Skip to content →

ভূট্টো যাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন


খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জুলফিকার আলী ভূট্টো যাকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন, তিনি আহমেদ রাজা কাসুরী। তাঁকে হত্যা করার উদ্দেশে আঠারো বার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। আঠারোতম হত্যা প্রচেষ্টায় নিহত হন আহমেদ রাজার পিতা নওয়াব মোহাম্মদ রাজা কাসুরী’র। এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ভূট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ভূট্টো যে আহমেদ রাজা কাসুরীকে তাঁর “অচেনা লোক” বলে বর্ণনা করেছিলেন, সেই ‘অচেনা লোক’টিই তাঁর জন্য কন্টকে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী তরুণ, ধনবান জোতদার, আভিজাতসুলভ বৈশিষ্ট্যে জনতাকে উত্তেজিত করে সীমাহীন অভিলাষ পূরণে পারঙ্গম এক ব্যক্তি।

সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছয় ফুট উচ্চতা-বিশিষ্ট চাবুকের মত পেটানো শরীর আহমেদ রাজা কাসুরীর। উচ্ছসিত কণ্ঠে ‘ধাসসালামু আলাইকুম’ এর পর আন্তরিক করমর্দন শেষে তিনি তাঁর মুঠি থেকে হাত ছেড়ে দিলে আপনাকে হাত মালিশ করতে হবে। কানের কাছে কয়েক গোছা চুলে পাক ধরেছে। তিনি চোখে চশমা পরেন। তাঁর পরনে ডোরাকাটা কাপড়ের শাট ও ট্রাউজার, তার ওপর বুক খোলা সোয়েটার। “আমি আহমেদ রাজা কাসুরী, ভূট্টো যাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিলেন,” তিনি নিজের পরিচয় দিলেন, “আর ইনি আমার মা, বেগম মায়মুনা বানো। তিনি লোহারু পরিবারের, আলীগড়ের নওয়াব ইসমাইল খানের ভাগনি এবং আপনাদের হিমাচল প্রদেশের গভর্নরের জ্ঞাতি বোন। ভূট্টোর পাঠানো ঘাতকরা যখন আমার আব্বাকে খুন করে, তখন উনিও সেই গাড়িতে ছিলেন।” তিনি বয়োবৃদ্ধা মহিলা, রূপালি-শাদা চুলের মাঝে তাঁর মুখ গাঢ় রঙয়ের। তাঁর চোখে পুরু চশমা। সারাজীবন তিনি পাঞ্জাবিদের মাঝে কাটালেও উর্দুতে কথা বলতে পছন্দ করেন।

রাওয়ালপিন্ডি কেন্দ্রীয় কারাগারে ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়ার কয়েক ঘন্টা পর আমি ইসলামাবাদে কাসুরীর বাংলোতে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি। আহমেদ রাজা আমাকে তাঁর ঝঞ্ঝাপূর্ণ রাজনেতিক জীবনের ওপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ক্লিপিংয়ের কয়েকটি অ্যালবাম দেখান। তাঁর মা আমাদেরকে চা পরিবেশন করছিলেন এবং কাসুরী আমাকে ক্লিপিং দেখাচ্ছিলেন। আমার কাছে তিনি প্রমাণ করতে চান যে, আদালতে শুনানির সময় ভূট্টো আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে কাসুরীকে যে ‘অচেনা’ বা ‘কেউ নয়’ বলে বর্ণনা করেছেন, তিনি কখনোই ‘অচেনা’ কেউ ছিলেন না; বরং তিনি দেশের অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একজন ছাত্রনেতা ছিলেন এবং এমন একজন ছিলেন, যিনি পিপলস পার্টি অফ পাকিস্তানকে (পিপিপি) গড়ে তুলতে ভূট্টোকে সহায়তা করেছেন। তিনি রাজরক্তের অধিকারী অভিজাত বংশধারার অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি, যে বংশের ইতিহাস ‘দ্য চিফস অফ দ্য পাঞ্জাব’ এ বর্ণিত হয়েছে। বাংলাদেশ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা, কর্তৃত্বপরায়ণ দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার অপরাধমুলক প্রয়োগের প্রশ্নে আহমেদ রাজা কাসুরী ভূট্টোর চক্ষুশূল ও প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেছিলেন। এরপর থেকে ভূট্টো তাঁকে হত্যা করার জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়েছেন যার পক্ষে তাঁর কাছে প্রমাণ রয়েছে।

“পিপিপি’র জন্ম হয়েছে কাসুরে আমার বাড়িতে এবং আমার বাড়িতেই পিপিপি কবরস্থ হয়েছে,” আহমেদ রাজা বলেন। তিনি একটি অ্যালবাম খুলে ১৯৬৭ সালের নভেম্বর মাসের সংবাদপত্রের ক্লিপিং দেখান যখন তিনি পিপিপি’র আহবায়ক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন, যে কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন জুলফিকার আলী ভূট্টো। কাসুরী ছিলেন কমিটির সর্বকণিষ্ঠ সদস্য এবং তাঁকে কমিটির অন্তর্ভূক্ত করার কারণ ছিল তিনি তখন লাহোরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্র নেতা ছিলেন। তাসখন্দ চুক্তির প্রতিবাদে মিছিলে ভূট্টোর সাথে তাঁর ছবি দেখা যাচ্ছিল অ্যালবামে। উভয়ে এক পক্ষকাল কারাগারে কাটান। দুই বছর পর ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসের একটি ছবিতে দেখা যায় ভূট্টোকে আটক করে রাখার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে কাসুরী নেতৃত্ব দিচ্ছেন; আরেকটি ছবিতে বেগম নুসরাত ভূট্টোকে কাসুরে আহমেদ রেজার বাড়িতে এবং একটি ছবিতে লাহোরে এক মিছিলে তাদের দু’জনকে টোঙ্গার ওপর দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি ভূট্টোর প্রার্থী ছিলেন এবং তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মিয়াঁ ইফতেখার উদ্দিনের পুত্র মিয়াঁ আরিফকে ৬০,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের কণিষ্ঠতম সদস্য নির্বাচিত হন।

এরপর থেকেই ভূট্টোর সাথে তাঁর মতানৈক্য শুরু হয়। তরুণদের মধ্যে আহমেদ রাজার বেড়ে চলা জনপ্রিয়তা এবং সংবাদপত্রগুলোর সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ভূট্টোকে ইর্ষান্বিত করে তোলে। সংবাদপত্রের সাথে সম্পর্ক এত ঘনিষ্ট ছিল যে তিনি ও ক্রিকেটার আবদুল হাফিজ কারদার সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চিত করার জন্য অনশন ধর্মঘট করেন। এক মাসের মধ্যে তাঁকে ও ভূট্টোকে প্রকাশ্যে ঝসড়ায় লিপ্ত হতে দেখা যায়। ভূট্টো পিপলস পার্টি থেকে পদত্যাগ করার হুমকি দেন এবং ১৯৭১ সালের ২ মে উভয়ে একজন আরেকজনকে দল থেকে বহিস্কার করে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী পিপিপি গঠন করেন।

আহমেদ রাজা কাসুরী সুফি সাধক বুল্লে শাহ’র উক্তি ‘সাচ বোলদিয়াঁ ভাম্বাদ বোলদে’ (সত্য গনগনে আগুন জ্বালিয়ে দেয়) উচ্চারণ করে বললেন, “ভূট্টো আমার স্পষ্টবাদিতা পছন্দ করতে পারেননি।” এরপর তিনি তাঁকে বিভিন্নভাবে অপমান করার কথা বললেন। ভূট্টো কাসুরীকে বলেছিলেন তার মাথা পরীক্ষা করাতে। কাসুরীও পাল্টা বলেন যে ভূট্টো একজন পাগল। যখন ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়, ভূট্টো তাঁর দলের সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে যেতে নিষেধ করে এই মর্মে হুমকি দেন কেউ যদি ঢাকায় যায় তাহলে তিনি তার পা ভেঙে দেবেন এবং যে যাবে তাকে ওয়ার-ওয়ে টিকেট নিয়ে যেতে হবে। কাসুরী পিপিপি’র একমাত্র সদস্য এর প্রতিবাদ করেন। তিনি যে শুধু ঢাকায় গিয়েছিলেন তা নয়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তিনি আবেদন জানান।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে জুলফিকার আলী ভূট্টো তেহরান সফরে গেলে কাসুরী তাঁকে সিআইএ’র এজেন্ট অভিহিত করেন। ১৯৭১ সালের আগস্টে পেশোয়ারের এক হোটেলে ভূট্টোর সমর্থকরা কাসুরীর ওপর হামলা চালায়। ভূট্টো যখন শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রশাসনকে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত করার জন্য “উধার তুম, ইধার হাম” বলে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, তখন কাসুরী পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ব্যাপারে ভূট্টোর অশুভ চক্রান্তের কথা বলে সোচ্চার হন।

আহমেদ রাজা কাসুরীকে ভূট্টো তাঁর জন্য প্রচণ্ড মাথা ব্যথা বলে বিবেচনা করতে থাকেন এবং ১৯৭১ সালের ১৭ জুলাই কাসুরীর জীবন নাশের জন্য হামলা চালান। ওই হামলায় তাঁর ভাই গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর ওপর একের পর এক হামলা করা হয় করাচি ও ইসলামাবাদে। কাসুরী এসব ঘটনার কারণে ভূট্টোর কাছে প্রতিবাদ জানালে ভূট্টো শুধু উত্তর দেন, “এতে আমার কী করার আছে?”

ভূট্টো যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের স্থলাভিষিক্ত হয়ে পাকিস্তানের শাসক হিসেবে আবির্ভূত হন তখন এই দুই ব্যক্তির দ্বন্দ্ব পার্লামেন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ভূট্টোর প্রস্তাবিত সংবিধানে কাসুরী স্বাক্ষর করতে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অংশ হতে অস্বীকৃতি জানান, যে ভূখণ্ডকে তিনি সবসময় পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। ১৯৭২ সালের ২০ ডিসেম্বর পিপিপি যখন পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় এক বছর পূর্তি উদযাপন করছিল আহমেদ রাজা কাসুরী কালো পতাকা মিছিল আয়োজন করেন এবং তাঁর ওপর মারাত্মক হামলা চালানো হয়। কোনো প্ররোচনা ছাড়াই জাতীয় পরিষদে কাসুরীর সদস্যপদ তিন মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

১৯৭৩ সালে বেলুচিস্তানের প্রাদেশিক স্বায়ত্বশানের দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়ে কাসুরী ভূট্টোর প্রশাসনকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পেলেন। সেই সন্ধ্যায় জাতীয় পরিষদের সদস্যরা যখন অধিবেশন শেষে বাড়ি ফিরছিলেন তখন তাদের ওপর সেনাবাহিনীর একটি জিপ চালিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় চৌধুরী ইকবাল নামে একজন সদস্য নিহত এবং অপর চার জন আহত হন। তারা সবাই ভূট্টোর সমর্থক ছিলেন। তারা কাসুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল, কিন্তু দৈবক্রমে তিনি অক্ষত ছিলেন। তাঁকে হত্যা করার জন্য আরেকটি প্রচেষ্টা চালানো হয় ১৯৭৪ সালের ২২ আগস্ট, তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে স্টেন গানের উপর্যূপরি গুলি করা হলেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। লাহোরে তাঁর ওপর চূড়ান্ত হামলা চালানো হয় ১৯৭৪ সালের ১১ নভেম্বর রাতে, যে হামলায় তাঁর পিতা গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

Published in Uncategorized

Comments are closed.