Skip to content →

পদ্মা সেতু ও কল্পনার মাথা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বলা যায়, সিংহভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। মূল সেতুর ২৯৪টি পাইলের মধ্যে ২৯২টির কাজ শেষ; ৪২টি পিয়ারের মধ্যে ৩০টি ইতোমধ্যে সম্পন্ন। ১৪টি স্প্যান বসানো হয়েছে। গত ৩০শে জুন পর্যন্ত সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৮১ শতাংশ। সেতু নির্মাণের যখন এই পর্যায়ে তখন একটি দুষ্ট চক্র কী কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পদ্মা সেতু নিয়ে জনমনে ভীতি সঞ্চারের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল তা আমার বোধগম্যতার বাইরে। এ ধরনের কল্পকাহিনি ছড়ানো নতুন কোনো ঘটনা নয়।


এখনো আমার স্মরণ আছে; আমি অনেক ছোট। সবেমাত্র স্কুলে যেতে শুরু করেছি। আমাদের বাড়ি থেকে দুই মাইল দূরে, পূর্বদিকে একটি ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কাটাখালি ব্রিজ। আমাদের গ্রামের পাশ ঘেঁষে যাওয়া খালটি নির্মাণাধীন ওই ব্রিজের পরই মিলিত হয়েছে বড় একটি বিলে। ব্রিজের কাছে পৌছার আগেই খালের প্রস্থ বাড়তে থাকে এবং ব্রিজটি যেখানে দক্ষিণ দিক থেকে আসা রাস্তাকে উত্তররাংশের সাথে যুক্ত করবে সেখানে পানির বিস্তৃতি অনেক। রাস্তা দক্ষিণে গেছে শহরের দিকে এবং উত্তরে গেছে গাড়ো পাহাড়ে। বড়দের যারা দিনের বেলায় কোনো কাজে, অথবা আত্মীয়সবজনের বাড়িতে সেদিকে যায়, ব্রিজ নির্মাণকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকাজুড়ে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে তারা তা দেখে আসে। আমরা বাড়ি থেকে বা স্কুলে থাকার সময়ে ব্রিজের দিক থেকে প্রচন্ড শব্দ ভেসে আসতে শুনি। বড়রা বলেন, পাইলিং এর কাজ চলছে। পাইলিং কী আমরা ছোটরা তা জানি না। বড়দের অনেকে জানেন না। শুনে শুনে শব্দটি মনে গেঁথে গেছে।

প্রতিদিন আমরা এমন শব্দ শুনতে পাই। থেমে থেমে শব্দটা কানে আসে। একই তালে, একই প্রচন্ডতায়। আমরা আগে কখনো এমন শব্দ শুনিনি। রাতের বেলায় এই শব্দ আর থাকে না। পরদিন আমাদের ঘুম ভাঙে আগের দিন সন্ধ্যায় থেমে যাওয়া শব্দ পুনরায় শোনার জন্য। যারা সেখানে যান তারা গ্রামে ফিরে পরিচিত সবাইকে বলে বেড়ান যে, কী এলাহি কারবার তিনি দেখে এসেছেন! শ্রোতারা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শোনে এবং বাড়ি গিয়ে বউ-ঝি’দের বলার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শোনা বর্ণনার সাথে বাড়তি রঙ যোগ করে। বাংলাদেশে কেউ যদি তিলকে তাল বানিয়ে নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে চায়, তা হলে গ্রামের বউ-ঝি’দের চেয়ে সেরা মাধ্যম আর নেই। সব গ্রামেই দু’চার জন মহিলা থাকেন, যারা ‘পাড়াবেড়ানি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। তাদের অন্য কোনো নাম আমরা জানতাম না। প্রত্যেক গ্রামে কিছু ভিখারিনীও থাকেন, যারা প্রতিদিন ভিক্ষা করতে কয়েকটি গ্রামে যান এবং প্রতিদিনই ক্লান্তিজনিত কারণে অথবা ইতোমধ্যে পাড়ায় পাড়ায় শোনা কাহিনি বলার জন্য এর ওর বাড়ির ছায়ায় বসেন, কপালের ঘাম মোছেন, কূয়া থেকে পানি তুলে পান করেন; এরপর থলে বা কোচড়ে গুঁজে রাখা পান-সুপারি বের করে খান। সেখানে আরও ভিখারিনী থাকে, তারাও পান চিবোয়। পাড়াবেড়ানি একাধিক মহিলা তাদের সঙ্গ দেন। পান সেবনে ও অন্যকে সেবন করাতে বাংলাদেশের মতো উদার দেশ বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। ভিখারিনীদের বয়সানুপাতে কেউ তাদেরকে দাদী, অন্যেরা চাচী, বেশির ভাগ ‘বইন গো’ বলে ডাকে। পাড়াবেড়ানি মহিলা ও ভিখারিনীদের বয়স সাধারণত কাছাকাছি হয়ে থাকে; অতএব, ‘বইন গো’ ডাকই বেশি প্রচলিত। ভিখারিনীদের প্রায় সবাই বিধবা এবং ইতোমধ্যে তাদের সন্তানরাও মৃত। তা সত্ত্বে মৃত স্বামীর নামের চেয়ে মৃত সন্তানের মা হিসেবেই তারা পরিচিতা। দু’জনের নাম এখনো আমার মনে আছে Ñ ‘ঝাটা মন্ডলের মা’ ও ‘ইন্দুরির মা’। এমন নামের ব্যাপারে আমাদের কোনো কৌতুহল ছিল না। পান চিবুতে চিবুতে তারা তাদের কথার ঝুলি খোলেন। ব্রিজ ছাড়া ওই সময় তাদের কথায় নতুন কিছু থাকে না। কারণ, এলাকাজুড়ে সবার মনোযোগের কেন্দ্রস্থল কাটাখালি ব্রিজ। ওইদিন পর্যন্ত যে যা শুনেছে, এক এক করে তারা উগড়াতে শুরু করেন। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী কাটাখালিতে ‘মস্তবড় একটি পুল’ বানানোর কাজ চলছে; এত্তো বড় যে, এক মাথা থেকে আরেক মাথা দেখা যায় না (আসলে ব্রিজটি অতো দীর্ঘ নয়)।

মুভির কাহিনিতে যেমন টুইষ্ট থাকে বা নতুন মাত্রার যোগ হয়; কাটাখালি ব্রিজ নির্মাণের কাহিনিতেও ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হলো। কিছুদিন ধরে ব্রিজের দিক থেকে শব্দ ভেসে আসছিল না। আমাদের অভ্যস্ত কান তা মেনে নিতে পারছে না। কানে কোনো সমস্যা হয়নি তো! লোকজন কথা বলছে, চারপাশে শব্দ হচ্ছে, পাখি কিচিরমিচির করছে Ñ সবই তো শুনতে পাই। নি:সন্দেহ হওয়ার জন্য বড়দের চোখ এড়িয়ে কবুতরের কোমল পালক সরিষা তেলে চুবিয়ে কানে ঢুকিয়ে ঘোরাই। তবুও ব্রিজের দিক থেকে আগের মতো শব্দ আসে না। আমাদের কৌতুহলের অবসান ঘটান, ‘ময়ূরের বাপ’। সব গ্রামেই এ ধরনের আজব নামে কেউ না কেউ থাকে। ‘ময়ূরের বাপ’ সুঠাম গড়নের দীর্ঘদেহী মাঝবয়সী ব্যক্তি। কাছের কোনো গ্রামে তার মতো দীর্ঘাকৃতির মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। তাকে কেন ‘ময়ূরের বাপ’ বলা হয় তা আমরা কোনোদিন জানতে পারিনি। জানার চেষ্টাও করিনি কখনো। পাশের গ্রামের সম্পন্ন কৃষক, সকলের আস্থাভাজন ব্যক্তি। তিনি যে কখনো মিথ্যা বলেন না, গ্রামের সকল বয়সের মানুষ তা জানে। ব্রিজ থেকে যে শব্দ ভেসে আসতো সে সম্পর্কে অনেকেই তাকে বলতে শুনেছেন। যেখানে ব্রিজ নির্মিত হচ্ছে, সেখানে একটি “কুর” (একটি নির্দিষ্ট স্থানে পানির ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট গভীর খাদ) আছে, যার কোনো থই (তলা) নেই। এই ‘কুর’ সকল বিপত্তির কারণ। সেখানে পাইলিং (খুঁটি পোতা) এর জন্য যতো খুঁটি পোতার চেষ্টা করা হচ্ছে সেই “কুর” সব খুঁটি টেনে নিচ্ছে। অথচ ওই স্থানটিই ব্রিজের কেন্দ্রস্থল, যেখানে পাইলিং করা গেলে কংক্রিটের স্তম্ভ গেঁথে তুলতে আর সমস্যা হবে না। ইঞ্জিনিয়ার, সাব-ইঞ্জিনিয়ার, ওভারশিয়াররা গলদঘর্ম। কী করবেন! হাজারটা ব্রিজ বানিয়েছেন তারা, কোথাও এমন হয়নি। এর মধ্যেই চিফ ইঞ্জিনিয়ার স্বপ্নযোগে আদেশ পেয়েছেন; “রক্ত দাও, রক্ত লাগবে!” তার অধীনস্থরা কয়েকটি খাসি জবাই করে খাসির রক্ত “কুর” এ ঢালেন। কাজ হয়না। আবার স্বপ্নাদেশ, “মানুষের রক্ত লাগবে।” এসবের সত্যাসত্য কেউ যাচাই করেনি। তবুও সকলের রক্ত হিম হয়ে যায়। কাহিনিতে বরাবর যা থাকে Ñ এ ধরনের ঘটনায় মানুষের রক্ত চাওয়ার মানে হলো, নিস্পাপ শিশুর রক্ত লাগবে এবং তা অনিবার্যভাবে ছেলে শিশুর। মেয়েদের রক্ত কোথাও চাওয়া হয়েছে, এমন ঘটনা কেউ কখনো শোনেনি।

শিশুরা তো নিস্পাপই থাকে। পাপ স্পর্শ করার বয়সই তো তাদের হয়নি। আমরা শুনে অভ্যস্ত যে, শিশুকালে কেউ মারা গেলে সে তার মা-বাবাকে নিজ হাতে ধরে পুলসিরাত পার করাবে, মা-বাবাকে সাথে নিয়ে বেহেশতের বাগানে খেলবে। যাই হোক, মানবশিশুর রক্তের প্রয়োজনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আশাপাশের সকল গ্রামে। গ্রামের হাটেও সবাই ফিসফিসিয়ে একই আলোচনা করে। যাদের বাড়িতে ছোট বাচ্চা আছে তারা হাট থেকে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরতে চেষ্টা করে। ব্রিজের জন্য শিশুর খোঁজে লোকজন নাকি ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বড় ঝোলা কাছে ফকিরের বেশে, এলোমেলো ময়লা জটাধারী ছালা পরিহিত পাগলের বেশে। আমাদের স্কুল, আশপাশের স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। কারো সন্তান নিরুদ্দেশ হলে কে নেবে দায়িত্ব! আমাদেরকে সকাল সন্ধ্যা পই পই করে বলে দেয়া হয়, আমরা যাতে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যেই থাকি। কেউ চোখের আড়াল হলেই বাড়ির লোকজন দ্রুত খোঁজ করে তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনে। আমরা ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় কাটাই।

ঠিক এসময় ব্রিজের কাছে একটি দুর্ঘটনা ঘটলো, এবং তা ঘটলো আমাদের পরিবারে Ñ আসলে আমার নানার পরিবারে। ব্রিজটি যেখানে নির্মিত হচ্ছিল, সেখান থেকে আমাদের গ্রাম দুই মাইল পশ্চিমে, নানার বাড়ি ব্রিজের পূর্ব দিকে; ব্রিজের জায়গা থেকে মাইলখানেক উত্তরে। যেহেতু ব্রিজের নির্মাণ কাজ চলছিল, সেজন্য যানবাহন চলাচলের সুবিধার্থে ব্রিজের পশ্চিম দিকে একটি বিকল্প কাচা রাস্তা তৈরি করা হয়েছিল। নানা আমার বড় মামা ডা: মহসীন আলীর বড় ছেলে লেবু ভাইকে (তিনি তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সের ছাত্র, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে কর্মরত চিকিৎসক) নিয়ে বাসযোগে শেরপুর যাচ্ছিলেন। লেবু ভাই শেরপুর ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে পড়তেন। বিকল্প পথ দিয়ে যাওয়ার সময় কাটাখালির মুখে পৌছতেই বাসটি উল্টে কাটাখালির পানিতে ডুবে যায়। ব্রিজের কাজ থেমে থাকলেও কর্মহীন শ্রমিকরা ঘটনাস্থলে ছিল; তারা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যাত্রীদের উদ্ধার করে। নানাকেও উদ্ধার করে তারা। কিন্তু উদ্ধারপ্রাপ্তদের মধ্যে লেবু ভাই ছিলেন না। গুজবের কারণে এবং গুজবজনিত আশঙ্কায় আমার নানা বিলাপ করে লেবু ভাইয়ের নাম ডাকতে থাকেন। লোকজন আবার পানিতে নামে। পানিতে জাল ফেলে এবং অনেক খোঁজাখুজির পর লেবু ভাইকে জ্ঞানহীন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। নানা কৌশলে তার পেট থেকে পানি বের করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এই দুর্ঘটনার কারণে লেবু ভাইয়ের একটি কান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে সেই কানে অপারেশন করাতে হয়েছিল। তার কানের পেছনে অপারেশনের কাটা দাগ এখনো আছে। (এ ঘটনার বহু বছর পর একই স্থানে আমাদের ধানচাল বহনকারী একটি নৌকাও ডুবে গিয়েছিল)।

বাস দুর্ঘটনার ফলে এলাকাবাসীর ধারণা আরো বদ্ধমূল হয় যে, ব্রিজের জায়গায় শনির দৃষ্টি পড়েছে। কিছু শিশুর রক্ত ছাড়া ব্রিজ নির্মাণ সম্পন্ন করা অসম্ভব ব্যাপার। যে বাড়িতেই শিশু রয়েছে তাদের অভিভাবকদের সতর্কতা আরো বাড়ে। আমাদের বলে দেয়া হয়, অচেনা কাউকে দেখলে আমরা যাতে কাছে না যাই। কাছে আসতে চেষ্টা করলেই আমরা যাতে দৌড়ে পালাই। তখনকার দিনে “ছেলেধরা” শব্দটিও আমাদের পরিচিত ছিল। আমরা বিশ্বাস করতাম, ছেলেধরারা ফুসলিয়ে ছেলেদের ধরে নিয়ে যায় এবং যেখানেই বড় ধরনের কোনো নির্মাণকাজ হয় সেখানে সমস্যার সৃষ্টি হলে তাদেরকে জবাই করে রক্ত ঢাললেই কাজে আর কোনো থাকে না।

কিছুদিন পর আবার ব্রিজের জায়গা থেকে শব্দ ভেসে আসতে শুনি। আমাদের মুরুব্বীরা হা হুতাশ করেন, ‘না জানি কার বুকের ধনের জীবন গেছে।’ তবে তারা আমাদের জন্য স্বস্তি অনুভব করেন। আমরা আবার স্কুলে যেতে শুরু করি। স্কুলে যাওয়ার সময় দাদী অথবা আম্মা দোয়া পড়ে “শরীর বন্ধ” করে দেন। স্কুল থেকে ফিরলে জামাকাপড় খুলে শরীর পরীক্ষা করেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আবার “শরীর বন্ধ” করেন। আম্মা অথবা দাদী দোয়া পড়ে বুকে ফু’ দিলে নিজেকে বলবান ভেবে ঘুমিয়ে পড়ি। মুরুব্বীদের আমরা বলাবলি করতে শুনেছি, ওপর থেকে বড় বড় ইঞ্জিনিয়াররা কাঁটাখালিতে আসেন। ব্রিজ নির্মাণে যে সমস্যা হচ্ছিল বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে তা পরীক্ষা করেন। “কুর’ এর ডুবুনি নামান। সমস্যা চিহ্নিত করে আবার নির্মাণ কাজ শুরু করার নির্দেশ দেন। স্বপ্নাদেশ, রক্তের প্রয়োজন ইত্যাদি সবই যে ভূঁয়া, দুষ্ট লোকদের কারসাজি স্থানীয় লোকজনকে এসব ব্যাখ্যা করেন। আমরাও তা জানতে পারি বড়দের নিকট থেকে। ব্রিজের কাজ পূর্ণ্যদেমে শুরু হয়। সেখান থেকে বাতাসে ভেসে আসা শব্দ শুনেই আমরা বুঝতে পারতাম, ঘটনা যাই হোক, মস্তবড় ফাড়া থেকে আমরা রক্ষা পেয়েছি।

এ ধরনের কাহিনি শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি। কুসংস্কারের মৃত্যু নেই। সকল সমাজে, সভ্যতায় কুসংস্কার ছিল, এখনো আছে এবং হয়তো ভবিষ্যতেও থাকবে। আমাদের প্রতিবেশি ভারতে দেবতাকে প্রসন্ন করতে “নরবলি” প্রাচীনকাল থেকে আচরিত পদ্ধতি। এখন যদিও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। আইন প্রয়োগকারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে এখনো নরবলি চলে। ১৯৯২-৯২ সালে আমি দিল্লির কানহাইয়া নগরে বাস করতাম। একটি খাল দিয়ে যমুনা নদীর পানি শহর ছাড়িয়ে দূরে কৃষি জমিতে নেয়া হয়। খালটি কানহাইয়া নগরের পাশ ঘেঁষে গেছে। সকাল-বিকাল একটি সাঁকোর ওপর দিয়ে আমি ওই খাল অতিক্রম করতাম। সেখানে আমার ছয় মাসের অবস্থানকালে তিনটি মুন্ডুবিহীন লাশ খালের পানিতে ভেসে যেতে দেখেছি। আমার বাড়িওয়ালা মনোহর লাল দং বলেছেন, উজানে বেশ ক’টি মন্দির আছে, যেখানে রাতের অন্ধকারে এখনো নরবলি দেয়া হয় বলে মানষের বিশ্বাস। প্রশাসন তত্ত্বতালাশ করে কিছু করতে পারে নি।
সার্বিয়ার নোবেল বিজয়ী সাহিত্যক আইভো অ্যানড্রিচ এর “দ্য ব্রিজ অন দ্য দ্রিনা” আমার একটি প্রিয় উপন্যাস। উপন্যাসে ষোড়শ শতাব্দীতে অটোম্যান শাসকদের দ্বারা সার্বিয়ার খরস্রোতা নদী দ্রিনি’র (ইংরেজিতে ‘দ্রিনা’) ওপর ব্রিজ নির্মাণকে কেন্দ্র করেও এ ধরনের কাহিনির উল্লেখ রয়েছে। অটোম্যানরা অধিকৃত ভূখন্ডগুলো থেকে শিশুদের নিয়ে যেত তাদের জন্মভূমি থেকে দূরে বহুদূরে ইস্তাম্বুলে। তারা দাসতূল্য হলেও প্রশিক্ষণ নিয়ে অটোম্যান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারতো। তাদের অনেকে অটোম্যান সেনা বাহিনীর উচ্চ পদাধিকারী, এমনকি সেনাপতি পর্যন্ত হয়েছেন। এক বসনীয় কৃষকের পুত্র মোহাম্মদ সো কোলু (গড়যধসসধফ ঝড়“শড়”ষষঁ“) ১৫৬৬ সালে তুরস্কের প্রধান উজির হন এবং ১৫৭৯ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। তার তুর্কি নাম ছিল মেহমেদ পাশা সোকোলি। এতো ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার মন পড়ে থাকত বসনিয়ায়। দ্রিনা নদীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণ জন্মস্থানের প্রতি তিনি তার কর্তব্য পালন করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনায় কৌশলগত কারণে ব্রিজটির অংশবিশেষ ধ্বংস করেছিল ইউরোপীয় শক্তিগুলো। যুদ্ধশেষে এর সংস্কার করা হয়। চমৎকারভাবে কাটা পাথর দিয়ে তৈরি এগারটি প্রশস্ত খিলানশোভিত ব্রিজটি কালে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই ব্রিজের অস্তিত্বের সাথে একই ধরনের কাহিনি বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে চমৎকারভাবে জড়িয়ে আছে। মানুষের মন থেকে এসব কুসংস্কার ও কল্পকাহিনি মুছে ফেলা যায় না। প্রজম্ম পরম্পরায় চলতে থাকে। কিন্তু কেউ স্মরণ করতে পারে না, কার কাছ থেকে এসব শুনেছে বা কখন প্রথম শুনেছে।

কোনো না কারণে দ্রিনা নদীর ওপর নির্মাণাধীন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছিল। দিনের বেলায় নির্মাণে যতটুকু অগ্রগতি ঘটে, পরদিন সকালে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখা যায়। এ অবস্থার অবসান ঘটে যখন পানির ভেতর থেকে কোন কিছু উঠে এসে প্রধান কারিগরের কানে কানে বলে যায়, দুটি জমজ শিশু — স্টোজা ও ওস্টোজাকে খুঁজে বের করে তাদেরকে সেতুর কেন্দ্রস্থলে স্তম্ভের মধ্যে গেঁথে ফেলতে হবে। শেষ পর্যন্ত ব্রিজের কাজে নিয়োজিত প্রহরীরা জমজ শিশু দুটিকে খুঁজে পায় প্রত্যন্ত এক গ্রামে। তখনো দুগ্ধপোষ্য। উজিরের লোকজন বলপূর্বক তাদেরকে ছিনিয়ে নেয়। শিশু দুটির মা প্রহরীদের পিছুপিছু বিলাপ করতে করতে ব্রিজ পর্যন্ত আসেন এবং তার জানা সকল অভিশাপ বর্ষণ করেন। প্রধান কারিগরের সামনে উপস্থিত হয়ে তার সন্তানদের জীবন ভিক্ষা চান।

শিশু দুটিকে সেতুর মূল স্তম্ভে গেঁথে ফেলা হয়, এর অন্যথা হওয়ার উপায় ছিল না। কিন্তু লোকজন বলে যে, প্রধান কারিগর দয়াপরবশা হয়ে স্তম্ভে একটু ফাঁকা জায়গা রাখে, যাতে অসহায় মা তার কোরবানি দেয়া সন্তানদের খাওয়াতে পারেন। এই করুণ ঘটনার কারণে সেই ফাঁকা জায়গাটির একটি স্থান দিয়ে মায়ের দুধের একটি ক্ষীণ ধারা স্তম্ভের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে শত শত বছর ধরে। শুভ্র ধারা বছরের একটি নিদিষ্ট সময়ে নিখুঁত সেতুটির গাত্র থেকে নির্গত হয়ে পাথরের গায়ে অমোচনীয় দাগ ফেলেছে। লোকজন স্তম্ভ থেকে সেই শুকিয়ে যাওয়া দুধের গুঁড়ো চেছে নেয় এবং ওষুধি গুঁড়ো হিসেবে সেইসব মহিলাদের কাছে বিক্রি করে, সন্তান জন্ম নেয়ার পর যাদের বুকে দুধ আসেনি। সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র সেগুলোই মনে রাখে ও বলে যেগুলো তারা ধারণ করতে এবং কাহিনীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়। আর বাদবাকি সবকিছু তাদের ওপর গভীর প্রভাব না ফেলেই অতিক্রান্ত হয়, কোন সূত্রবিহীন স্বাভাবিক ঘটনার মতো, যা কল্পনাকে স্পর্শ করে না অথবা স্মৃতিতেও থাকে না।

বাস্তব ঘটনা যদি ভিন্নরকমও থাকে,তবুও মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে কল্পকাহিনি ডালপালা ছড়ায়। ঘটনাটি ছিল পর্বতের ওপরের একটি গ্রামে এক দরিদ্র বোকাসোকা মেয়ের। সে গৃহপরিচার কাজ করত এবং কারো দ্বারা গর্ভবর্তী হয়ে পড়ে। যথাসময়ে কোনো আস্তাবলে সে মৃত জমজ সন্তান প্রসব করে। শিশু দুটিকে কবর দেয়া হলেও প্রসবের তিনদিন পর দুর্ভাগা মা তার সন্তানদের খোঁজ করতে গ্রামের সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। গ্রামবাসীরা তাকে সান্ত্বনা দিতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। তাকে বলে যে, তার সন্তানদের জন্ম হয়েছিল মৃতাবস্থায় এবং তাদেরকে কবর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার বিরামহীন প্রশ্ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে শেষ পর্যন্ত তারা তার কাছে ব্যাখ্যা করে যে, তুর্কিরা তার সন্তান দুটিকে নিয়ে গেছে ব্রিজ নির্মাণের জায়গায়। মেয়েটি ঘুরতে ঘুরতে ব্রিজের নির্মাণস্থল খুঁজে বের করে। দুর্বোধ্য ভাষায় তার সন্তানদের ব্যাপারে তাদেরকে প্রশ্ন করে। মেয়েটি যখন দেখলো যে, সে যা বলতে চাইছে তুর্কিরা তা বুঝতে অক্ষম, তখন মোটা কাপড়ে তৈরি জামার সম্মুখভাগের বোতাম খুলে তাদেরকে তার বেদনায় ভারাক্রান্ত স্ফীত স্তন দেখায়। স্তনের বোঁটা ইতোমধ্যে ফেটে ফেটে যাচ্ছে এবং বোঁটা থেকে দুধ বের হয়ে তার দেহের সম্মুখভাগ ভিজে গেছে। কেউ বুঝতে পারছিল না কী করে মেয়েটিকে সাহায্য করবে অথবা কিভাবে তাকে ব্যাখ্যা করবে যে, তার সন্তানদেরকে সেতুর স্তম্ভে গেঁথে ফেলা হয়নি। সব ধরনের সান্ত্বনা বাক্য ও আশ্বাসের পর, গালি ও ধমক দেয়া সত্ত্বেও মেয়েটি বিক্ষিপ্তভাবে এবং অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ব্রিজের কর্মব্যস্ত জায়গাগুলোতে ঘুরাফিরা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখে। শেষ পর্যন্ত তারা মেয়েটিকে কোনভাবে নিপীড়ন না করতে এবং অবাধে ঘুরাফেরা করায় বাধা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু কাহিনীটি চালু হয়ে গিয়েছিল যে, তুর্কিরা তার সন্তানদের ব্রিজের স্তম্ভে গেঁথে ফেলেছে, একথা কেউ কেউ বিশ্বাস করেছে, আবার অনেকে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ কাহিনি কমবেশি আলোচিত হয়েছে এবং তা বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়েছে।

আমাদের দেশেও এ ধরনের কাহিনি নতুন কিছু নয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে দুষ্টবুদ্ধির কেউ কল্পকাহিনি উদ্ভাবন করলেও তা খুব দোষনীয় নয়। মানুষ কল্পনাগ্রবণ। অলস মস্তিক আরো বেশি কল্পনার জন্ম দেয়। কল্পনার বিস্তৃতি যাতে ক্ষতির কারণ না ঘটায় সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সতর্ক দৃষ্টি থাকলেই হলো।

Published in Uncategorized

Comments are closed.