Skip to content →

হাডসন তীরের ক্রোটন পয়েন্ট পার্কে শনিবার

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

আজকের গন্তব্য ছিল ওয়েস্টচেষ্টার কাউন্টির ক্রোটন পয়েন্ট পার্ক। জায়গাটি নিউইয়র্ক সিটি থেকে ৪২ মাইল উত্তরে। মোটামুটি এক ঘন্টার ড্রাইভ। হাডসন নদী পূর্ব তীরে ৫০৮ এক স্থান জুড়ে গড়ে তোলা নয়নাভিরাম এক বিনোদন কেন্দ্র। তবে এ বিনোদন মূলত প্রকৃতি প্রেমিকদের জন্যই। নদীর পশ্চিম তীরে রকল্যাণ্ড কাউন্টির পার্বত্য শোভা। আউস্টেট নিউইয়র্কের অ্যাড্রিয়নডেক পর্বত থেকে বের হয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে ক্রোটন পয়েন্ট পর্যন্ত আসতে হাডসন নদীকে প্রায় ২৭০ মাইল অতিক্রম করতে হয়েছে। আর মাইল তিনেক দক্ষিণ-পূর্বদিকে এগিয়ে নদী মিলিত হয়েছে হ্যাভারষ্টে উপসাগরে, যেখানে হাডসনের প্রস্থ বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন মাইল হয়েছে। উপসাগরে পড়েই হাডসনের অবসান হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হয়নি। শেষ হয়েছে আরো ৩৭ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ম্যানহাটানের পশ্চিম ঘেঁষে নিউইয়র্ক হারবারে আটলান্টিক মহাসাগরে।

আজ শনিবার কোথাও বের হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। অনেক লেখার কাজ পড়ে আছে। শেষ করতে পারছি না। আমাদের পরবর্তী পারিবারিক পিকনিক হওয়ার কথা ছিল রোববার। কিন্তু রোববার বৃষ্টিপাতের আভাস রয়েছে। মুক্তি যখন ফোন করে তখনো আমরা বিছানায়। সাড়ে ৯টা বাজে। রওয়ানা হওয়ার সময় সাড়ে ১১টা। পিকনিকে যাওয়ার জন্যে কিছুটা বিলম্বিত সময়। তাতে সমস্যা খুব হবে না। আমরা তো খাবার তৈরি করেই নিয়ে যাই। মুক্তি গাজরের হালুয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা ঝটপট তৈরি হয়ে নাকেমুখে সামান্য খাবার গুঁজে রওয়ানা হই। মিলিত হওয়ার স্থান জ্যামাইকার হিলসাইড। কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী মুক্তি, তাদের দুই কন্যা সারাফ ও নভো, কবি মাহবুব হাসান, ইমিগ্রেশন রাইটস এক্টিভিষ্ট কাজী ফৌজিয়া, আমি ও আমার স্ত্রী। পিকনিকের স্পট ঠিক করেছেন কাজী ফৌজিয়া। সিটির বাইরে বলে এই পার্কে আগে কখনো যাওয়া হয়নি।

ভৌগেলিক সংজ্ঞায় ক্রোটন পয়েন্টকে হাডসন নদীর সর্ববৃহৎ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমার ভূগোল বিদ্যায় যেসব উপদ্বীপের নাম জানি, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপদ্বীপ হচ্ছে ‘আরব উপদ্বীপ, যার আয়তন সাড়ে ১২ লাখ বর্গমাইল, দ্বিতীয় বৃহত্তম উপদ্বীপ হচ্ছে ভারতের ডেকান উপদ্বীপ, আয়তন ৮ হাজার বার্গমাইল। আর ক্রোটন পয়েন্ট উপদ্বীপের আয়তন হচ্ছে মাত্র ৫০৮ একর। গুগল জানালো বিশ্বের সবচেয়ে ছোট উপদ্বীপের আয়তন মাত্র ৬ একর। বে অথবা উপসাগরের কথা বলা হলে আমাদের বঙ্গোপসাগর বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর, আয়তন ৮ লাখ ৩৯ হাজার বর্গমাইল; মিয়ানমার উপকূল থেকে শুরু করে দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই তুলনায় আটলান্টিকের কোলে হ্যাভারষ্টে উপসাগরের আয়তন জেনেও মনে হলো, এটিেেক উপসাগর নাম দিয়ে বরং উপসাগরকে কলঙ্কিত করা হয়েছে Ñদৈর্ঘ্যে ৫ মাইল, আর প্রস্থে প্রায় সাড়ে তিন মাইল। একটি কৌতুক মনে পড়লো। দিল্লির অন্যতম দর্শনীয় স্থান কুতুব মিনার দেখতে প্রচুর ভিড় হয়। সারাদিন জনস্রোত থাকে সেখানে। ইতরের হদ্দ অনেক শিশু থাকে। অমন এক শিশু পরিবারের সাথে কুতুব মিনার দেখে ফিরে আসছে। রাস্তায় যানজট। টোঙার ওপর দাঁড়িয়ে সে প্রস্রাব করছে। কুতুব মিনার দেখতে যাচ্ছে এমন এক সরদারজিকে ডেকে তার লিঙ্গ প্রদর্শন করে বলে, সরদারজি, ওদিকে অনেক ভিড়, তুমি বরং আমার কুতুব মিনার দেখো। ওর কুতুবের দৈর্ঘ্য মাত্র দুই ইঞ্চি, আর কুতুব উদ্দিন আইবেক নির্মিত কুতুব মিনারের দৈর্ঘ্য ২৩৮ ফুট।

আয়তন যাই হোক ক্রোটন পয়েন্ট পার্কের নান্দনিক শোভা বর্ণনা করে কারো নয়ন সুখ মেটানো যাবে না। আমরা গাড়ি থেকে খাবারের ব্যাগ, পানি, চা বয়ে একটি গাছের ছায়ায় বসে প্রথমেই খাবার সেরে নিলাম। হাজার লোকের সমাবেশেও যদি কাজী ফৌজিয়া থাকে. তাহলে আর কেউ কথা বলার সুযোগ পায় না। জানে না এমন বিষয় নেই। অনেকে বিরক্ত হয়, আমি হই না। কারণ গত ১১ বছর যাবত তাঁর প্যাচাল শুনে শুনে আমি অভ্যস্ত। বাংলাদেশী কেউ বিপদে পড়লে কাজী ফৌজিয়া এককভাবে তার বিপদে যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কোনো কমিউনিটি নেতা বা সংগঠন তা করে না। অতএব তাঁর মাঠ দখল করার যৌক্তিকতা আমরা মেনে নেই। মানুষকেও আপ্যায়ন করতেও দরাজদিল। খিচুরি, ডিম, ছোলার ডাল, সালাদ, ্আঙুর, আম, খেজুর এনেছেন তিনি। মুক্তি এনেছে দুই ধরনের সব্জি, ডাল, চা, কেক। রেষ্টুরেষ্ট থেকে রুটি ও পরাটা নেয়া হয়েছে। আমরা নিয়ে গাজরের হালুয়া, আলুর চপ ও পান-সুপারি। আট জনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার।

চা পান করে মুখে পান পুরে আমরা প্রকৃতি দর্শনে বের হই। পার্কের বেষ্টনির পরেই অ্যামট্রেন এবং নর্থ-ইস্টার্ন রেলওয়ে ট্র্যাক পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গেছে। দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেন ঘন ঘন নিউইয়র্ক সিটি থেকে আসছে, নিউইয়র্কের দিকে যাচ্ছে। পার্কে খুব একটা ভিড় নেই। অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ। ইমিগ্রান্ট কমিউনিটি লোকজন নেই বললেই চলে। সবুজ মাঠে চাদর বিছিয়ে সর্টস পরা পুরুষের পাশে স্বল্প বসনা তরুণীরা শুয়ে বা চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছে। আমরা হেঁটে পার্কের একেবারে উত্তর প্রান্তে যাই। সেখানে ৯/১১ স্মরণে স্থাপিত হয়েছে একটি ভাস্কর্য। টুইন টাওয়ারে ওয়েষ্টচেষ্টার কাউন্টির যে ক’জন বাসিন্দা নিহত হয়েছে তাদের স্মৃতি ধরে রাখতে উত্তর টাওয়ারের একটি দোমড়ানো ইস্পাতের বিম সানডায়াল বা সূর্যঘড়ির হিসাব অনুযায়ী দাঁড় করানো হয়েছে ১৬ টন ওজনের একটি প্রস্তর খণ্ডের ওপর। এটি স্থাপন করা শুরু হয় ২০০৯ সালে এবং নাম দেয়া হয় “রিচিং থ্রু দ্য শ্যাডো” (ছায়ার মধ্য দিয়ে পৌঁছা)। পরবর্তীতে আশা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে একটি ব্রোঞ্জের নারী মূর্তি স্থাপন করা হয় ইস্পাতের বিমের নিচে।
আমরা আমাদের জায়গায় ফিরে আসি। বিছানো চাদরে গড়াগড়ি করি, চা-পান খাই। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে থাকি। ইয়াট ক্লাবের পরই পার্কের আরেকটি অংশ। বেশ নিরিবিলি স্থান। প্রবেশ মুখে পৌঁছতেই পুলিশ আমাদের থামিয়ে আঙুল দিয়ে সাইনবোর্ড দেখায়। তাতে লেখা, ওই স্থানটি স্থানীয় এলাকাবাসীর জন্য সংরক্ষিত। আমরা আরো কিছুটা দক্ষিণে হাঁটি। আবার নিসর্গ উপভোগ করতে করতে ফিরে আসি।

গোছগাছ করে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় বাড়ির পথ ধরি। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে দল বেঁধে পাহাড়ের তীর ঘেঁষা নদী বরাবর প্রকৃতি উপভোগের চেয়ে আনন্দদায়ক আর কিছু হতে পারে না। সামার শেষ হয়ে আসছে। আর ক’টা রোববার পাবো, বড় জোর দুটি। সারাফ ও নভোর স্কুল খুলে যাবে। তখন আমাদের আর এতো ঘন ঘন বের হওয়ার সুযোগ হবে না।

Published in Uncategorized

Comments are closed.