আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে ওয়াশিংটন ষ্টেটে কলাম্বিয়া নদীর তীরে ছোট ছিমছাম সিটি রিচল্যান্ড। খুব পুরনো সিটি নয়। ৭৪ বছরের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৩ সালে গোড়াপত্তন হয় রিচল্যান্ড সিটির। আধা মরু এলাকা। নাৎসি জার্মানি আণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে জানতে পেরে আমেরিকা তড়িঘড়ি আণবিক বোমা তৈরির জন্য গ্রহণ করে “ম্যানহাটান প্রজেক্ট”। এর অংশ হিসেবে কলাম্বিয়া নদীর তীবে ৫৮৬ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয় ‘হ্যানফোর্ড সাইট’। সেখানে বসবাসরত আদিবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে হ্যানফোর্ড সাইটে কর্মী সংখ্যা উন্নীত হয় প্রায় ৪৫ হাজারে। তখন প্রকল্পের প্রশাসক ও ইঞ্জিনিয়ারদের ৪৩ হাজার পরিবারের জন্য গড়ে তোলা হয় রিচল্যান্ড গ্রাম। বর্তমানের রিচল্যান্ড সিটি। পার্শ্ববর্তী আরো দুটি সিটি ক্যানউইক ও পাসকো মিলে পরিচিত ‘ট্রাই-সিটিজ’। রিচল্যান্ড এখনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ারসহ উচ্চ পেশাজীবী এবং যারা উচ্চতর পড়াশুনা করতে এসেছে তাদেরই সিটি। বাসিন্দাদের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান। কোন কৃষ্ণাঙ্গ, হিসপানিক চোখে পড়ে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু লোক আছে।
নিউইয়র্ক থেকে সল্টলেক সিটি পৌছে কানেকটিং ফ্লাইটে পাসকো দেড় ঘন্টার পথ। ১লা আগষ্ট গভীর রাতে পাসকো এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। আকরাম অপেক্ষা করছিল। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলাম। এর আগে আগে আরো দু’বার পাসকো থেকে উড়েছি। নামলাম এই প্রথম। সাথে ্আমার স্ত্রীও আছেন। তার কারণেই এবারের ভ্রমণ। রিচল্যান্ডে আমি প্রথমবার যাই ২০১০ সালের সামারে। বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি। আবার গেছি ২০১৫ সালের আগষ্টে, আকরামের মেয়ে শামিনার বিয়েতে। প্রফেসর আকরাম হোসাইন। ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটির রিচল্যান্ড ক্যাম্পাসের ইনটেরিম ভাইস চ্যান্সেলর। আমেরিকান কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে ওকে শীর্ষ বাংলাদেশী বললেও বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না। ছাত্র জীবন থেকেই ইনট্রোভার্ট, নিভৃতচারী। আমার চেয়ে বয়সে একটু ছোট হলেও আমরা বন্ধু। ভাইবোনেরা ওকে ‘মিয়া ভাই’ ডাকে। আমিও তাই ডাকি। সবকিছু শেয়ার করা, নির্ভর করা ও জড়িয়ে থাকার মতো বন্ধু। একই এলাকায় আমাদের বাড়ি। পরিবারের সবার সাথে পরিচিত ও ঘনিষ্ট। ১৯৭৪ সালের বন্যা ও দুর্ভিক্ষের সময় আমরা ঢাকায় আসি। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই, আকরাম ভর্তি হয় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকি। অল্প দূরত্বে নজরুল ইসলাম হলে থাকে আকরাম। দেখাসাক্ষাৎ নিয়মিতই ছিল। পড়াশুনা শেষ হলে আকরাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিল। আমি ছাত্রাবস্থায় সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম, তাই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে আমাকে চাকুরি খুঁজতে হয়নি। সাংবাদিকতা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। আকরাম বিয়ে করেছিল আমার কয়েক মাস আগে। বিয়ের কয়েক বছর পর ১৯৮৪ সালে আকরাম পিএইচডি করার জন্য পুলম্যানে ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতে চলে আসে। ওর চলে আসা আমার জন্য বেদনাদায়ক ছিল। কষ্ট চেপে ওকে বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। কিছুদিন পর বড় মেয়ে মিতুলসহ ভাবী যোগ দেন ওর সাথে।
১৯৮৮ সালে আমি রয়টার্সের ফেলোশিপের জন্য আবেদন করি। দু’মাস পর আমাকে জানান হয়, আমি শর্ট লিষ্টে আছি। আরো একমাস পর আমাকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করা হয়েছে বলে ট্যালেক্সে বার্তা পাঠান হয়। আমি উচ্ছসিত হই। রয়টার্সের ঢাকা অফিসের ব্যুরো চিফ আতিকুল আলম ফোন করে অভিনন্দন জাানিয়ে বলেন, যারা ফেলোশিপের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, লন্ডন থেকে তাদের পরিচিতিসহ একটি নিউজ আসছে। একটু পরই টেলিপ্রিন্টারে নিউজটি আসার পর সংগ্রামে আমার সহকর্মীরা উল্লাসে চিৎকার করেন, আমাকে জড়িয়ে ধরে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। ১৯৮৩ সালে রয়টার্স ফাউন্ডেশন এই ফেলোশিপ প্রোগ্রাম চালু করার পর আমি রয়টার্সেও প্রথম বাংলাদেশী ফেলো হতে পারায় গর্ব অনুভব করি। কয়েকদিন পর রয়টার্স থেকে আমাকে পাঠানো আনুষ্ঠানিক অভিনন্দন বার্তায় জানান হয়, কমনওয়েলথ দেশুগুলো প্রায় তিনশ আবেদনকারীর মধ্যে ছয় জনকে ফেলো হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজনকে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, দু’জনকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্বািবদ্যালয়ে এবং ফরাসি ভাষাভাষি একজনকে ফ্রান্সের বর্দো বিশ্ববিদ্যালয়ে সংযুক্ত করা হবে। আমার কাছে অপশন চাওয়া হয়েছে, আমি কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাই। আমি দ্বিতীয় চিন্তা না করে ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানিয়ে দিলাম। আকরাম আমেরিকায় আছে, সুযোগটা যখন পেয়েছি আমারও ওর কাছে থাকা উচিত, এমন একটা চিন্তাও কাজ করেছিল ষ্ট্যানফোর্ডে যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে। সিনিয়র সাংবাদিকরা আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন অক্সফোর্ড পছন্দ না করার জন্য। ষ্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের জন. এস নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের ডাইরেক্টর, দু’বার পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক জেমস রিসার ফোন করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে আমাকে প্রস্তুতি নিতে বললেন। আকরামকে টেলিফোনে খবরটি জানালাম। ওর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ষ্ট্যানফোর্ডের দূরত্ব প্রায় আটশ’ মাইল। আমেরিকায় মতো দেশে এটা কোন দূরত্বই নয়।
আগষ্ট মাসের শেষ দিকে যখন আমার টিকেট পাঠানো হলো তখন দেশজুড়ে প্রবল বন্যা। ঢাকা প্রায় ডুবে গেছে। আমার বাসার সামনে কোমর পানি। এয়ারপোর্টে পানি উঠেছে। আন্তর্জাতিক সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। রানওয়ের এক চিলতে জায়গা ভেসে আছে যেখান থেকে বাংলাদেশ বিমানের ছোট আকৃতির ফকার ফ্রেন্ডশিপ এয়ারক্রাফটে ইমার্জেন্সি প্যাসেঞ্জারদের কলকাতা পর্যন্ত পৌছে দেয়া হচ্ছে। আমার টিকেট ছিল সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের। ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে স্যান ফ্রান্সিসকো। কলকাতা পর্যন্ত বিমানের টিকেট পেতে অসুবিধা হলো না। অতএব আমাকে ঘোরা পথে কলকাতা-ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর-হংকং হয়ে স্যান ফ্রান্সিসকো পৌছতে হয়েছিল। আকরাম আমাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিত। আমেরিকার সেরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াশুনা করার সুযোগ পাওয়ায় আকরামও আনন্দিত। আমাকে ওর ওখানে ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। আমার স্ত্রী-সন্তান এসে পৌছলে যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করি এবং সবাইকে নিয়ে ডিসেম্বরে ক্রিসমাসের ছুটিতে সপরিবারে গিয়েছিও পুলম্যানে। ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে আকরামের পিএইচডি সম্পন্ন হয় এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। পুলম্যানে ওয়াশিংটন ষ্টেট ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাস থেকে রিচল্যান্ড ক্যাম্পাসে চলে আসে একসময়। সেই যে ১৯৮৪ সালে ছাত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, মাঝখানে মাত্র দুই বছর সাউথ ক্যারোলিনার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটানো ছাড়া দীর্ঘ ৩১ বছর সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। আকরাম ঘুরাঘুরি খুব একটা উপভোগ করে না। দেশেও করেনি। বাংলাদেশের পাঁচটি জেলায় গেছে কিনা সন্দেহ। ওর ছোটভাই মোহাম্মদ রাজীব হাসান (রুমী) লুইজিয়ানা ষ্টেট ইউনিভার্সিটিতেে পিএচডি করছে। বছর চারেক যাবত আমেরিকায়। এরই মধ্যে অর্ধেকটা আমেরিকা ঘুরে ফেলেছে।
এরপরও আমি আকরামকে কাছে পেতে পছন্দ করি, ওর সঙ্গ উপভোগ করি। আমার পছন্দ হচ্ছে না, এমন কোন কথা বলতে চেষ্টা করলে এখনো আগের মতো ওর মুখ চেপে ধরি, সে আমাকে আগের মতো জোর করে খাওয়ায়। ২০১০ এ যখন গেছি তখন আকরাম আমাকে নিয়ে ওর পুরনো পুলম্যান ক্যাম্পাস, সিয়াটেল, ওরিগনের মালটনোমাহ ফলস, ক্যানন আইল্যান্ডে বেড়াতে নিয়ে গেছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বের চাপে শনিবার, রোববার ছাড়া সময় নেই। এবার এক শনিবার মালটনোমাহ ফলসে নিয়ে গেল। কাছাকাছি ভিসতা হাউজ, বনভিল ফিস হ্যাচারি ঘুরে দেখলাম। জায়গাগুলোতে আগেও গেছি। এবারের ঘোরাঘুরি আমার গিন্নির জন্য। ২০১০ এর মে মাসে মালটনোমাহ ফলসের পানির উৎস দেখতে পর্বতারোহণ করেছি প্রায় এক মাইল। ফলসের উচ্চতা সাড়ে ছয়শ ফুট হলেও পর্বতের বাঁক ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়। এবার ফলসের পাদদেশেই পৌছেছি পৌছি পড়ন্ত বেলায়। বিকেল ৬টায় পর পর্বতে উঠা বন্ধ, তাই উঠা হয়নি।
কলাম্বিয়া নদীতে বিশালাকুৃতির কানাডিয়ান গিজের সমাবেশও উপভোগ্য। মানুষের উপস্থিতির তোয়াক্কা করে না, কোন ডর ভয় নেই। কারণ কেউ ওদের অনিষ্ট করে না। খাবার দিলে হাত থেকে খাবার নিতে দৌড়ে আসে। গিন্নি ও আমি প্রতিদিন সকালে কলাম্বিয়ায় তীর ঘেঁষে লেসলি গ্রেভ পার্কে হাটতে যাওয়ার সময় সাথে পাউরুটি নিয়ে গেছি হাসগুলোকে খাওয়াতে। নদীর তীরে হেলে পড়া গাছ বেয়ে উঠতে হয়না। আমার গিন্নি জীবনে গাছে উঠেনি। সেই সাধও পূরণ করেছে সেখানে। ভাবীর বাগানে অনেক প্রজাতির সব্জি। প্রতিবছর সামারে তার নিয়মিত কাজ। এর ব্যত্যয় ঘটে না। জাংলায় লাউ এর ছাড়াছড়ি। ক’টা আর খাওয়া হয়। চেনাজানা সবার মাঝে বিলিয়ে দেন। ভাবী হিসাব রাখেন ক’টা লাউ গাছ থেকে কাটা হলো। গত বছর দু’শ ছাড়িয়েছিল। গতবারের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে এবার।
বন্ধুর সান্নিধ্য পেতে পশ্চিম উপকূলে
Published in Uncategorized
Comments