Skip to content →

বাঙ্গালিই বাঙ্গালির শত্রু

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু • 

আমার কাহিনীর সূচনা শুক্রবার, ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ৪৩ তম বিজয় দিবসের বিকেল। আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসেছি। পাকিস্তান আমলে এটি ছিল রেসকোর্স বা ঘোড়দৌড়ের মাঠ। ১৯৭১ সালের এই দিনটিতে পরাজিত পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ও বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান লে: জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। ‘ইন্সট্রুমেন্ট অফ সারেন্ডার’ বা আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর আছে পাকিস্তানের পক্ষে লে: জেনারেল এএকে নিয়াজি এবং ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর পক্ষে অরোরার। সাক্ষী হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর একে খন্দকার। কিন্তু সেই ‘ইনষ্ট্রুমেন্ট’ এ সাক্ষীর স্বাক্ষর, এমনকি বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অনুষ্ঠানের যতোগুলো চিত্র আছে সবগুলোতে বেসামরিক পোশাক পরিহিত একে খন্দকারকে পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে গলা যথাসম্ভব লম্বা করে স্বাক্ষর দানের দৃশ্য অবলোকনের প্রচেষ্টারত অন্যান্য দর্শকের মতোই একজন দর্শক বলে ভ্রম হয়। আত্মসমর্পণ করার পর পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে এবং সেখান থেকেই তাদেরকে মুক্তি দিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হয়। প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বর ভারত তাদের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের হেডকোয়ার্টার কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামসহ ভারতের অন্যান্য সেনানিবাসগুলোতে পাকিস্তানকে পরাভূত করার এই দিনটিকে সাড়ম্বরে উদযাপন করে। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মেজাজ মর্জি ভালো থাকলে কোন কোন বছর ফোর্ট উইলিয়ামের এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, বিশেষত যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে আমন্ত্রণ জানান হয়।

ভারতের কাছে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের এই উৎসবকে বাংলাদেশের বিজয় দিবস কেন উদযাপন করা হয় সে সম্পর্কে কারো গবেষণালব্ধ কোন ধারণা নেই। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হবে, এমন কোন ঘোষণা নেই। ভারত ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঘোষণা করার পর ভারতীয় কমান্ডের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানীরা আগেভাগেই তাদের অবস্থান থেকে পিছু হটায় সেসব স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ‘মুক্তাঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করে। বিভিন্ন অঞ্চল বিভিন্ন তারিখে মুক্ত হয় এবং যে অঞ্চল যে তারিখে মুক্ত হয়েছে বিগত ৪৩ বছর যাবত ওইসব এলাকার প্রধান শহরে ওই নির্দিষ্ট তারিখে ‘হানাদার মুক্ত দিবস’ পালন করা হচ্ছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপনের যথার্থতা রয়েছে। কারণ, সেদিন পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু ১৯৭২ সাল থেকে ওই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিন হিসেবে উদযাপন করা একটি কষ্টকর রীতিতে পরিণত হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সকল শাখা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনীগুলোকে ওই দিনের কুচকাওয়াজে অংশ নিতে মার্চের প্রচন্ড উত্তাপে কঠোর প্রশিক্ষণ দিতে হয়। সে তুলনায় ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানীদের পরাজয় বাংলাদেশের জন্য আশির্বাদস্বরূপ ছিল। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পুস্পস্তবক অর্পনের পর ছোটবড় রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাতে কেউ আর ডিসেম্বরের শীত অনুভব করে না। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদনকারীদের করার মত আর কিছু থাকে না। বাংলাদেশে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি শীত জেঁকে বসে, সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে রূপ নেয়। চারদিকে পাখির কিচিরমিচির শোনা যায়। দিন থাকে উপভোগ্য।

স্বাধীনতা দিবস ছাড়াও উপমহাদেশের দেশগুলো আরেকটি দিবস পালন করে, যেটি স্বাধীনতা দিবসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতার দিক থেকে জাঁকজমকপূর্ণ। ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ আগষ্ট, সেদিন কেন্দ্রীয়ভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে লাল কিল্লার উপর থেকে কিল্লার সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। কিন্তু অত্যন্ত ঘটা করে উদযাপন করা হয় ২৬ জানুয়ারী রিপাবলিক ডে বা প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারতের গণপরিষদ ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান পাস করে, যে সংবিধান অনুমোদিত হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী এবং দেশটি সত্যিকার অর্থে প্রজাতন্ত্র হিসেবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যেহেতু ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারী ভারতের ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দেয়া হয়েছিল, অতএব সেদিনটিকেই তারা প্রকৃত অর্থে অধিক গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট এবং দিনটিকে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করে দেশ জুড়ে। কিন্তু আরেকটি দিন পাকিস্তানের জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি ২৩ মার্চ। এদিনটির নাম ‘পাকিস্তান দিবস’। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন প্রস্তাবটি পাঠ করেন একজন বাঙ্গালি, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। ১৯৭১ সালের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমরাও ১৪ আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস ও ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপনের নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক কোন ঘোষণাপত্র, ঘোষণার দিন ও ঘোষক নেই। ঘোষণার দিন ও ঘোষক সম্পর্কে তিন ধরনের দাবী প্রবলভাবে বিদ্যমান। ওই দাবীগুলো অনুসারে ঘোষণাপত্র বলতে টিকে আছে কয়েকটি বাক্য মাত্র। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হলেও দিন এবং ঘোষক নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনো ঘটেনি। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠণ করা হয়, যে সরকারের মন্ত্রীরা মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণ করেন। ওই দিনেরও কিছু সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতা মুজিবনগর দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

বাংলাদেশের সরকারি ছুটির তালিকায় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের পরই ‘বিজয় দিবস’ সবচেয়ে বড় উৎসব এবং এই একটি উৎসবই সমগ্র দেশব্যাপী মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধসহ সকল সম্প্রদায়ের লোক দ্বারা উদযাপিত হয়। দেশের সর্বত্র সরকারিভাবে পতাকা উত্তোলন, পুলিশ, আনসার, বয়েজ স্কাউট ও গার্লস গাইডদের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এ দিনে। শহরের প্রতিটি বাড়িতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন অনেকটা বাধ্যতামূলক। পতাকা না তুললে স্বাধীনতা বিরোধী অভিধায় ভূষিত হওয়ার আশংকা থাকে।

রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশের সামরিক শক্তি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের যে জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর যে আয়োজন প্রতিবছর ২৬ মার্চ করা হয়, তা ১৬ ডিসেম্বরে করা হলেই বেশী উপভোগ্য হতো। এই প্রদর্শনী আগে অনুষ্ঠিত হতো সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউ এ। কিন্তু এখন এই রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দেয়ায় রাস্তা সংকুচিত হয়ে গেছে এবং কুচকাওয়াজের জন্য স্থায়ী প্যারেড স্কোয়ার করা হয়েছে তেজগাঁও পুরনো বিমানবন্দরের পরিত্যক্ত রানওয়েকে। বাংলাদেশের সমর প্রস্তুতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে প্রতিবছর ২৬ মার্চ মারণাস্ত্র ও সামরিক শক্তির এমন মহড়ার উদ্দেশ্য কি? আমাদের শত্রু কে? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেনাবাহিনীর হাতে দু’জন রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট সপরিবারে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কতো সদস্য নিজেদের দ্বারা নিহত হয়েছেন তার কোনো সংখ্যা কেউ জানে না। ১৯৯৬ সালের মে মাসে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল নাসিমের নেতৃত্বে সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের অংশ হিসেবে যশোহর ও সাভার সেনানিবাস থেকে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকামুখী হয়েছিল সেনাপ্রধানের অনুগত একটি অংশ। আরেকটি অংশ কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে রওয়ানা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে আগুয়ান বাহিনীকে সামাল দিতে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী জরুরী অবস্থা জারী করা হলে ঢাকার রাস্তায়, বিশেষ করে বঙ্গভবনের সামনে বেশ কিছু ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছিল। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় বাংলাদেশ রাইফেলস এর সদর দফতরে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করে বিদ্রোহী বিডিআর সদস্যরা। বিডিআর বিদ্রোহ দমন করার জন্য সেনাবাহিনী ঢাকার রাজপথে নেমেছিল এবং ধানমন্ডি ও নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থান নিয়েছিল। ওই সময় বিডিআর সদও দফতরের উপর দিয়ে কয়েকটি হেলিকক্টারও চক্কর দিয়েছিল। এসবের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করেছি যে আমাদের সকল যুদ্ধ প্রস্তুতি নিজেদের সঙ্গে লড়ার জন্য। আমরা ছাড়া আমাদের শত্রু বলে কেউ নেই। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলীতে প্রায় প্রতিদিন বাংলাদেশের কেউ না কেউ নিহত বা আহত হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রতিবাদ নেই। বেসামরিক ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব সমভাবে প্রযোজ্য। বৃহৎ প্রতিবেশীর কাছে সকল বিষয়ে আমরা সমর্পিত ও অনুগত। আসল সত্য হচ্ছে, আমরা বাংলাদেশীরা স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। আমরা বিশ্বের কাছে প্রচার করি, ‘ফ্রেন্ডশিপ টু অল, ম্যালিস টু নান’। কিন্তু আমরা নিজেদের বন্ধু নই এবং বিদ্বেষও পোষণ করি নিজেদের সাথে। আমরা আইনের শাসনের কথা বলি, কিন্তু বিনা কারণে যেখানে সেখানে পিটিয়ে মানুষ হত্যা করি। আমরা মনের পবিত্রতা, সতীত্ব ও যৌন সংযমের কথা বলি, আর সারাক্ষণ যৌনতার মাঝে নিজেদের আচ্ছন্ন রাখি।

আমার কাহিনীতে ফিরে যাওয়াই উত্তম। দুপুর পর্যন্ত চলে সাভারে জাতীয় স্মৃতি সৌধে ফুল দেয়ার প্রতিযোগিতা। যারা নিজেকে কিছু একটা মনে করেন তাদেরকে সেখানে যেতেই হয়, কারণ কেউ প্রশ্ন করলে যদি উত্তরটা নেতিবাচক হয়, তাহলে বিপক্ষরা না যাওয়ার পিছনে কারণ বের করতে দ্বিধা করেন না। কিন্তু এমন একটি উৎসবের দিনে সাধারণ মানুষের করার মতো তেমন কিছু থাকে না। ঢাকায় বিনোদনের জায়গা একেবারেই কম। রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দি উদ্যান, শিশু পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, লালবাগ কেল্লা, চন্দ্রিমা উদ্যানসহ সংসদ এলাকা এবং ওদিকে মিরপুর চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন লোকে লোকারন্য হয়ে পড়ে। রেষ্টুরেন্টগুলোও থাকে গ্রাহকে পরিপূর্ণ। কোথাও খোলামেলা ও শান্ত সমাহিত পরিবেশ পাওয়া যায় না। রাজধানীর বহু লোকের বিশেষত তরুণ-তরুণী, মফস্বল এলাকা থেকে সদ্য আগত পরিবার, গার্মেন্টস এ কাজ করে এমন মেয়েরা তাদের ছেলে বন্ধুদের সাথে সেখানে দিনের অবশিষ্ট সময় কাটাতে আসে। ঢাকার যে কোনো জায়গা থেকে খুব সহজে এখানে আসা যায়। সোহরাওয়ার্দি উদ্যান একসময় সম্পূর্ণ খোলা জায়গা ছিল। ঘোড়দৌড় হতো সেখানে। দেশের স্বাধীনতা লাভের পর সরকার ঘোড়দৌড় নিষিদ্ধ করে সেটিকে আওয়ামী লীগের অবাঙ্গালি নেতা সোহরাওয়ার্দির নামে উৎসর্গ করে এবং বহু প্রজাতির গাছপালা লাগায় প্রায় পরিকল্পনাহীনভাবে। এসব গাছ অধিকাংশই কোন ফল দেয় না, যার ফলে নিতান্ত বাধ্য না হলে কোন পাখী সেসব গাছে বসেও না, বাসাও বাঁধে না। তার চেয়ে বরং রাস্তার অপর পারেই রমনা পার্কে আম জামের মতো মওসুমী ফল ছাড়াও বট-পাকুরসহ ফলদায়ক প্রজাতির অনেক গাছ আছে সেগুলোতে পাখীদের খাদ্য সংস্থান হয় বলে রমনা পার্কে তুলনামুলকভাবে পাখীর ্সংখ্যা অধিক দেখা যায়।

অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে ঢাকাকে পূর্ব বাংলার রাজধানীতে পরিণত করায় ঢাকায় প্রাদেশিক মন্ত্রীসহ পূর্ব বাংলা প্রশাসনের পদস্থ অধিকারীদের উপযোগী বাড়ীঘর ও বিনোদনের জন্য স্থান নির্বাচন করেছিলেন রমনা এলাকাকে। বৃটিশ ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কলকাতা থেকে পাঠানো হয়েছিল খ্যাতমান বৃটিশ উদ্যানবিদ, স্থপতি ও তাদের সহকারীদের। তাদের পরিকল্পনা অনুসারেই একটি লেকসমৃদ্ধ রমনা পার্কসহ আশেপাশের এলাকাকে গড়ে তোলা হয়েছিল অভিজাত আবাসিক এলাকা। রাস্তাগুলোর নামকরণও করা হয়েছিল তখন, বেইলি রোড, মিন্টো রোড, ইস্কাটন রোড ইত্যাদি। সেসব এখন ইতিহাস। কিন্তু তা সত্বেও তখনকার নির্মিত সুপরিসর লাল বাড়ীগুলো আছে, যেখানে এখনো মন্ত্রীরা বসবাস করেন। কিছু নতুন বাড়ি নির্মাণ করে পুরনো ঐতিহ্য ও স্থাপত্য সৌন্দর্য বিনষ্ট করা হয়েছে। মন্ত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ দর্শিয়ে। কিন্তু এটি যৌক্তিক কোন কারণ নয়। বাঙ্গালি ঐতিহ্য প্রেমিক কোনো জাতি নয়, ধ্বংস করার মধ্যে তারা আনন্দ লাভ করে এবং ধ্বংসের দোষ অন্যকেও চাপানোকে ঐতিহ্যের অংশ বলেই মনে করে। এক বিচিত্র জাতির উত্তরসূরী আমরা। বাঙ্গালি জাতির বৈশিষ্ট সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলা আমার মতো মুষিক তূল্য ব্যক্তির পক্ষে রীতিমতো ধৃষ্টতামূলক। কারণ যে দেশে হাজার বছরের, এবং অতি উৎসাহীদের মতে পঞ্চ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ একজন বাঙ্গালিকে প্রেরণ করে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং ধন্য হয়েছিলেন বলে দাবী করার কাছাকাছি চলে যাওয়া হয়।

কিন্তু বাঙ্গালিদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কে এই জাতিকে শাসন করতে আসা বিদেশি শাসক, বাণিজ্য করতে আসা বিদেশি বণিক ও ভ্রমণ করতে আসা পরিব্রাজকরা কি বলেছেন, সেসবকে বিবেচনায় না নিয়ে শুধুমাত্র প্রাত:স্মরণীয় বাঙ্গালি বিদগ্ধজনের অমৃত বচন বিশ্লেষণ করলেই উপলব্ধি করতে সমস্যা হবে না যে জাতি হিসেবে বাঙ্গালির অবস্থান কোথায় হতে পারে। বাঙ্গালি হিন্দু জাতীয়তাদের অন্যতম প্রবক্তা, ‘বন্দে মাতরম’ সঙ্গীতের রচয়িতা, চরম মুসলিম বিদ্বেষী লেখক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপধ্যায় তার স্বজাতি সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করতেন, তা দেখা যাক। তিনি বলেছেন, “কোন কোন তা¤্রশ্মশ্রু ঋষির মত এই যে, যেমন বিধাতা ত্রিলোকের সুন্দরীগণের সৌন্দর্য তিল তিল করে সংগ্রহ করিয়া তিলোত্তমার সৃজন করিয়াছিলেন; সেইরূপ পশুবৃত্তির তিল তিল করিয়া সংগ্রহপূর্বকেই অপূর্ব নব্য বাঙ্গালি চরিত্র সৃজন করিয়াছেন। শৃগাল হইতে শঠতা, কুক্কুর হইতে তোষামুদ ও ভিক্ষানুরাগ, মেষ হইতে ভীরুতা, বানর হইতে অনুকরণপটুতা, এবং গর্ধভ হইতে গর্জন।”

বাঙ্গালির অহমিকাবোধ এতোই প্রচন্ড যে, একজন রাজনীতিবিদ গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বলে গেছেন, “বাংলা আজ যা ভাবে, অবশিষ্ট ভারত তা ভাববে আগামীকাল।” ঔপন্যাসিক বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন, “বাঙ্গালিরা ভাবে যে, পৃথিবীতে বাংলাই একমাত্র স্থান। বাংলার বাইরে আর কোনকিছু নেই।”

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায়ের মৃত্যুর ১১০ বছর পর মৃত্যুবরণকারী বাংলাদেশের খ্যাতিমান লেখক, শিক্ষক ও গবেষক প্রফেসর ড. হুমায়ুন আজাদ বাঙ্গালি চরিত্র চিত্রায়ণ করতে গিয়ে লিখেছেন: “বাঙ্গালি পৃথিবীর সবচেয়ে অহমিকাপরায়ণ জাতিগুলোর একটি, বাস করে পৃথিবীর এককোণে; ছোটো, জুতোর গুহার মতো, ভূভাগে;- খুবই দরিদ্র, এখন পৃথিবীর দরিদ্রতম। প্রতিটি বাঙ্গালি ভোগে অহমিকারোগে, নিজেকে বড়ো ভাবার অচিকিৎস্য ব্যাধিতে আক্রান্ত বাঙ্গালি। জাতি হিশেবে বাঙ্গালি বাচাল ও বাকসর্বস্ব; অপ্রয়োজনেও প্রচুর কথা বলে। বাঙ্গালির স্বভাব উঁচু গলায় কথা বলা; সাধারণত শুরুই করে উচ্চকণ্ঠে, বা ক্রমশ তার গলার আওয়াজ চড়তে থাকে। যদি আলাপের বিষয়টি বিতর্কিত হয়, পক্ষবিপক্ষ থাকে, তাহলে অল্প সময়েই তারা প্রচন্ড আওয়াজ সৃষ্টি করতে থাকে; এবং অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা যদি দুয়ের বেশি হয়, তিন-চার-পাঁচজন হয়, তাহলে আলোচনা পুরোপুরি পন্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যে-কোনো আলাপে বাঙ্গালি নিজেই নিজেকে প্রবেশ করিয়ে দেয়, অন্যদের অনুমতির প্রয়োজন বোধ করে না; এমনকি, অনেক সময়, আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু না জেনেই বাঙ্গালি তীব্র আলোচনায় অংশ নেয়। বাঙ্গালির যুক্তি কণ্ঠের উচ্চতা; যার কণ্ঠ যতো উঁচু, সে নিজেকে ততোটা যুক্তিপরায়ণ বলে গণ্য করে; এবং নিজের জয় অবধারিত বলে জানে। যুক্তিতে কোনো বাঙ্গালি কখনো পরাজিত হয় নি, হয় না, ভবিষ্যতেও হবে না।”

বাঙ্গালি চরিত্র বিশ্লেষণে একজন ভারতীয় কবি বলেছেন, “তুমি যদি কোনোকিছুকে লম্বা করতে চাও তাহলে বাঙ্গালির কথা শোনো, আর বাঙ্গালি রমণীর চুল দেখো।” কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদক বাঙ্গালিদের সম্পর্কে তার বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন, “অনেকে বাঙ্গালিদের বিবেচনা করে অদক্ষ বাক্যবাগীশ হিসেবে। কিন্তু রাজনৈতিক বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ, যারা বন্দুকের প্রথম গুলির শব্দেই কোথায় মিলিয়ে যায়, তা কেউ টের পায় না।” এহেন চারিত্রিক বৈশিষ্টের অধিকারী বাঙ্গালি জাতির অবক্ষয় সম্পর্কে একজন খ্যাতিমান বাঙ্গালি নীরদ সি চৌধুরী তার “আত্মঘাতী বাঙ্গালি” গ্রন্থে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, “বাঙ্গালি বিলুপ্তির হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমরা জানি না যে, কিভাবে এই বিলুপ্তি ঘটবে. কোন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে, নাকি ধীর অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে।”

Published in Uncategorized

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *