আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রবাসে সতীর্থের মতো আপনজন আর হয় না। এমনকি আপনজনের সাথেও যা ব্যক্ত করা যায় না, সকল সতীর্থকে তা জানাতে দ্বিধাবোধ হয় না। নিউইয়র্কে আট বছর কাটানোর পর পরিচিত একজন জানতে চাইলেন, নূর মোহাম্মদ নামে কাউকে আমি চিনি কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। অবশ্যই চিনি। দীর্ঘদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন। কোথায় থাকেন জানি না। উনি বললেন, আমরা সহকর্মী। একই স্কুলে শিক্ষকতা করি। একদিন স্কুল শেষে উনার সাথে আমার অফিসে আসলেন নূর মোহাম্মদ। কাছেই তার বাসা। কাজেই সিটির উজান ভাটিতে যেতে হয়নি। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর পর দেখা। টিপটপ থাকতেন। চোখে অধিকাংশ সময় কালো চশমা পরতেন। তার কাছ থেকেই খোঁজ পেলাম, আমাদের ক্লাসের আর কে আমেরিকার কোথায় আছে। দুই সহপাঠি মুশতাক ও লীরা (দম্পতি) নিউ জার্সি থাকে ঢাকা থেকেই জানতাম।
খাজা ইয়াওয়ারের কথা জানতাম। আমার জানার বাইরে যারা থাকে তাদের নাম জানলাম নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে ÑÑ আলাউদ্দিন, হালিম ও আজাদ নিউইয়র্কেই থাকে। ইতোমধ্যে আমাদের ব্যাচের একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলা হয়েছে বলে জানালেন নূর মোহাম্মদ। এই গ্রুপে প্রবেশ করে ঢাকায় কথা বললাম তসলিম, মুখলেস ভূঁইয়া, আবদুল হালিম মুন্সী, সালাহউদ্দিন মাহমুদ, নূরুল আমিনের সাথে। গ্রুপ থেকেই জানা গেল রীনা গুরুত্ব অসুস্থ, কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রস্তুতি চলছে (ইতোমধ্যে ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়ে গেছে)। খালেদার স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থতায় কাটিয়ে ইন্তেকাল করেছেন (আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন)। আরো কয়েকজনকে টেক্সট দিয়ে রাখলাম। নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে প্রায়ই কথা হচ্ছিল। লীরা, মুশতাকের সাথেও কথা হলো। সুইডেন থেকে খোরশেদুজ্জামান আফ্রাদ কল দিয়েছিল। ধরতে পারিনি। পরে আমি কলব্যাক করে কথা বলেছি। লীরার কাছে জানতে পারি খালেদা কানাডায় এসেছে ছেলের কাছে। নিউইয়র্কে তার আসার কথা আছে। খালেদা যখন আসবে আমরা যারা এখানে আছি তারা একসাথে বসতে পারি কিনা সে বিষয়ে নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করি। উনি অন্য সবার সাথে কথা বলেন। বসার স্থান হিসেবে আমার অফিসের প্রস্তাব দেই। ১৫/১৬ জন হলেও অসুবিধা হবে না। পাশেই হিলসাইড এভিনিউয়ে অনেক রেষ্টুরেন্ট, বন্ধু আপ্যায়নে ত্রুটি হওয়ার কথা নয়।
তারিখ: ২৩শে জুন রোববার বিকাল। সতীর্থ সংখ্যার বিচারে একেবারেই ছোট আকারের পুনর্মিলনী। বড় নয়, আবার মিনি নয়। আজাদের ব্যস্ততা ছিল, আসতে পারেনি। হালিমকে পাওয়া যায়নি। আলাউদ্দিনের সাথে ঢাকায় হঠাৎ হঠাৎ দেখা সাক্ষাত হয়েছে বলাকা ভবনের করিডোরে বা সিড়িতে। রিপোর্টার হিসেবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার কর্মস্থলে আমাকে নিয়মিত যেতে হয়েছে। ভাবীসহ এসেছিল সে। মুশতাক ও লীরার সাথে দেখা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর এই প্রথম। লীরা আগেই মতোই প্রাণচাঞ্চল্যে উচ্ছল। কয়েক সপ্তাহ আগে লীরাকে বোন বানিয়ে ফেলেছি, আমার গিন্নিকে বলে দিয়েছি, তোমার যা প্রয়োজন ও দাবী আমার বোনকে জানাবে। ওই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ফোন করেছিল আমার মেয়ে দীয়া। সবার সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার সময় লীরার পালা এলে বললাম, ‘সবাই আন্টি, কিন্তু এটা ফুফু। বিশ্ববিদ্যালয়ে সদাহাসিমুখ খালেদা ওর জীবনের উপর সাম্প্রতিককালে বয়ে যাওয়া ঝড়ে বেশ বিপর্যস্ত। শেষবার যখন ঢাকায় দেখি, তখনো ওর হাসি ছিল অমলিন। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর রিপা’র সাথে বছর চারেক আগে নিউইয়র্কে। জ্যাকসন হাইটসে ম্যাকডোনাল্ডসে একাধিক দিন তার ও তার স্বামীর সাথে একত্রে বসে কফি খেয়েছি। রিপা’কে চেনা চেনা মনে হয়েছে, কিন্তু কোন কিছু বলিনি। কামাল ভাই এর স্ত্রী। কামাল ভাই আমাদের অগ্রজ সাংবাদিক। বহুদিন ধরেই পরিচিত। সবাইকে ঘটনাটি বললাম। সবাই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের স্মরণীয় কিছু ঘটনা বললো। স্মৃতিচারণের জন্য সময় দীর্ঘ ছিল না। খালেদাকে লং আইল্যান্ডে পৌছে দেবে মুশতাক-লীরা এবং যাবে নিউ জার্সিতে নিজেদের বাড়িতে। আমার ও নূর মোহাম্মদ ভাইয়ের আয়োজনে যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা ছিল। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে ত্রুটির উর্ধে থাকতে চেষ্টা করবো। সেজন্য সকলের পরামর্শ ও সহযোগিতা আশা করছি। বাংলাদেশে আমাদের সকল সহপাঠিকে আমরা ভালোবাসার সাথে স্মরণ করেছি। তাদের নিয়ে কথা বলেছি। আমরা সবার জন্য দোয়া করি সবাই যাতে আল্লাহ রহমতে ভালো থাকে; আমরা প্রত্যেকের দোয়া কামনা করছি।
পুনশ্চ: বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৩-৭৪ ব্যাচে যারা অনার্সে ভর্তি হয়েছিল, তারা স্বাভাবিক নিয়মে, পূর্ণ কারিকুলাম অনুসরণ করে পূর্ণ নম্বরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে, ভালো ফলাফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে এবং ভর্তির সকল প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ন ভর্তি হয়েছিল। এর আগের দুটি ব্যাচে যারা ভর্তি হয়েছিল তারা (কনডেন্সড কোর্স খ্যাত) উচ্চ মাধ্যমিকে সাকুল্যে ২০০ নম্বরের পরীক্ষা দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাও ছিল অনুরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ওই দুটি বছর তেল ও ঘি সমান দামে কেনাবেচনা হয়েছে। তবে সেশন জট লেগে গিয়েছিল স্বাধীনতা তখন থেকে। আরও আগে থেকে বলা যায়, ১৯৬৯ এর গণ আন্দোলনের সময় থেকে জট বাঁধতে শুরু করেছিল। ক্লাস হয়নি, পরীক্ষা হয়নি। ১৯৭১ এ তো প্রশ্নই ছিল না। অতএব জটের অনিবার্যতা অস্বীকার করা যায় না। আমরা যদিও নিজেদেরকে ৭৩-৭৪ ব্যাচের বলে দাবী করি, আসলে তা এক সেশন এগিয়ে বলি। ১৯৭৩ এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক ছিল না। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাই তো হয়েছে ১৯৭৪ এর মার্চ-এপ্রিলে। আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অবস্থান করে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। ’৭৪ এর ৪ এপ্রিল মোহসীন হলে ৭ জন ছাত্রলীগ নেতাকে প্রতিপক্ষ গ্রুপ হত্যা করে। বিশ্বদ্যিালয় বন্ধ ও হল খালি করে দেয়া হয়। তখনো আমার দুটি পরীক্ষা বাকি ছিল। একজন মাত্র পরিচিত লোক ছিলেন বাড্ডায়। তার বাসায় কাটিয়ে দুটি পরীক্ষা দিয়ে বিদায় নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হতে পারতো ১৯৭৩ সালের প্রথম দিকে। তবুও সবদিক বিচার করে ৭৩-৭৪ ব্যাচের আমরা, অন্তত আমি গর্বিত অনুভব করি যে, ‘কনডেন্সড কোর্স’ এর মতো খয়রাতি পরীক্ষায় আমাদেরকে পাস করতে হয়নি এবং কোন তরফের তদবীরে বা কোন দলের মিছিল মিটিং এ অংশ নেয়ার দাসখত দিয়ে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হয়নি বা হলে সিট নিতে হয়নি। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তবেই ভর্তি হয়েছি। সেদিক থেকে মেধা ও মননে আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা নিজ নিজ মেধা ও যোগ্যতায় উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু অনার্স ও মাষ্টার্সের চার বছরের পরিবর্তে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন ছিল দীর্ঘ সাত বছরের। আমাদের বন্ধুত্বের নিবিড়তার পেছনে এটিও একটি কারণ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যারা সিভিল সার্ভিসে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষকতা করেছে, ব্যবসায় যোগ দিয়েছে – প্রত্যেকে সফল হয়েছে। যেখানে তাদের হাতের স্পর্শ পড়েছে তা সোনায় রূপান্তরিত হয়েছে।
Comments are closed.