Skip to content →

শের ও শায়েরি এবং জাহিদুল ইসলাম বিশ্বাস এর মন্তব্য


জাহিদুল ইসলাম বিশ্বাস একজন আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক। তার সাহিত্যানুরাগ আমাকে প্রীত করেছে। দিল্লিতে পড়াশোনা করেছেন। দীর্ঘ সময় দিল্লিতে অবস্থানের সুযোগ হয়েছে তার। কাছে থেকে সেই নগরী ও নগরবাসীদের দেখেছেন। আহা, আমার যদি সেই সুযোগ হতো! উর্দু ভাষার কয়েকজন খ্যাতিমান কবির কবিতার উর্দু উচ্চারণ এবং বাংলা অনুবাদ করে দেয়া আমার পোষ্টে বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি এবং ক’জন বন্ধু ও অনুরাগী মন্তব্য করেছেন। অনুবাদে কিছু ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন। জাহিদুল ইসলাম বিশ্বাস তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন মন্তব্যে। মন্তব্য হিসেবে দেয়ায় অধিকাংশ ফেসবুক বন্ধুর অগোচরে রয়ে যাবে ভেবে আমি তার মন্তব্যের সাথে আমার বক্তব্য জুড়ে দেয়ার সুযোগ গ্রহণ করলাম।

শাসক শ্রেণীর নানারকম হাতিয়ার থাকে জনগণকে দাবিয়ে রাখার জন্য। শাসকের নিজস্ব ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা তার একটি। ইংরেজরা উপমহাদেশের শাসক হওয়ার আগে ফারসি ছিল রাষ্ট্রীয় ভাষা। মোগলদের সরকারি কাজকর্ম সবই চলতো ফারসিতে। কিন্তু শেষ দিকের মোগল শাসকরা তাদের নিত্যদিনের ব্যবহার্য ভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করেছিল এবং তা বেশি পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সময়ে। তিনি নিজেও উর্দু কাব্য চর্চা শুরু করেন। ইংরেজরা বহু কিছু পরিবর্তন করলেও বিচারিক কার্যক্রমে ফারসি ভাষাকে পুরোপুরি পরিহার করতে পারেনি শেষ পর্যন্ত। পূর্ববঙ্গের বা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীরা ফারসি বা ইংরেজির বিরুদ্ধে শত শত বছর প্রতিবাদ না করে পাকিস্তান হওয়ার এক বছরের মধ্যে কী কারণে উর্দুর বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছিল তা শুধু জিন্নাহ’র রাষ্ট্রভাষার ঘোষণার কারণে বলে এখনো আমার মনে হয় না। এটা হয়েছিল হীনমন্যতা থেকে। ভারত বিভক্ত করে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার ক’জন নেতা ছিলেন? ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব বাড়িতে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই নবাবরা ছিলেন উর্দুভাষী। ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্যরা এখনো যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তাদের পারিবারিক ভাষা উর্দুই রয়ে গেছে। আমরা “বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলা”র নামে এখনো পাগল। তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী। তার পরবর্তী নবাব মীরজাফর, নবাব মীর কাসিমও ছিলেন উর্দুভাষী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যে দুই শীর্ষ বাঙালীর নাম আমরা জানি, তারা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। সোহরাওয়ার্দি ছিলেন উর্দুভাষী। এই দু’জন এবং তাদের সাথে মাওলানা ভাসানিসহ আরো কিছু ছোটখাট নেতা থাকলেও তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়ে ভারত ১৯৪৭ সালে বাংলাদেশকে যদি স্বাধীন করা সম্ভব হতো তাহলে বৃটিশ যুগ থেকে যারা ভারতের বিভিন্ন অংশে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে আসছিল, তারাও আগে পরে স্বাধীন হতো। তারা এখনো ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এবং স্বাধীন হতে পারছে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন সহজতর হয়েছে। একাত্তরে না হলেও আর কিছুকালের মধ্যেই যে স্বাধীন হতোই তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এটি বিরাট এক রাজনৈতিক ইস্যু। রাষ্ট্রবিজ্ঞানিদের গবেষণা ও বিশ্লেষণের বিষয়। আমি যদি উপমহাদেশের সাহিত্যের মধ্যে আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখতে চাই তাহলে অবশ্যই একথা বলবো যে, উর্দু উপমহাদেশের সবচেয়ে নতুন ভাষা হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যকে যেভাবে সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে পুরনো অনেক ভাষা তা করতে পারেনি। বিশেষ করে উর্দু শের বা কবিতার শক্তি এতোটাই যে শাহী দরবার থেকে কিভাবে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে গেছে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ওই সময়ে তো উর্দু কোন দেশের বা কোন জাতির রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা ছিল না। নীরবেই ঘটনাটি ঘটে গেছে। কেউ চাপিয়ে দেয়নি। সমাজের খুব নিচু স্তরের লোকজন নাপিত, মুচি, মেথর, ফুটপাতে বসা দোকানিও শায়েরির সমঝদার। মীর তকী, গালিব, জউক এর শের মুখে মুখে বলতে পারে তারা। মায়ের ভাষা ভিন্ন অন্য ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হোক তা কেউ চায় না। পূর্ব পাকিস্তানিরাও চায়নি। অতএব ’৪৮ এ ‘নো, নো’ বলেছে, ‘৫২ তে পাকিস্তানি (বাঙালী) পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়ে বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ না করার সঙ্গে উর্দুকে এবং সেই সাথে উর্দুভাষীদের ঘৃণা করার সংস্কৃতি আমাদেরকে পিছিয়ে দিয়েছে অনেকখানি। মধ্য যুগের এক পুঁথি লেখক যদিও “যে জন বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গ বাণী, সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন’ জানি” ধরনের কথা বলে বাংলাভাষীদের উস্কে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাকে আধুনিক পর্যায়ে আনতে অনেক কঠখড় পোড়ানোর পর বাংলা ভাষা এখন হিন্দি ভাষার কবলে পড়ে হযবরল হয়ে যাচ্ছে। হিন্দির এই প্রভাব ঠেকানোর চেষ্টা করেও যে খুব লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। এর কারণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দৈন্যতা। আমাদের সাহিত্য উচ্চ মার্গীয় এবং দুর্বোধ্য; সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। হৃদয় উৎসারিত নয় বলে বাংলা কবিতা সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌছে না।

দিল্লিতে আমার অবস্থানকাল আপনার মতো দীর্ঘ ছিল না। মাস ছয়েকের (১৯৯২-৯৩) একটি কোর্স করতে দিল্লিতে যাই এবং প্রথম দিকে নিজামুদ্দিনে কাটাই; মির্জা গালিবের (যা এখন গালিব একাডেমী) বাড়ির পাশেই। গালিবের বেশ কিছু শের আগেই পড়া ছিল। হিন্দি কিছু জানতাম বলে গালিবের কবিতার হিন্দি অনুবাদ বই কিনে গোগ্রাসে পড়তে থাকি, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে সান্ধ্য কাওয়ালিতে প্রায় প্রতিদিন হাজিরা দেই। রাস্তার ওপারে হুমায়ূনের মাজারে ঘুরে বেড়াই। কাঠের বিশাল গেটের এক প্রান্তের ছোট্ট দরজা দিয়ে যতোবার বের হয়ে এসেছি ততোবার প্রায় চোখে দেখার মতো মনে হয়েছে বাহাদুর শাহ জাফর এই দরজা দিয়ে বের হয়ে আসছেন, মেজর হাডসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। এরপর নিজামুদ্দিন ছেড়ে একটু দূরে আজাদ মার্কেট ছাড়িয়ে কানহাইয়া নগর চলে যেতে হয়। তখনো ছুটির দিনগুলোতে যেতাম দরিয়াগঞ্জে, ইংরেজি বা হিন্দি ভাষায় উর্দু কবিদের বই খুঁজতে। জামা মসজিদের পাশে করিম’স খেতে।
এরপরও কোন কনফারেন্স, সেমিনারে দিল্লিতে গেছি অনেকবার, ১৫/১৬ বার তো হবেই। কিন্তু এসব কনফারেন্স হতো বিজ্ঞান ভবন অথবা হ্যাবিটেট সেন্টার, বা ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে। তবুও আগে দেখা মোগল সৌধগুলো দেখতে বারবার ফিরে গেছি। বই কিনতে আর দরিয়াগঞ্জে যাওয়া হয়নি। তখন কিনতাম খান মার্কেটে। বেশির ভাগই উর্দু কবিদের কবিতার ইংরেজি বা হিন্দি অনুবাদ। উর্দু শিখতে না পারার আফসোস জীবন ভর রয়ে যাবে। মূল উর্দু থেকে শের এর স্বাদ নেয়ার মজাই আলাদা। দিল্লিতে যতোবার গেছি, ততোবার মনে হয়েছে, শত শত বছরের পরও দিল্লি এখনো মোগল দিল্লিই রয়ে গেছে।

Published in Uncategorized

Comments are closed.