খুশবন্ত সিং
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
(ভূট্টো পরিবারের নিয়তি অপঘাত মৃত্যুর সাথে জড়িত। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে জুলফিকার আলী ভূট্টোর মত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তাঁর পুত্র শাহ নওয়াজ ভূট্টোকে ১৯৮৫ সালে হত্যা করা হয় ফ্রান্সে। ্অপর পুত্র মীর মুর্তাজা ভূট্টো ১৯৯৬ সালে করাচিতে গুলিতে নিহত হন এবং ২০০৭ সালে রাওয়ালপিণ্ডিতে গুলির আঘাত ও বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন বেনজীর ভূট্টো)।
জুলফিকার আলী ভূট্টোর নাতনি, মীর মুর্তাজা ভূট্টোর কন্যা ফাতিমা ভূট্টো তাঁর অনবদ্য রচনায় নিজের পরিবারের দু:খজনক ঘটনাগুলো তুলে আনলেও তাঁর প্রিয় দাদার বাড়াবাড়ির দিকগুলো কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। ফাতিমা ভূট্টোর লেখা “সংস অফ ব্লাড এণ্ড সোর্ড: এ ডটারস মেমোয়ার” ভূট্টো পরিবারের ইতিহাসের ওপর চমৎকার গদ্যে লেখা কাহিনি পাঠ করে যেকোনো মুগ্ধ হতে পারত, যদি না বইটি ভয়ঙ্কর সব চক্রান্ত, বিশ্বাসঘাতকতা, হিংস্রতা ও ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ডের বিবরণে পূর্ণ না থাকত। এটি এক দীর্ঘ দু:স্বপ্ন, যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত পাঠকের রাতের ঘুম বিঘ্নিত করবে; কাহিনির চরিত্রগুলোর মত পাঠক অনিদ্রার শিকারে পরিণ হবে। বইটি জুলফিকার আলী ভূট্টো ও তাঁর দুই কন্যা ও দুই পুত্রের রাজনৈতিক জীবন কাহিনি এবং লিখেছেন তাঁর বড় পুত্র মীর মুর্তাজা ভূট্টোর কন্যা ফাতিমা ভূট্টো।
ভূট্টো পরিবার পাকিস্তানের লারকানা জিলার গরহি খুদা বখশ এ অবস্থিত সিন্ধের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ ভূমি মালিক। তারা ছিলেন ‘ভাদেরো’ Ñ বড় লোক। তারা বাস করতেন অসংখ্য ভৃত্য ও সশস্ত্র প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় প্রাসাদোপম বাড়িতে। তাদের দ্বিতীয় আবাস ছিল করাচির অভিজাত আবাসিক এলাকা ক্লিফটনে, যেখান থেকে চোখে পড়ে আরব সাগর। তারা তাদের সন্তানদের পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছেন আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডের সেরা স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় র্যাডক্লিফ, হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ডে। পরিবারের কারও জন্মদিন পালনের জন্য পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য মহাদেশগুলো পাড়ি দিতে তারা কখনও দ্বিতীয় বার চিন্তা করেননি। এবং তারা সবাই পাকিস্তানের রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন।
জুলফিকার আলী ভূট্টো ছিলেন জুনাগড়ের দিওয়ান স্যার শাহ নওয়াজ ভূট্টোর পুত্র। জুলফিকার তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন কাটান বোম্বেতে। ১৯৪৭ সালে জুনাগড়ের নওয়াব তাঁর দিওয়ানের পরামর্শে পাকিস্তানে যোগদানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর ভূট্টো পরিবার পাকিস্তানে তাদের পারিবারিক ভূমি সিন্ধে ফিরে আসেন। সকল ভারতীয়, বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি জুলফিকারের অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছিল তখনই। উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশে ভূট্টো হার্ভার্ডে যান এবং ‘ডাস ক্যাপিট্যাল’ পাঠ করার পর মার্ক্সবাদীতে পরিণত হন। তিনি যখন অক্সফোর্ডে ছিলেন তখন তাঁর মাঝে মার্ক্সবাদ গভীর স্থান করে নেয়। তিনি পাকিস্তানকে সামন্ত রাষ্ট্র থেকে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সংকল্পবদ্ধ ছিলেন।
দেশে ফিরে আসার পর তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ও বিজয়ী হন। তাঁকে রাষ্ট্রের মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভূক্ত করা হয় এবং জেনারেল আইয়ুব খানের মন্ত্রীসভায় তিনি সর্ব কণিষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। একনায়ক-জেনারেল পাকিস্তানকে আমেরিকান নীতির অধীনস্থ করে কমিউনিষ্ট চীন ও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে একটি বেষ্টনি তৈরি করে দিয়েছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে জুলফিকার আলী ভূট্টো অনেকটা তাঁর প্রেসিডেন্টের নাকের নিচ দিয়েই পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দেন। তিনি চীনের সঙ্গে আলোচনার পথ উন্মুক্ত করেন। চীন পাকিস্তানকে আমেরিকানদের চেয়েও উদারভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং ভারতের সাথে দ্বন্দ্বের প্রশ্নে চীন হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানের প্রধান মিত্রে। এরপর ভূট্টো ব্যক্তি মালিকানায় জমির পরিমাণ নির্ধারণ, ব্যাংক ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প জাতীয়করণের উদ্যোগ নেন। একটি ক্ষেত্র তিনি স্পর্শ করেননি, তা হলো মুসলিম ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, কারণ তিনি তাদের সমর্থন লাভ করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদের প্রাচীন আইনগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে মদ্যপান নিষিদ্ধ ও আহমদিয়াদের অমুসলিম বলে ঘোষণা করেন।
ক্ষমতাচ্যূত হয়ে জুলফিকার আলী ভূট্টে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। দলের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় এক শিয়া মতাবলম্বী ও ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সৈয়দা হামীদের চাচা মুবাশ্বের হোসেনের বাসভবনে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে তাঁর কৃতিত্ব ছিল পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত করার প্রক্রিয়া সূচনা করা এবং পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করতে পরোক্ষভাবে সহায়তা করা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যেকোনো ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে, যা তাঁর কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রক্ষা করেন এবং ঢাকায় তাঁর নিজের সরকারের কাছে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। তাঁর প্রধান বিচ্যুতি বা ঘাটতি ছিল তাঁর অহঙ্কার। বেশ ক’জন সিনিয়র জেনারেলকে ডিঙিয়ে তিনি জেনারেল জিয়াউল হককে সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগ করার পর প্রকাশ্যে জিয়াউল হককে বিদ্রƒপ ও অবমাননা করতে শুরু করেন। জেনারেল জিয়া তাঁকে নিয়ে জনসমক্ষে ঠাট্টা-মস্করা করার কারণে ভূট্টোঁকে কখনো ক্ষমা করতে পারেননি। জুলফিকার আলী ভূট্টোকে যখন মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয় (একজন বিচারক ভিন্ন রায় দিয়েছিলেন, যিনি একজন পার্সি ছিলেন), জিয়াউল হক তাঁকে ক্ষমা করার জন্য গোটা বিশ্বের আবেদন অগ্রাহ্য করেন। তিনি বলেছিলেন, “দুটি লাশ, একটি কফিন,” অর্থ্যাৎ এটি হয় ভূট্টো অথবা তিনি। ১৯৭৯ সালে ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়া হয়।
ফাতিমা ভূট্টো তাঁর দাদা জুলফিকার আলী ভূট্টো ও পিতা মীর মুর্তজা ভূট্টোর প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। তাঁর কাছে তাদের একজনও সম্ভবত কোনো ভুল করতে পারেন না। কিন্তু তাঁর দাদার যে আরেকটি দিক ছিল, যা তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন। জুলফিকার আলী ভূট্টোর সাথে বেশ ক’বার আমার সাক্ষাৎ করার এবং সমালোচকরা তাঁর সম্পর্কে কী বলেছেন তা পাঠ করার সুযোগ হয়েছে। তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় লাহোরে মনজুর কাদিরের বাড়িতে, যে বাড়িটি দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত আমার বাড়ি ছিল। মনজুর আইয়ুব খানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন। তিনি যখন দর্শনার্থীদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন এবং আমি একা তাঁর পাঠকক্ষে ছিলাম, তখনই একজন দামী ও রুচিসম্মত পোশাক পরিহিত সুদর্শন এক তরুণ প্রবেশ করলেন। আমি তাঁকে কলেজের ছাত্র বলে ধারণা করেছিলাম। মনজুর এসে বললেন, “ও, তোমাদের তাহলে পরিচয় হয়েছে।” আমাদের পরিচয় হয়নি বলার পর মনজুর আমাকে বললেন যে উনি জুলফিকার, মন্ত্রীসভায় সর্বকণিষ্ঠ মন্ত্রী। তাদেরকে একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিতে আমি রুম থেকে বের হয়ে আসি। ভূট্টো মনজুর কাদিরের বন্ধুত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন তাঁকে মুক্তমনা ও ভালো মুসলিম নয় হিসেবে নিন্দা করার মধ্য দিয়ে। মনজুরকে মন্ত্রীসভা থেকে বাদ দেয়া হয়। তিনি আইন পেশায় ফিরে যান এবং পাঞ্জাব হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এখন পর্যন্ত আমি তাঁর মতো সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষের দেখা পাইনি।
ভূট্টো আমাকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান। আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় করাচিতে। তাঁর বাড়ির লনে বসে আমরা মদ্যপান করি। দু’দিন পর আমি ইসলামাবাদে তাঁর সঙ্গে আরেকটি সন্ধ্যা কাটাই এবং দ্বিতীয় দফা পান করি। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি আমাকে একটি বার্তা দেন যে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত উদগ্রীব। পরদিন সকালে আমাকে পার্লামেন্টের অধিবেশন দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পার্লামেন্টে দেশের উন্নয়নের ধীর গতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়। ভূট্টো তরল ভর্তি একটি বোতল হাতে বিরোধী দলের আসনের দিকে যান এবং দর্শনীয় ভঙ্গিতে সেটি বিরোধী দলীয় নেতার হাতে তুলে দেন। বোতলে ছিল পেট্টোল Ñ পাকিস্তান জ্বালানি তেল পেয়েছে। এটি ছিল আস্থা অর্জনের উজ্জ্বল প্রদর্শন।
আমি দিল্লি ফিরে এসে মিসেস গান্ধীর সাথে সাক্ষাতের জন্য সময় প্রার্থনা করি। তাঁকে ভূট্টোর শুভেচ্ছা বার্তার কথা জানাই। তিনি এক বাক্যে উত্তর দেন, “সে জঘন্য এক মিথ্যুক।”
এক সময় ভূট্টো তাঁর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির একটি সক্রিয় যুব সংগঠন গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁকে লণ্ডন-ভিত্তিক এক তরুণ পাকিস্তানি সাংবাদিকের নাম বলা হয়। ভূট্টো যা বলে তার ব্যাপারে আপত্তি জানান, তা হলো, “আমার মনে হয় না যে আমাকে সে খুব একটা পছন্দ করে। কারণ সে জানে আমি তার মাকে সঙ্গম করেছি।”
আরেক বার তিনি তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যদের তাঁর সাথে নৈশাহারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তারা যথাসময়ে আসেন এবং তাদেরকে ফলের জুস পরিবেশন করা হয়। ভূট্টো সাহিব তখন অন্য এক রুমে তাঁর মোসাহিব-চামচাদের সাথে হুইস্কি পান করছিলেন। মন্ত্রীরা তাঁর জন্য দুই ঘন্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। সবচেয়ে প্রবীণ মন্ত্রীর পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি, তিনি বাড়ি চলে যান। শেষ পর্যন্ত ভূট্টো যখন তাদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য এসে জানতে পারেন যে বয়োজ্যষ্ঠ মন্ত্রী বাড়ি চলে গেছেন। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং তাঁর লোকজনকে পাঠান মন্ত্রীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে ধরে আনতে। পরদিন বেচারা মন্ত্রী পাকিস্তান ছেড়ে পালায়।
এসব কথা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং সবই মানুষের সাধারণ জ্ঞানের মধ্যে আছে। কিন্তু এসব ঘটনা ফাতিমা ভূট্টোর বীরগাঁথার মধ্যে স্থান পায়নি।
ফাতিমা ভূট্টো তাঁর দাদাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী বিক্ষোভের কথা লিখেছেন। ভূট্টোর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সময় ঘটনাক্রমে আমি জেনারেল জিয়াউল হকের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য ইসলামাবাদে ছিলাম। আমি একটি অভিজাত হোটেলে অবস্থান করছিলাম, এবং বিদেশি সাংবাদিকদের অধিকাংশই ওই হোটেলে অবস্থান করছিলেন। তারা কারাকর্মীদের ঘুষ দিয়ে পরদিন ভূট্টোর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য গৃহীত প্রতিটি পর্যায়ের খুঁটিনাটি খবর পাচ্ছিলেন। প্রেসিডেন্টের সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বিদেশি সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত করার কৌশল হতে পারে: ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়ার পর প্রেসিডেন্ট কিছুতেই একজন ভারতীয় সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিতে সম্মত হতে পারেন না। আসলে কি তিনি আমাকে সাক্ষাৎকার দেবেন? না, তারা বোকা ছিলেন না। পরদিন আমি হোটেল রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেলাম ট্যাংক ও সাজোয়া যান হোটেল ঘিরে রেখেছে। আমাদের রাষ্ট্রদূত শংকর বাজপেয়ীকে ফোন করে তাঁকে পরিস্থিতি জানালাম। তিনি বললেন, “কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি আপনাকে ফোন করছি।” একটু পর তিনি ফোন করলেন, “ওরা ওদের কাজ শেষ করেছে।” নাশতা করার জন্য আমি নিচে রেষ্টুরেন্টে গেলাম। ওয়েটাররা আমাকে ঘিরে ধরে জানতে চাইলেন, “সরদার সাহেব, ইয়েহ খবর সাচ হ্যায়?” আমি উত্তর দিলাম, “জি, সাচ হ্যায়।” তাদের পক্ষ থেকে সাড়া ছিল, “বহুত জুলম হুয়া।”
কিছুক্ষণ পর আমি ইসলামাবাদের অদূরে রাওয়ালপিণ্ডি গেলাম সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। দোকানপাট সব বন্ধ এবং এখানে ওখানে লোকজন জটলা পাকিয়ে নিচু গলায় কথা বলছে। বিকেলে বোরখা-পরা মহিলাদের নেতৃত্বে একটি মিছিল মীনাবাজার প্রদক্ষিণ করল। পুলিশ তাদেরকে কোনো বাধা দেয়নি। মৃতের জন্য প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হলো।
জেনারেল জিয়ার সাথে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট এক সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। আমি করাচি গেলাম সেখানে কোনো বিক্ষোভ হচ্ছে কিনা দেখতে। আমাদের কনসাল মনি শংকর আয়ারের সঙ্গে অবস্থান করলাম। গাড়িতে ওঠে বিকেলে আমরা নগরীতে ঘুরে বেড়ালাম। সিনেমা হলগুলো বাইরে দর্শকদের দীর্ঘ সারি। মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলছিল। দেখে মনে হলো অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি।
জেনারেল জিয়ার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য এক সপ্তাহ পর আমি ইসলামাবাদে ফিরে এলাম। তাঁর বাড়ির গেটে অল্প কয়েকজন প্রহরী ছিল। অত্যন্ত সৌজন্যের সাথে তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাঁর মেদবহুল বেগম ও মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তাঁর কাছে আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল, “জেনারেল সাহিব, ভূট্টোকে ফাঁসি দেয়ার কি প্রয়োজন ছিল? আপনি কি তাঁকে ক্ষমা করতে পারতেন না?” তিনি উত্তর দিলেন, “তিনি খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, যার একমাত্র সাজা মৃত্যু। ক্ষমা করার অধিকার মানুষের হাতে নেই, ক্ষমা করতে পারেন শুধু আল্লাহ।”
ফাতিমা ভূট্টো তার ফুফু বেনজীর ও তাঁর স্বামী, বর্তমান প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারি সম্পর্কে যে নিচু মতামত ব্যক্ত করেছেন তার সাথে আমি একমত পোষণ করি। রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে বেনজীর দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা সত্বেও সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেননি। বরং তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যাণ্ডে রিয়েল এষ্টেট সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। এ সম্পর্কে নিউইয়র্ক টাইমসে বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর স্বামী আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন এবং সংশয়পূর্ণ লেনদেনে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে সুইজারল্যাণ্ডের আদালত কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছে। সরকারের সাথে কোনো ব্যবসায়িক চুক্তির কমিশন গ্রহণের জন্য এখনও তিনি ‘মিষ্টার টেন পার্সেন্ট’ নামে পরিচিত। তাছাড়া তিনি অমার্জিত এবং অশ্লীল গালিগালাজ করতে অভ্যস্ত।
ফাতিমা ভূট্টোর পিতা মীর মর্তুজা ভূট্টোকে জানার সুযোগ আমার হয়নি, যার প্রতি ফাতিমার প্রশংসা সীমাহীন। দৃশ্যত তিনি যেমন সুদর্শন ছিলেন তেমনি ভালো মানুষও ছিলেন। তার গ্রন্থের শেষ দিকের পৃষ্ঠাগুলোতে তিনি আসিফ জারদারিকে সরাসরি অভিযুক্ত করেছেন চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং অনুগত বিচার বিভাগের মাধ্যমে সকল অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত করিয়ে নেয়ার জন্য। ফাতিমা ভূট্টো সুন্দরী, উচ্চ মেধা ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন। তিনি করাচিতেই বসবাস করছেন। আমি তার দীর্ঘ জীবনের জন্য প্রার্থনা করি।
Comments are closed.