাইরেক্টর হ্যারি এন প্রেস ছিলেন ফেলোশিপ প্রোগ্রামের প্রাণ। অসাধ্য সাধন করার মতো একজন ব্যক্তিত্ব। ওয়েষ্ট কোষ্টের, বিশেষত: স্যানফ্রান্সিকো বে এরিয়ায় অনেকগুলো সংবাদপত্রের সাথে কাজ করে হ্যারি ১৯৬৭ সালে ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামে এবং ১৯৮৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে ৯৩ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন।


আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম মিডিয়া গ্রুপ নাইট নিউজপেপারস এন্ড রাইডার পাবলিকেশন্সের বড় ধরনের গ্রান্টের পাওয়ার পর ১৯৬৬ সালে ষ্ট্যানফোর্ডের কমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্টে জন এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রাম চালু হয়। অনুদান দাতাদের মধ্যে ফোর্ড ফাউন্ডেশনসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও ছিল। ১৯৩৩ সালে নাইট রাইডার গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ষ্টেট থেকে ৩২টি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশনা ছাড়াও এক ডজনের অধিক টেলিভিশন পরিচালনা করতো। ২০০৬ সালে এ কোম্পানিটি ম্যাক্ল্যাথি কোম্পানির কাছে মালিকানা সত্ত্ব বিক্রি করে দেয়। তখনো পত্রিকাগুলোর সম্মিলিত প্রচার সংখ্যা ছিল ৩৩ লক্ষ। নতুন কোম্পানি ১২টি সংবাদপত্র অন্য আরেকটি কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করে। প্রফেসর লাইল এল নেসলন ১৯৬৯ সালে প্রোগ্রামের প্রথম ডাইরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৫ সালে জেমস রিসারের কাছে ডাইরেক্টরের দায়িত্ব তুলে দিয়ে ১৯৮৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ষ্ট্যানফোর্ডে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬১ সালে। ১৯৯৭ সালে তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরেটাস এবং নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের সিলেকশন কমিটির সদস্য। এছাড়াও তিনি ছিলেন চাইনিজ বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার আমেরিকান এডভাইজার, রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর এবং ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ফান্ড রেইজার। লাইল নেলসন অবসর নেয়ার পর প্রোগ্রামের সাবেক ফেলোদের উদ্যোগে তার নামে একটি ফেলোশিপের অর্থায়নের উদ্যোগ নিলে ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে এবং তার জীবদ্দশায় ১৯৯৪ সালে তার সম্মানে একটি ফেলোশিপ চালু করে, যা শুধুমাত্র বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য।

রিইউনিয়নে অংশ নিয়ে প্রফেসর লাইল ও হ্যারি প্রেস এর কথা খুব মনে পড়েছে। আমি ফেলোশিপ শেষ করে দেশে চলে যাওয়ার পরও লাইল ও তার স্ত্রী কোরিন এবং হ্যারি প্রেসের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। একবার দীর্ঘ ব্যবধানে সম্ভবত ২০০৪ সালে হ্যারিকে মেইল করে তার কুশলাদি জানতে চাওয়ার পর তার স্ত্রী মার্থাকে আমার শুভেচ্ছা জানাতে বলি। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে হ্যারি উত্তর দেন যে, মার্থা মারা গেছেন এবং তিনি সানফ্রান্সিসকো ক্রনিকলে থাকাকালে তার সহকর্মী ছিলেন এমন এক সাংবাদিকের বিধবা স্ত্রীকে বিয়ে করেছেন। তখন হ্যারির বয়স ৮৫ বছর তার তার দ্বিতীয় স্ত্রীর বয়স ৬৫ বছর। এরপরও হ্যারি আরো নয় বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু বেশির ভাগ সময় রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে। একবার নিউইয়র্ক থেকে স্যানফ্রান্সিসকো যেতে প্লেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে হিপবোনহ বেশ কিছু হাড়গোড় ভাঙ্গার ঘটনা ঘটার পর থেকে পায়ে নাট বোল্ট লাগিয়ে তিনি প্রায় স্থায়ীভাবে শয্যাশায়ী ছিলেন। তখনো তিনি সাবেক ফেলোদের পাঠানো প্রতিটি মেইলের উত্তর দিতেন। তাকে সাহায্য করতেন তার পুত্র। প্রফেসর লাইল এর স্ত্রী কোরিন আমাদের আমেরিকান জীবন সহজ করতে আমি ষ্ট্যানফোর্ডে পৌছতেই সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাড়ি ভর্তি করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে পৌছে দিয়েছিলেন, বাচ্চাদের জন্য খেলনা পর্যন্ত। এমনকি আমার জন্য একটি বাইক, যাতে ক্যাম্পাসে চলাফেরা করার জন্য নগদ অর্থ ব্যয় করে আমাকে বাইক কিনতে না হয়। তার বাড়িতে প্রায়ই আমন্ত্রণ জানাতেন। ১৯৮৯ সালে আমরা দেশে চলে যাওয়ার পরও কয়েকবছর তারা আরো ক’বছর ষ্ট্যানফোর্ডের বাড়িতেই ছিলেন। লাইল মারা যাওয়ার পর কোরিন ওয়েষ্ট কোষ্টের ষ্টেট ওরিগনে চলে যান। পোর্টল্যান্ড সিটির কাছকাছি কোন ছোট্ট সিটিতে। তখনো তার সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তিনি এক সিনিয়র হোমে উঠেছেন এবং একটি চার্চের হয়ে চ্যারিটি প্রোগ্রামে কাজ করছেন। তার দুই মেয়ে তাকে মাঝে মাঝে দেখে যান বলে আমাকে জানিয়েছেন। ২০১০ সালে আমি আমার পর তার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেন। তখন তার বয়স ৮৪ বছর। আমি তাকে দেখতে যাবো বলে মনে মনে স্থির করি। কিন্তু এখনো তাকে দেখতে যাওয়া হয়নি।


আমার ফেলোশিপ ছিল ১৯৮৮-১৯৮৯ একাডেমিক ইয়ারে। রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আবেদন করতে বলা হয়েছিল। প্রতিবছর রয়টার্স ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫টি ফেলোশিপ দেয়া হতো। দু’টি ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে, দু’টি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এবং ফরাসি ভাষাভাষী সাংবাদিকদের জন্য একটি ফেলোশিপ ছিল ফ্রান্সের বর্দো ইউনিভার্সিটিতে। আবেদনে আমার প্রেফারেন্স ছিল ‘ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি’। বিশ্ববিদ্যালয়টি সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না আমার। ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএচডি করছিল আকরাম। ওকে একটি চিটিতে জানালাম। অত্যন্ত উচ্ছসিত হয়ে সে জানালো যে, ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি আমেরিকার সেরা কয়েকটি ইউনিভার্সিটির একটি। আমিও আনন্দিত হলাম। যথাসময়ে ইউনিভার্সিটিতে পৌছে দেখলাম, রয়টার্সের ফেলোশিপে অপর যে সাংবাদিক প্রোগ্রামে এসেছেন তিনি নাইজিরিয়ার। ওলাতুনজি লার্ডনার জুনিয়র। ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। মাসখানেক পর আমার দুই সন্তান নিয়ে যোগ দিল আমার বউ কামরুন্নাহার মনি। ক্যাম্পাসে চমৎকার একটি ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করা ছিল। আমাদের ক্যাম্পাস জীবন শুরু হয়েছিলো।


এবার যে ষ্ট্যানফোর্ডে যাবো তা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম, কবে আমার বউ আমেরিকায় এসে পৌছবে। ২০০৯ সালের রিইউনিয়নে অংশ নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। ভিসার জন্য সপরিবারে আবেদন করেছিলাম। ইন্টারভিউ এ সবাইকে একসাথে ডাকলেও আমার ভিসার জন্য ক্লিয়ারেন্স আসতে সময় লাগবে বলে পাসপোর্ট রেখে দিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের ভিসা দিয়ে দেয়। রিইউনিয়ন ছিল ওই বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে। আমাকে ভিসা নিতে ডাকলো জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে। অতএব ২০০৯ এর রিইউনিয়নে আসা হয়নি। আগষ্ট মাসে আমার স্ত্রী কন্যাকে আমেরিকার টিকেটে কিনে দিলাম ঘুরে আসুক। আমি আর আমার ছেলে ঘুরতে গেলাম পাশের দেশ নেপালে। কয়েক মাস আমার বউ দেশে ফিরে গেলে ২০১০ সালের এপ্রিলে ওয়েষ্ট কোষ্টের ষ্টেট ওয়াশিংটনে গেলাম আমার বন্ধু ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সির্টির এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রফেসর আকরাম হোসেনের কাছে। ওর ওখানে সপ্তাহ তিনেক অবস্থানকালে ওয়াশিংটন ও ওরিগনের বেশ কয়েকটি সিটি ও অবকাশ কেন্দ্র ঘুরে ফিলাডেলফিয়ায় গেলাম মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। আমার মেয়ে দীয়া ফিলাডেলফিয়ার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করবে বলে ভর্তি হয়েছে। পরিবার ছাড়া একা কখনো কাটায়নি মেয়েটা। আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছে। মুখটা শুকনো, যেনো কতোদিন ভালো করে খেতে পায়নি। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। ওর মায়ের খালাতো বোনের বাসায় থাকতো ওই দিনগুলোতে। আশ্রয় নিরাপদ থাকলেও হয়তো খাপ খাওয়াতে কষ্ট হচ্ছে ওর।

যাহোক, আমার খালাতো শ্যালিকা পারভীনের বাসায় চারদিন অবস্থান করে নিউইয়র্কে আমার পুরনো বন্ধু তারেকের বাসায়। দীয়াও সাথে ছিল। বিকেল পর্যন্ত দীয়া আমার সাথে ছিল, তারেক ভাইসহ ম্যানহাটানের ক্যানাল ষ্ট্রিটে ফিলাডেলফিয়ার টিকেট কেটে দিয়ে দীয়াকে বুকে জড়িয়ে অশ্রু ভেজা চোখে বিদায় দিয়েছিলাম। দু’দিন নিউইয়র্কে কাটিয়ে দেশে ফিরে গেলাম কিছুদিন পরই আবার এসে ইমিগ্রেশনের কাজগুলো শুরু করবো বলে তারেক ভাই, সাংবাদিক বন্ধু মঈনুদ্দীন নাসেরসহ ঘনিষ্টদেরকে জানিয়ে। দেশে দু’মাস কাটিয়ে জুলাই মাসের শেষ দিকে আমি আবার আমেরিকায় এসে নিউইয়র্ক ষ্টেটের পার্বত্য এলাকা আপষ্টেটের অ্যালেনভিলে মাসখানেক কাটিয়ে নিউইয়র্ক সিটিতে চলে আসি। আমি আসায় দীয়া ফিলাডেলফিয়া থেকে নিউইয়র্কে মুভ করে। আমরা জ্যামাইকায় এক বাড়ির বেসমেন্ট ভাড়া নেই। একটু থিতু হয়ে ষ্ট্যানফোর্ডের পুরনো ফেলোদের সাথে যোগাযোগ শুরু করি। আমার সাথে ষ্ট্যানফোর্ডে ১২ জন আমেরিকান ফেলো ছিল। তাদের অনেকেই সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছে। ১৯৮৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত ইনভেষ্টিগেটিভ রিপোর্টার জন ওয়েষ্টেনডিক তার পুরনো কর্মস্থল ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারার ছেড়ে বাল্টিমোর সান এ জয়েন করেছিল। ফোন করার পর জানালো যে, সে বাল্টিমোর সানও ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখক হয়েছে। বউ এর সাথে ছাড়াছাড়ির হয়েছে বেশ আগে। শুধু একটি কুকুর নিয়ে তার সংসার।

লুইজিয়ানার টিভি সাংবাদিক অ্যালেন সুমনও সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে মেয়েদের রূপচর্চা বিষয়ক কনসালটেন্সি ফার্ম দিয়েছে। আর্ল গর্ডন নিউইয়র্কেই একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্টানের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ। নিউইয়র্ক টাইমসের বারবারা আয়ারল্যান্ড ও এপি’র জন হেনরি অবসর নিয়েছে। আমি নিউইয়র্কে আসার কিছুদিন পরই খবর বেরুলো, ডেনভার পোষ্টের এডিটরিয়াল কার্টুনিষ্ট মাইকেল কিফি পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেছে। কিফি’কে নিয়ে নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্তের সংখ্যা ২১ এ দাঁড়ালো। তাকে অভিনন্দন জানানোর সময় আগামী রিইউনিয়নে স্ত্রীসহ আমার ও তার যাওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়। আমি আসার পর আমার বউ দু’বার আমেরিকা ঘুরে গেছে। সাদের বিবিএ ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই দু’জন চলে আসবে। বেসমেন্ট ছেড়ে আমরা বড় একটি বাসা নিয়েছি, যাতে সবাই একসাথে থাকা যায়।


২০১৩ সালের মে মাসে ওরা চলে আসার পর টিকেট কেটে লিন্ডাকে জানিয়ে দিলাম। রিইউনিয়ন ১১ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার একদিন পর ১২ জুলাই সকাল সাড়ে ন’টায় স্যানফ্রান্সিকো এয়ারপোর্টে পৌছবো। লিন্ডা এল আরিলাগা। পঁচিশ বছর আগে আমাদের ষ্ট্যানফোর্ডে অবস্থানকালে লিন্ডার পরিবারের সাথে আমাদের যে বন্ধনের সৃষ্টি হয়েছিল তা অটুট ছিল স্থান ও কালের ব্যবধান সত্বেও। লিন্ডা ওর বাড়িতেই উঠতে বলেছিল। ওর দুই ছেলে ক্রিষ্টোফার, গ্যাব্রিয়েল কেউ নেই। দু’টি বেডরুম ফাঁকা। উঠলে ক্ষতি ছিল না, বেশ কয়েকশ’ ডলার হোটেল ভাড়া বেচে যেত। কিন্তু আমি রাজি হইনি। ষ্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাস থেকে লিন্ডার বাড়ির দূরত্ব ২৫ মিনিটের ড্রাইভ। প্রতিদিন ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠানস্থলে পৌছে দেয়া আবার অনুষ্ঠান শেষে ক্যাম্পাস থেকে বাড়ি নিয়ে আসার ঝামেলা ওকে দিতে চাইনি বলেই ওকে না জানিয়ে পালো আল্টো শেরাটনে বুকিং দিয়েছিলাম। রিইউনিয়নে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পালো আল্টো শেরাটন ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েছিল। তাছাড়া হোটেল থেকে অনুষ্ঠানস্থলগুলোতে নেয়া ও হোটেলে ফিরিয়ে আনার জন্য শাটল বাসের ব্যবস্থা ছিল।

এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালের গেট দিয়ে বাইরে বের হতেই লিন্ডার ফোন। বললাম ৮ নম্বর গেটের সামনে অপেক্ষা করছি। এক মিনিটের মধ্যে লিন্ডার গাড়ি থামলো আমাদের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই পরম আবেগে জড়িয়ে ধরলো আমার বউকে। দীর্ঘক্ষণ দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে রাখলো। আবার যে দু’জনের দেখা হতে পারে, লিন্ডার কাছে তা অকল্পনীয়। ওকে ছেড়ে আমাকেও আলিঙ্গনবদ্ধ করলো লিন্ডা। সিকি শতাব্দীর ব্যবধানে আমাদের সাক্ষাৎ। ১৯৮৮ সালের সামারের শেষ দিকে আমরা যখন ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে, লিন্ডা ষ্পেনে দু’বছর কাটিয়ে সবেমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে নিজ বাড়িতে ফিরেছে। ওর স্বামী বিল আরিলাগা একজন ভিয়েতনাম ভেটার্ন এবং তখন সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্টে কাজ করছিল। লিন্ডার কোন কাজ করার প্রয়োজন ছিল না। অর্থ আয়ের জন্য তাকে কাজ করতেও দেখিনি। কিন্তু কোন কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে আগ্রহী ছিল সে। সেজন্যে ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে ভলান্টিয়ার হিসেবে নাম রেজিষ্ট্রেশন করে রেখেছিল, বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের বিনা ফি’তে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দিতে এগিয়ে আসতো। লিন্ডার সাথে আমার বউ এর পরিচয় ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। সেখানে সে গিয়েছিল ওকে ইংরেজি শেখাবে এমন কাউকে খুঁজে পেতে। লিন্ডাকেই পেয়ে যায় সে। এরপর থেকে লিন্ডা এসকন্ডিডো ভিলেজে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে আসতো। আমার বউকে ইংরেজি শেখাতো, বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতো।

আমরা ওর বাড়িতে ডিনারে যেতাম, লিন্ডাও সপরিবারে আমাদের ক্যাম্পাস অ্যাপার্টমেন্টে ডিনারে আসতো। লিন্ডা ও বিলের ১৩ বছর বয়সী ছেলে ক্রিষ্টোফারের সাথে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠেছিল আমার ছেলেমেয়ের। ফেলোশিপ টার্ম শেষ করে লিন্ডার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশে ফিরে যাওয়াই বেশ কষ্টকর ছিল। বিদেশি বন্ধুর বিদায়ে একজন আমেরিকান বন্ধু অশ্রু বিসর্জন করবে, এমন ভাবা যায় না। কিন্তু লিন্ডা আমার বউকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। আমাদেরও কষ্ট হয়েছিল ভাবতে যে ওর সাথে হয়তো আর কোনদিনই সাক্ষাৎ হবে না। কিন্তু দেশে ফিরে যাওয়ার পরও লিন্ডার সাথে আমাদের যোগাযোগ অক্ষুন্ন ছিল। ১৯৯৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আমি ও আমার বউ কয়েক দফা আমেরিকায় এলেও ক্যালিফোর্নিয়ায় যাওয়া হয়নি। টেলিফোনে কথা হয়েছে লিন্ডার সাথে। ১৯৮৯ সালে আমরা আমেরিকা থেকে চলে যাওয়ার পর ১৯৯০ সালে লিন্ডার আরেকটি পুত্রের জন্ম হয়। লিন্ডা তখনই জানিয়েছিল যে ক্রিষ্টোফারের জন্মের তেরো বছর পর সে আবার কনসিভ করবে বলে ধারণা করেনি। অনেকটা অপরিকল্পিতভাবেই দ্বিতীয় সন্তান লাভ করে সে। গ্যাব্রিয়েল। এখন সে ২৩ বছরের যুবক। নিউ মেক্সিকোর আলবুকার্কে ম্যাথ এন্ড কম্পিউটার সায়েন্সে আন্ডারগ্র্যাড করছে।
পঁচিশ বছর দীর্ঘ সময়। আটত্রিশ বছর বয়সী লিন্ডার বয়স এখন তেষট্টি। ওর তেরো বছরের পুত্র ক্রিষ্টোফারের বয়স সাইত্রিশ বছর। চাইল্ড সাইকোলজিতে পিএইচডি করার পর ওকল্যান্ডে একটি চাকুরির পাশাপাশি কনসালট্যান্সি করছে। ক্রিষ্টোফার ২০০৭ সালে বিয়ে করেছিল। বিয়ের ছবিও পাঠিয়েছিল লিন্ডা। ক্রিষ্টোফারের তরুণী স্ত্রীকে ছবিতে অতি সুন্দরী মনে হয়েছে। কিন্তু ক্রিষ্টোফারের সে বিয়ে টিকেনি। কয়েক বছর পর প্রথম স্ত্রীর সাথে ওর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর কৃষ্ণাঙ্গিনী অ্যালিশাকে বিয়ে করে। অ্যালিশাও পিএইচডি ধারী। মিসিসিপির মেয়ে।


আমার নিজের পরিবর্তনও কম হয়নি। মাথার ঘন কালো চুল এখন প্রায় ধবধবে সাদা। চৌত্রিশ বছরের যুবক উনষাট বছরের বৃদ্ধে পরিণত হয়েছি। আমার ছয় বছরের কন্যার বিয়ে হয়েছে, দুই বছরের পুত্রের বয়স এখন সাতাশ বছর। লিন্ডা চল্লিশ বছর যাবত একই স্বামী বিলের ঘর করছে। প্রথম বিয়ে করা স্ত্রী নিয়ে আমারও সংসার চলছে ৩২ বছর ধরে। আমেরিকায় এমন দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন খুবই ব্যতিক্রম। আমার সাথে তখন ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারী ১২ জন আমেরিকান ও ৬ জন বিদেশি সাংবাদিকের মধ্যে বেশ ক’টি বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। আগেই উল্লেখ করেছি, ফিলাডেলফিয়া এনকোয়ারারের জন ওয়েষ্টেনডিকের বিয়ে টিকেনি। নিউইয়র্ক টাইমসের বারবারা আয়ারল্যান্ড ফেলোশিপ ইয়ারেই তার দ্বিতীয় স্বামীকে নিয়ে ক্যাম্পাসে গিয়েছিল। ২০০৭ সাথে আমাদের নিউইয়র্ক সফরকালে বারবারা ম্যানহাটানে টাইমসের নতুন ভবনে লাঞ্চে আমন্ত্রণ করলে আমি ও আমার বউ জানতে পারি যে সে এখন তৃতীয় স্বামীর ঘর করছে। কারো সাথে কথা বলার সময় কোন্টা বলা সঙ্গত আর কোন্টা অসঙ্গত, সেসবের ধার ধারে না আমার বউ। খাওয়ার টেবিলে বলেই বসলো, তোমার আগের স্বামী তো ভালোই ছিল, ওর সাথে কি সমস্যা হয়েছিল? বারবারা খুব স্বাভাবিকভাবে তার সাবেক স্বামীর ব্যাপারে বললো যে সে অন্য মেয়েদের সাথে শুতে শুরু করেছিল। আরেক ফেলো আর্ল গর্ডন অবিবাহিত ছিল। ২০১০ সালে এসে ওকে ফোন করে জানলা, দুই সন্তানসহ এক মহিলাকে বিয়ে করে নিউইয়র্ক সিটিতেই বসবাস করছে। ষ্টিভ গ্যানেস তার তিন সন্তানের মাকে ডিভোর্স দিয়ে এক মহিলাকে বিয়ে করে। কিন্তু বিয়ে করার এক বছরের মধ্যে ওই মহিলা ব্রেষ্ট ক্যান্সারে মারা যায়। ষ্টিভ এখন একা। তবে কিছুদিনের মধ্যেই সে আবার বিয়ে করবে বলে আমাকে বলেছে। বিদেশি ফেলোদের মধ্যে নাইজিরিয়ার ওলাতুনজি লার্ডনারের প্রথম গার্লফ্রেন্ড ছিল এক ব্ল্যাক ইংলিশ। তার সাথেই বিয়ে হবে সব ঠিকঠাক ছিল। ষ্ট্যানফোর্ডে আসার সময় সে লন্ডনে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কাটিয়ে এসেছে এবং ষ্ট্যানফোর্ডে থাকাকালেও ছুটিতে লন্ডনে গিয়ে গার্লফ্রেন্ডের সাথে কাটিয়ে এসেছে। রিইউনিয়নে দেখা হওয়ার পর জানতে পারলাম, ওর দুই মেয়ে সাথে এসেছে। লন্ডনের ওই গার্লফ্রেন্ডই ওর বউ কিনা জানতে চাইলে তুনজি বললো যে, ওই গার্লফ্রেন্ডকে সে বিয়ে করেনি। কারণ লন্ডন ছেড়ে তার সাথে নাইজিরিয়ায় যেতে সম্মত হয়নি তার গার্লফ্রেন্ড। তুনজি নাইজিরিয়ায় ফিরে গিয়ে যাকে বিয়ে করে দুই কন্যার জন্মের পর থেকে তাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে, যা ডিভোর্সে পরিণতি লাভ করেছে। সে এখন নতুন করে বিয়ে করার কথা ভাবছে।


স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্ট থেকে পালো আল্টো সিটির দূরত্ব চল্লিশ মিনিটের। লিন্ডা আমাদেরকে হোটেলে না নিয়ে প্রথমেই নিয়ে গেল ওর পোর্টোলা ভ্যালির বাড়িতে। বাড়িটি রেনোভেট করা হয়েছে। গ্যাব্রিয়েল যখন লিন্ডার পেটে তখনই নতুন অতিথিকে বরণ করতে বাড়িতে অতিরিক্ত একটি রুম সংযোজন করেছে লিন্ডার স্বামী বিল। এর ফলে বাড়ির পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। আগে বাড়ির সামনের দিকটায় প্রাচীর ছিল। এখন পুরো বাড়ি ঘিরে কাঠের প্রাচীর। ভিতরের ও সামনের লনের ঘাস সুন্দর কওে ছাঁটা। আমাদের ঘুরিয়ে দেখালো লিন্ডা। ফ্রেশ হয়ে চা নাশতা খাওয়ার পর বেলা ১২টার দিকে আমাদেরকে হোটেল পালো আল্টো শেরাটনে পৌছে দিল। সন্ধ্যায় আবার সে নিয়ে যাবে ওর বাড়িতে ডিনারের জন্য।


হোটেলে চেক ইন করে ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে গোসল করলাম। জামাকাপড় বদলে ধোপদুরস্ত হয়ে নিলাম। ক্যাম্পাসে প্রোগ্রাম ভেন্যুতে গিয়ে লাঞ্চ সারবো। পালো আল্টো শেরাটন অত্যন্ত ব্যস্ত হোটেল। ছোট্ট পালো আল্টো সিটির লোকসংখ্যা এক লক্ষের কিছু বেশি। কিন্তু ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অবস্থান এবং সিলিকন ভ্যালি হওয়ার কারণে অনেকগুলো চেইন হোটেল রয়েছে এ সিটিতে। পালো আল্টো শেরাটন সুউচ্চ কোন ভবন নয়, কিন্তু বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এক পাশ দিয়ে গেছে সিটির প্রধান সড়ক এল কামিনো রিয়েল আরেক পাশ দিয়ে ক্যালট্রেন লাইন। ষ্ট্যানফোর্ডে অবস্থানকালে ১৯৮৯ সালের মার্চে একবার এ হোটেলে এসেছিলাম। গেষ্ট হিসেবে নয়। আমেরিকার প্রবাদতূল্য একজন রাজনৈতিক সাংবাদিক, ওয়াশিংটন পোষ্টের রিপোর্টার ও কলামিষ্ট ডেভিড ব্রোডারের সাথে আমাদের ব্রেকফাষ্ট মিটিং ছিল এ হোটেলে। আগের দিনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইট লাউঞ্জে আমাদের উইকলি সেমিনারে তিনি আমেরিকান পলিটিক্সেও উপর বক্তব্য দিয়েছেন। সেটি ছিল নির্ধারিত সময়ের সেমিনার। সময় শেষ হলেই আমাদের প্রত্যেককে দৌড়াতে হয়েছে যার যার ক্লাসে। তার কথা বিশ্লেষণ শোনার জন্য আমেরিকান ফেলোদের আগ্রহই ছিল বেশি। প্রেসিডেন্ট বুশ (সিনিয়র) মাত্র দু’মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। অতএব তার নিকট থেকে আমেরিকান ডমেষ্টিক ও ইন্টারন্যাশনাল পলিসির তত্ত্ব ও সেসবের বিশ্লেষণ জানার আবশ্যকীয়তা ছিল তাদের। ডেভিড ব্রোডারের মতো খ্যাতিমান সাংবাদিকের সাথে ব্রেকফাষ্টে অংশ নেয়া আমার বা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থেকে আসা সাংবাদিকদের জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।


ডেভিড ব্রোডারের পরিচিতি আগেই সরবরাহ করা হয়েছিল আমাদেরকে। ওয়াশিংটন পোষ্টের পলিটিক্যাল রিপোর্টার হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে ৩৭ বছর বয়সে। এর আগে তিনি ছিলেন ওয়াশিংটন ষ্টার ও নিউইয়র্ক টাইমসের পলিটিক্যাল রিপোর্টার। যে ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডালের কারণে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, সেই স্ক্যান্ডাল সম্পর্কিত রিপোর্টিং এর কারণে ডেভিড ব্রোডার ১৯৭৩ সালে পুলিৎজার প্রাইজ লাভ করেন। এছাড়া ১৯৫৬ সাল থেকেই তিনি নিয়মিত প্রেসিডেন্সিয়াল কনভেনশন কভার করে আসছিলেন। তাকে বলা হতো “ডীন অফ ওয়াশিংটন প্রেস কোর।” “বেষ্ট পলিটিক্যাল করেসপন্ডেন্ট ইন আমেরিকা” বলেও খ্যাতি ছিল তার। আমাদের সাথে বৈঠকে তিনি প্রেসিডেন্ট বুশের আমলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশংকা ব্যক্ত করেন, যা ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখলের মধ্য দিয়ে কোয়ালিশন ফোর্সের নামে আরব ভূখন্ডে আমেরিকান বাহিনীর স্থায়ী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীতে তার পুত্র জুনিয়র বুশের আমলে নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের অজুহাতে আফগানিস্তানে আমেরিকার হামলা ও ঘাঁটি স্থাপন এবং বিশ্বকে ‘ওয়েপনস অফ মাস ডেষ্ট্রাকশন’ এর হুমকি থেকে রক্ষার অজুহাতে, তথা ‘ওয়ার অন টেরর’ এর নামে ইরাকে সর্বাত্মক হামলা ও ঘাঁটি স্থাপনের সুযোগ নেয়। একের পর এক যখন ঘটনাগুলো ঘটেছে তখন ডেভিড ব্রোডারের মতো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কথা মনে পড়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর আমার জন্য একটি আনন্দের খবর ছিল আমার বন্ধু ডেনভার পোষ্টের এডিটোরিয়াল কার্টুনিষ্ট মাইকেল কিফির পুলিৎজার পুরস্কার প্রাপ্তি এবং দু:খের খবর ছিল ওই মাসেই ডেভিড ব্রোডারের মৃত্যু। তার মৃত্যুর পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর পড়ে জেনেছি যে, যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেয়া হয়, এমন সব প্রধান এওয়ার্ড লাভ করেছেন, যার মধ্যে ‘হোয়াইট বাসকেট মিলার প্রেসিডেন্সিয়াল এওয়ার্ড’, ‘ফোর্থ এষ্টেট এওয়ার্ড’, ‘ডিষ্টিংগুইশড কন্ট্রিবিউশন টু জার্নালিজম এওয়ার্ড’ অন্যতম। টানা চার দশক তিনি কাজ করেছেন ওয়াশিংটন পোষ্টের সাথে। ডেভিড ব্রোডারের সাথে ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে পর পর দ’ুদিন সাক্ষাৎ হওয়া এবং তাকে একটি প্রশ্ন করা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক না থাকলেও এবার হোটেলটিতে প্রবেশ করে তার কথাই বেশি মনে পড়েছে।

উইক ডে’তে প্রতি পনের মিনিট পর পালো আল্টো সিটি সেন্টার ও ষ্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে যাতায়াতের জন্য বিনা টিকেটে বাসের ব্যবস্থা রয়েছে। যে কেউ এই বাসের যাত্রী হতে পারে। বাসগুলো সিটির সব জায়গায় যায় না। পঁচিশ বছর আগেও ষ্ট্যানফোর্ডে ফ্রি বাসের ব্যবস্থা ছিল। সেগুলো ছিল আকৃতিতে ছোট এবং ক্যাম্পাসের বাইরে কোথাও যেতো না। এখনকার বাসগুলো আকৃতিতে বড় এবং ক্যাম্পাস ছাড়াও সিটি সেন্টারে যাতায়াত করে। এর প্রধান কারণ হলো, ষ্ট্যানফোর্ডে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হওয়ায় সব ছাত্রের জন্য ক্যাম্পাসে আবাসিক সংস্থান সম্ভব না হওয়ায় তারা সিটিতে প্রাইভেট হাউজে থাকে। তাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য বাসগুলোর সার্ভিষ এরিয়া ক্যাম্পাসের বাইরে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।


রিইউনিয়নের প্রোগ্রাম আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। অতএব কোথায় প্রি-লাঞ্চ প্রোগ্রামটি চলছে তা জানাই ছিল। হোটেল থেকে বের হয়ে বাস ষ্টপেজে দাঁড়ালাম। একটু পর বাস এলে উঠে বসলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে আরো কিছু ছাত্রছাত্রী এসে বাসে উঠলে বাস প্রধান ‘এল কামিনো রিয়েল’ (কিংস ওয়ে বা রাজপথ) পেরিয়ে এক সময়ের প্রতিদিনের চলাচলের পথ ‘পাম ড্রাইভ’ হয়ে এগুতে লাগলো। দু’পাশে পাম গাছের সারি আগের মতোই আছে। পামের সারির পরই সবুজ গাছপালায় ঢাকা ঘন বন। মাঝে মাঝেই বন চিড়ে চলে গেছে রাস্তা। আগে অধিকাংশই ছিল ইউক্যালিপটাস গাছ। এখন নানা প্রজাতির গাছ বেশ বেড়ে উঠেছে। পাম ড্রাইভের অর্ধেকটা এসেই বাস বামে ঘুরলো, ষ্ট্যানফোর্ড মেডিক্যাল স্কুল ও হাসপাতালের দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বাসের জানালা দিয়ে মেডিক্যাল স্কুলের পিছনের লনে নাইট জার্নালিজম ফেলোশিপের লোগো লাগানো বোর্ড আর লোকজনের ভিড় দেখে বুঝলাম, এদের মাঝেই আমার পুরনো বন্ধুরা আছে।

পরবর্তী ষ্টপেজে বাস থেকে নেমে ভিড়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রথমেই সামনে পড়লো ফেলোশিপ প্রোগ্রামের বর্তমান ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ডন গর্সিয়া। আগে কখনো তার সাথে দেখা হয়নি। কথা হয়েছে ফোনে। মেইলে যোগাযোগ হয়েছে। আমাকে ও আমার বউকে জড়িয়ে স্বাগত জানিয়ে বললো, ‘আগে লাঞ্চ সেরে নাও। আমি এরিকাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি রিইউনিয়নের প্রয়োজনী সামগ্রী তোমাদেরকে দিতে।’ অধীর আগ্রহে আমি আমার ব্যাচের ফেলোদের খুঁজছিলাম। ওই তো কয়েকটি টেবিলের পরই বসেছে টম গিবোনি, ব্রেন্ডা ও তার স্বামী ষ্টিভ, মাইকেল কিফি ও তার স্ত্রী অ্যানিটা, ষ্টুয়ার্ট গেনেস ও নাইজরীয় তুনজি লার্ডনার। ভিড় ঠেলে সেদিকে গেলাম। পিছন থেকে তুনজির পিঠে হাত রাখলাম। বিশালদেহী তুনজি ঘাড় ফিরিয়ে আমাকে দেখে প্রায় লাফিয়ে উঠে ‘আনোয়ার’ বলে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরলো। দীর্ঘক্ষণ আমরা আলিঙ্গনবদ্ধ থাকলাম। টেবিলের সবাই উঠে দাঁড়িয়েছ্ েতুনজির বাহুপাশ থেকে বের হয়ে একে একে সবার সাথে বুক মিলিয়ে নিলাম। আমার বউও সবার পরিচিত। তাকেও সাদরে গ্রহণ করলো। দীর্ঘ আড়াই দশক কেটে গেলেও আমরা কেউ কারো অপরিচিত হয়ে যাইনি। আমরা ভাবাবেগে আপ্লুত। আমাদের সবার মনে অনেক প্রশ্ন। আমার মেয়ে দীয়ার সাথে এসকন্ডিডো এলিমেন্টারি স্কুলে পড়তো ষ্টুয়ার্টের মেয়ে লিজি, মাইকের মেয়ে ডিলেনি। লিজি পড়াশুনা শেষ করে স্যান ফ্রান্সিকোতে সাংবাদিকতা করছে। ডিলেনি লস এঞ্জেলেস এ এক ইউনিভার্সিটিতে আইনে পড়াশনা করে মাইকের প্রিয় সিটি ডেনভারে ফিরে এসেছে সেখানেই প্রাকটিস করবে বলে। দু’জনের কেউই এখনো বিয়ে করেনি। দীয়ার বিয়ে হয়ে গেছে। আমাদের কথা যেন ফুরোবার নয়। লাঞ্চ আওয়ার শেষ হওয়ার পথে। রিইউনিয়নের অবসর সময়গুলোতে ফেলে আসা পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো বলে লাঞ্চের টেবিলে ফিরে গেলাম।


লাঞ্চের পর প্রায় তিন ঘন্টা অবসর। মূল ক্যাম্পাসের প্রথম ভবনের চার তলায় কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টে জন এস নাইট ফেলোশীপ প্রোগ্রামের লাউঞ্জে গিয়ে কিছুটা সময় কাটানোর ইচ্ছা ছিল আমার। লাউঞ্জের দেয়ালে পুরনো সব ফেলোদের সাথে আমার ছবিও টানানো আছে। ছবিসহ লাউঞ্জটি চমৎকার একটি জায়গা। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের অথবা বলা চলে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির কলকাঠি নেড়েছেন যারা তাদের অনেকেরই পদচারণা ঘটেছে সেখানে। আমার অবস্থানকালেই সেখানে সাক্ষাত হয়েছে সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী জর্জ শুলজ, ওয়ারেন ক্রিষ্টোফার ও কন্ডোলিজা রাইসের সাথে। ষ্ট্যানফোর্ডের ফেলো হিসেবে একটি বাড়তি সুবিধা ছিল আমাদের। নিয়মিত ছাত্রদের সাথে ক্লাস করা সত্বেও আমাদের পরিচয় ছিল ‘অডিটর’ এবং অডিটর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ক্লাবের সদস্য হওয়ার অথবা সদস্য না হয়েও শুধু আইডি দেখিয়ে আমরা ফ্যাকাল্টি ক্লাবের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অধিকারী ছিলাম। ফ্যকাল্টি ক্লাবে খ্যাতিমান সব শিক্ষকদের সাথে বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করা যেতো। কিন্তু লাউঞ্জে যাওয়ার হলো না। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে আমার বউ অবসন্ন। হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নেয়াকেই প্রাধান্য দিলো সে। বিকেলে নবনির্মিত বিং কনসার্ট হলে একটি প্রেজেন্টেশন এবং ডিনার আছে। আমাদেরকে অবশ্য ডিনার করতে হবে লিন্ডার বাড়িতে। লিন্ডা প্রথম দিনেই ওর বাড়িতে ডিনার করতে পীড়াপীড়ি করেছে। কারণ ওর ছেলে ক্রিষ্টোফার ও তার বউ অ্যালিশা ওকল্যান্ড থেকে আসবে ডিনার করতে। লিন্ডা চায় ওদের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হোক। প্রেজেন্টেশন শেষ হলেই লিন্ডা এসে আমাদের নিয়ে যাবে।

হোটেলে গিয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবার তৈরী হলাম। বাসে উঠে অল্পক্ষণেই পৌছলাম বিং কনসার্ট হলে। এটি আগে ছিল না। অতি সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে। শুধু কনসার্ট হলই নয়, ক্যাম্পাস জুড়ে অনেক নতুন নতুন স্থাপনা। নতুন ভবনগুলো আধুনিক স্থাপত্য শৈলীতৈ নির্মিত বলে এগুলোর স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে মূল ক্যাম্পাস থেকে একটু দূরে, যাতে পুরনো গাম্ভীর্যপূর্ণ স্থাপত্যের নান্দনিক কোন বৈসাদৃশ্য না ঘটে। আট হাজার একরের অধিক আয়তন জুড়ে প্রতিষ্ঠিত ষ্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে জায়গার অভাব নেই। এখনই ছোট বড় মিলে প্রায় সাতশ ভবন রয়েছে ক্যাম্পাসে। এরপরও অর্ধেক জায়গা এখনো ফাঁকা পড়ে আছে। বিং কনসার্ট হলে গত বছরের নাইট ফেলোদের মিডিয়া প্রজেক্ট এর প্রেজেন্টেশন। অনুষ্ঠানস্থলে আমরা যা দেখে অভ্যস্ত তেমন দীর্ঘ টেবিলের অপর পাশে সারি সারি চেয়ারে সভাপতি, প্রধান অতিথি, প্রধান বক্তা, বিশেষ অতিথি নেই। কারো বসার জন্য একটি চেয়ার পর্যন্ত নেই মঞ্চে। ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ডন গর্সিয়া দরজার আড়াল থেকে এসে এক এক জন বক্তার নাম ঘোষণার আগে পরিচিতিমূলক কয়েকটি বাক্য উচ্চারণ করার পর বক্তা এসে তার প্রেজেন্টেশন দিচ্ছে। সুনির্দিষ্ট বিষযের উপর নির্ধারিত সময়ের আলোচনা ও পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। প্রেজেন্টারদের সকলেই তরুণ সাংবাদিক। মনে হলো, মেধা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে সাংবাদিকতায় বিপ্লব সৃষ্টি করতে চলেছে তারা। পুরনো দিনের সাংবাদিকতায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এই পেশা ও শিল্পে এ দু’টোর তেমন প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করছে হালের তরুণরা। অথবা তারা কি তাদের মেধাকেই জ্ঞানের সাথে গুলিয়ে ফেলছে? আমি তো এ দু’টোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে বলেই শিখেছি যে, জ্ঞান হলো কোন কিছু জানার সামর্থ, আর মেধা হলো জ্ঞানের সাহায্যে কোনকিছু করার সামর্থ। উন্নত বিশ্বের সাথে পাল্লা দিয়ে উন্নয়নশীল বা অনুন্নত বিশ্বেও সাংবাদিকতায় প্রযুক্তি ব্যবহারের মেধাই মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে এ পেশায় এখন জ্ঞানী ব্যক্তিদের আগমণ কম ঘটছে বলে আমার ধারণা।


প্রেজেন্টেশন শেষ হলো। আমরা কনসার্ট হলের বাইরে আসার সময়ই আমার বউ এর চোখে পড়লো ফেলোশীপ প্রোগ্রামের সাবেক ডাইরেক্টর জেমস ভি রিসারকে। সে প্রায় দৌড়ে ‘জিম, জিম’ বলে ডাকতে ডাকতে তার কাছে গেল। জিম পিছন ফিরে ওকে দেখে ‘মণি! হোয়াট এ সারপ্রাইজ! ইউ মেড ইট!’ জিমের বয়স ৭৬ বছর। ২৫ বছর পরও আমার বউ এর নাম মনে রাখাটা বিম্ময়ের ব্যাপার। আমিও কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। জিম বললেন, ‘আমি কারো কাছে শুনেছি যে, তুমি কিছুদিন যাবত আমেরিকায় আছো। তোমার ছেলেমেয়েরা কোথায়? ওরা কতো বড় হয়েছে? তুমি কি করছো?’ একসাথে অনেক প্রশ্ন। আমিও এক এক করে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তার স্ত্রী স্যান্ডির কথা জানতে চাইলে উনি বললেন, ‘স্যান্ডিও এসেছে। তবে আজ এখানে আসেনি। কাল ওর সাথে তোমাদের দেখা হবে।’ জিম খ্যাতিমান সাংবাদিক। নবীন প্রবীণ অনেক সাংবাদিক তার সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়িয়েছে দেখে আমরা তাদেরকে সুযোগ দিতে কাল আবার দেখা হবে বলে ভিড় ছেড়ে এলাম।


কনসার্ট হলের লাউঞ্জ ও সামনের লনে ডিনারের আয়োজন। যেহেতু লিন্ডার বাড়িতে ডিনার করতে হবে সেজন্য পরিচিতদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করে হলের বাইরে এসে লিন্ডাকে ফোন দিলাম। লিন্ডা ক্যাম্পাসে চলে এসেছিল। আমরা কোথায় জানতে চাইলে তাকে বললাম। তিন চার মিনিটের মধ্যে সে চলে এলো। গাড়িতে উঠে বসতেই লিন্ডা বললো যে, ওর এক বিত্তবান কাজিন ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জন্য একটি ভবন তৈরী করে দিয়েছে। ইউনিভার্সিটিও ভবনটির নাম তার কাজিনের নামেই করেছে। সেজন্য সে নিজেও অহংকার বোধ করে যে তার ফ্যামিলি ইউনিভার্সিটির সাথে স্থায়ীভাবে জড়িয়ে থাকবে।

রিইউনিয়নের নির্ধারিত কর্মসূচির সমাপনী ছিল ১৪ জুলাই সকালে পালো আল্টো শেরাটনে ব্রাঞ্চ মিটিং দিয়ে। সেদিনই হোটেল থেকে চেক আউট করে বিকেলের কোন ফ্লাইট ধরলেই হোটেলে একদিনের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হতো না। কিন্তু ক্যাম্পাসে স্মৃতিময় জায়গাগুলো ঘুরে দেখা তখনো বাকী ছিল। বিশেষ করে এসকন্ডিডো ভিলেজের যে অ্যাপার্টমেন্টে আমরা দীর্ঘদিন কাটিয়েছি সেটি দেখে না গেলে অতৃিপ্ত রয়ে যাবে। তাই ব্রাঞ্চ শেষ করে এসকন্ডিডো ভিলেজের দিকে যাবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। লিন্ডা ফোন করে জানালো সে দু’টার পর আসবে। তখন আমাদের পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট ঘুরিয়ে হাফ মুন বে সিটিতে নিয়ে যাবে। হাতে প্রায় তিন ঘন্টা আছে। আমার বউকে আগের দিন ষ্ট্যানফোর্ড শপিং সেন্টারে নিয়ে গেছিলাম। সময় পেয়ে সে আবার সেখানে যেতে চায়। ওকে বললাম, তার চেয়ে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের প্রয়োজন মেটাতো যে ‘সেইফওয়ে’ সেই গ্রোসারীতে যেতে পারি। প্রায় প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে ‘সেইফওয়ে’তে আসতাম ছোটখাট কেনাকাটার জন্য। আমার গাড়ি ছিল না। বেশী কেনাকাটা থাকলে মাসে একবার বা দু’বার হাঙ্গেরীয়ান রিচার্ড হারশিলারকে বলতে হতো। হারশিলার ড্রাইভিং জানতো না। ওর স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিতো। অথবা কখনো অষ্ট্রেলীয় ষ্টিভ হ্যারিস বা ডেনভার পোষ্টের কার্টুনিষ্ট মাইকেল কিফিকে কল দিতাম। কয়েক মাস এভাবে চলার পর আমার পড়শী হিসেবে আসে এক ইরানি ফ্যামিলি। মোহসীন, ওর স্ত্রী শোহরেহ এবং দু’টি ছোট মেয়ে, আমার ছেলেমেয়ের বয়সী। শোহরেহ নিজেই ড্রাইভ করতো। ও শপিং এ গেলে আমার বউ এর কাছে জানতে চাইতো সে যাবে কিনা। ওরা পড়শী হয়ে আসায় আমার কেনাকাটা ও সাইকেলে বয়ে আনার পরিশ্রম কমে গিয়েছিল। তবে অন্যদিকে দায়িত্ব কিছুটা বেড়েছিল, আমার সাড়ে ছয় বছর বয়সী মেয়ে দীয়া ও দুই বছর বয়সী পুত্র সাদের সাথে ওদের প্রায় সমবয়সী শোহরেহ’র দুই মেয়েকে সামলে রাখতে হতো।
একদিন শোহরেহ এর সাথে শপিং থেকে ফিরে আমার বউ বলে, ‘ওদের দেয়া কোন খাবার আর খাওয়া যাবে না।’ আমি জানতে চাই, ‘কেন কি হয়েছে?’ ও বলে, ‘ওরা শুয়োরের মাংস খায়।’ আমি বলি, ‘কি আবোল তাবোল বলছো, তুমি জানলে কি করে?’ ও বলে, ‘আজ শোহরেহ এর সাথে সেইফওয়েতে শপিং এ গিয়ে আমি দেখলাম ও পর্ক নিচ্ছে। ভাবলাম, ও বোধহয় ভুল করছে। তাই ওকে বললাম যে, এটা তো বিফ নয়, তুমি ভুলে পর্ক নিচ্ছো। শোহরেহ বললো, ভুলে নয়, পর্কই নিয়েছি, আমরা তো পর্ক খাই। ওদের রান্না করা কোনকিছু আর খাওয়া যাবে না।’ তখন আমার বিস্মিত না হয়ে উপায় ছিল না। ওরা যখন এলো তার ক’দিন পরই আয়াতুল্লাহ খোমেনি ইন্তেকাল করেন। তথনো ওরা টেলিভিশন কিনেনি। মোহসীন প্রায়ই খবর দেখতে আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসতো। খোমেনির মৃত্যু সংবাদ দেখতে এসে সে খবর দেখছিল আর ওর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছিল। ১৯৭৯ এ যখন ইরানে বিপ্লব ঘটে তখন মোহসীন তেহরানের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। শাহ বিরোধী বিক্ষোভে নিয়মিত অংশ নিয়েছে। বিপ্লব শেষে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়। উচ্চ শিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসার স্বপ্ন ছিল বিপ্লবের আগে থেকেই। কিন্তু বিপ্লবের পর আমেরিকার সাথে ইরানের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় তার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। কিন্তু আশা ছাড়েনি সে। পোলান্ডে তার এক চাচা বাস করতেন। মোহসীন সপরিবারে পোলান্ড চলে যায়। সেখানে ইমিগ্রান্ট হিসেবে বেশ কয়েক বছর থাকার পর পোলিশ পাসপোর্ট নেয় এবং পোলিশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আসে তার উচ্চ শিক্ষার ইচ্ছা পূরণ করতে। ইরানের বিপ্লবী মোহসীন পরিবারকে শুয়োরের মাংস খাওয়ার সাথে মিলাতে পারি না। ওদের শুয়োরের মাংস খাওয়ার বিষয়টি আমাদের মধ্যে বিবমিষার সৃষ্টি করলেও আমরা মোহসীন বা শোহরেহ’কে তা কখনো বুঝতে দেইনি। তবে ওরা রান্না করা কোন খাবার দিলে আর খাওয়া হতো না।


যাহোক, এল কামিনো রিয়েল ধরে সেফওয়েতে গেলাম। অনেক পরিবর্তন হয়েছে এই সুপারষ্টোরের। এর পাশেই পে-লেস নামে একটি বড় ষ্টোর ছিল। সেটিতেও এখন সেফওয়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় সেফওয়ে আগের আয়তনের চেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাম দিকটা ফাঁকা ছিল। সেখানে এখন কিছু ছোট আকারের শপ ও রেষ্টুরেন্ট চালু হয়েছে। সামান্য কেনাকাটা করে হোটেলে ফিরে এলাম। যথাসময়ে লিন্ডা এলো। বিলও সাথে এসেছে এবং সে গাড়ি চালাচ্ছে। বিল জানতে চাইলো যে, এতো বছরের ব্যবধানে আমি আমার পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট চিনতে পারবো কিনা। ওকে নিশ্চিত করলাম, এতোগুলো দিন যে আবাসে কাটিয়েছি তা ভুলবো কি করে। ষ্ট্যানফোর্ড ষ্টেডিয়াম বামে ফেলে এসকন্ডিডো ভিলেজের দিকে টার্ন নিলো বিল। ওলমষ্টেড ষ্ট্রিটের পাশেই ছিল আমার অ্যাপার্টমেন্ট। ৮২/এ। বিল একটু আগে চলে গেল। বিলকে গাড়ি থামিয়ে পিছনে নিতে বললাম। বিল গাড়ি পিছিয়ে পার্কিং লটে থামলো। আমার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে একটি ওক গাছ ছিল, সেটি এখন নেই। গাছেন গুড়ি প্রমাণ দিচ্ছে অল্পদিন আগেই কেটে ফেলা হয়েছে। পার্কিং লটের এক পাশে বড় আকৃতির দু’টি ট্র্যাশ বিন ছিল, সেগুলোও সময়ের ব্যবধানে স্থান পরিবর্তন করেছে। আমাদের সাথে লিন্ডাও গাড়ি থেকে নামলো। অ্যাপার্টমেন্টের আগের নম্বর নেই। নতুন নম্বর শুধু ৮২। সামনের দরজায় নক না করে অ্যাপার্টমেন্টে ঘেঁষে যে ওয়্যার ফেন্স সেদিকের দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। একটি গোলাকৃতির বড়োসড়ো লন ঘিরে ৩৬টি ডুপ্লেক্স অ্যাপার্টমেন্ট। পুরো এসকন্ডিডো ভিলেজে আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের এটি বৈশিষ্ট ছিল। লনের কেন্দ্রস্থলে কয়েকটি গাছ। সেখানে বাচ্চাদের খেলার জায়গা। ওখানে ঘাসের চাদর নেই। খেলতে গিয়ে বাচ্চারা যাতে আঘাত না পায়, সেজন্যে বালি ছড়ানো। প্রতি মাসে একদিন মহিলারা যার যার ঘরে রান্না করা খাবার নিয়ে সেখানে জড়ো হতো। গল্পগুজব, খেলাধূলা, পুরস্কার বিতরণ ও খাওয়া দাওয়ার করতো হৈ হল্লা করে। একটি বুলেটিনও বের করতো তারা, ‘এরাউন্ড স্যান্ড পুল’ নামে। অ্যাপার্টমেন্ট ভিতরের দিক থেকেও বন্ধ। আমরা থাকতে ভিতরের দিকে প্রাচীর বলতে ছিল পুরো কাঁচের সুইং ডোর। ফ্লোর থেকে সিলিং পর্যন্ত। কিন্তু এখন চার ফুট উঁচু ইটের প্রাচীরের উপরের অংশে কাঁচ বসানো। একটি কাঠের দরজা, যেটি আগে ছিল না। লিন্ডাই এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করে ডাকলো, ‘হ্যালো, এনিবডি হোম? অ্যা ফ্যামিলি হ্যাজ কাম টু ভিজিট দ্য হাউজ হু লিভড হিয়ার টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স এগো।’ দু’টি তরুণ এগিয়ে এসে দরজা খুলে আমাদেরকে স্বাগত জানালো। ১৯৮৯ সালের ১৪ জুন এই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে গিয়েছিলাম।

আবেগে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। দুই তরুণ চীনা বংশোদ্ভুত। একজন কানাডিয়ান, আরেকজন আমেরিকান সিটিজেন। ওরা জানালো, ক্যাম্পাস হাউজিং এ এখন ফ্যামিলিসহ কোন ষ্টুডেন্টের আবাসিক সংস্থান করা হয় না। যারা ফ্যামিলিসহ আসে তাদেরকে থাকতে হয় পালো আল্টো বা আশেপাশের ছোট সিটিগুলোতে। অ্যাপার্টমেন্টের নিচতলায় লিভিং রুম, কিচেন, ডাইনিং স্পেস। উপর তলায় দু’টি বেডরুম ও বাথরুম। আমার বউ নির্বাক হয়ে সব দেখে। কিচেনে ওভেন, রেফ্রিজারেটর, ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। ওকে বলি, উপরে গিয়ে বেডরুমটা দেখে এসো। সে নিরবেই যায়। একটু পর নেমে আসে। ওর চোখ ছলছল করছে। আমি প্রতি মাসে ভাড়া দিয়েছি ৬৩২ ডলার করে। এখন অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া দুই হাজার ডলার। প্রত্যেক ছাত্রকে দিতে হয় এক হাজার ডলার করে। পঁচিশ বছরের ব্যবধানে হতেই পারে।

আমার স্কলারশিপ ছিল রয়টার্স ফাউন্ডেশনের। ইউনিভার্সিটির ট্যুইশন ফি রয়টার্স সরাসরি পরিশোধ করতো লন্ডন থেকে। আমার ব্যাংক একাউন্টে বার্ষিক পঁচিশ হাজার ডলার প্লাস ডলার বুক এলাউন্স মাসিক কিস্তি অনুযায়ী পাঠাতো। এখন বুক এলাউন্স, বেবি সিটিং এলাউন্স, মুভিং এলাউন্স ইত্যাদিসহ বার্ষিক স্কলারশিপের পরিমাণ ৭০ হাজার ডলারের অধিক। সিলিকন ভ্যালিতে বাড়ি ভাড়া নিউইয়র্ক সিটির চেয়ে অনেক বেশি। ছাত্রদের মধ্যে যাদের স্কলারশিপ আছে তাদেরকে যদি পালো আল্টো, মেনলো পার্ক, মাউন্টে ভিউ, রেডউড সিটি, লস আল্টোস বা আশেপাশে অন্য সিটিতেও থাকতে হয়, তাহলেও এখনকার স্কলারশিপ মানি খুব বেশি নয়। দুই তরুণের বয়স পঁচিশের নিচে। ওরাও বিস্মিত যে, ওরা যেখানে বাস করছে ওদের জন্মের আগে সেখানে বসবাস করেছে এমন একটি দম্পতির সাথে সাক্ষাত হলো। আমাদেরকে আপ্যায়ন করার জন্য পীড়াপীড়ি করলেও আমরা ওদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে ভারাক্রান্ত মনে বিদায় নিলাম। বেঁচে থাকতে আর কখনো কি ওখানে ফিরে যাওয়া হবে?

Published in Uncategorized

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *