Skip to content →

প্রিয়ভাজন মাহমুদ এর “মোগলনামা” ও আমার নিবেদন

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ফেসবুকে মাহমুদ ছেলেটার সাথে আমার পরিচয় আট ন’মাস আগে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে কঠিন সাবজেক্টে পড়াশোনা করে। ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং। আমার মতো মোটা বুদ্ধির মানুষের মাথায় ঢোকার বিদ্যা নয়। ওর যে বিষয়টি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা ফেসবুকে ওর পোষ্ট। যেসব বই সে পাঠ করেছে, ওইসব বইয়ের ওপর পান্ডিত্যপূর্ণ পর্যালোচনা। বই তো অনেকেই পড়ে। জানার জন্য পড়ে, বিনোদনের জন্য পড়ে, শুধু সময় কাটানোর জন্যই পড়ে। আবার অনেক সৌখিন বই ক্রেতা ড্রয়িং রুমের শেলফে সাজিয়ে রাখার জন্যই বই কেনে। এরপর আর ছুঁয়েও দেখে না। ক্রেতা ব্যক্তিটির মৃত্যুর অল্পদিন পরই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই বইগুলো ফুটপাথের পুরনো বইয়ের দোকানে কিনতে পাওয়া যায়।


মাহমুদ ভিন্ন ধরনের তরুণ। ওর বইয়ের আলোচনার গভীরতা আমাকে টানে। আমি মুগ্ধ-বিস্মিত হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন বিষয় চর্চার পাশাপাশি সিলেবাসের বাইরে এতো পড়ার সময় পায় কী করে! পর্যালোচনার ধরনে মনে হয়, সে যা পাঠ করে, তা হৃদয়ে গেঁথে ফেলে। ওর সাথে কথা হয়। প্রথমে ফেসবুকের ইনবক্সে। পরে ম্যাসেঞ্জারে। কথা বলা এখন কতো সহজ। ৩০ বছর আগে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে কিছু পড়াশোনা করতে এসেছিলাম, আমার পুরো অবস্থানকালে আমার মায়ের সাথে একটা দিনের জন্যও কথা বলতে পারিনি। মাহমুদের সাথে যতো কথা হয়, আমার মুগ্ধতা ততো বাড়ে। ওর পাঠাভ্যাসের আওতায় নেই, এমন কোনো বিষয় কী আছে? মিথলজি, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য। সব ক্ষেত্রে ওর বিচরণ। মুভিও দেখে। ওইসব বিষয়ে আলোচনা করার দক্ষতাও ওর আছে।


আমি মাহমুদের প্রেমে পড়ে যাই। ওর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ৪০ বছরেরও বেশি। বয়সের ব্যবধান বড় কথা নয়। বাংলাদেশে পাঁচটি ভিন্ন বৈশিষ্টের মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে আমার সিনিয়র, সমবয়সী বা জুনিয়র অনেক সহকর্মী সংখ্যা অনেক। কিন্তু বন্ধু একজনও নেই। একজন মাত্র নিবিড় বন্ধু আছে আমার, যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদ থেকে মাস ছয়েক আগে অব্যাহতি নিয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ফিরে গেছে। ৪৭ বছর আগে আমি ওকে যেভাবে চাইতাম, এখনো একইভাবে ওকে চাই। সেও আমাকে একইভাবে চায়। এর বাইরে যারা আমার বন্ধু তারা আমার চেয়ে ২০ থেকে ৪০ বছরের ছোট। হঠাৎ করেই আমার মাঝে এ ধরনের অসম বন্ধুত্বের আবেগ সৃষ্টি হয়েছে এমন নয়। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন আমার বন্ধুরা পড়তো ক্লাস ফোর, ফাইভ, সিক্সে। ছেলে মেয়ে সবাই ছিল। দেশের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ওরা। আমাদের মাঝে প্রচুর চিঠি বিনিময় হতো। অনেক সময় ওইসব বন্ধুর বাড়িতে হাজির হতাম। অভিভাবকরা যথেষ্ট সম্মান করতেন। ওই বন্ধুগুলোর গুটিকয়েক ছাড়া সবাই এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। সবার সাথে যোগাযোগ নেই। এখনো ছোটরাই আমার বন্ধু।


মাহমুদের লেখালেখির অভ্যাসের কথা জানতে চাইলে সে মোগলদের ওপর একটা কাজ করছে বলে জানায়। আমি আরো আগ্রহী হই। মোগল রাজবংশ আমার অবসেশন। শেষ মোগল বাহাদুর শাহ জাফর ও সিপাহি বিদ্রোহের ওপর আমি বেশ ক’টি বই অনুবাদ করেছি। অনুবাদ করা ছাড়া মৌলিক কিছু লেখার যোগ্যতা আমার নেই। মোগলদের ওপর যথেষ্ট বই পড়েছি। পড়ার সময় মোগল সাম্রাজ্যে বিচরণ করেছি। দিল্লিতে কিছু পড়াশোনা করতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়ায় চাইতে মোগল স্থাপত্য ঘুরে ঘুরে দেখেছি। লাল কিল্লার কোথায় সম্রাট শাহজাহান কোথায় বসতেন, আওরঙ্গজেব ছোট্ট যে মসজিদে ধ্যানস্থ থাকতেন, জেনানা, নহবতখানা, মীনাবাজার। কিল্লা থেকে অদূরে জুমা মসজিদ, চাঁদনি চক। পুরানা কিল্লা। নিজামুদ্দিন আউরিয়ার মাজার প্রাঙ্গনে শাহজাদী জাহানারা বেগমের কবর, একটু দূর রাস্তার ওপরেই হুমায়ুনের সমাধি Ñ যেখানে মেজর হাডসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বিশাল ফটকের কোণার ছোট দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছেন, যতোবার গেছি, ততোবার দুর্গ সদৃশ সমাধি থেকে বের আসতে আমি যেন সেই দৃশ্য অবলোকন করেছি। আগ্রা দূর্গে সম্রাট শাহজাহানকে যেখানে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে শাহজাহান তাজমহলের পানে তাকিয়ে আছেন অসহায়ের মতো। আরো কিছু দূরে ফতেপুর সিক্রি, আকবরের রাজধানী, দুর্গ, যোধা বাইয়ের প্রাসাদ। সেকেন্দ্রাবাদ, যেখানে আকবর শায়িত। লাহোরে গিয়েও মোগল স্থাপত্যই দেখেছি। অন্য কিছুতে মন টানেনি। লাহোর কিল্লা, বাদশাহী মসজিদ, শালিমার বাগ, জাহাঙ্গীরের সমাধি, আনারকলি বাজার।


আমি তো শুধু দেখেছি। পরিব্রাজকের চোখে। কিন্তু মাহমুদ বাস্তব রূপ দিয়েছে ওর সদ্য প্রকাশিত “মোগলনামা” গ্রন্থে। প্রকাশিত হওয়ার ছ’মাস আগে আমি ওর পান্ডুলিপি পাঠাতে বলি। তখনো লেখা শেষ হয়নি। আমাকে কয়েকটি অধ্যায় পাঠায়। আমি অবাক বিস্ময় নিয়ে পাঠ করি। এই ছোট্ট ছেলেটির পক্ষে কী করে সম্ভব হলো এমন একটি বিষয়ের ওপর সাবলীল বর্ণনা তুলে ধরা! মোগলদের ওপর কী বিস্তর পড়াশোনা করতে হয়েছে ওকে! মাহমুদের বইটি এখনো পুরোটা আমার পড়া হয়নি। “বিটুইন দ্য লাইনস” বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, “মোগলনামা” সঠিক অর্থে তাই। এটি ইতিহাস নয়। ইতিহাস কেন্দ্রিক বই। ইতিহাস গ্রন্থে প্রধান চরিত্র এবং তার প্রধান প্রধান কাজগুলোই মূখ্য হয়ে উঠে। পার্শ্বচরিত্র কিছুটা স্থান পায়। ছোটখাট চরিত্রগুলোর কথা কেউ মনেও রাখে না। মাহমুদের “মোগলনামা” ছোটখাট সেই চরিত্রগুলো এবং আড়ালের ঘটনাগুলোও তার বর্ণনা ভঙ্গিতে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলে বইটিকে সুখপাঠ্য করেছে। পাঠকরা ইতিহাস ও উপন্যাস দুটির স্বাদই পাবেন বলে আশা করি। আবারও অভিনন্দন মাহমুদ।


[দ্রষ্টব্য: মাহমুদ বিড়ি টানে। বিড়িখোর বন্ধু আমার খুব একটা নেই। একেবারে ছোটবেলায় পাড়ার সমবয়সী পোলাপান বিড়ি টানতো। টেন্ডু পাতায় মোড়ানো বিড়ি। আমার বড় ভাইও ছিল। আমি বিড়ি টানতে চাইতাম না। কিন্তু জোর করে টান দিতে বাধ্য করতো। কারণ আমি বিড়ি টানলে আম্মার কাছে ভাইয়ের বিড়ি খাওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ করতে পারবো না। কিন্তু আম্মাকে বলে দিতাম। বড় ভাই তখন মার দিয়ে বলতো, আবার বললে ‘বড় আড়া’য় বেঁধে রাখবে। বড় আড়া মানে টিলার জঙ্গলবেষ্টিত জায়গা। ভয়ে একা বড় আড়ায় যেতাম না। অনেক শেয়াল থাকতো ওখানে। ছোট খাট বাঘ ছিল বলেও তখন বিশ্বাস করতাম। যাই হোক, আমি বিড়ি খাওয়া শিখিনি। পেশা জীবনে এসে বাংলাদেশ-আমেরিকান টোবাকো’র সিগারেটের কার্টুন উপহার পেতাম প্রায় নিয়মিত। দোকানে পুরো কার্টুন বিক্রি করে দিতাম।]
হিতোপদেশ: মাহমুদ, বিড়ি ছাড়ো!

Published in Uncategorized

Comments are closed.