Skip to content →

খুনের অভিযোগের আঙুল ছিল বেনজীর ও জারদারির দিকে


আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

ফাতিমা ভূট্টোর বাবা, ফুফু ও চাচা সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের বিখ্যাত রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য ফাতিমা তার নিকটজনের মৃত্যুর ঘটনা দেখে ও এ সম্পর্কে আলোচনা শুনে বড় হয়েছেন। মৃত্যু ও সংঘাত এই পরিবার থেকে কখনো খুব দূরে ছিল না। ২০০৭ সালে বেনজীর ভূটো যখন তাঁর তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন তখন ফাতিমা তার ফুফুর প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সক্রিয় ছিলেন। ফুফুকে হত্যা করার খবর শুনে তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। তার মনে হয়েছে, আততায়ীরা আরেকজন ভূট্টোকে হত্যা করার সাহস করতে পারেনা। এক দশক আগে তার বাবা মর্তুজা ভূট্টোর হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে তিনি আবেগাপ্লুত হয়েছেন। তিনি তার “সঙস অফ ব্লাড এণ্ড সোর্ড” গ্রন্থে লিখেছেন, ‘পরবর্তী পাঁচদিন আমি শুধু কেঁদেছি। আমার অশ্রু যখন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি সবার জন্য কেঁদেছি।”

বেনজীর ভূট্টোর জন্য ফাতিমার কান্না কাক্সিক্ষত ছিল না। তিনি সবসময় তার ফুফু বেনজীর ও ফুফা আসিফ আলী জারদারির তুখোড় সমালোচক এবং তার বাবাকে হত্যার পেছনে দু’জনের হাত ছিল বলে অভিযোগের আঙুল সবসময় তাদের দিকে তাক করেছেন। ভূট্টো পরিবার কয়েক দশক পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল। কিন্তু পারিবারিক রাজনীতি নির্দয় অন্তর্ঘাতমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিয়েছিল। বেনজীর ভূট্টো তাঁর ভাইদের প্রতিপক্ষ বিবেচনা করেছিলেন, যার একজন ছিলেন ফাতিমার বাবা। এরপর জেনারেল জিয়া পাকিস্তানের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভূট্টোকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। জিয়াকে উৎখাত করার উদ্দেশে তার ভাইয়েরা যখন কাবুল থেকে পরিকল্পনা করছিলেন এবং ১৯৮১ সালে তাদের বিরুদ্ধে বিমান হাইজ্যাক করার চক্রান্তে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়। বেনজীর তাদের অনুপস্থিতির রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে দুই বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং দুই বারই দুর্নীতির অভিযোগে তাকে অপসারিত হতে হয়। ভাইবোনরা পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হন। মুর্তাজা ভূট্টোকে ১৯৯৬ সালে যখন তাদের করাচির পারিবারিক বাসভবনের বাইরে গুলি করে হত্যা করা হয় তখন ফাতিমার বয়স ১৪ বছর। তখন থেকেই তিনি তার বাবাকে হত্যার জন্য সবসময় তার ফুফুকে সন্দেহ করেছেন।

বাবাকে হত্যার ঘটনার তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি ফাতিমা, একদিন তিনি তার ফুফু তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেনজীরকে ফোন করেন। কিন্তু বেনজীর তার সাথে কথা বলতে অস্বীকার করেন। আসিফ জারদারিও তার সাথে ভালোভাবে কথা বলেননি। ফাতিমার বই তার নিহত বাবার প্রতি আবেগ দিয়ে লেখা। তিনি বাবার জীবনের কাহিনি, তার রাজনীতির কথার পাশাপাশি পাকিস্তানের ইতিহাসও সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেছেন, যা তিনি নিজের প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি তার পরিবারের শত্রু ও মিত্রদের কথাও বলেছেন। তার দাদা জুলফিকার আলী ভূট্টোর প্রতি অবিচার করা হয়েছে মর্মে তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এক ব্যক্তি যখন তাকে বলেন যে তার দাদা হিটলারের চেয়ে ভালো কোনো নেতা ছিলেন না তখন তিনি মর্মাহত হয়েছেন।
ফাতিমা ভূট্টো কাবুলে ১৯৮২ সালে ২৯ মে জন্মগ্রহণ করেন। সিরিয়ায় প্রথম স্কুলে যান এবং প্রথমবার পাকিস্তানে আসেন ৭ বছর বয়সে। তিনি নিউইয়র্ক ও লণ্ডনের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন এবং আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজি বলেন। তিনি কথা বলতে স্বচ্ছন্দ। এতো যাতনা বহন করার পরও তিনি কখনো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন না। তিনি বলেন, “ক্রোধ এক ধরনের সহিংসতা এবং ক্রোধ পোষণ করে রাখা ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। তার বাবার হত্যাকাণ্ডে দায়ী তার ফুফু ও ফুফাকে কখনো বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি এবং পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিটি চক্রান্তে পেছনে কারা দায়ী তা নিয়ে অনেক কল্পকাহিনি সৃষ্টি করা হয়েছে। তার চাচাকে ফ্রান্সে বিষ প্রয়োগের জন্য পরিবার দোষারূপ করেছে জেনারেল জিয়াকে, এবং সম্ভবত সিআইএ’কে। বেনজীরকে হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেছে আল-কায়েদার একটি গ্রুপ। কিন্তু জীবদ্দশায় বেনজীর ভয় করতেন যে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। ফাতিমার বাবা মর্তুাজার হত্যা মামলায় অন্যতম আসামী তার ফুফা আসিফ জারদারিকে অভিযোগ থেকে নিস্কৃতি দিয়েছে আদালত, যাতে তিনি কোনো অভিযোগ মাথায় না নিয়ে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। ফাতিমা বিস্মিত হয়েছেন যখন তার বাবার নিহত হওয়ার দিনটিকেই জারদারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের দিন বেছে নিয়েছিলেন।

ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক ও লেখক খুশবন্ত সিং তার মৃত্যুর চার বছর আগে ২০১০ সালে ফাতিমা ভূট্টোকে নিয়ে হিন্দুস্থান টাইমসে লেখা এক নিবন্ধে ভূট্টো পরিবারের বিয়োগান্তক কাহিনি তুলে ধরতে পরিবারটিকে গ্রীক কাহিনির অভিশপ্ত ‘অ্যাটরিউসের পরিবারের’ সাথে তুলনা করেছেন, যে পরিবারটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল হত্যাকাণ্ড, বিশ্বাসঘাতকতা ও আতঙ্কে। আরগসের অ্যাটরিউস ছিলেন আগামেমনন ও মেনেলাসের পিতা, যিনি বিয়ে করেছিলেন ক্লাইটেমনেষ্ট্রা ও ট্রয়ের হেলেনকে। কাহিনিতে একটির পর একটি দু:খজনক ঘটনা ঘটতে থাকে এবং সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঘটনা ছিল অ্যাটরিউসের স্ত্রীর সঙ্গে তার ভাই থায়েসটেসের প্রেমঘটিত সম্পর্ককে কেন্দ্র করে দুই ভাইয়ের মধ্যে সৃষ্ট কলহ, যার পরিণতিতে থায়েসটেসকে আরগস থেকে বিতাড়িত হতে হয়। থায়েসটেস সমঝোতায় সম্মত হলে কিছুদিন পর তাকে আরগসে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। ভাইয়ের সম্মানে অ্যাটরিউস জাঁকজমকপূর্ণ ভোজসভার আয়োজন করেন এবং তাকে তাঁর দুই পুত্রের মাংস রান্না করে পরিবেশন করা হয়। পিতা থায়েসটেস না জেনে পুত্রদের মাংস খান। তাঁকে যখন জানান হয় যে তিনি কী খেয়েছেন তখন আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে অ্যাটরিউসের পরিবারকে অভিশাপ দিয়ে পালিয়ে যান। কাহিনি অনুসারে তার অভিশাপ পরিশুদ্ধি হিসেবে কাজ করে।

খুশবন্ত সিং এর মতে ফাতিমা ভূট্টো চমৎকার গদ্যে ভূট্টো পরিবারের কাহিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। তবে সেই কাহিনিতে যদি বেইমানি, চক্রান্ত, সহিংসতা ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার ঘটনা না থাকতো তাহলে সেটি আরও সুখপাঠ্য হতে পারতো। নারী সম্পর্কে খুশবন্তের বর্ণনা সবসময় খোলামেলা ও রসপূর্ণ এবং তরুণী ফাতিমার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। ফাতিমা দিল্লিতে তার বইয়ের প্রকাশনার মাস খানেক আগে তিনি খুশবন্ত সিং এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। খুশবন্ত পরে লিখেছেন, “আমি তার ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারিনি। তার নাকে বাম পাশে নাকফুলের উজ্জ্বল হীরক খণ্ড, কাঁধ পর্যন্ত লম্বিত তার কোকড়ানো ঘন কালো চুলের দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগে অন্তত আরেক বার আমি তাকে দেখার আশা পোষণ করি।”
ভূট্টো পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি ততটা মুগ্ধ ছিলেন না এবং বাংলাদেশ ইস্যুতে জুলফিকার আলীর ভূমিকা নিয়ে তিনি কঠোর শব্দ প্রয়োগ করেছেন। তাদেরকে তিনি একথাও বলেছেন যে পাকিস্তানে যে গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারেনি সে জন্যও ভূট্টো দায়ী ছিলেন। তিনি তাঁর বন্ধু মনজুর কাদির, যিনি আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন, ভূট্টো তাঁর সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁকে ‘ভালো মুসলিম নয়’ বলে চিত্রিত করে তাঁকে মন্ত্রীত্ব থেকে হটানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করায় খুশবন্ত ভূট্টোকে ক্ষমা করতে পারেনি। ভূট্টোর জন্য দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর ভূট্টোর এক বয়োবৃদ্ধ মন্ত্রী জে এ রহিম ভোজ অনুষ্ঠান থেকে চলে যাওয়ার কারণে ভূট্টো তাঁর দল পিপলস পার্টির গুন্ডাদের পাঠিয়ে যে তাঁকে প্রহার করান খুশবন্ত এ কথাগুলোও তার পরিবারের সদস্যদের বলে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন।

ফাতিমা ভূট্টোর গ্রন্থ ‘সঙস অফ ব্লাড এণ্ড সোর্ড’ এর ওপর লণ্ডনের ‘সানডে টাইমস এ আলোচনা করেছেন ম্যাক্স হেস্টিংস। তিনি ভূট্টো পরিবারের ওপর ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনাবলীকে গ্রীক ট্র্যাজিডির পরিবর্তে সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ব্রিটিশ ‘জ্যাকোবীয় ড্রামা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার বৈশিষ্ট ছিল ফাঁেিস ঝোলানো, বিষ প্রয়োগ, সন্ত্রাস, হত্যা ও গুপ্ত হত্যা Ñ এক কথায় ঘৃণা ও রক্তপাতের ঘটনার ধারাবাহিকতা। তাঁর কাছে ফাতিমার গ্রন্থটি “আবেগে ভরা, খণ্ডিত, সাদামাটা এবং বিশেষ করে আসলে কে কার প্রতি কী করেছে স্সেব বর্ণনা পুরোপুরি অনির্ভরযোগ্য। পারিবারিক বিভীষিকার কাহিনির প্রতি যাদের ঝোঁক আছে তাদের কাছে গ্রন্থটির পাঠযোগ্যতা রয়েছে।” ফাতিমাকে হেস্টিংস ক্ষমাশীলভাবে দেখেননি। কিন্তু আসিফ জারদারির ব্যাপারে হেস্টিংসও খড়গহস্ত। কারণ জারদারি তার স্ত্রী বেনজীর ভূট্টোর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনকালে যে দুর্নীতি করেছেন তা তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে কুখ্যাত দুর্নীতিবাজের তালিকাভূক্ত করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানকে শাসনের অযোগ্য একটি দেশ, যেখানে যখন তখন নির্বাচিত সরকারকে সেনাবাহিনী কর্তৃক উৎখাতের আশঙ্কা বিদ্যমান, ফাতিমা তার গ্রন্থে সেই ভীতির বার্তা দিতে পেরেছেন, এবং সেটিই তার সার্থকতা।

Published in Uncategorized

Comments are closed.