খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
[খ্যাতিমান ভারতীয় সাংবাদিক, লেখক খুশবন্ত সিং ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর সাথে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত প্রকাশ না করলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়ার বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্য সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি যখন তাঁর কাছে জানতে চান যে, বঙ্গবন্ধুর কোনো ঘাতককে কেন গ্রেফতার করা বা শাস্তি বিধান করা হয়নি, তাঁর প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য না করে অস্থিরভাবে হাতঘড়ির পিানে তাকাচ্ছিলেন।]
শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দু’জনের সঙ্গেই আমার অনেকবার সাক্ষাৎ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমার জানামতে শুধুমাত্র বাঙালি মুসলিম হওয়া ছাড়া তাদের উভয়ের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। মুজিবের উচ্চতা ছিল একজন বাঙালির গড় উচ্চতার চেয়ে বেশি, তাঁর ছিল শরীর মাংসল এবং পরনে থাকতো ঢিলেঢালা পোশাক। জিয়া আকৃতিতে খাটো, তাঁর শরীর হালকা-পাতলা হলেও গঠন চাবুকের মতো শক্ত। একবার তাঁর দেহরক্ষী আমাকে বলেছিলেন, “তাঁর এক মুষ্টাঘাত কোনো মানুষকে বেহুশ করে ফেলতে পারে।” মুজিব অত্যন্ত আন্তরিক, উষ্ণ-হৃদয়ের, বহির্মুখী এবং কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন; জিয়া সুদূরের, গম্ভীর এবং অল্প কথা বলেন। মুজিবের দফতর মোগল আমলের প্রাচ্যদেশীয় দরবারের মতো: কয়েক ডজন মানুষ কার্পেটের ওপর, সোফা ও চেয়ারের ওপর ছড়িয়ে বসে থাকে, দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। সারাক্ষণ একটির পর একটি টেলিফোন বাজে; তিনি ফোনে কথা বলার পাশাপাশি উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে যিনিই তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন তার সাথে কথা বলছেন এবং তাঁর সামনে টেবিলে রাখা কাগজপত্রে স্বাক্ষর করছেন। পুরো বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ। জিয়ার অফিস তাঁর মতোই শীতল। ওয়েটিং রুমে তাঁর সচিব ও নিরাপত্তা কর্মীরা বিচক্ষণতার সাথে আপনাকে মার্জিত কথাবার্তার মধ্যে ব্যস্ত রাখেন এবং তাদের সতর্ক দৃষ্টি খুঁজে ফিরে আপনার কাছে কোনো গোপন অস্ত্র আছে কিনা। এক সাথে একজনের বেশি দর্শনার্থীকে তিনি স্বাগত জানান না এবং সময় মেনে চলেন ষ্টপওয়াচের মতো। তাঁর রুমে হুট করে অঘোষিতভাবে প্রবেশ করার সাহস কারো নেই। কোনো টেলিফোনও বাজে না। আপনার প্রশ্নগুলো বাতাসে জমে থাকবে; তাঁর নির্দিষ্ট-পরিমিত উত্তর আপনার জমাট প্রশ্নগুলোকে গলাতে পারবে না। মুজিব আপনাকে আলিঙ্গন করবেন এবং দ্বিতীয় সাক্ষাতে আপনার তাঁর ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে সম্বোধন করবেন। জিয়া তাঁর শীতল হাতে আপনার সাথে হাত মেলাবেন এবং চিনতে পারার স্বীকৃতি হিসেবে অষ্পষ্ট, ম্লান হাসবেন। মুজিব নিজের সম্পর্কে স্বয়ং তৃতীয় পুরুষে বলেন, “বঙ্গবন্ধু বলেছেন,” এবং আপনার কাছেও অনুরূপ সম্বোধন আশা করবেন। জিয়া কখনো তাঁর মুখ খোলেন না, অথবা তাঁর সাথে কাউকে খুব ঘনিষ্ট হতে দেন না। তিনি সবসময় ‘মিষ্টার’, ‘প্রেসিডেন্ট,’ ‘স্যার’ ছিলেন।
জিয়াউর রহমান তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করার দুই বছর পর তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। সামরিক একনায়কদের ব্যাপারে আমার আপত্তি ও নেতিবাচক মনোভাব ছিল এবং এমন একজনের প্রতি ভিন্ন ধরনের বিতৃষ্ণা ছিল, যিনি মুজিবের ঘাতকদের শাস্তি বিধান করার পরিবর্তে তাদেরকে কূটনৈতিক দায়িত্বে ন্যস্ত করার মাধ্যমে পুরস্কৃত করেছিলেন। তা সত্বেও বাংলাদেশে অতিবাহিত করা সপ্তাহে ঢাকার পরিবেশের যতটুকু দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হযেছে, তাতে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছি। মাত্র কয়েক বছর আগেও যে এলোমেলো নগরীতে বিরাজ করছিল চরম বিশৃঙ্খলা, সেখানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় গড়ে ওঠা শপিং সেন্টার ও মার্কেটগুলো দেখে সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট লক্ষণ বোঝা যায়। দেশটিতে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ঢাকার বাইরে পল্লীগুলোকে আরও সবুজ, আরও পরিচ্ছন্ন এবং আমি আগে যেমন দেখেছি তার চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধশালী মনে হয়ে। আমি জিয়াকে একথা বলার পর তাঁকে অত্যন্ত সন্তুষ্ট মনে হয় এবং তিনি তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎকারের সময় প্রলম্বিত করেন। তাঁর কাছে আমার শেষ প্রশ্ন ছিল তাঁর দেশে ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী মনোভাব সম্পর্কে। অনেক দেয়ালের ওপর শ্লোগান লেখা: “ভারতীয় কুকুর, হটে যাও’, ‘বাংলাদেশের ওপর থেকে হাত গুটিয়ে নাও”। আমি জিয়ার কাছে জানতে চাই যে, তিনি তাঁর দেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের কোনো দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে পারেন কিনা। তিনি যা বলতে পারলেন, তা হলো ভারত সরকার কর্তৃক বাঘা সিদ্দিকী ও শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান। আমি তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য দায়ী একজনকেও কেন গ্রেফতার করা বা শাস্তি প্রদান করা হয়নি? আমার প্রশ্নে তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না; বরং অধৈর্য্যর মতো তাঁর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলেন। আমি জানতাম, সাক্ষাৎকারের সময় শেষ হয়েছে।
সেই সন্ধ্যায় আমিই ছিলাম জিয়ার শেষ দর্শনার্থী। করিডোর দিয়ে আমার কয়েক গজ সামনে বিশালদেহী দু’জন দেহরক্ষীর অবস্থানের মাঝখান দিয়ে তিনি হেঁটে যাচ্ছিলেন। তখনই আমি লক্ষ্য করলাম যে আকৃতিতে তিনি কতোটা খাটো ছিলেন Ñ পাঁচ ফুটের সামান্য বেশি। তিনি হাই-হিল জুতা পরতেন।
(খুশবন্ত সিং এর ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড এণ্ড দ্য রিডিকুলাস থেকে)
Comments are closed.