Skip to content →

সাক্ষাৎকার: বাংলাদেশের বিজয় ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের সেরা অর্জন

অ্যাম্বরিশ কাথেওয়াড় দিওয়ানজি
অনুবাদ: আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

[ভারতের সাহিত্য ও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র পরলোকগত খুশবন্ত সিং-এর মতে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জীবনের সেরা মুহূর্ত এবং সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল বাংলাদেশকে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করায় সহায়তা করা। যেভাবে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন তা নজিরবিহীন, যখন তাঁর সব দক্ষতা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল। তিনি পাকিস্তানকে পুরোপুরি আহাম্মকে পরিণত করেছিলেন। শরণার্থী সমস্যা যখন চরমে পৌঁছে তখন তিনি তাঁর বিচক্ষণতার প্রমাণ দেন। পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এ অসামান্য বিজয়ে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘ভারত রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। খুশবন্ত সিং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যেমন নিবিড়ভাবে মিশেছেন ভারতের খুব কম সংখ্যক সাংবাদিকের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। অধুনালুপ্ত ইংরেজি ম্যাগাজিন ‘ইলাসট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া’ ও ‘দ্য হিন্দুস্থান টাইমস’-এর সম্পাদক হিসেবে তিনি ইন্দিরা গান্ধীর ১৬ বছর দীর্ঘ শাসনকালের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্ত খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। খুশবন্ত সিং তাঁর মৃত্যুর ১০ বছর আগে ২০০৪ সালে rediff.com নিউজ-এর সম্পাদক অ্যাম্বরিশ কাথেওয়াড় দিওয়ানজির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সেই স্মৃতিচারণ করেন।]

দিওয়ানজি: ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর ২০ বছর পর আপনি তাঁর সঙ্গে আপনার স্মৃতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

খুশবন্ত সিং: ইন্দিরা গান্ধীর দুটি দিক ছিল। একটি রাজনীতিবিদের এবং অপরটি একজন মানুষের। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সম্পর্কে সবার সাধারণভাবে জানা আছে, কিন্তু একজন মানুষ হিসেবে তাঁর সম্পর্কে এবং তাঁর পরিবার ও কর্মচারীদের সম্পর্কে খুব কম সংখ্যক লোকই জানেন। বাদবাকি বিষয় সন্ধিক্ষণ ও যোগসূত্র এবং সবাইকে তা বিশ্বাস করতে হয়।

দিওয়ানজি: আপনার সঙ্গে কীভাবে তাঁর পরিচয় হয়েছিল?

খুশবন্ত সিং: তাঁর সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তখন তিনি অবিবাহিতা ছিলেন। কাশ্মীর যাওয়ার পথে তিনি লাহোরে আসেন। তিনি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ছিলেন, যারা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের বাড়িতে তোলা তাঁর সঙ্গে আমার একটি ছবি আছে। তিনি অত্যন্ত লাজুক ছিলেন এবং খুব বেশি কথা বলতেন না। পরবর্তী সময়ে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় যখন তিনি কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন। একটি সভায় তিনি সভাপতিত্ব করছিলেন এবং আমার যতদূর মনে পড়ে, আমি সেখানে ম্যাডাম ক্যামার (নারী নেত্রী ভিকাইজি ক্যামা) ওপর বক্তব্য দিচ্ছিলাম। এরপর তিনি যখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সরকারে তথ্য ও বেতারমন্ত্রী হন তখন নিউইয়র্ক টাইমসের পক্ষ থেকে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনার ওপর একটি নিবন্ধ লেখার জন্য। নিবন্ধটি তাঁর সম্পর্কে বিরূপভাবে লেখা হয়েছিল, কারণ এতে আমি কিছু লোকের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম, যারা বলেছিলেন যে, তাঁর পক্ষে দেশের নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়। ভারত কখনো কোনো নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়নি। আমাদের একজন রাজিয়া সুলতানা ছিলেন, কিন্তু সেই একবার। আমি এ কথাও বলেছিলাম যে, শুধুমাত্র নেহরুর কন্যা হওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো যোগ্যতা নেই। বাস্তবেও পিতার কারণে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি পদে আসীন হওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না।

দিওয়ানজি: কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিই তো প্রধানমন্ত্রী হলেন-

খুশবন্ত সিং: ঘটনা হলো, লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর পর জনগণ প্রধানমন্ত্রী পদে গুলজারীলাল নন্দা অথবা মোরারজি দেশাইকে চায়নি। অতএব তিনি প্রধানমন্ত্রী হন এবং যারা তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন তারা ভেবেছিলেন যে, তারা তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু এই লোকগুলো তাঁর জন্মগত রাজনৈতিক বোধ ও চেতনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না অথবা প্রধানমন্ত্রী পদের যে নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে তা তারা খতিয়ে দেখেননি। প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি মোরারজি দেশাই এবং কামরাজের মতো অন্যদের কোণঠাসা করে ফেলেন। তিনি অনেকটা একনায়কের মতো শাসন করেছেন। লোকজন বলত যে মন্ত্রিসভায় মাত্র এক লোক (ইন্দিরা গান্ধী) আছেন এবং বাকি সবাই হিজড়া। আসলে তিনি তাদেরকে ওই পর্যায়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন।

দিওয়ানজি: তাঁর শাসনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?

খুশবন্ত সিং: তাঁর শাসনের ব্যাপারে আকর্ষণীয় তেমন কিছু নেই। তিনি কোনো ধরনের সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। কিছু লোকের প্রতি তিনি ঘৃণা পোষণ করতেন, কারণ তিনি ভাবতেন যে তারা তাঁকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তাদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো একজন ভালো ও সৎ লোকও ছিলেন। তিনি তাঁকে সহ্যই করতে পারতেন না, কারণ তিনি একজন জাতীয় নেতা হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি বড় চ্যালেঞ্জ ছিলেন, বিশেষ করে তাঁর শাসনের ব্যাপারে যখন জনগণের মোহ ভঙ্গ হয়েছিল। দেশে নানা সংকট ছিল, খরা চলছিল এবং জয়প্রকাশ নারায়ণ একজন নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। দুর্নীতির ব্যাপারে তিনি অতিমাত্রায় সহনশীল ছিলেন, যা তাঁর বিরুদ্ধে আরেকটি বড় নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল। তিনি ভালোভাবে অবগত ছিলেন যে, তাঁর কিছু মন্ত্রী চরম দুর্নীতিপরায়ণ, তা সত্ত্বেও যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের দুর্নীতির কারণে তাঁর কোনো ক্ষতি না হয়েছে ততক্ষণ তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তিনি যদি কাউকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে জানতেন তবুও তাকে সহ্য করতেন। কিন্তু তাঁর ক্ষতির কারণ ঘটলে তিনি ওই ব্যক্তির খপ্পর থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতেন। দুর্নীতির ব্যাপারে আসলে তাঁর জোরালো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না, যে কারণে তাঁর সময়ে দুর্নীতি আকাশ ছুঁয়েছিল। এ ছাড়া তিনি শিক্ষিত, মার্জিত লোকদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। যার ফলে যশপাল কাপুর, তাঁর অফিসের স্টেনোগ্রাফার আরকে ধাওয়ান এবং তাঁর পেছনে ঘুরঘুর করে বেড়ানো মোহাম্মদ ইউনুসের মতো লোকজনের উত্থান ঘটেছিল। আমার বিশ্বাস, তাঁর উচ্চশিক্ষা না থাকার কারণেই এমন হয়েছিল। তিনি শান্তি নিকেতনে গিয়েছিলেন, এরপর বিদেশে ব্যাডমিন্টন স্কুলে যান, সেখান থেকে যান অক্সফোর্ডে। কোনো জায়গায় তিনি কোনো পরীক্ষা দেননি অথবা কোনো ডিগ্রি অর্জন করেননি। আমার মনে হয়, একজন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ার কারণে তাঁর মধ্যে এক ধরনের ভিন্নবোধের সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি অনেক বই পড়েছেন বলে মনে করতেন। তিনি ফরাসি ভাষায় কথা বলেন, যা তিনি শিখেছিলেন তাঁর অসুস্থ মা কমলার সঙ্গে সুইজারল্যান্ডে অবস্থানের কারণে, এটি তাঁর পক্ষে গেছে। সবকিছুর ভালো ও মন্দ দিক রয়েছে, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ এবং যাদের অতীত স্বচ্ছ ও গৌরবের তাদের সাহচর্যে তাঁর মধ্যে এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ কাজ করত। দ্বিতীয় স্তরের লোকজনের সঙ্গে তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

দিওয়ানজি: তাঁর এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে, এর ফলে ভারতের কতটা ক্ষতিসাধিত হয়েছে?

খুশবন্ত সিং: তিনি নিরাপত্তাবোধ করতে পারেননি বলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলেছিলেন। সামর্থ্য ও যোগ্যতার চেয়ে আনুগত্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে তিনি তাঁর সমর্থকদের পার্লামেন্টে জড়ো করেছিলেন; বিচারপতিদের ডিঙিয়ে তাঁর অনুগতদের ওপরে বসিয়েছেন; তিনি সিভিল সার্ভিসকে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছেন। পক্ষপাতিত্ব ও আনুকূল্য প্রদর্শন তাঁর কাছে খেলার মতো হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানতেন যে লোকজনকে কীভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে হবে এবং এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত কুশলী ছিলেন। তিনি কারও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন না, কিন্তু যখন তাঁর মনে হতো যে লোকটি বড় কিছু হয়ে যাচ্ছে তখন তাকে ঊর্ধ্বতন কোনো পদে নিয়োগ করার পরিবর্তে তাকে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী পদে নিয়োগ করতেন। কারণ তিনি জানতেন এর ফলে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূচনা হবে। এর সবচেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত হচ্ছেন ভিপি সিং। তাঁর বড় ভাই এসবি সিংকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ করা হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী বেছে নিলেন ভিপি সিংকে, যিনি তাঁর বড় ভাইয়ের চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করার জন্যই এটি করা হয়েছিল। অত্যন্ত চিন্তাভাবনা ও হিসাব কষে তিনি কাজটি করেছিলেন এবং এই দরকষাকষিতে দুই ভাই পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হন এবং তাদের পরিবার ভেঙে যায়। কিন্তু সুদূরপ্রসারী চিন্তা করলে দেখতে পাবেন তিনি যে খেলা শুরু করেছিলেন তা দেশের জন্য ভালো ছিল না।

দিওয়ানজি: ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে বড় সাফল্য কী?

খুশবন্ত সিং: যেভাবে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন সেটিই ছিল তাঁর জীবনের সেরা মুহূর্ত এবং সবচেয়ে বড় অর্জন ও বিজয়, যেখানে তাঁর সব দক্ষতা একসঙ্গে জড়ো হয়েছিল। তিনি পাকিস্তানকে পুরোপুরি আহাম্মকে পরিণত করেছিলেন। সীমান্ত পেরিয়ে বন্যার তোড়ের মতো প্রবেশকারী শরণার্থী নিয়ে ভারত বিরাট এক সংকটে পড়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করেন এবং দুনিয়াজুড়ে সফর করে বিশ্ববাসীকে জানান যে কী ঘটে চলেছে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া তিনি আর কারও পক্ষ থেকে সাড়া পাননি। সোভিয়েত ইউনিয়ন যে কোনো কারণে আমাদের সঙ্গে ছিল। যখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে, সংকট চরমে পৌঁছে গেছে, তখন তিনি তাঁর বিচক্ষণতার প্রমাণ দেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান হাইজ্যাক করার ঘটনার কথা বলতে পারি। এখন আমরা জানি যে, বিমানটিকে লাহোরে অবতরণ করানোর পরিকল্পনা ভারতীয়দেরই ছিল। এরপর লাহোরে পাকিস্তানের ওই সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজের মূর্খতা প্রমাণ করেন তাঁর উপস্থিতিতে বিমানটিকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ দিয়ে। ভারতের ওপর দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করার জন্য এ ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে দেখানোর প্রয়োজন ছিল ভারতের। এর ফলে বোঝা যাচ্ছিল যে যুদ্ধ নিকটবর্তী হচ্ছে। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ রাখার জন্য তাদের বিমানগুলোকে ভারতের আকাশসীমা এড়িয়ে ঘোরাপথে উড়ে শ্রীলঙ্কায় নেমে বিমান রিফুয়েল করতে হচ্ছিল।

পাকিস্তানের তখনকার প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন কী ঘটতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, আমার মনে হয় ওই সময়ের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ১০০ মাইল ভিতরে ছিল। দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। পাকিস্তানিরা শহরগুলোতে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল; কিন্তু ভারতীয় সৈন্যরা শহরগুলো এড়িয়ে সোজা ঢাকার উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছিল। সব বিচার বিশ্লেষণে এটি ছিল তাঁর ‘মহাকৌশল’ এবং সংগত কারণেই তিনি ‘ভারত রত্ন’ উপাধি লাভ করেছেন।

দিওয়ানজি: কিন্তু এমন একটি উচ্চতায় ওঠার বড় বিপদ হলো সেখান থেকে নিচে নেমে আসা। এরপরই এসেছিল জরুরি অবস্থা।

খুশবন্ত সিং: জি হ্যাঁ, এ কথা সত্য। জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ যেহেতু এসেছে, সেজন্য আমাকে বলতে হয়, বিরোধী দল অত্যন্ত দায়িত্বহীন ও উন্মত্ত আচরণ করছিল। সন্দেহ নেই যে, দেশ দ্রুত বিশৃঙ্খলার চরম অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছিল। স্কুলগুলো বন্ধ ছিল, কলেজগুলো খুলছিল না, বিশাল বিশাল মিছিল হচ্ছিল, দাঙ্গার ঘটনা ঘটছিল। আমার মনে হয় জয়প্রকাশ নারায়ণ তাঁর নেতৃত্বে নয়াদিল্লিতে বিরাট এক মিছিল পরিচালনার সময় আইন প্রণেতাদের ঘেরাও করা ও তাদেরকে অফিসে যেতে না দেওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলেন; ঠিক ওই সময়ে গুজরাটে এ ঘটনা ঘটেছিল ‘নবনির্মাণ আন্দোলনের’ সময় এবং জনতা গুজরাট বিধানসভার সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। নয়াদিল্লিতে পার্লামেন্টের ক্ষেত্রেও তিনি জনগণকে তা করতে বলেন, যাতে নির্বাচিত লোকজন তাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারে। এর চেয়ে বাজে ঘটনা ছিল আইন প্রণেতাদের অপসারণের জন্য পুলিশ ও সেনা সদস্যদের প্রতি তাঁর আহ্বান। যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিবাদন্ডবিক্ষোভের একটি সীমা রয়েছে এবং ভারতে উদ্ভূত পরিস্থিতি সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য নেতাও ছিলেন, আপনি তাদের সবার নাম বলতে পারেন, যারা ইন্দিরা গান্ধীর অস্বস্তি ও অসহায়ত্ব উপভোগ করছিলেন। তারা ভাবছিলেন যে আপনা-আপনি তাঁর পতন ঘটবে।

আমি জয়প্রকাশ নারায়ণকে একটি চিঠি লিখেছিলাম। আমি তাঁকে জানতাম এবং ভক্ত হিসেবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতাম। কিন্তু আমি তাঁকে এই মর্মে লিখি যে, তিনি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিয়মকানুন অমান্য ও লঙ্ঘন করছেন। উত্তরে তিনি একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেন এবং আমি তাঁর সেই চিঠি ‘দ্য ইলাসট্রেটেড উইকলি’তে প্রকাশ করেছি। কিন্তু অন্য কোনো কিছু ঘটার আগে এলাহাবাদ হাই কোর্টের রায় ঘোষিত হয় এবং তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। আমার মনে হয় তাঁর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল, কারণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

দিওয়ানজি: এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর আপনি কি বিশ্বাস করেন যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা সংগত ছিল?

খুশবন্ত সিং: আমি এখনো বিশ্বাস করি যে তিনি যখন জরুরি অবস্থা আরোপ করেন তাঁর সব অধিকার ছিল তা চাপিয়ে দেওয়ার। কারণ বিরোধী দলের নেতারা জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী, দায়িত্বহীন ও উন্মত্ত আচরণ শুরু করেছিলেন এবং তাঁর অসহায়ত্ব দেখছিলেন দর্শকের মতো। আমার পরিষ্কার মনে আছে যখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয় তখন দেশজুড়ে সাধারণভাবে স্বস্তির ভাব নেমে এসেছিল। স্কুল-কলেজগুলো আবার চালু হয়, ট্রেনগুলো সময়মতো চলাচল শুরু করে এবং দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় সর্বত্র জনগণের মধ্যে কৃতজ্ঞতার বোধ পরিলক্ষিত হয়।

এ কথা ঠিক যে জনগণের স্বাধীনতা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গণমাধ্যমের ওপর কড়াকড়ি আরোপ না করার জন্য বলেছি। আমি তাঁকে বলি যে, আমার মতো আরও অনেক লোক যারা তাঁকে সমর্থন করেন। কিন্তু আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করেনি, বরং বলেছেন যে আপনি যদি কিছু বলেন তাহলে আপনাকে কারারুদ্ধ করা হবে। কিন্তু তিনি আমার কথায় সম্মত না হয়ে বলেছিলেন যে, জরুরি অবস্থা থাকবে এবং একই সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও থাকবে তা হতে পারে না। এতে বরং সমস্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমার মনে হয়েছিল তিনি আমাকে কারাগারে পাঠাবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি সম্ভবত এর কারণ ছিল আমি দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁকে ও তাঁর পুত্র সঞ্জয়ের পক্ষে লিখেছি। যাহোক, শেষ পর্যন্ত তিনি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করেন।

Published in সাক্ষাৎকার

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *