আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
এক বছরের কিছু বেশি সময় আগে ভারত-চীন সীমান্ত সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে অষ্ট্রেলীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল এর কথা বার বার মনে পড়েছে। গতবছর ৯৩ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। ১৯৬২ সালে সংঘটিত ভারত-চীন যুদ্ধের ওপর তাঁর লেখা ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থটি তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিয়েছিল। কিন্তু বইটির কারণে ভারতে তিনি কঠোরভাবে সমালোচিত। গ্রন্থে তাঁর দেখানো ভারতের সামরিক দুর্বলতাগুলো ভারতের কোনো সরকার স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি এবং মিলিটারি হাইকমান্ড বিব্রত হয়েছে। কিন্তু চীন সরকার তাঁকে প্রশংসা করেছে। ১৯৭১ সালে বেইজিং এ এক সরকারি ভোজসভায় উপস্থিত ছিলেন লন্ডনের দ্য টাইমস রিপোর্টার অষ্ট্রেলীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েল। প্রধানমন্ত্রী ঝাউ এনলাই এবং পাকিস্তানি নেতা জুলফিকার আলী ভূট্টো তাদের আসন থেকে ম্যাক্সওয়েলের টেবিলে আসেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে বলেন, “মি: ম্যাক্সয়েল, আপনার বই সত্যের প্রতি অনেক অবদান রেখেছে এবং চীন তা থেকে উপকৃত হয়েছে।” একজন রিপোর্টারের জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! পরবর্তীতে ম্যাক্সওয়েল বলেছেন, “এ ঘটনা আমার স্মৃতি গভীর ছাপ রেখেছে।” বইটি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে সেতুবন্ধন স্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। হেনরি কিসিঞ্জার চীনের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, “বইটি পড়ার পর আমার মনে হয়েছে আমি আপনাদের সাথে কাজ করতে পারবো।” ১৯৭২ সালে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরকালে তিনি বইটি পড়েছেন বলে ঝাউ এনলাইকে জানান এবং ম্যাক্সওয়েলের তুলে ধরা যুক্তিকে যথার্থ বলে স্বীকার করেন।
ভারত-চীন যুদ্ধ চলাকালে ওই সময়ে দিল্লিতে কর্মরত অন্যান্য বিদেশি গণমাধ্যমের রিপোর্টারদের মধ্যে একমাত্র নেভিল ম্যাকওয়েলই যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর ভারতের সরকারি ভাষ্যের ওপর নির্ভর না করে তাঁর নিজস্ব সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য ও বিশ্লেষণ প্রেরণ করতেন দ্য টাইমসে। যার পরিণতিতে তাঁকে কার্যত ভারত থেকে বহিস্কৃত হতে হয়। ১৯৭০ সালে ‘ইন্ডিয়া’র চায়না ওয়ার’ প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত সরকার নেভিল ম্যাক্সওয়েলের বিরুদ্ধে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ ভঙ্গ করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে এবং ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পরামর্শ দেয় গ্রেফতার এড়ানোর জন্য ভারত সফর না করতে এবং আট বছর পর্যন্ত তিনি আর ভারতে যাননি। মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হলে তিনি পুনরায় ভারতে যান। কিন্তু এখনও ভারতীয় রাজনৈতিক মহল ও গণমাধ্যমে তিনি বিতর্কিত ও সমালোচিত। ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধকে চীনের ‘বিশ্বাসঘাতকতা ও সম্প্রসারণবাদের’ সৃষ্টি বলে যে অভিযোগ করে ম্যাক্সওয়েলের গ্রন্থে তা খণ্ডন করে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, “এ যুদ্ধ ছিল মূলত ভারতের সৃষ্টি এবং সে কারণেই এটি ছিল ‘ভারতের চীনা যুদ্ধ’। কিন্তু ম্যাক্সওয়েল বইটির বিষয়বস্তুর প্রধান সূত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন ভারতের টপ ক্লাসিফাইড দলিল ‘হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট’, যাতে ভারতের সামরিক বিপর্যয়ের কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছিল, যার একটি কপি ম্যাক্সওয়েল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। চীন থেকে কোনো তথ্য লাভ করা কঠিন বলে ১৯৬২ সালের যুদ্ধ সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়ন জানতে তাঁকে মূলত চীনের সরকারি বিবৃতির ওপর নির্ভর করতে হয়েছে এবং সেসব তথ্যের যথার্থতা যাচাই করারও সুযোগ ছিল না।
নেভিল ম্যাক্সওয়েল এর সাথে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমার জানা ছিল না যে তিনি কত বড় মাপের সাংবাদিক। ১৯৮৮ সালে আমি রয়টার্স ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পাওয়ার পর ফাউন্ডেশনের বোর্ড অফ ট্রাস্টিজ এর সদস্য হিসেবে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সাথে তাঁর বন্ধু অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আরেকটি চিঠি দিয়েছিলেন। ওই বছরের শেষ দিকে তাঁর সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তিনি গিয়েছিলেন রয়টার্সের পরবর্তী বছরের ফেলো নির্বাচনের জন্য সভায় যোগ দিতে এবং তাঁর তিন দিনের অবস্থানকালে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ ও আলোচনা হয়। দ্য টাইমস এর প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে অবস্থানকালে ষাটের দশকে তাঁর ঢাকা সফরের স্মৃতি সম্পর্কে বলেন। তাঁর সম্পর্কে এর চেয়ে বেশি তখন জানা হয়নি, এমনকি তাঁর বহুল আলোচিত বইটি সম্পর্কেও কেউ আমাকে কিছু বলেনি। ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে আর কখনও আমার দেখা হয়নি, যোগাযোগও ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার তিন বছর পর ১৯৯২ সালে তাঁর ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ পাঠ করে তাঁর সম্পর্কে এবং ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের বিস্তারিত জানার সুযোগ হয় নয়া দিল্লিতে।
কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিষ্ট্যান্স প্রোগ্রামের আওতায় নয়া দিল্লিতে ভারতীয় পার্লামেন্টের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ পার্লামেন্টারি এন্ড কন্সটিটিউশনাল স্টাডিজ’ এ আরেকটি ফেলোশিপ করার জন্য যাই। ইন্সটিটিউটের লাইব্রেরির পরিসর ছোট হলেও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসের ওপর প্রকাশিত গ্রন্থ ও দুর্লভ দলিলপত্রে সমৃদ্ধ। এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর ওই সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং অন্যান্য দেশে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এত বিপুল সংখ্যক বই ছিল, যা আমি বাংলাদেশের কোনো সরকারি লাইব্রেরিতে দেখিনি। লাইব্রেরি অবাধে ব্যবহার ও যে কোনো সংখ্যক বই বাড়িতে নিয়ে আসার স্বাধীনতা ছিল আমাদের। খাতায় এন্ট্রি করে নিলেই হলো। বই ঘাঁটার সময় একদিন নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ হাতে পড়ে। যেহেতু লেখক আমার পরিচিত, অতএব আগ্রহের সাথে বইটি নেই এবং থ্রিলার পড়ার মত মুগ্ধতায় মাত্র পাঁচ দিনে প্রায় পাঁচশ পৃষ্ঠার বই পড়ে শেষ করি। বইটি পড়ার পূর্ব পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ সম্পর্কে এতদিন পর্যন্ত শুধু জানা ছিল যে যুদ্ধে ভারতকে পরাজিত করতে চীনকে কোনো বেগ পেতে হয়নি। চীনের অগ্রাভিযানের খবরে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল যে ভারত সরকার এমনকি আসামের চীন সীমান্তবর্তী শহরগুলো থেকে প্রশাসন ও জনগণকে নিরাপদ স্থানে হটে আসার পরামর্শ দিয়েছিল। অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ভারতীয় বাহিনী পিছু হটতে শুরু করলে চীন একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে এবং তাদের বাহিনীকে আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেয়। ভারতের সরকারি হিসেবে ওই যুদ্ধে তাদের ১,৩৮৩ জন সৈন্য নিহত, ১,০৪৭ জন আহত ও ১,৬৯৬ জন নিখোঁজ হয়েছিল। কিন্তু হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে ভারতীয় পক্ষে ২,০০০ এর অধিক সৈন্য নিহত এবং ৪,০০০ এর অধিক সৈন্যকে যুদ্ধবন্দি করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ১৫,০০০ হাজার সৈন্যের একটি ডিভিশনকে অপমানজনকভাবে পিছু হটতে হয়েছিল।
‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ গ্রন্থে দুই দেশের মধ্যে দুই হাজার মাইলের অধিক অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়ে বিরোধের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। ভারত বরাবর দাবী করছে যে, উভয় দেশের সীমান্ত হচ্ছে ১৯১৪ সালে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চিহ্নিত ‘ম্যাকমোহন লাইন,’ এবং চীন তা অতিক্রম করে লাদাখ এলাকায় ৪৩,০০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করে রেখেছে। চীন কখনও ম্যাকমোহন লাইনকে দুই দেশের সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করেনি। তারা ১৯৫৯ সাল থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বলতে বোঝায় ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল’ যা উভয় দেশের দীর্ঘ সীমান্তের শুধু পূর্ব দিকে ম্যাকমোহন লাইনের সঙ্গে অভিন্ন। চীনের সম্প্রসারণবাদী উদ্যোগ প্রতিহত করতে জওহরলাল নেহরুর ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’ অনুযায়ী ভারত ১৯৬২ সালে ম্যাকমোহন লাইন পর্যন্ত যতদূর সম্ভব এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে। ওই বছরের জুন মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী ম্যাকমোহন লাইনের উত্তরে ‘নামকা চ’ু উপত্যকায় ধোলা নামে একটি স্থানে সীমান্ত চৌকি স্থাপন করার পর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাথে ভারতীয় বাহিনীর ছোটখাট সংঘর্ষ চলতে থাকে। মূল যুদ্ধ শুরু হয় ২০ অক্টোবর এবং যুদ্ধ থাগলা রিজ থেকে উত্তর দিকের প্রায় ছয়শ মাইল সীমান্ত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। ২১ নভেম্বর পর্যন্ত মাসব্যাপী যুদ্ধে চীনের বিপুল বাহিনীর মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় বাহিনীকে পিছু হটতে হয়।
ভারত চীনের এ হামলাকে তাদের পিঠে ছুরিকাঘাত বলে বর্ণনা করে। কিন্তু চীনের ব্যাখ্যা ছিল যে তাদের ভূখন্ডে ভারতের অভিযান প্রতিহত করতে তাদেরকে পাল্টা হামলা চালাতে হয়েছে। যুদ্ধের প্রথম দিকে নেভিল ম্যাক্সওয়েল পাশ্চাত্যের অন্যান্য সাংবাদিকের মত প্রায় দ্বিধাহীনভাবেই ভারতীয় ভাষ্য গ্রহণ করেছেন। কিন্তু গভীরভাবে দুই দেশের সংঘাতের ওপর পড়াশোনা করার পর তিনি সীমান্ত সংকটের ওপর চীনের বক্তব্যকেও তাঁর রিপোর্টে স্থান দিতে শুরু করেন, যা ভারত সরকারকে ক্ষুব্ধ করে। সত্তর সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থে তিনি তুলে ধরেন যে ভারত কীভাবে চীনকে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল। আগেই উল্লেখ করেছি যে, ম্যাক্সওয়েলের গ্রন্থের মূল তথ্যসূত্র ছিল ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত ‘হ্যান্ডারসন ব্রুক-ভগত রিপোর্ট’। ১৯৬৩ সালে রিপোর্টটি তৈরি করেন লে: জেনারেল হ্যান্ডারসন ব্রুক ও ব্রিগেডিয়ার প্রেমিন্দ্র সিং ভগত (পরবর্তীতে লে: জেনারেল)। অতি গোপনীয় রিপোর্টটি কীভাবে ম্যাক্সওয়েলের হাতে পড়লো, তা নিয়ে অনেক কথা থাকলেও সন্দেহের তীর ছিল লে: জেনারেল হ্যান্ডারসন ব্রুকসের দিকে। কারণ হ্যান্ডারসন ছিলেন অষ্ট্রেলীয় বংশোদ্ভুত এবং ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে রয়ে যান এবং তাঁর সাথে অষ্ট্রেলীয় বংশোদ্ভুত ম্যাক্সওয়েলের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। দুই খন্ডের রিপোর্টের প্রথম খন্ড ম্যাক্সওয়েল সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন।
হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্টে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনা অভিযানের চুলচেরা মূল্যায়ন করতে গিয়ে সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যর্থতার কারণে মুখ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করা হয়েছে। যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া চীনের মত বিশাল এক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক নীতি নির্ধারকদের ত্রুটিগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। নেহরু সরকারের উচ্চাভিলাষী ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ বাস্তবায়নের নামে নতুন ভূখন্ড অধিকার ও চীনের সৈন্যদের সেসব এলাকা থেকে উচ্ছেদ করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সামনে ঠেলে দেয়ার পরিণতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে রিপোর্টে এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছাড়া সীমান্তে বিরাজমান অবস্থা রাতারাতি পাল্টে দেয়ার চেষ্টার অর্থ চীনকে উস্কানি দেয়ার শামিল বলে সীমান্তে নিয়োজিত সেনাধ্যক্ষরা বার বার সতর্ক করলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে ফলাফল উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টটি প্রকাশের জন্য বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মহল থেকে দাবী ওঠলেও সব সরকার সেটিকে স্পর্শকাতর এবং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর ভেবে প্রকাশ করেনি। ২০১০ সালের পর সূত্র গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে নেভিল ম্যাক্সওয়েল ভারতের প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রে তাঁর ঘনিষ্ট সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে রিপোর্টটি পাঠান। কিন্তু কোনো সংবাদপত্র তা প্রকাশ করেনি। অতএব ম্যাক্সওয়েল তাগিদ অনুভব করেন যে তিনি যদি রিপোর্টটি প্রকাশ না করেন তাহলে এটি হয়তো কখনও আলোর মুখ দেখবে না। ২০১৪ সালের ১৭ মার্চ তিনি তাঁর ব্লগে রিপোর্টটি প্রকাশ করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ভারতে আরেক দফা সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি আশাবাদ পোষণ করেছেন যে ভারত সরকার রিপোর্টের কোনো অংশ বাদ না দিয়ে বা সম্পাদনা না করেই উভয় খন্ডই প্রকাশ করবে। তাঁর ব্লগে রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর সাউথ চায়না মর্নিং পোষ্টের সাবেক সাংবাদিক ও বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ সিডনি’র ‘সিডনি ডেমোক্রেসি নেটওয়ার্কের’ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো দেবাশীষ রায় চৌধুরী ম্যাক্সওয়েলের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এ সাক্ষাৎকারেও তিনি ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনকে নয়, বরং ভারতকেই আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক রীতি উপেক্ষা করে একতরফাভাবে সীমান্ত নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয় এবং নেহরু ও তাঁর সহযোগীরা চীনের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে বিবেচনা না করে নিজেরাই মানচিত্রে তাদের চূড়ান্ত আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারণ করে নেন, এমনকি আকসাই চিন নামে একটি এলাকা ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেন, যার ওপর ব্রিটেনও কখনও অধিকার দাবী করেনি।
হ্যান্ডারসন ব্রুক-ভগত রিপোর্টে ১৯৬২ সালে চীনের কাছে স্বাধীন ভারতের চরম সামরিক বিপর্যয়ের জন্য যাদেরকে অভিযুক্ত করেছে এবং নেভিল ম্যাক্সওয়েল একইভাবে তাঁর ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ এ স্থান দিয়েছেন, তারা হচ্ছেন; প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর ডাইরেক্টর বিএম মল্লিক, ওই এলাকায় যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দায়িত্বশীল চিফ অফ জেনারেল স্টাফ লে: জেনারেল বিএম কাউল, পররাষ্ট্র সচিব এমজে দেশাই, ডাইরেক্টর মিলিটারি অপারেশনস ডিকে পালিত। রিপোর্টটি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল পিএন থাপারের ভূমিকা সম্পর্কে নীরব। এর কারণ হিসেবে ম্যাক্সওয়েল বলেছেন ১৯৬২ সালের বিপর্যয়ে নেহরু এবং থাপারকেই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছে। চীনের একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার একদিন পর ১৯৬২ সালের ২২ নভেম্বর জেনারেল থাপার পদত্যাগ করেন। নেহরু তাঁর প্রস্তুতিহীন ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’কে কৌশলগতভাবে মারাত্মক ভুল ছিল বলে অনুশোচনার মধ্যে ছিলেন এবং চীনের কাছে পরাজয়ের দুই বছর পর ১৯৬৪ সালে ভগ্নহৃদয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
ব্রুকস রিপোর্টে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে কৃষ্ণ মেননের দায়িত্ব পালনের ধরণকে ‘বিস্ময়কর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উর্ধতন সামরিক অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতেন না। কৃষ্ণ মেননের জীবনী লেখক জয়রাম রমেশ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “১৯৬২ সালের বিপর্যয়ের জন্য তাঁকে সঠিকভাবে বা ভুলভাবে তাঁকে দায়ী করা হয়। কিন্তু তিনি একমাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তি নন। বিশ্বের সর্বত্র সামরিক বিপর্যয়ের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারূপ করা হয়। এর ধারাবাহিতায় কৃষ্ণ মেনন অভিযুক্ত হতে পারেন।” তিনি ম্যাক্সওয়েলের ‘ইন্ডিয়া’স চ্য়ানা ওয়ার’ গ্রন্থের উল্লেখ করে বলেন, গ্রন্থটি কৃষ্ণ মেননের রাজনৈতিক জীবনে এবং ভারতের সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে এই গ্রন্থটি। এই যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধ ছিল না, বরং এটি ছিল চীনের যুদ্ধ। মাও জে দং ভারতকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের কারণে আরেকজন ব্যক্তিকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল, তিনি চীনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধান সামরিক অফিসার লে: জেনারেল বিএম কাউল। ব্রুকস রিপোর্টে জেনারেল কাউলের যুদ্ধ পরিকল্পনা ও নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্য তাঁকে পরোক্ষভাবে দোষারূপ করা হয়। যদিও রিপোর্টে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ করার না করার নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল, কিন্তু জেনারেল কাউল এর ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁকে সরাসরি আক্রমণ করা হয়েছে যে, বিভ্রান্তিকর গোয়েন্দা তথ্যের ওপর নির্ভর করে তিনি সৈন্যদের জন্য অসম্ভবকে এক যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’র বাস্তবায়নে চীন কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করবে না মর্মে রাজনৈতিক ধারণার মধ্যে তিনিও মগ্ন হয়েছিলেন। তাছাড়া চিফ অফ জেনারেল স্টাফের পদ শূন্য রেখে তিনি ‘নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি (নেফা) নামে খ্যাত বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে সদ্য গঠিত ফোর্থ কোরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফোর্থ গঠনের পেছনে জেনারেল কাউলের উদ্দেশ্য ছিল কোরের প্রধান স্টাফ অফিসারদের দ্রুততার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ করানো। কিন্তু সরাসিরি যুদ্ধ লড়ার অভিজ্ঞতা নেই এমন কাউকে কোনো কোর গঠন বা বড় ধরনের যুদ্ধে লিপ্ত করানো যেতে পারে না। বিএম কাউলের ভূমিকার সমালোচনায় ম্যাক্সওয়েল আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছেন এবং ম্যাক্সওয়েলের সাথে সুর মিলিয়েছেন “হিমালয়ান ব্লান্ডার” এর লেখক ব্রিগেডিয়ার জন পরশুরাম দালভি, যিনি ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের সেভেনথ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেডের কমাণ্ডিং অফিসার ছিলেন এবং চীনের হাতে যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন। তিনি যুদ্ধে ভারতের লজ্জাজনক পরাজয়ের জন্য জেনারেল কাউলকে দায়ী করেছেন। কাশ্মীরি সূত্রে কাউলের সঙ্গে নেহরুর পারিবারিক সম্পর্কের কারণে তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অফ জেনারেল স্টাফ পদ বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে দালভি অভিযোগ করেন। যখন যুদ্ধ অত্যাসন্ন তখন তাঁকে যুদ্ধ প্রস্তুতির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার চেয়ে যে কাজগুলো তাঁর অধীনস্থ অফিসারদের দ্বারা করা সম্ভব, সেসব কাজ করতে তিনি হেলিকপ্টারে ওঠে চলে যেতেন। তাঁর যুদ্ধের প্রকৃত অভিজ্ঞতা ছিল না বলেও বর্ণনা করেছেন অনেক উর্ধতন সেনা অফিসার।
লে: জেনারেল বিএম কাউল সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করার পর “দ্য আনটোল্ড স্টোরি” নামে আত্মজীবনীমূলক যে গ্রন্থটি রচনা করেন, আমার দিল্লি অবস্থানকালে সেটিও পড়ার সুযোগ হয়। জীবনের বহু ঘটনা বর্ণনার সাথে পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার এই গ্রন্থের বহুলাংশ জুড়ে ১৯৬২ সালের চীনের সাথে যুদ্ধে বিপর্যয়ের কারণে তাঁকে যেভাবে দোষারূপ করা হয়েছে তা খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীকে রাজনীতিকরণ করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। স্বাধীন ভারতের প্রথম কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল স্যার রবার্ট লকহার্ট প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা উপস্থাপন করলে তিনি তাঁকে উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাদের কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনার প্রয়োজন নেই। আমাদের নীতি হচ্ছে অহিংসা। আমরা কোনো সামরিক হুমকি দেখছি না। আপনি সেনাবাহিনীর আকার ছোট করতে পারেন। আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন মেটাতে পুলিশই যথেষ্ট।” সামরিক বাহিনীর প্রতি রাজনৈতিক নেতৃত্বের এ ধরনের উদাসীনতার কারণে যুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া একটি বাহিনীর যে ধরনের প্রস্তুতি থাকা উচিত ছিল কাউল তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন বলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
জেনারেল বিএম কাউলের “দ্য আনটোল্ড স্টোরি” ম্যাক্সওয়েলের “ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার” এর তিন বছর আগে প্রকাশিত হলেও, ম্যাক্সওয়েল হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে ‘দ্য টাইমসে’ কাউলকে দোষারূপ করে যে রিপোর্টগুলো করছিলেন, তার প্রেক্ষিতে তিনি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট লংঘনের জন্য ম্যাক্সওয়েল এবং সরকারি আমলাদের কঠোর সমালোচনা করেন, যারা বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে গদগদ হয়ে সকল গোপনীয়তা প্রকাশে উদারতা প্রদর্শন করেন। ম্যাক্সওয়েলকে ভৎর্সনা করতে ভারতের সাংবাদিকরাও পিছিয়ে ছিলেন না। হ্যান্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট প্রকাশ করার কারণে ‘দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ এর সাবেক সম্পাদক শেখর গুপ্ত নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ওপর এক হাত নিয়েছেন। ম্যাক্সওয়েলের ব্লগে হ্যান্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পাঁচদিন পর ২০১৪ সালের ২২ মার্চ এক নিবন্ধে তিনি বিষোদগার করেছেন, “কী করে একজন নির্বোধ, ভারতীয় আতিথেয়তার প্রতি অকৃতজ্ঞ শ্বেতাঙ্গ ১৯৬২ সালের আগ্রাসনের জন্য ভারতকে দোষারূপ করার ধৃষ্টতা দেখায়? কীভাবে তাঁর সাহসা হয় জওহরলাল নেহরু, এমনকি সমমনা কমিউনিস্ট কৃষ্ণ মেননকে অপমান করার? তিনি কেমন মানুষ যে তিনি ভারতীয় সৈনিকদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন, যারা প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্বেও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। আরও বেশি অপমানজনক যে কীভাবে তিনি এ যুদ্ধকে ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ বলার ধৃষ্টতা দেখান? ÑÑÑ যারা ম্যাক্সওয়েলকে হ্যান্ডারসন ব্রুকস-ভগত রিপোর্ট সরবরাহ করতে সহযোগিতা করেছে, তাদেরকে বিশ্বাসঘাত হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।”
(যারা নেভিল ম্যাক্সওয়েলের ‘ইন্ডিয়া’স চায়না ওয়ার’ এবং লে: জেনারেল বিএম কাউলের ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ পাঠ করেননি, ভারত-চীন সীমান্ত সংকট আরও ভালোভাবে বুঝতে বই দুটি পড়তে পারেন)
Very quickly this web site will be famous among all
blogging and site-building viewers, due to it’s fastidious articles
my blog post LipoZem Dosage