Skip to content →

রুুশদী: যাকে প্রশংসা ও ইর্ষা করতে হয়


খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

সালমান রুশদীর ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ পাঠ করার পর থেকে আমি তাঁর প্রতি সম্ভ্রম বোধ করেছি। তাঁর প্রতিভা আমাকে বিস্মিত করেছে এবং যারা তাঁর এ গ্রন্থটি পাঠ করেছে তারাও বিস্মিত হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই এটি ‘বুকার পুরস্কার’ লাভ করেছে। গ্রন্থটির ওপর আমি আমার কলামে এটিকে আমার এ যাবত পাঠ করা সেরা উপন্যাস বলে প্রশংসা করেছি। রুশদী আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এবং আমার সঙ্গে পান করেন। আমি অত্যন্ত আমোদিত বোধ করেছি।

‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ প্রকাশিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সবকিছু ভালোভাবে চলছিল। আমি বইটির পান্ডুলিপি পাঠ করি এবং এটির প্রকাশনা সংস্থা ইংল্যান্ডের পেঙ্গুইন ভাইকিং এর অনুরোধে আমি আরও দু’বার পাঠ করতে হয়েছে। ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ মুসলমানদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্রোধের সৃষ্টি করে। ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনি তাঁকে হত্যার জন্য ফতোয়া ঘোষণা করেন। মুসলিম দেশগুলো, এমনকি ভারত সরকারও বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এ পরিস্থিতির মধ্যে ব্রিটিশ সরকার রুশদীকে ‘নাইট’ খেতাবে ভূষিত করে ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের মুখে চপেটাঘাত করার কারণ ঘটায়। বইটির প্রকাশক চাইছিল দিল্লিতে তাদের ভারতীয় শাখা বইটি ভারতে প্রকাশ করুক। আমি যদিও বই ও শিল্পকর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপকারীদের প্রতি প্রকাশ্যেই ঘৃণা পোষণ করি, তবুও আমি পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াকে পরামর্শ দেই ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ এর ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশের ঝুঁকি গ্রহণ না করতে। আমি রুশদীকে ইসলাম সম্পর্কে পণ্ডিত বলে স্বীকার করলেও এ সম্পর্কে আমার জ্ঞান একেবারেই সামান্য ও ভাসা ভাসা। কিন্তু তিনি সাধারণ মুসলিমদের স্পর্শকাতরতা আঁচ করতে পারেননি। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে বইটি যদি দিল্লিতে প্রকাশিত হয় তা হলে ভারতে পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার কোনোকিছু আর টিকে থাকবে না। আমার মনে হয়, আমার ধারণাই সঠিক ছিল। রুশদীর ধারণা হয় যে, বইটি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আমার কিছুটা হাত ছিল। আমাদের উভয়ে বন্ধু লণ্ডনে ভারতে ডেপুটি হাই কমিশনার সালমান হায়দারের কাছে আমি প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু রুশদী আমাকে ক্ষমা করেননি।

আমি রুশদীর একজন ভক্ত ছিলাম এবং সবগুলো উপন্যাস আমি পাঠ করেছি। তাঁর একটি মাত্র বই ‘অ্যানচেনট্রেস অফ ফ্লোরেন্স’ আমাকে অত্যন্ত হতাশ করেছে। এটি তাঁর অন্যান্য বইয়ের মতো মানসম্পন্ন হয়নি এবং আমি এ সম্পর্কে আমার মতামত ব্যক্ত করে লিখেছি।

এখন আমাদের হাতে তাঁর সর্বশেষ বই ‘লুকা এণ্ড দ্য ফায়ার অফ লাইফ’ এসেছে। এটি পড়ে আমি বিহ্বল হয়েছি। বইটিকে একটি রূপকথা বা কল্পকাহিনি হিসেবে বলা হয়েছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তা হলে সালমান রুশদীর লেখার ধরনের সাথে যারা পরিচিত তারা এটিকে শিশতোষ কোনো বই বলবেন না, বরং এটি বড়দের জন্য লেখা বই। যারা তাঁর ‘হারুন এণ্ড সী অফ স্টোরিজ’ পাঠ করেছেন তারা নিশ্চয়ই ইঙ্গিতটি খুঁজে পাবেন এবং রুশদী তাঁর শেষ বইয়ে কী বলার চেষ্টা করেছেন সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করবেন। আগের বইটির বীর হারুন, তার ১২ বছর বয়সী ছোট ভাই লুকা কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র। ‘আলিফবে (আরবি ও উর্দু বর্ণমালার প্রথম দুটি অক্ষর ‘আলিফ’ ও ‘বে’) নামে এক দেশে রশিদ খলিফা এক কথক বা গাল্পিক। ‘সিলসিলা’ নামে পরিচিত এক কর্দমাক্ত নদীর পাশে গড়ে ওঠা ‘কাহিনি’ নগরীতে বাস করেন তার স্ত্রী সুরাইয়া ও তাদের দুই পুত্র। রশিদ খলিফা এদিন গভীর নিদ্রিত অবস্থায় ছিলেন এবং বহুদিন পর্যন্ত তিনি আর ঘুম থেকে ওঠেননি। সবাই ভয় করছিল যে তিনি মারা যাচ্ছেন। পিতার জীবন রক্ষা করার উদ্দেশ্যে লুকা তার জীবনের আলো জ্বালানোর উদ্যোগ নেয়। দরজায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ‘নোবোড্যাডি’র, যিনি ঠিক তার পিতার চেহারার প্রতিরূপ। তিনি মানুষের জান কবচ করার জন্য আল্লাহ প্রেরিত মৃত্যুর ফেরেশতা ‘আজরাইল’, যিনি রশিদ খলিফার জীবন হরণ করতে এসেছেন। লুকা তার দুটি পোষা প্রাণী নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। পোষা প্রাণী দুটি হচ্ছে, ‘বিয়ার’ নামে একটি কুকুর এবং ‘ডগ’ নামে একটি ভালুক এবং ‘নোবোড্যাডি’র সঙ্গে সে যায় জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর জানতে। ‘ইনসুলানার’র সঙ্গে তাদের সাক্ষাতের পর প্র্রশ্নটির ওপর গভীর অনুসন্ধান শুরু হয়। ‘ইনসুলানা’ দেখতে লুকার মায়ের অবিকল তরুণী রূপ এবং তার নামও লুকা’র মায়ে নামে ‘সুরাইয়া’। তার মালিকানায় রয়েছে জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন উড়ন্ত গালিচা ‘রেশম’, যা হাজার হাজার মানুষ ও প্রাণীকে ধারণ করতে এবং প্রচণ্ড গতিতে উড়ে যেতে পারে। গালিচাটি বাতাসের মধ্যে স্থির দাঁড়াতেও পারে। অনেক সময় গালিচা জুড়ে থাকে বড় বড় ইঁদুর, আবার কখনো হাতির আকৃতির হাঁস এবং অন্যান্য প্রাণী অতিকায় প্রাণী। তারা আলিমদের (জ্ঞানী লোক) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এবং ইংরেজি ‘জে’ আদ্যক্ষর দিয়ে নাম ‘জো হুয়া’, ‘জো হ্যায়’, ও ‘জো হোগা’র সঙ্গে অতিক্রান্ত সময় নিয়ে আলোচনা করে চির পরিবর্তনশীল বিশ্ব সম্পর্কে জানতে।

রুশদী কী বলছেন তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করে আমার মাথা চক্কর দিতে থাকে। তিনি কি উন্মাদ হয়ে গেছেন? অথবা আমার কি স্মৃতিবিভ্রম বা চিত্তবৈকল্য ঘটেছে? কিন্তু আমার পক্ষে বইটি অর্ধেক পাঠ করে রেখে দেওয়া সম্ভব ছিল না। এটি শেষ হয় জাদুর গালিচার মালিক সুরাইয়াকে দিয়ে, যিনি লুকাকে কিছু গরম আলু দেন তার পিতার মুখে পুরে দেওয়ার জন্য। সে ঠিক উপযুক্ত সময়ে কাজটি করে এবং রশিদ খলিফা সেরে ওঠেন। এরপর পরিবারটি সুখে দিন কাটাতে থাকে।

উর্বর কল্পনা শক্তি এবং শক্তিশালী কলম ছাড়াও রুশদী আরও বেশি প্রতিভার অধিকারী। তাঁর মস্তিস্ক ছাড়াও তাঁর শরীরের অন্যান্য অংশও সমান গুণসম্পন্ন ও সমৃদ্ধ। কার পক্ষে এমন কথা বলা সম্ভব যে ক্ষুদ্র চোখ বিশিষ্ট, দাড়ি শোভিত মধ্যবয়সী লোকটির শয্যা উষ্ণ করার জন্য একজনের পর একজন করে স্ত্রী ও রক্ষিতার আগমন ঘটেছে। তাঁকে ইর্ষা ও প্রশংসা করার এটিও একটি কারণ।

Published in Uncategorized

Comments are closed.