Skip to content →

তিন যুগ পেরিয়ে চতুর্থ যুগে পা ফেলা

কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরুলাম। একটি প্রেমপত্রও কেউ লিখেনি। কখনো কোন মেয়ের কাছে প্রেম ভিক্ষা করে আমিও লিখিনি। সৌন্দর্যের অনুরাগী হলেও কোন সুন্দরীকে কখনো বলিনি বা বলতে পারিনি “লাখো হাসিন হ্যায় লেকিন তুম কিউ পছন্দ হো,” অথবা আকাংখা প্রকাশ করে কাউকে বলা হয়নি “তুঝসে মুঝকো চাহনেওয়ালা ইস দুনিয়া মে কোঈ আউর হ্যায়?” ধরেই নিয়েছিলাম, “হাম হি নেহি হ্যায় পিয়ার কি কাবিল।” বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বন্ধুকে দেখতাম এক প্রেমিকা ছেড়ে আরেক প্রেমিকা ধরছে।

এরই মধ্যে আমার এক বন্ধু, দূরে থাকে, তার সাথে আমার নিয়মিত পত্রালাপ হয়। একবার তার বাড়িতেও বেড়াতে গেছি। তার এক বোন আমার একটি ছবি চেয়ে চিঠি লিখলো। আমি ছবি পাঠালাম, ছবির সাথে একটি চিরকূট দিলাম, ‘ছবি চেয়েছো দিলাম, কখনো আমাকে চেয়ে বসো না।’ ক’দিন পর ছবিটি ফেরত এলো, সাথে একটি চিরকূট, তাতে লিখা, ‘আপনি কিছু চাইতেও পারেন না, দিতেও পারেন না।’ তাতে জীবন টা যে পানসে হয়ে গেছিল তাও নয়। সবসময় ব্যস্ত থাকতাম। ক্লাস, পরীক্ষা, চাকুরি, বই পড়া, কিছু লিখা। প্রেম করার অবসরই বা কোথায়! তাছাড়া চিরকুমার থাকারও একটা ইচ্ছা ছিল আমার। শৈশব থেকেই আমার এলাকায় অনেক হিন্দু চিরকুমার সজ্জন ব্যক্তিকে দেখে আমি তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। তারা সবাই কমিউনিজমে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে কখনো কোন অভিযোগ উঠেছে এমন শুনিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও দেখলাম প্রফেসর রাজ্জাক স্যার, ওদুদুর রহমান স্যার, আবু মাহমুদ স্যার, মুনিরুজ্জামান মিয়া স্যার চিরকুমার। প্রত্যেকে শিক্ষক হিসেবে সবার আদর্শ। বিশ্ববিদ্যালয়ে মহীরুহ। শিক্ষকতাই তাদের ধর্ম।

প্রত্যেকের সাথে কোন না কোন পর্যায়ে আমার কথা হয়েছে। তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি, কারো সাথে ঘনিষ্টতাও গড়ে উঠেছিল। বিমুগ্ধ মগ্নতায় তাদের কথা শুনতাম। তাদের পদধূলি হওয়ার যোগ্যতা নেই আমার।
আমি যুধিষ্ঠির ছিলাম না। মহাভারতের পঞ্চ পান্ডবের জ্যেষ্ঠ ভাই যুধিষ্ঠিরকে ভালোবাসতো এক তরুণী। কিন্তু যুধিষ্ঠির বিয়ে বা নারীসঙ্গ থেকে নিজেকে বিরত রাখান পণ করেছেন। সেই তরুণী প্রেম নিবেদনে ব্যর্থ হয়ে এই আশায় যুধিষ্ঠিরের গুরুর কাছে যায় যে, যুধিষ্ঠির গুরু আজ্ঞা অগ্রাহ্য করতে পারবেন না। গুরু যুধিষ্ঠিরকে তলব করে তাকে আদেশ করেন তরুণীর পাণি গ্রহণ করতে। যুধিষ্ঠির তার সিদ্ধান্তে অটল। গুরুর আদেশ পালন যে অবশ্য কর্তব্য তা স্মরণ করিয়ে দেন। যুধিষ্ঠির গুরুকে বলেন, “মা আমার গুরু, বাবাও আমার গুরু, আমি তাদের আদেশে বিয়ে করিনি। আপনার আদেশেও করতে পারবো না।” গুরু তাকে অভিশাপ দেন। যুধিষ্ঠিরও গুরুকে পাল্টা অভিশাপ দেন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠিরকে অন্যভাবে নারী সঙ্গ লাভ করতে হয়। ছোটভাই অর্জুন যখন পাঞ্চলার রাজকন্যা দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত হয়ে তাকে জয় করে বাড়িতে এনে মা কুন্তিকে বলেন, ‘মা, দেখো কি এনেছি।” মা প্রার্থনারত ছিলেন, তিনি পেছনে না ফিরে বলেন, ‘যা এনেছো সবাই ভাগ করে নাও।’ মাতৃ আজ্ঞায় দ্রৌপদী পঞ্চ পান্ডবের স্ত্রী হন। যুধিষ্ঠিরের এক পুত্রও জন্মগ্রহণ করে তার গর্ভে। সেই পুত্র এক যুদ্ধে নিহত হন। পরবর্তীতে যুধিষ্ঠির দেবিকা নামে এক নারীকে বিয়ে করেন।

অনুরূপ আরেকটি কাহিনী পাঠ করেছি। এক তরুণ সুদর্শন সন্যাসী ধ্যানমগ্ন থাকেন। ভক্তরা আসে, প্রনাম করে, আশির্বাদ নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে এক তরুণী ভক্ত সন্যাসীর প্রেমে পড়ে। ভক্তদের ভিড় কমলে সন্যাসী যখন নি:সঙ্গতার আশ্রয় নেন তখন তরুণী তার প্রেম নিবেদন করে। সন্যাসী মানেই ব্রক্ষ্মচর্য, সংযম পালনের ব্রত গ্রহণ করেছেন, যার অন্যতম ইন্দ্রিয় সংযম। কিন্তু তরুণীর নিবেদন তার শরীরে কাঁপন ধরায়, ইন্দ্রিয় জেগে উঠে। পরক্ষণেই তিনি তার সাধনা সম্পর্কে সচেতন হন। তরুণীকে বলে কয়ে বিদায় দেন। তরুণী আবার আসে, তার কামনা ব্যক্ত করে। সন্যাসী ভাবেন দৃষ্টিই ইন্দ্রিয় সংযমে তার সিদ্ধ হওয়ার বাধা। তরুণীকে দেখতে পান বলেই তার দেহ জাগ্রত হয়। তিনি নিজের চোখ খুঁচিয়ে অন্ধ হয়ে যান। তাতেও তরুণীর প্রেমে ভাটা পড়ে না। তিনি আসেন, যে কোন অবস্থায় সন্যাসীর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। তরুণীর স্পর্শে অন্ধ সন্যাসীর ইন্দ্রিয় চেগিয়ে উঠে। কিন্তু না, তাকে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতেই হবে। একদিন তিনি একটি পাথরের উপর তার বিশেষ অঙ্গ স্থাপন করে আরেক পাথর দিয়ে সেটি ছেঁচে ফেলেন। হতাশ তরুণী হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।


আমি যুধিষ্ঠির নই (যদিও যুধিষ্ঠির পণ ভঙ্গ করে নারী সংসর্গ লাভ করেন), সন্যাসীও নই। সকল মানবিক দুর্বলতা আমার মাঝে সদর্পে বিদ্যমান। জীবনের একমাত্র প্রেমপত্রটি (আসলে প্রেমপত্র ছিল না, পরামর্শ পত্র) লিখলাম আমার উপকারভোগী এক মেয়েকে। এটাও বন্ধুর বোন। তেমন সুন্দরী নয়, তবে ভালো ছাত্রী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ফেল মারলো। ছাত্রত্বের সাথে সাংবাদিকতার তকমা থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল বিভাগীয় প্রধান ও প্রশাসনের পদস্থ ব্যক্তির সাথে আমার ঘনিষ্টতা ছিল। মেয়েটির এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজ দেখিয়ে কোনমতে ভর্তির ব্যবস্থা করা গেল। সে কাহিনী দীর্ঘ। এ কাজে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিলেন আমাদের প্রিয় রতন দা (ঢাবি সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান রতন), যিনি। মেয়েদের হলে আমার বন্ধুর প্রেমিকার সাথে ডাবলিং করার ব্যবস্থাও করে দিলাম। সব ব্যবস্থা পাকা করে দেয়ার পরই আমার পত্র বাণ নিক্ষেপ করেছিলাম। কোন উত্তর তো পেলামই না, পেলাম আঘাত। রীতিমতো শরাঘাত। বুয়েটের এক ছাত্রের সাথে তার আগে থেকেই আশনাই চলছিল। কি রহস্যময় নারী চরিত্র! কিন্তু এই যে কয়েকটি মাস আমার উপর দিয়ে ধকল গেল, ওই প্রেমিক প্রবরের টিকিটিও দেখিনি। ক্লাস শুরু হওয়ার পর দেখি দু’জন হাত ধরাধরি করে ক্যাম্পাসে হাঁটছে। তাতে আমার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি।


এরপরও কি আমার মনে বিয়ের সাধ জাগা উচিত ছিল? বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে এখন থেকে ৩৬ বছর আগে আরেক মেয়ের সাথে দেখা। অল্পতেই ভালো লাগা। আমার জীবনে যেহেতু “মন দেয়া নেয়া অনেক করেছি, মরেছি হাজার মরণে, নূপুরের মতো বেজেছি চরণে চরণে,” ধরণের কোনকিছু নেই, অতএব কালক্ষেপণ নিরর্থক। আমার ভগ্নিপতিকে বললাম মেয়েটির তত্ত্বতালাশ নিতে। আম্মাকে লিখলাম ঢাকায় চলে আসতে। মাস খানেকের মধ্যেই দুই পরিবারের জনা কয়েক সদস্যের উপস্থিতিতে নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত বিয়ে। ‘দিল্লির লাড্ডু’ নয়। খেয়ে বা না খেয়ে পস্তানোর কিছু নেই। জীবনের নানা উত্থান-পতনের পরও পরীক্ষার শেষ নেই। এখনো শিখছি। এভাবেই

Published in Uncategorized

Comments are closed.