Skip to content →

জেনারেল জিয়াউল হক ও আমার মুগ্ধতা


খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু


দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে আমার নেয়া অনেক রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে যিনি জনসংযোগে নিজেকে অত্যন্ত চৌকস প্রমাণ করেছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক। তাঁর তথ্যমন্ত্রী অথবা জনসংযোগ অফিসাররা নয়, স্বয়ং তিনি যেসব মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তাদের ওপর উষ্ণতা ও শুভেচ্ছা স্থায়ী প্রভাব রেখে গেছেন। বিষয়টি আমি ব্যাখ্যা করছি। আমার বন্ধু এমএ রেহমান, যাকে আমি আমার লাহোরের দিনগুলো থেকে জানি, তিনি আমাকে লিখে জানান যে আমি জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই কিনা। সাথে সাথে আমি ইতিবাচক উত্তর দিলাম। অনেক কারণেই তিনি সংবাদ শিরোনাম ছিলেন। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল তাঁর পূর্বসূরী জুলফিকার আলী ভূট্টোর মৃত্যুদণ্ডের রায়, যার ভাগ্য নির্ভর করছিল জেনারেল জিয়ার হাতে।

আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নির্ধারণ করা হয়েছিল। একদিন আগে আমি ইসলামাবাদে পৌঁছলাম এবং আমাকে সেখানকার সবচেয়ে অভিজাত হোটেলে রাখা হলো। বিদেশি সাংবাদিকে গিজগিজ করছিল হোটেলটি; আমেরিকান, ব্রিটিশ, জার্মান, ভয়েস অফ আমেরিকা, বিবিসি, ডয়েচে ভেলে; ৮৫টি নাম বলুন, তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কোনোভাবে তারা আঁচ করেছিলেন যে পরদিন সকালে ভূট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। সান্ধ্য সংবাদপত্রগুলো একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে যে সেদিনই প্রেসিডেন্ট একজন ভারতীয় সাংবাদিককে তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য সময় দিয়েছেন। বিদেশি সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত করার জন্য এটি একটি কৌশল ছিল। ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়ার পর একজন ভারতীয় সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেবেন, এটি বিশ্বাস করা কঠিন ছিল।

পরদিন ভোররাতে ভূট্টোর ফাঁসি কার্যকর করা হলো। আমাকে কয়েকদিন পর আসার জন্যবলা হলো। জনগণের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমি একটি গাড়িতে ওঠে ইসলামামাবাদ ও পার্শ্ববর্তী ঘুরে সময় কাটালাম। বোরখা-পরা মহিলাদের একটি বিক্ষোভ মিছিল এবং মৃতের জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া সামান্য প্রতিক্রিয়া ছিল। দোকানপাট খোলা ছিল। আমি করাচি চলে গেলাম। মনি শংকর আয়ার করাচিতে ভারতীয় কনসাল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি আমাকে নগরীর অবস্থা দেখাতে বের হলেন। বাজারগুলো খোলা। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। শোকের দৃশ্যমান কোনো লক্ষণ নেই। আমি দিল্লি ফিরে গেলাম।

কয়েকদিন পর ইসলামাবাদে ফিরে এসে একই হোটেলে ওঠলাম। বিকেলে একটি সরকারি গাড়ি আমাকে উঠিয়ে ক্যান্টনমেন্টে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে নিয়ে গেল। আমি বৈঠকখানায় প্রবেশ করার পর আমাকে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে বলা হলো। টেবিলের ওপর আমার লেখা একগাদা বই দেখতে পেলাম। প্রেসিডেন্ট যে বইগুলো পড়েননি অথবা পড়ার কোনো ইচ্ছাও তাঁর নেই সে সম্পর্কে আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বইগুলো প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ পূরণ করেছে।

ভূট্টোর ফাঁসি সংক্রান্ত অনেকগুলো প্রশ্ন ছিল আমার। আমার ভেতরে যে বিষ জড়ো করে রেখেছিলাম তা নি:শেষ হয়ে গেল। তিনি সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা পরে এসে উষ্ণভাবে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, “সরদার সাহিব, আমাকে প্রশ্ন করার আগে মেহেরবানি করে আমার জন্য আপনার বইগুলো স্বাক্ষর করে দিন। যদিও তাঁর কথায় আমি আমোদিত হয়েছি, তবুও তাঁকে প্রশ্ন করলাম, “জেনারেল সাহিব, ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আপনি তাঁকে ক্ষমা করতে পারতেন এবং তাঁর সাজা লাঘব করতে পারতেন?” দৃঢ়তার সাথে তিনি উত্তর দিলেন, “ক্ষমার অধিকার আল্লাহর হাতে, মানুষের হাতে নয়। তিনি খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার একমাত্র সাজা মৃত্যু।”

জিয়া গড় উচ্চতা-বিশিষ্ট ছিলেন, চুলে ভালোভাবে তেল মাখতেন এবং সিঁথি কাটতেন মাঝ বরাবর। তাঁর কালো চোখের চারপাশ ঘিরে কালো দাগ। লোকজন তাঁকে বলতো ‘সুরমে ওয়ালি সরকার,’(সুরমা পরা সরকার প্রেসিডেন্ট)। আমার প্রশ্ন শেষ হওয়ার পর তাঁর বেগম, ফর্সা মোটাসোটা মহিলা এবং তাদের ১২ বছর বয়সী মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে আমাদের সঙ্গে চা পানের সময় যোগ দিলেন। আমি বিদায় নেয়ার সময় জেনারেল জিয়া আমার জন্য গাড়ির দরজা খুললেন। আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধান এটা করেননি। এক বা দুই বছর পর রেহমান আমাকে বললেন লাহোরে তাঁর ছেলের বিয়েতে অংশগ্রহণের জন্য।

মদপানের ওপর পাকিস্তানে যদিও কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল, আমি আমার বিছানার পেছনের শেলফে স্কচ হুইস্কির ছয়টি বোতল দেখতে পেলাম; জেনারেল জিয়ার সৌজন্যে। আমি আমার জন্মস্থান হাদালি গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। লাহোর থেকে হাদালির দূরত্ব ৩০০ মাইল। আমাকে একটি গাড়ি দেয়া হয়েছিল। আমার গ্রামবাসীরা আমাকে উষ্ণতার সাথে অভ্যর্থনা জানালেন। এটাও জেনারেল জিয়াউল হকের সৌজন্যে। এক বছর পর আমার স্ত্রীর জ্ঞাতি বোন কুন্তালিন কাউর, যিনি একজন মুসলিমকে বিয়ে করেছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নূরজাহান বেগম নাম গ্রহণ করেছিলেন, তিনি আমার সাহায্য কামনা করলেন। তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ঘোষণা করে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আমি এ বিষয়ে জেনারেল জিয়াকে লিখলাম। সম্পত্তিতে তাঁর অধিকার পুন:প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী শরণ সিং প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাঁকে এবং আটজন ভারতীয় কূটনীতিককে তিনি নৈশভোজে আমন্ত্রণ করেছিলেন। ভোজের পর শরণ সিং প্রেসিডেন্টে গাড়িতে তাঁর হোটেলে ফিরে আসেন। আমাদের হাইকমিশনার তাঁর গাড়িতে ওঠে চলে যান। দিলীপ মেহতা ও লাম্বা’র একটি অ্যামবেসেডর গাড়ি ছিল। গাড়ির ব্যাটারি খারাপ হয়ে যায় এবং ষ্টার্ট নেয়ার জন্য গাড়ি ধাক্কা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। প্রেসিডেন্টের বাসভবনের পোর্চে দিলীপ ও লাম্বা যখন গাড়ি ধাক্কা দিচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট তাদের সাথে যোগ দেন গাড়ি ধাক্কা দিতে। এরপর তিনি দু’জনের সাথে হাত মেলান ও হাত নেড়ে বিদায় জানান।

জেনারেল জিয়াউল হকের সাথে আমার আনন্দময় স্মৃতি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ভুল বানানে লেখা আমার নামের নিচে জেনারেলের স্বাক্ষর করা তাঁর পক্ষ থেকে আমাকে উপহার দেয়া শিল্পী চুগতাইয়ের অলঙ্করণ শোভিত মির্জা গালিবের কবিতার বই। আমার কাছে তিনি ‘মর্দ-ই-মোমিন’ ও ‘মর্দ-ই-হক্ক’।
১৯৮৮ সালের ১৭ই আগষ্ট জিয়াউল হকের বিমানে বোমার বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং আটজন পাকিস্তানি জেনারেল ও অন্যান্য লোকজন নিহত হলে অত্যন্ত দু:খবোধ করি। আজ পর্যন্ত কেউ জানে না যে এর পেছনে কে ছিল এবং কেন। পাকিস্তানের একমাত্র মদ ব্যবসায়ী মিনু ভাণ্ডারা আয়োজিত এক ডিনারে জেনারেল জিয়ার ছেলের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ঘটনা সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা আছে কিনা। তিনি তাঁর সন্দেহের কথা বললেও ঘাতকদের পরিচয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি। খুব কমসংখ্যক লোক আমার মতামতের সাথে একমত হয়। অধিকাংশ মানুষ জিয়ার নাম শুনলে থুথু ছিটায়। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত রাশিয়াকে বিতাড়ন করার উদ্দেশে মুজাহেদিন ও তালিবানকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য জেনারেল জিয়া আমেরিকানদের হাতে তাদের মর্জির পুতুল ছাড়া আর কিছু ছিলেন না। তিনি পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে তালিবানের অভয়ারণ্যে পরিণত করার সুযোগ প্রদান এবং দেশে কঠোর শরিয়াহ আইন কার্যকর করেন।

তাঁর ১১ বছরের শাসনকাল ছিল স্বেচ্ছাচারমূলক, যার ফলে দেশ চলে গিয়েছিল ধর্মীয় চরমপন্থীদের হাতে, যা থেকে পাকিস্তান আর কখনো উদ্ধার পায়নি। মোহাম্মদ হানিফ নামে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন অফিসার, যিনি বর্তমানে বিবিসি উর্দু বিভাগের প্রধান, তিনি সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ করেছেন “এ কেস অফ এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোজ” নামে তাঁর লেখা চমৎকার উপন্যাস।
তিনি জেনারেল জিয়াকে চিত্রিত করেছেন ভীত ছোটখাট আকৃতির মানুষ, যিনি এমনকি নিজের ছায়াকেও ভয় করেন; লুকায়িত বাণীর জন্য তিনি সারাক্ষণ কোরআন ঘাটেন, যাকে তাঁর সন্দেহ তাকে কঠোর শাস্তি দিয়ে তিনি সুখ লাভ করেন; তাঁর শাস্তির কবল থেকে এমনকি একজন অন্ধ নারী নিস্কৃতি পাননি, বিধবাদের নগদ অর্থ বিতরণের সময় যে নারী একটি দৃশ্যের অবতারনা করেছিলেন। তিনি প্রচারণা পছন্দ করতেন এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ধার্মিকতা সত্বেও তাঁর চোখ খুঁজে ফিরে মহিলাদের জামার বুকের অংশের ফাঁকা স্থান, যাতে তাদের স্তন দেখতে পারেন। তিনি মদ্য পান করতেন না। প্রেসিডেন্ট জিয়া বিমানে তাঁর সাথে আমের যে ঝুড়িগুলো নিয়েছিলেন তাতে যিনি বা যারা ট্ইাম বোমা স্থাপন করেছিলেন হানিফ তার উপন্যাসে তাদের কাজের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। পুরোটাই কল্পকাহিনি, কিন্তু আকর্ষণীয় ও সুপাঠ্য।

ইংরেজি ভাষার ওপর চমৎকার দখলসহ মোহাম্মদ হানিফ আজন্ম গাল্পিক। প্রকাশক আশ্বাস দিয়েছেন বইটি বেষ্ট-সেলার হবে। কিন্তু ধারণা করা হচ্ছে বইটি পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হতে পারে। অতএব প্রত্যেক পাকিস্তানি ও ভারতীয় অবশ্যই বইটি পাঠ করার ইচ্ছা পোষণ করবেন।
(২০০৮ সালে প্রকাশিত মোহাম্মদ হানিফ এর “এ কেস অফ এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গোজ” উপন্যাসটি শুধু বেষ্ট-সেলার নয়, অনেকগুলো পুরস্কার অর্জন করেছে এবং পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়নি। ইংরেজির পাশাপাশি বইটির উর্দু সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে)।

Published in Uncategorized

Comments are closed.