নিউইয়র্ক টাইমস এর মত একটি মর্যাদাবান দৈনিকে বাংলাদেশের ভাল কোন খবর প্রকাশিত হলে আমরা আহলাদে আটখানা হই। সরকার সেই খবরটিকে নিজেদের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে প্রচার করার ব্যবস্থা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক কোন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কোন খবর প্রকাশিত হলে সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে। তাতে বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র আবিস্কার করে। সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি, আন্দোলন দানা বেঁধে উঠা ও মন্ত্রীদের দুর্নীতিসহ যে কোন অপকর্মের কারণে সরকারের আন্তর্জাতিক চপেটাঘাত পড়লেই ২০১০ সাল থেকে সরকার এসবের পিছনে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউসুসের চক্রান্ত খুঁজে পাচ্ছিল। অতি সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অতি অল্প মজুরী এবং গার্মেন্টস শিল্প মালিকদের অঢেল বিত্তের মালিক বনে যাওয়ার উপর দীর্ঘ একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সরকার সে সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। গার্মেণ্টস শিল্প সম্পর্কে প্রকাশিত সাম্প্রতিক রিপোর্ট আমার আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। বঙ্গ জননী এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর, বলার ও লিখার জন্য বহু বিজ্ঞ ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশী অধ্যুষিত অন্যতম এলাকা, বিশেষত জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ ষ্ট্রিট, যেখানে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৮০ শতাংশই বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন এবং বাংলাদেশীদের সকল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড যেখানে অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে ফুটপাতের উপর পানের পিক ফেলা নিয়ে গত ২০১২ সালের ১৩ আগষ্ট নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ সচিত্র প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করতেই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।
‘এখানে থুতু ফেলিবেন না,’ ‘পানের পিক ফেলিবেন না,’ অথবা ‘এখানে প্রস্রাব করা নিষেধ, করিলে —টাকা জরিমানা,’ লিখা ফলকগুলো অফিস আদালতসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে দেখে আসছি শৈশব থেকে। কিন্তু ওই নিষেধাজ্ঞাগুলো কখনো পালিত হয়েছে বা নিষেধ অমান্য করলে জরিমানা দিতে হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। বাংলাদেশে লোকজন যেখানে সেখানে থুতু ফেলে, যারা পান খায় তারা পানের পিক ফেলে, প্রস্রাব পায়খানা করে তারা বরং নিষেধের ফলক টানানো জায়গাগুলো তো বটেই, ব্যস্ত রাস্তার দু’পাশকেও প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পাদনের আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেয়। প্রকাশ্যেই তারা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়। পাশ দিয়ে যানবাহন গেলেও প্রকৃতির এই দাসগুলো তাদের মাথা হাঁটুর ফাঁকে লুকিয়ে যাত্রী ও পথচারীদের বিব্রত হওয়া থেকে রক্ষা করে। থুথু ফেলা ও সশব্দে নাক ঝাড়ার ক্ষেত্রে কোন রাখঢাকের প্রয়োজন বোধ করে না তারা।
বিদেশে এসে তারা তাদের আজন্ম লালিত অভ্যাসগুলোকে কিভাবে অবদমন করেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। এরপরও কথা আছে: “ইল্লত যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না ম’লে,” বা সংস্কৃত ভাষায়; “অঙ্গারং শতধৌতেন মলিনত্ব ন মুঞ্চতি,” সোজা বাংলায় “কয়লা ধুলে ময়লা যায় না।” নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসকে প্রবাসীরা দাবী করেন ‘বাংলাদেশীদের বাণিজ্যিক রাজধানী’ বলে। কিন্তু পানের পিক ফেলার অভিযোগ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তাদের রাজধানীকে তাম্বুল রসে বা পানের পিকে রঞ্জিত করছে উপমহাদেশের অন্য দেশের তাম্বুলসেবীরা। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার পাকিস্তানী মালিকানাধীন রেষ্টুরেন্ট ‘কাবাব কিং’ এর নিচতলায় বাংলাদেশী পান বিক্রেতা ইউসুফের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছেন। ১৩ আগষ্ট রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্য তিনি দাবী করেছেন যে, তিনি বাংলাদেশী নন। তিনি যে দেশেরই হোন না কেন, তার মতে, সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে তিনি গড়ে ২০০ পান বিক্রি করেন এবং তার ক্রেতাদের ৯৫ শতাংশই পাকিস্তানী। উইকএন্ডসে তার বিক্রির পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়। জ্যাকসন হাইটসের ৩৭ এভিনিউ ও ৭৩ ষ্ট্রিটের কর্ণারে অবস্থিত কাবাব কিং এর বাইরে যত্রতত্র পানের পিক ফেলার বিষয়টিকে তিনি পুরোপুরিই অস্বীকার করে দাবী করেন যে তার ক্রেতারা প্রকাশ্যে পিক ফেলে না। নিউইয়র্ক টাইমস সংবাদদাতা নিকোলাস হার্শন যে পান বিক্রেতা ইউসুফের বক্তব্য আদৌ বিশ্বাস করেননি তা বুঝা যায় রিপোর্টে তার মন্তব্যে, “এসব ক্ষেত্রে নিজ দেশের লোকজন ছাড়া তারা দ্রুত অন্য দেশের লোকদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয় অক্লেশে। পুরনো অভিবাসীরা নবাগতদের দোষ দেয় যে নবাগতরা এখনো তাদের দেশের বদভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেনি।” “অন জ্যাকসন হাইটস সাইডওয়াকস, এ ট্রিট’স মেসি আফটারম্যাথ” শীর্ষক রিপোর্টে পানের উপকরণের বিবরণসহ ফুটপাতে পানরসিকদের পিক ফেলার বিষয়ও উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “জ্যাকসন হাইটসের অনেক দোকানি, কিছু পথচারী ফুটপাতেই অর্ধ চর্বিত পান ও পিক ফেলে, ঠিক নিজ দেশে তারা যা করতো।”
কাবাব কিং এর ৫৫ বর্ষীয় পান বিক্রেতা ইউসুফ তার বক্তব্যে সত্য গোপন করেছেন, যা নিকোলাস উপমহাদেশীয় না হয়েও বুঝতে পেরেছেন এবং বলেছেন যে “এরা নিজের দোষ অন্যের উপর চাপাতে পারঙ্গম।” ইউসুফ ভালোভাবে জানেন যে পাকিস্তানী ও ভারতীয়রা যে পান খেতে অভ্যস্ত তা প্রধানত মিষ্টি পান। বহু ধরণের মিষ্টি উপকরণ সহযোগে প্রস্তুত এবং মূল্যও অধিক। মিষ্টি পান খেতে অভ্যস্তরা সাধারণত পানের পিক ফেলে না, কারণ, পিক ফেলার প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশীরা নিতান্ত শখের বসে না হলে মিষ্টি পান খায় না। তারা জর্দা, খয়ের ও চুন মিশ্রিত পান খায়, যা প্রচুর পরিমাণে রক্ত বর্ণের পিক উৎপাদনে সহায়ক । প্রবাসীরা যেহেতু জ্যাকসন হাইটসকে “বাংলাদেশীদের বাণিজ্যিক রাজধানী” বলে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, অতএব তাদের কর্মকান্ড জ্যাকসন হাইটস ঘিরে। গভীর রাত পর্যন্ত তারা ফুটপাতে আড্ডা দেন, শোরগোল করেন, পান খান, পিক ফেলেন এবং সকলের সামনেই শরীরের গোপন অংশ চুলকাতেও দ্বিধা করেন না। জ্যাকসন হাইটসের প্রতিটি বাংলাদেশী গ্রোসারীতে পান সুপারি, জর্দা খয়েরসহ পানের অন্যান্য উপকরণ বিক্রি হয় এবং বাংলাদেশীরাই সেসবের প্রধান ক্রেতা। সেখানে ভারতীয় মালিকানাধীন দু’টি বড় গ্রোসারী ‘সব্জি মন্ডি’ ও ‘আপনা বাজার’ এ হাজারো পণ্যের সমাহার এবং সেসব পণ্যের ৯০ শতাংশ ক্রেতা বাংলাদেশী হওয়া সত্বেও গ্রোসারী দু’টিতে পান সুপারি জর্দা বিক্রি করা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশী মালিকানাধীন ছোটবড় প্রতিটি গ্রোসারীতে পান ও পান খাওয়ার সকল উপকরণ পাওয়া যায়। সেখানে যে ক’জন ফুটপাতের উপর বাক্স সাজিয়ে খিলি পান বিক্রি করেন তাদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশী। ‘কাবাব কিং’ এর ওয়েটারদের প্রায় সবাই বাংলাদেশী এবং সেখানে রসনা তৃপ্তির জন্য যারা যায় তাদের বড় অংশই বাংলাদেশী। আর ইউসুফ মিয়া তার পানের খিলির ৯৫ শতাংশ ক্রেতাকে অবলীলায় পাকিস্তানী দাবী করেছেন, যারা পিক ফেলে না। তিনি বাংলাদেশী হয়ে থাকলে জাতীয়ভাবে তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার বা ৩ লক্ষকে যদি ৩০ লক্ষে রূপান্তরিত করা যায় তাহলে ইউসুফকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
সিটির হেলথ ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র আলেকজান্দ্রা ওয়াল্ডহর্ন নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন যে প্রকাশ্য থুতু ফেলার দায়ে জরিমানার পরিমাণ কমপক্ষে ২০০ ডলার। কিন্তু জ্যাকসন হাইটসে পানের পিক বা থুতু ফেলার জন্য জরিমানা আদায়ের ঘটনা কখনো ঘটেনি। ফুটপাত থেকে পানের পিকের দাগ তুলতে স্যানিটেশন ডিপার্টমেন্টের কেউ কখনো আসেনি। কারণ ফুটপাত থেকে পানের পিক বা অন্য কোন কিছুর দাগ তোলা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। তবে ৭৪ ষ্ট্রিটের ভারতীয় মালিকানাধীন ‘দিল্লি হাইটস রেষ্টুরেটের’ কর্মচারীরা তাদের রেষ্টুরেন্টের সামনের ফুটপাত থেকে পানের পিকের দাগ ঊঠাতে প্রতিদিন ব্লিচ সহযোগে ঘষামাজা করেন। তাদের মতে পানের পিক উঠানো সাধ্যাতীত ব্যাপার।
পান খেয়ে পিক ফেলার সংস্কৃতি বাংলাদেশসহ উপমহাদেশে বহুল আচরিত ঐতিহ্য। অনেকের মতে উপমহাদেশে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের সূচনাকাল থেকেই পান সেবন ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে। অনুমান করা হয়, এ ঐতিহ্য তিন হাজার বছরের প্রাচীন। উপমহাদেশের প্রতিটি ভাষার সাহিত্য ও সঙ্গীতে পানের উল্লেখ রয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মার্কোপোলো, পঞ্চদশ শতাব্দীতে তাঞ্জিয়ারের ইবনে বতুতা এবং সপ্তদশ শতাব্দীর পরিব্রাজক ভেনিসের নিকোলাও মানুচি, যারা উপমহাদেশে ভ্রমণকালে এদেশবাসীর পান খাওয়ার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। মানুচি তার ভ্রমণ কাহিনী ‘স্টোরিয়া ডি মোগর’ অর্থ্যাৎ মোগল যুগের কাহিনীতে পান খাওয়ার অভ্যাস সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন কিছুটা বাড়তি রস সংযোজন করে, মূলত: তার কাহিনীকে উপভোগ্য করতে। তিনি লিখেছেন, “আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, প্রায় সবাই মুখ থেকে রক্তের মত কিছু ফেলছে। মনে হলো, এদেশে কোন সমস্যার কারণে এমন হয়ে থাকবে অথবা তাদের দাঁত ভেঙ্গে গেছে। এক ইংলিশ মহিলার কাছে জানতে চাইলাম, এদেশের লোকজন কি তাদের দাঁত তুলে ফেলে। আমার প্রশ্ন বুঝতে পেরে তিনি উত্তর দিলেন যে, এটি কোন ব্যাধি নয়, বরং তারা এক ধরনের সুগন্ধি পাতা খায়, পর্তুগীজ ভাষায় যাকে বলা হয় ‘বেটেল’। তিনি তার ভৃত্যকে নির্দেশ দিলে সে পান আনলো এবং একটি নিজে খেয়ে আরেকটি আমাকে দিলেন। সেটি খাওয়ার পর আমার মাথা এমন প্রচন্ডভাবে ঘুরে গেল, আমার ভয় হলো যে, আমি মরে যাচ্ছি। আমি মেঝের উপর পড়ে গেলাম। তিনি আমার মুখে কিছু লবণ দেয়ার পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হলাম। তিনি বললেন, প্রথমবার পান খেলে সবার এমন হতে পারে।” মার্কোপোলোও তার সফরনামায় উপমহাদেশে পান খাওয়ার বিবরণ দিয়েছেন যে, অভিজাত ব্যক্তিরা, রাজা ও নওয়াবরা মহা আয়েশের সাথে পান খায় এবং পান দিয়ে অন্যকে আপ্যায়ন করে। ইবনে বতুতা বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে পানের প্রচলনের কথা বলেছেন যে, পান সমাজের সর্বস্তরে সেবন করার একটি উপাদান এবং অতিথি আপ্যায়নে এটি আবশ্যিক। অতিথিকে পান না দিলে তা অতিথিকে অপমান করার শামিল বলে বিবেচিত। এমনই ছিল পানের কদর ও সামাজিক গুরুত্ব, যা বাংলাদেশীরা দেশে ও বিদেশে এখনো যত্নের সাথে লালন করছে।
সাহিত্য সংস্কৃতিতে পানের অবস্থান অত্যন্ত পাকাপোক্ত। পুরনো একটি বাংলা গানে পান খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এভাবে: “ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা পান খাইয়া যাও।” খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী রুনা লায়লায় অতি জনপ্রিয় গানের একটি হলো: “পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম, বন্ধু ভাগ্য হইল না।” আরেকটি জনপ্রিয় গান হলো: “যদি সুন্দর এক খান মুখ পাইতাম, সদরঘাটের পানের খিলি তারে বানাই খাওয়াইতাম—।” পান নিয়ে আরো একটি জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান হচ্ছে: “মহেশখালীর মিষ্টি পান, খাইয়া আমার সোনার চান, মিষ্টি মিষ্টি কথায় আমায় ভুলাইল।” পান খাওয়ার উপর মুম্বাই এর হিন্দি ছায়াছবির গান এবং উর্দু কবিতাও প্রমাণ করে যে, উপমহাদেশে পান কত জনপ্রিয়। বলিউডের ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছায়াছবিতে মুহাম্মদ রফির কণ্ঠে একটি গানের প্রথম লাইন হলো:“খা কর তুনে পান কসম সে লে লি মেরি জান —।” ‘ডন’ ছায়াছবিতে জাভেদ আখতারের রচিত একটি গান গেয়েছেন খ্যাতিমান সঙ্গীত শিল্পী উদিত নারায়ণ, আর মুভিতে ঠোট মিলিয়েছেন অমিতাভ বাচচান: “খাই কে পান বেনারসওয়ালা, খোল গ্যায়ে বন্দ আকল কে তালা —।” একটি বিখ্যাত উর্দু কবিতায় বলা হয়েছে: “পান খানা সুরখ লাগানা লব হিলানা চাহিয়ে, মুস্কুরা কে আশিকো কা দিল ভুলানা চাহিয়ে।” বলিউডের নায়ক অমিতাভ ও গোবিন্দা, কিংবা নায়িকা রেখাকে অনেক ছায়াছবিতেই দেখা যায় পান খেয়ে তারা ঠোট লাল করেছেন এবং মুখ ভর্তি পানের পিক যত্রতত্র ফেলছেন।
রূপালী পর্দার কথিত তারকাদের প্রকাশ্যে এ কর্মটি করতে দেখলে তাদের ভক্ত অনুরক্তরা যে তা সঙ্গত কারণেই অনুকরণ করবেন তা বলাই বাহুল্য। অতএব. তাদের ভক্তদের পিক ফেলার মধ্যে দোষনীয় কিছু দেখি না। বিদেশে এসে যুগের পর যুগ বসবাস করেও তারা যদি দেশীয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার জন্য যেখানে সেখানে পিক ফেলেন তাহলে ঐতিহ্য প্রীতির জন্য তারা যথার্থই প্রশংসার দাবীদার। নিউইয়র্ক টাইমস এ উপমহাদেশীয়দের ঐতিহ্য বিরোধী একটি নির্দয় প্রতিবেদন প্রকাশ তাদের নিরাশ হওয়ার কোন কারণ হতে পারে না। বরং উপমহাদেশের লোকজন এদেশে আসার পর দেয়ালের দিকে দাঁড়িয়ে বা ফুটপাতের পাশে অর্নামেন্টাল গাছগুলোর উপর প্রস্রাব করে না, একটু ফাঁকা জায়গা পেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে মলত্যাগ করতে বসে না, এসবের ভূয়সী প্রশংসা করা উচিত ছিল প্রতিবেদক নিকোলাসের। তিনি যদি উপমহাদেশের দেশগুলো সফর করেন তাহলে অফিস-আদালত, বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, যানবাহন সর্বত্র দেখতে পাবেন যে দেয়াল এবং বিশেষ করে কোন অট্ট্রালিকায় সিড়ি দিয়ে উঠতে প্রতিটি কোনা যেন লাল রং দেয়া ক্যানভাস। পান সেবনকারী যারাই উঠানামা করছেন, তারা সদ্য চুনকাম করা দেয়ালে দ্বিগুণ উৎসাহে পিক ফেলছেন। প্রতিটি দেয়াল, মেঝে চারুশিল্পের বাহনে পরিণত হচ্ছে। শুধু পানের পিক নয়, তারা থুতু ফেলছেন, সশব্দে নাক ঝাড়ছেন এবং হাতে লেগে থাকা শ্লেষা অক্লেশে দেয়াল বা সিঁড়ির রেলিং এ মুছছেন।
যেখানেই উপমহাদেশের লোকজন গেছেন, সেখানে তারা তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে চলেছেন সযত্নে। ১৯৮৩ সালের গ্রীস্মকালে লন্ডনের বাঙ্গালী অধ্যুষিত ইষ্ট লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় দিনকতক বসবাসের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে বাংলাদেশীদের পান খেতে দেখে এবং প্রকাশ্যে ফুটপাত, দেয়ালে পানের পিক ফেলতে দেখে আমি রীতিমতো উচ্ছসিত হয়েছি। এক ব্যবসায়ী বন্ধু আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশে ফিরে আমি যাতে একটি এক্সপোর্ট লাইসেন্স করে যুক্তরাজ্যে জর্দা রফতানি করি। তিনি আমাকে জর্দা রফতানিতে মুনাফার হিসাব কষে দেখাতেও কার্পণ্য করেননি। কারণ, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে বিনা শল্কে জর্দা রফতানি করা যায়। জর্দা তামাকজাত একটি নেশাপণ্য। কি করে যুক্তরাজ্যের মতো একটি দেশে তা এমন অবলীলায় প্রবেশাধিকার পায় সে ব্যাপারে আমার সংশয় ব্যক্ত করলে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, জর্দা তামাক হিসেবে যায় না, ইনভয়েসে জর্দাকে দেখানো হয়, ড্রায়েড ভেজিটেবল অর্থ্যাৎ শুকনো সব্জি হিসেবে। যুক্তরাজ্যে আমদানিকৃত অধিকাংশ খাদ্য সামগ্রী তখন ছিল শুল্কমুক্ত। যাহোক, আমার ব্যবসা করা হয়নি।
গালফ ওয়ার চলাকালে ১৯৯০ সালে ইরাকিদের হামলায় দেশ ছেড়ে আসা কুেেয়তিদের একটি কনফারেন্স কভার করতে জেদ্দায় গিয়েছিলাম। পোর্ট অফ কল ছিল সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ বিমানবন্দর। ইমিগ্রেশনের বেষ্টনী পার হয়ে কাষ্টমস এলাকায় প্রবেশ করে দেখলাম মাথা সমান উঁচু পানের স্তুপ। ঢাকা থেকে বোয়িং ৭৪৭ এ আসা প্রায় চারশ’ যাত্রীর অধিকাংশই শ্রমিক। তাদের ব্যাগেজ তল্লাশি করে পান বের করে রাখা হচ্ছে। একজন যাত্রী যদি অন্তত দুই বিড়া করে পানও নিয়ে থাকে তাহলে প্রায় ৮শ বিড়া পান। বিশাল ব্যাপার। কয়েকজন সহযাত্রীর সাথে কথা বলে জানা গেল, সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে অতি সাম্প্রতিক কালে। সৌদি আরবের পৌরসভার তত্ত্বাবধানকারীরা নাকি রাস্তায় রক্তের দাগ দেখে দু:শ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। পরে তদন্ত চালিয়ে দেখতে পান পৌরসভার বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত উপমহাদেশের শ্রমিকরা রাস্তায় গাঢ় লাল দাগের উৎস। তাদের একটি বড় অংশ কিছু একটা খায়, যা মুখে রক্ত বর্ণের রস সৃষ্টি করে এবং তাদের মুখনিসৃত রক্তিম রসে রাজপথ রঞ্জিত হয়। এরপরই সৌদি কর্তৃপক্ষ তাদের দেশে পান প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের হিউষ্টনে ঘটে যাওয়া অনুরূপ একটি ঘটনার কথা জানা যায়। সিটির স্বাস্থ্য বিভাগ হঠাত করেই আবিস্কার করে যে, একটি এলাকায় ফুটপাতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। শংকিত হয়ে তারা তত্ত্ব তালাশ শুরু করে এবং তাদের অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে যে একটি দোকান সেই দাগের প্রধান উৎস। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানী ইমিগ্রান্টদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসবাস সেই এলাকায়, যারা ওই দোকান থেকে এক ধরনের সবুজ পাতার সাথে বিভিন্ন উপকরণ মেশানো একটি খাবার চিবুতে থাকে এবং তাদের মুখ লাল রসে পূর্ণ হয়। সেই রস তারা পুরোটা গলধ:করণ না করে থুতুর মতো ফুটপাতে নিক্ষেপ করে, যা ফুটপাতকে স্থায়ীভাবে রঞ্জিত করতে ভূমিকা রাখে। বেরসিক কর্তৃপক্ষ এটিকে পাবলিক নুইসেন্স বিবেচনায় দোকানটি বন্ধ করে দেয়।
পানের পিক ও থুতুর মধ্যে পার্থক্য হলো পিক রক্ত বর্ণ এবং এর দাগ প্রায় স্থায়ী। অন্যদিকে থুতু ফেলার পর তা শুকিয়ে গেলে আর বুঝা যায় না। উপমহাদেশের অন্য দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারত থুতু ফেলার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। বাংলাদেশীরা যখন তখন, যেখানে সেখানে থুতু ফেলে। পবিত্র রমজান মাসে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশী মুসলিমরা আরো বেশী থুতু ফেলে এই ভেবে যে থুতু গিলে ফেললে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। অথচ থুতু খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে গণ্য নয়। রোজা ভঙ্গের অন্যান্য প্রধান কারণগুলো ছাড়া খাদ্য বিষয়ক একটি বর্ণনায় শুধু উল্লেখ রয়েছে যে একটি ছোলা পরিমাণ খাদ্য গিলে ফেললে রোজা ভঙ্গ হবে। কিন্তু রমজান মাসে অধিকাংশ রোজাদার বাংলাদেশী মুসলিমদের মধ্যে থুতু ফেলার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শুধু বাংলাদেশ বা উপমহাদেশের মানুষই যে এ কর্মটি করে তা নয়। পাশ্চাত্যে, এমনকি থুতু ফেলার উপর নিষেধাজ্ঞা, এমনকি জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা থাকা সত্বেও অনেক জায়গায়, বিশেষ করে স্পেনের সিয়েজা সিটিতে থুতু ফেলার জন্য প্রতিযোগিতার আয়োজন আছে যে প্রতিযোগীদের কে কত দূরে থুতু নিক্ষেপ করতে পারে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এটি স্থান করে নিয়েছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে হলিউডের সেরা একটি ছায়াছবি ‘টাইটানিক’ না দেখা লোক কম পাওয়া যাবে। তাতে একটি দৃশ্য আছে, নায়ক লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও এবং নায়িকা কেট উইন্সলেট জাহাজের সামনের অংশে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছেন যে, দু’জনের কে কতটা দূরে থুতু নিক্ষেপ করতে পারেন। আবার ভিন্ন চিত্রও আছে, কারো মুখে থুতু নিক্ষেপের ঘটনা বিবেচিত হয় ঘৃণার চরম প্রকাশ হিসেবে। বাস্তবে দেখা যাক বা না যাক, বলিউডের হিন্দি ছায়াছবি দেখে যারা অভ্যস্ত তারা অহরহই দেখে থাকেন যে খলনায়কের বাড়াবাড়িতে নায়কের প্রেমে দুর্বার নায়িকা আর কিছু না পারলেও প্রবল ঘৃণায় খলনায়কের মুখে থুতু নিক্ষেপ করছে। বাংলা সিনেমায়ও এমন দৃশ্য থাকা একটু কঠিণ, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নায়িকাকে দেখা যায়, খলনায়কের সামনে হাত জোড় করে বা দু’হাতে পা জড়িয়ে ধরে, ‘আপনি আমার ধর্ম বাপ,’ ‘ধর্মের ভাই’ ধরণের বাক্য উচ্চারণ করে সর্বনাশ থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছে । কিন্তু ঘৃণার প্রকাশ ঘটিয়ে খলনায়কের মুখে থুতু নিক্ষেপের ঘটনা আদৌ ঘটেনা অথবা কম ঘটে।
আমেরিকাসহ বিশ্বের বহু দেশে প্রকাশ্যে থুতু ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। থাইল্যান্ডে থুতু বিরোধী অভিযানে নামতে হয়েছিল স্বয়ং রাজা ভূমিবলকে। মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ, পূর্ব এশিয়ার জাপান, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে থুতু ফেলা বন্ধ করা হয়েছে আইন করে। উপমহাদেশের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে থুতু ফেলার বিরুদ্ধে আইন আছে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। আইনের উপর স্থান কওে দৌর্দন্ড প্রতাপে টিকে আছে থুতু ও পিক ফেলার ঐতিহ্য। থুতু না ফেলা সম্পর্কে আমেরিকার ঐতিহ্য অবশ্য খুব প্রাচীন নয়। এরা বরং অফিস-আদালতে এতো থুতু ফেলতো যে এমনকি আদালতে বিচারকদের টেবিলে থাকতো ‘স্পিটুন’ বা ‘থুকদান’ যাকে উপমহাদেশীয়রা ‘পিকদান’ ‘চিলমচি’ ইত্যাদি বলে থাকে। বাংলাদেশেও পিকদান আছে, কিন্তু পিক বা থুতু ফেলার কাজে এসব কমই ব্যবহৃত হয়। পানসেবীরা খোলা জায়গাকেই এসব কর্মের আদর্শ স্থান বলে বিবেচনা করে।
Comments