আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
জার্মান দার্শনিক ফেডারিক নিটশে’র ‘ইশ্বরের মৃত্যু’র ধারণা খুব সুখকর ছিল না। একজন ইশ্বরের অস্তিত্ব ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের মৌলিক বিশ্বাসের কাঠামো বিপর্যযের মধ্যে পড়বে বলে মনে করতেন। তা সত্বেও তিনি ১৩৪ বছর আগে ঘোষণা করেছিলেন : “ইশ্বর মারা গেছেন।” তাঁর ঘোষণা দর্শনের ছাত্রদের কাছে উনবিংশ শতাব্দীতে যে যৌথ শির:পীড়ার কারণ হয়ে ওঠেছিল তা এখন পর্যন্ত দূর হয়নি। এটি সম্ভবত দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে অন্যতম পরিচিত বক্তব্য, যা এমনকি যারা কখনো নিটশে’র এ বক্তব্যের উৎস তাঁর গ্রন্থ “দ্য গে সায়েন্স” ছুঁয়েও দেখেননি, তাদের কাছেও সুপরিচিতি। কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানেন না যে এর দ্বারা তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন, এবং তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের কাছে এ বক্তব্যের অর্থ কী?
নিটশে তাঁর বয়স্ক জীবনে আস্তিক ছিলেন এবং তিনি একথা বোঝাতে চাননি যে একজন ইশ্বর ছিলেন, যার মৃত্যু ঘটেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশের যুগে বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ড ঐশ্বরিক আদেশের অধীনে নয় বরং ভৌত আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ধারণার উদ্ভব হয়েছে সেটিই বিজ্ঞান ভিত্তিক ও বাস্তবসম্মত বিবেচনা করা হচ্ছে। আধুনিক দর্শনও মনে করে যে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে আর ঐশ্বরিক অধিকারের কোনো বৈধতা নেই, বরং শাসিতের সম্মতি ও যুক্তি দ্বারা পরিচালিত এবং ইশ্বরের উপস্থিতি বা ঐশ্বরিক আদেশ ছাড়াই নৈতিক তত্ত্ব দ্বারা সরকার ব্যবস্থা পরিচালিত হয়। এটি অদ্ভুত এক ঘটনা ছিল। ইউরোপে নীতি-নৈতিকতার উৎস হিসেবে ইশ্বরের আর প্রয়োজন ছিল না। দর্শন ও বিজ্ঞান আমাদের জন্য মূল্যবোধ অথবা বিশ্বে শৃঙ্খলার বিধিবিধান দেওয়ার জন্য সমর্থ। পাশ্চাত্যে চিন্তাভাবনার ক্রমবর্ধমান ধর্মনিরপেক্ষতা নিটশে’কে এ উপলব্ধিতে পৌঁছতে বাধ্য করে যে, শুধু যে ইশ্বর যে মৃত্যুবরণ করেছেন তা নয়, মানুষই বিজ্ঞানের বিপ্লব এনে পৃথিবীকে আরো ভালোভাবে জানার আকাক্সক্ষায় ইশ্বরকে হত্যা করেছে। তিনি তাঁর “টোয়াইলাইট অফ দি আইডলস” এ লিখেছেন: “খ্রিষ্টবাদে বিশ্বাসী কেউ যখন তার বিশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন তিনি কারো পায়ের নিচ থেকে খ্রিস্টান নৈতিকতার অধিকারকে টেনে নেন। খ্রিস্টবাদ একটি ব্যবস্থা, সবকিছুকে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা। এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান ধারণা ‘ইশ্বরের ওপর বিশ্বাস’কে ভেঙে ফেলার অর্থ হচ্ছে সমগ্র বিশ্বাসকে চুরমার করে ফেলা।”
নিউইয়র্কের রচেষ্টার কাউন্টির ডন হ্যামিল্টন ১৯৬৬ সালের দিনটিকে ভুলতে পারেননি। তার বয়স তখন ১২ বছর। এক সহপাঠি তাকে প্রশ্ন করে: “তোমার বাবা কি মনে করেন যে ইশ্বর মারা গেছেন?” হ্যামিল্টন ‘হ্যা’ সূচক উত্তর দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর তার আরেক বন্ধুর দাদিমার নেতৃত্বে হ্যামিল্টনের বাবা রচেষ্টার ডিভাইনিটি স্কুলের শিক্ষক উইলিয়াম হ্যামিল্টনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে তাকে চাকুরিচ্যুত করেন। ১৯৬৬ সালের ৮ এপ্রিল সংখ্যা ‘টাইম’ ম্যাগাজিন “ইশ্বর কি মৃত?” শীর্ষক কভার স্টোরি করার পর হ্যামিল্টনের পরিবারকে রচেষ্টার ত্যাগ করতে হয়। নিবন্ধটি লিখেছিলেন ‘টাইম’ এর ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক জন এলসন। পাঠকদের কাছ থেকে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়ে ৩,৪২১টি চিঠি আসে টাইম দফতরে। অধিকাংশ প্রতিবাদের ভাষা ছিল: “তোমাদের কুৎসিত কভার ধর্মদ্রোহমূলক।” ‘দ্য ন্যাশনাল রিভিউ” ম্যাগাজিন ‘টাইম’কে প্রশ্ন করে যে আসলে ‘টাইম’ মরে গেছে কিনা। ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি ও সঙ্গীত শিল্পী বব ডিলান ১৯৭৮ সালে প্লেবয় ম্যাগাজিনে এক সাক্ষাৎকারে ‘টাইম’ এর নিবন্ধের সমালোচনা করে বলেন: “আপনি যদি ইশ্বর হতেন, তাহলে নিজের সম্পর্কে অমন লেখা দেখে আপনার কেমন লাগত?” ৫৫ বছর পরও ‘টাইম’ এর সেই কভার ম্যাগাজিনটির ইতিহাসে প্রকাশিত সবচেয়ে অনন্য কভার হিসেবে বিবেচিত।
‘টাইম’ ম্যাগাজিনের কভারের তিনটি শব্দ “Is God Dead?” (ইশ্বর কি মৃত?) নিয়ে কিছু খ্রিস্টান মৌলবাদী ধমতাত্ত্বিক বিতর্কে অবতীর্ণ হন এবং গোটা আমেরিকা জুড়ে ভীতি-মিশ্রিত তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নিবন্ধে টমাস অ্যালটাইজার নামে “ইশ্বরের মৃত্যু” বিষয়ক তাত্ত্বিকের বক্তব্য ছিল; তিনি বহু বছর পর ইশ্বরের মৃত্যু প্রসঙ্গে তাঁর সুর পাল্টে বলেন, “আমি অন্তত এটা কল্পনা করতে পারি না। আমরা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে বাস করছি।” ১৯৬৬ সালে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের বিতর্কিত সংখ্যাটি প্রকাশিত হওয়ার পর কাছাকাছি সময়ে অ্যালটাইজার ও হ্যামিল্টন এ বিষয়ের ওপর একটি নিবন্ধ সংকলন প্রকাশ করেছিলেন, “র্যাডিক্যাল থিওলজি এন্ড ডেথ অফ গড” নামে। টাইম’ এর কভারের বক্তব্যের সঙ্গে তাদের বক্তব্যে সুক্ষ্ম ব্যবধান ছিল। যদিও তারা ইশ্বরের মৃত্যু’ সম্পর্কিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এড়িয়ে যাননি, কিন্তু তাদের বক্তব্যকে রূপক অর্থে গ্রহণ করতে বলেছেন। ইশ্বরের অস্তিত্বে তারা অস্বীকার বা অবিশ্বাস করেননি। ইশ্বর ছিলেন, কিন্তু তিনি মারা গেছেন।
হ্যামিলটনের কাছে ‘ইশ্বরের মৃত্যু’ ব্যাপক অর্থে একটি নীতিগত সমস্যা। মানুষের দ্বারা যে কাজ করা প্রয়োজন সেজন্য যিশু খ্রিস্টই বরং ইশ্বরের চেয়ে উত্তম মডেল। বিশেষ করে হ্যামিল্টনের ক্ষেত্রে আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট একটি দৃষ্টান্ত ছিল, যখন তিনি ধর্মের স্থান দেখেছেন পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে; স্বর্গে নয়। অ্যালটাইজার আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন: “ইস্টারের আগে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার জন্য যিশু খ্রিস্টকে মরতে হয়েছে, এবং একইভাবে ইশ্বরকে মরতে হবে বিপর্যয়ের জন্য।” এ বক্তব্যের কারণে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের নিবন্ধ নিয়ে বিতর্ক চলাকালে তাকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে।
১৯৬৬ সালে আমেরিকানদের জন্য বিশ্বাস করা সহজ ছিল না যে একজন কল্যাণকামী ইশ্বর সক্রিয়ভাবে মানুষের জীবন পরিচালনা করছে। বহু বছর দেশের বাইরে অবস্থান করে আমেরিকানরা দেখেছে যে ইশ্বরহীন কমিউনিজম বিশ্বজুড়ে অশুভ পর্দা টেনে দিয়েছে এবং আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন অমানবিকতার শিকারে পরিণত হচ্ছে, তাদের নিজ জাতি শুধু ত্বকের ভিন্ন রঙ এর কারণে নিজেদের নাগরিকদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিন পাঠকের ক্ষোভ প্রশমন করতে পরবর্তীতে ব্যাখ্যা দেয়: “অন্ধকারের অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্বাস সবসময় ‘ইশ্বরের দান” হিসেবে অযৌক্তিক অবদান রাখে। আগের শতাব্দীগুলোর মতো চার্চের পক্ষে এখন আর মানুষকে হুমকি দেওয়া বা বাধ্য করার উপায় নেই। ডাচাও এর হত্যাকান্ড (১৯৪৫ সালে জার্মাানির ব্যাভারিয়ায় ডাচাও এ জার্মান যুদ্ধবন্দী শিবিরে আমেরিকানদের দ্বারা পরিচালিত হত্যাকান্ড) ও হিরোশিমা-নাগাসাকির তাৎক্ষণিক মৃত্যুর ঘটনা পৃথিবীতে নরকের বহু প্রকৃত সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।”
আমেরিকান আধ্যাত্মিকতার নতুন ইতিহাসের লেখক পিটার ম্যানসেয়াও তাঁর “ওয়ার নেশন, আন্ডার গড” গ্রন্থে বলেছেন: “বিংশ শতাব্দীর নৃশংসতাই শেষ উপাদান নয়। আরো খবর রয়েছে – মোহাম্মদ আলীর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ অথবা ভিয়েতনাম যুদ্ধে অংশগ্রহন কি আমেরিকানদের খিস্টধর্মের পরিবর্তে অন্য ধর্মের কথা ভাবতে বাধ্য করবে? পুরোনো যুগের জরিপে দেখা গেছে যে ৯৭ শতাংশ আমেরিকান ইশ্বরে বিশ্বাস করে। কিন্তু সে বিশ্বাস হ্রাস পেয়েছে। ২০১৪ সালের পিউ রিসার্চ এর জরিপে ধর্মে বিশ্বাসী আমেরিকানের সংখ্যা নেমে এসেছে ৬৩ শতাংশে। আধ্যাত্মিকতার দাবী করেন বহু আমেরিকান, নিজেদেরকে কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে পরিচয় দেন না। সে প্রেক্ষিতে দেখা যায়, ইশ্বরের প্রতি আমেরিকানদের বিশ্বাস হ্রাস পেয়েছে, যদিও যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা কট্টর অবস্থানে রয়েছেন। ধর্মের উপস্থিতি রয়েছে রাজনীতি, শিক্ষা এবং পপ কালচারে।
রাব্বাই ডোনিয়েল হার্টম্যান তাঁর “পুটিং গড সেকেন্ড” গ্রন্থে বলেছেন, “এখন কেউ আর প্রশ্ন করে না যে ইশ্বর মারা গেছেন কিনা। কেউ যদি ইশ্বরকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালনকারী হিসেবে স্বীকার না করে তাহলে তার পক্ষে পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশ দ্বন্দ্ব-সংঘাত উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না।” ধর্মততত্ত্ববিদ ও একেশ্বরবাদী ধর্মীয় চিন্তাবিদদের অনানুষ্ঠানিক জরিপে প্রধান কিছু বিষয় বের হয়ে এসেছে, যার প্রতিটির মধ্যে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে জাগতিক ও পরজাগতিক উপায়গুলোর প্রতিফলন ঘটেছে। বৈচিত্রের উত্থান বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী আমেরিকানদের বাধ্য করেছে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে। কিন্তু তা সকল ক্ষেত্রে এক নয়। কারণ ইব্রাহিম থেকে উৎসারিত এক ইশ্বরে বিশ্বাসী ধর্মে বিশ্বাসীরা সংঘাতময় বিশ্ব সম্পর্কে অর্থ্যাৎ যা হওয়া উচিত সে সম্পর্কে ভিন্নভিন্ন ধরনের ভাবনা পোষণ করেন। মুসলিম ও খ্রিস্টানরা একই ইশ্বরের প্রার্থনা করে মর্মে বক্তব্য দেওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে হোয়েটন কলেজের এক প্রফেসরকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও সিভিল রাইটস মুভমেন্ট “ইশ্বরের মৃত্যু” আন্দোলনের অংশ ছিল; মানুষের বিশ্বাসের মাঝেও সবসময় একটি প্রশ্ন ঝুলতো, যিনি সর্বময় ক্ষমতার মালিক, সেই ইশ্বর পৃথিবী জুড়ে এতো দুর্দশা-যাতনা ও অন্যায়ের মধ্যে কীভাবে বিরাজ করেন? ধর্মীয় চিন্তাবিদরাও কুলকিনারা করতে পারছিলেন না মানুষের মাঝে কীভাবে তারা বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখবেন। অন্যেরা দুর্ভোগ দেখে ও বিশ্বাসীরা দুর্ভোগ বন্ধে ভূমিকা রাখছে না তাতে যে শুধু বিস্মিত হয় তাই নয়, ইশ্বরের কোনো বিঘ্ন ঘটেছে কিনা তাও ভাবে। উইলিয়াম হ্যামিলটন ১৯৮৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে এই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, “ইশ্বর হয়তো মারা যাননি, কিন্তু তিনি ভুল মানুষের হাতে আছেন এবং তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। কিছু লোকের কাছে এই প্রশ্নের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
ইশ্বর মারা যাননি — মৃত্যু হয়েছে ইশ্বরকে উপলব্ধির সক্ষমতার
‘টাইম’ ম্যাগাজিনের “ইজ গড ডেড?” শিরোনামের নিবন্ধের আলোকে আমি 19 March, 2019 বৃহস্পতিবার ফেসবুক ওয়ালে যে পোস্ট দিয়েছি অনেকে তাতে আপত্তি করেছেন। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। খুব কম সংখ্যক লোক নিবন্ধের প্রশাংসা করেছেন। অনেকে বিষয়টি স্পর্শকাতর বলে এড়িয়ে গেছেন। ৫৫ বছর আগে ‘টাইম’ এর নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর আমেরিকায় শিক্ষিত খ্রিস্টানদের মধ্যেও ভীতি-মিশ্রিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। আমার খ্যাতিমান পাকিস্তানি সাংবাদিক বন্ধু, আলোচিত টেলিভিশন টকশো ব্যক্তিত্ব, সুফিবাদী ধ্যানধারণা পোষণকারী
(জায়ঘাম খান) বাংলা না বূঝলেও সম্ভবত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের কভার দেখেই যে মন্তব্য করেছেন তা আমাকে চমৎকৃত করেছে। তিনি লিখেছেন: In terms of psychology of Carl Jung, I believe, death of God on psychological level would mean madness, because “Self” is the central point of psyche and an internal representation of what we believe to be univarssal God. Any disconnect between Ego, the part of personality we know, and Self results in psychological problems. Isn’t itinteresting that Nitsche died as an insane person? আমার লেখার উদ্দেশ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি নয়। আমি একজন বিশ্বাসী। কখনো সংশয় ব্যক্ত করি আলোচনার দিগন্তকে প্রসারিত করতে এবং নতুন কিছু জানতে। গতকালের পোস্ট আমার নিবন্ধের একটি অংশ ছিল, যার অবশিষ্টাংশ আজ পোস্ট করছি। যারা ইতোমধ্যে ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত হয়েছেন, আশা করি তারা এই অংশ পাঠ করে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত হবে।
খ্রিস্টান জগৎ ও বাক-স্বাধীনতার স্বরূপ
খ্রিস্টান-প্রধান পাশ্চাত্যে প্রকাশ্যে ধর্ম, ইশ্বর, বাইবেল ও যিশু বা অন্য ধর্মের ইশ্বর, ধর্মগ্রন্থ, নবী বা প্রবক্তাদের নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ, এমনকি ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করার ওপর সাংবিধানিকভাবে কোনো বাধা নেই। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে খ্রিস্টবাদের কঠোর সমালোচনা হলেও খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে তেমন প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে না। মত প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতা প্রয়োগের সুযোগ থাকায় অনেক সময় পত্রপত্রিকাগুলো ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা: কে বিদ্রƒপ করার সুযোগ নেয়। বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। কিন্তু পাশ্চাত্যের সরকারগুলোর তেমন করণীয় থাকে না। সংবিধান তাদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছে। তারা বড় জোর সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করতে পারে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি পারে এমন কোনো কিছু করা থেকে বিরত থাকতে। সংশ্লিষ্ট ঘটনায় যদি গ্রেফতারের কোনো ঘটনাও ঘটে তাহলেও তা সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
অনেকের মনে থাকতে পারে ২০১২ সালে ফ্লোরিডার এক ইভানজেলিক্যাল চার্চের যাজক টেরি জোনস (৬৯) ৯/১১ এ নিউইয়র্কে টুইন ট্ওায়ার ধ্বংসের দ্বাদশ বার্ষিকীতে ওই ঘটনায় নিহত ২,৯৯৮ জনের প্রত্যেকের স্মরণে বা তাদের আত্মার শান্তির জন্য ২,৯৯৮ টি কোরআন জ্বালানোর ঘোষণা দেন। মুসলামানদের ওপর ক্ষুব্ধ ওই ভদ্রলোক ২০১১ সালে তার চার্চে এক ধর্মীয় সমাবেশে একটি কোরআন জ্বালিয়ে পরবর্তী বছর বিপুল সংখ্যক কোরআনের বহ্নোৎসব করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ও তার সঙ্গী আরেকজন যাজক মারভিন স্যাপ জুনিয়র (৫২) ২০১২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর একটি পিকআপ ভ্যানে যখন কেরোসিনে ভেজা কোরআন ও বারবিকিউ সেঁকার বড় আকৃতির গ্রিল বহন করে আগুন জ্বালাতে একটি পার্কে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো ও টাম্পা সিটির মধ্যবর্তী স্থান ৩,০০০ জনসংখ্যা অধ্যুসিত ছোট সিটি মালবেরিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কেউ কোরআন, বাইবেল পোড়ালে আইনত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। টেরি জোনসকে গ্রেফতারের কারণ ছিল তিনি জ্বালানি পরিবহন আইন ভঙ্গ ও দর্শনীয়ভাবে কোমরে আগেনয়াস্ত্র বহন করেছিলেন।
২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি ঘটনা ঘটে মার্ক ইউসেফ (Mark Youseff) ওরফে নাকোলা ব্যাসেলে নাকোলা (Nakoula Basseley Nakoula) নামে এক অখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতার তৈরি সস্তা বাজেটের চলচ্চিত্র “ইনোসেন্স অফ মুসলিমস” নামে একটি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে। এ চলচ্চিত্রে নবী মুহাম্মদ সা: কে অত্যন্ত ঘৃণিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মার্ক ইউসেফকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু ইসলাম বিরোধী চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিযোগে নয়। তার বিরুদ্ধে আটটি ভিন্ন অভিযোগ ছিল। ব্যাংক প্রতারণা, নাম জালিয়াতি ইত্যাদি। চারটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত তাকে এক বছরের কারাদন্ড এবং দন্ডকাল শেষ হওয়ার পর চার বছরের প্রবেশন বা পুলিশী নজরদারিতে থাকার শাস্তি দেয়। পরে তার বিরুদ্ধে আরও একটি প্রতারণা অভিযোগ যুক্ত হয়। অভিযোগটি এনেছিলেন “ইনোসেন্স অফ মুসলিমস” এর এক অভিনেত্রী সিনডি লী গর্সিয়া (Cindy Lee Garcia)। তার অভিযোগ ছিল চলচ্চিত্রের ধরন সম্পর্কে নির্মাতা মার্ক ইউসেফ তাকে বিভ্রান্ত ও তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাকে চুক্তিবদ্ধ অর্থ পরিশোধ করা হয়নি। চলচ্চিত্রটির মূল নাম ছিল “ডেজার্ট ওয়ারিয়র” এবং চলচ্চিত্রে তার মুখে মুসলিম বিরোধী যেসব সংলাপ তুলে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো তিনি বলেননি, বরং অভিনয়ের পর সংলাপগুলো জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ইসলাম বা মুসলিম নিয়ে সিনডি গর্সিয়ার মাথাব্যথার কোনো কারণ ছিল না। চলচ্চিত্রটির ট্রেলার ইউটিউবে আপলোড করার কারণে অভিনেত্রী হিসেবে তার যে অখ্যাতি হয়েছে, তিনি তা পুনরুদ্ধারের জন্য আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
আমেরিকান সরকারের কিছুই করার নেই। সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বলা হয়েছে: “Congress Shall make no law respecting and establishment of religion; or prohibiting the free exercise thereof, or abridging the freedom of speech, or the press.” এ স্বাধীনতা এতোই উদার যে মত প্রকাশের জন্য কারো গায়ে হাত তোলা ছাড়া যার যা খুশি তাই করতে পারে। কারো স্বাধীন মত প্রকাশের ফলে অন্য কারো ক্ষতি হলে বা আপত্তির কারণ ঘটলে প্রতিকারের জন্য আদালতে দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ নেই। ধর্মীয় গ্রন্থর অবমাননা, সৃষ্টিকর্তা ও ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, আপত্তিকর কার্টুন আঁকা ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কারণে হুজ্জত ও খুন-জখমের মতো ঘটনা ঘটলেও যারা ধর্মবিরোধী কর্মকান্ডে ইন্ধন জুগিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না, যতোক্ষণ পর্যন্ত না প্রশাসন তাদের দ্বারা অন্য কোনোভাবে আইন লঙ্ঘিত হয়েছে কিনা তা প্রমাণিত হয়।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ইউরোপের দেশগুলোতেও মানুষের বাক-ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কমবেশি একই রকম। বরং ক্ষেত্রবিশেষে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি। ডেনমার্কে সংবাদপত্র “জিল্যান্ডস-পোস্টেন” (Jellands-Posten) ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর “দ্য ফেস অফ মুহাম্মদ” শিরোনামে ১২টি এডিটোরিয়াল কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে, অধিকাংশই কার্টুনে নবী মুহাম্মদ সা: ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। সংবাদপত্রটি ঘোষণা করেছিল যে, ইসলামের সমালোচনা ও সেলফ-সেন্সরশিপ নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তাদের উদ্যোগ সে বিতর্কের অংশ। সারা বিশ্বে মুসলমানরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। কোনো কোনো মুসলিম দেশে দাঙ্গা ঘটে। ডেনিশ মুসলিম সংগঠনগুলো আদালতে মামলা করে, কিন্তু আইন দ্বারা সমর্থিত নয় বলে ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে মামলাটি নাকচ করা হয়। এমনকি এ বিষয়ে আলোচনার করার জন্য ডেনমার্কে নিয়োজিত মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে ডেনমার্কের সরকার এবং এ ব্যাপারে সরকারের কিছু করার নেই বলে জানিয়ে দেয়। কার্টুনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০০৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে সহিংস ঘটনায় ২৫০ জনের মৃত্যু, ডেনমার্কসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর দূতাবাস, চার্চ ও খ্রিস্টানদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। অনেক মুসলিম দেশ ডেনমার্ক থেকে পন্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী এ বিতর্কে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডেনমার্কের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে বর্ণনা করেন। বিভিন্ন চরমপন্থী ইসলামী গ্রুপ সংশ্লিষ্ট পত্রিকা ও সাংবাদিকদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ২ নভেম্বর ফ্রান্সের ব্যঙ্গ পত্রিকা “শার্লি হেবদো (Charlie Hebdo) নবী মুহাম্মদকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশ করায় সেই রাতেই পত্রিকাটির অফিসে বোমা নিক্ষেপ করা হয় এবং সম্পাদক ও তার দুই সহকর্মী পুলিশের নিরাপত্তা লাভ করেন। “আল-কায়েদা ইন দি অ্যারাবিয়ান পেনিনসুলা” তাদের হিটলিস্টে শার্লি হেবদো’র সম্পাদক স্টেফানি শার্লিবোনিয়ার সহ আরও কয়েকজনের নাম প্রকাশ করে। পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে আদালতে নেওয়া হলেও আদালত তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খারিজ করে দেয়। এ ঘটনায় ফরাসি মুসলিমরা আরও ক্ষুব্ধ হয় এবং কার্টুনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সহিংস ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি ওই অফিসে মুখোশ পরা দুই বন্দুকধারীর হামলায় পত্রিকাটির সম্পাদকসহ ১২ জন নিহত ও ১১ জন আহত হয়। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জিল্যান্ড-পোস্টেন পত্রিকাটি শার্লি হেবদো’তে প্রকাশিত কার্টুনগুলো পুন:মুদ্রন করেনি।
অন্যদিকে কার্টুন প্রকাশ করাকে বাক-স্বাধীনতা বৈধ প্রয়োগের সমর্থকরা জোরালে যুক্তি প্রদর্শন করতে থাকেন যে প্রকাশের বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, সন্ত্রাসের ভীতিতে পিছু না হটে ইসলাম সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কার্টুনের মাধ্যমে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আরও স্পষ্টভাবে বোধগম্য হয়ে ওঠে। ডেনমার্কে মত প্রকাশের উচ্চ সহনশীলতা ঐতিহ্যের দিকটিও তারা তুলে ধরে। সকল সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও পাশ্চাত্যের বৃহত্তর সমাজে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
‘জিল্যান্ডস-পোস্টেন এর কালচার এডিটর ফ্লেমিং রোজ মুহাম্মদ সা: এর ব্যঙ্গচিত্র আঁকার উদ্দেশ ব্যক্ত করে মোট ৪২ জন শিল্পীকে চিঠি দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন ইতিবাচক সাড়া দেন, তিনজন অংশগ্রহন করতে অস্বীকার করেন, একজন পরিকল্পনাটি অস্পষ্ট বলে উল্লেখ করেন, একজন এটিকে একটি বাজে ধারণা ও একজন তার ভীতির কথা জানা। ১২টি কার্টুন জমা পড়ে, যার মধ্যে তিনটি পত্রিকাটির নিজস্ব শিল্পীদের আঁকা। সম্পাদকদের কাছে ফলাফল আশাব্যঞ্জক ছিল না, অতএব তারা এটিকে কোনো নিউজ স্টোরি হিসেবে প্রকাশের পরিবর্তে ফ্লেমিং রোজের নির্দেশনায় কালচার সেকশনে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফ্লেমিং রোজ কার্টুনের সঙ্গে যে সম্পাদকীয় যোগ করেন, তাতে তিনি যুক্তি উপস্থাপন করেন যে ইসলাম সম্পর্কে সাংঘর্ষিক বিষয় নিয়ে ভীতির বিরুদ্ধে বাক-স্বাধীনতাকে উর্ধে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি তার নিউজ স্টোরিকে বৈধ বিবেচনা করেন। এর পক্ষে তিনি কিছু দৃষ্টান্তও উপস্থাপন করেন। যার মধ্যে কৌতুকাভিনেতা ফ্র্যাঙ্ক হায়াম ( Frank Havam) কর্তৃক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে কোরআনের ওপর নয়, বরং বাইবেলের ওপর প্রস্রাব করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন বলে উক্তিও সংযোজন করেন। রোজ লিখেন: “আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজকে কিছু মুসলিম অগ্রাহ্য করে। তারা নিজস্ব ধর্মীয় অনুভূতির বিশেষ স্থান, বিশেষ বিবেচনা দাবী করে। এটি সমসাময়িক গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যেখানে একজনকে অবশ্যই অবমাননা, বিদ্রƒপ ও উপহাস গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এটি অবশ্যই সবসময় আকর্ষণীয় ও দেখতে শোভন নয়, এর অর্থ এমন নয় যে ধর্মীয় অনুভূতিকে যে কোনো মূল্যে ঠাট্টা-মস্করার বিষয়ে পরিণত করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি খুব ক্ষুদ্র একটি বিষয় — আমরা পিচ্ছিল একটি পথের দিকে যাচ্ছি, যেখানে কেউ বলতে পারে না যে কীভাবে সেলফ-সেন্সরশিপের অবসান ঘটবে। সেজন্যই “জিল্যান্ডস-পোষ্টেন” ডেনিশ এটিটোরিয়াল কার্টুনিষ্ট ইউনিয়নের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে যে তারা মুহাম্মদকে যেভাবে দেখেন তা অঙ্কন করতে।”
পরবর্তী সময়ে ফ্লেমিং রোজ “দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট” এ তার উদ্দেশ সম্পর্কে আরও ব্যাখ্য দেন: “কার্টুনিষ্টরা যেভাবে খ্রিস্ট ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, হিন্দু ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে যেমন আচরণ করে, ইসলামকেও একইভাবে বিবেচনা করেছেন। এবং ডেনমার্কের মুসলিমদের প্রতি একই ধরনের আচরণ করে তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে ‘আমরা আপনাদেরকে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করার ডেনিশ ঐতিহের মধ্যে সম্পৃক্ত করছি, কারণ আপনারা আমাদের সমাজের অংশ, অজ্ঞাত কেউ নন। কার্টুনগুলো মুসলিম সমাজকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য, পরিহার করার জন্য নয়।” ফ্লেমিং রোজ যাই বলুন না কেন, কার্টুনগুলোর সঙ্গে তার সম্পাদকীয়ের শিরোনাম ছিল: ‘দ্য থ্রেট ফ্রম দ্য ডার্কনেস’ বা ‘অন্ধকার থেকে হুমকি’, যাতে ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতৃবৃন্দ, যারা নবীর বাণীর ব্যাখ্যা করেন তাদের নিন্দা করা হয়েছে এবং বুদ্ধিদীপ্ত ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের বস্তু হওয়ার অপমান সহ্য করতে পারেন না।’”
ইশ্বরের মৃত্যু হয়নি —
ইশ্বর সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির সক্ষমতার মৃত্যু ঘটেছে: শোহাইব সুলতান
‘টাইম’ ম্যাগাজিন ১৯৬৬ সালের ৩ এপ্রিল “ইশ্বর কি মৃত?” (Is God Dead?) শীর্ষক কভার স্টোরি প্রকাশ করার ৫০ বছর পর ২০১৬ সালে সেই প্রতিপাদ্য খন্ডন করে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির মুসলিম লাইফ প্রোগ্রামের পরিচালক শোহাইব নাজির সুলতান ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ লিখেন। নিবন্ধে তিনি বলেছেন:
“১৯৬৬ সালের ‘টাইম’ এর “ইজ গড ডেড” শীর্ষক কভার স্টোরি একটি প্ররোচনা সৃষ্টিকারী প্রশ্ন এবং ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের লিবারেল-প্রোটেস্টান-খ্রিস্টান প্রেক্ষাপটে জাতি-বিদ্বেষমূলক বক্তব্য। ইশ্বরের কাহিনিকে আধুনিক যুগে ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বলার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে হয়।
মুসলিম বিশ্বকে উপনিবেশবাদ থেকে শুরু করে সহিংস সাম্প্রদায়িকতা পর্যন্ত সবকিছুর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হয়েছে। তা সত্বেও এমন কোনো ধরনের দৃষ্টান্ত নেই যে, মুসলমানরা গণহারে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস পরিত্যাগ করছে অথবা মসজিদ থেকে পলায়ন করছে। বরং এর বিপরীতে বিগত কয়েক শতাব্দী ইতিপূর্বে ধর্মনিরপেক্ষ করে ফেলা মুসলিম সমাজ এবং সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো, যেখান থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে ফেলা হয়েছি সেসব স্থানে ধার্মিকতার পুনর্জাগরণ প্রত্যক্ষ করেছে। পাশ্চাত্যের বহু চিন্তাবিদ ভাবতে পারেন যে ইশ্বর-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রত্যাবর্তনের পেছনে কারণ হলো গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি অথবা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার স্বাধীনতার অভাব। কিন্তু আমি যুক্তি দিতে চাই যে, ৫০ বছর আগে ‘টাইম’ ম্যাগাজিন ধর্মতাত্ত্বিক যে সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিল সেসব কিছু সমস্যার ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাস ও সভ্যতা হিসেবে ইসলাম হচ্ছে প্রকৃত সমাধান।
শুরুতেই বলতে হয় যে, ইশ্বর সম্পর্কে আধুনিক মানুষের কাছে যা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে ইশ্বর সম্পর্কে মুসলমানদের ধারণা তা প্রত্যাখ্যান করে। ইসলামের ‘আল্লাহ’ একটি স্বত:সিদ্ধ অনৃতাত্ত্বিক অস্তিত্ব। কোরআনে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা হয়েছে: “কোনোকিছু আল্লাহর অনুরূপ নয়” (৪২;১১)। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদদের একটি সাধারণ প্রশ্ন হচ্ছে: “আল্লাহকে উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে তোমার অক্ষমতাই হচ্ছে আল্লাহ সম্পর্কিত তোমার াযথাযথ ধারণা।” ইসলামে বিশ্বাসের পক্ষে সাক্ষ্যের শুরুই হয় ‘না’সূচক বক্তব্য দিয়ে, আল্লাহকে স্বীকার করার আগে “লা ইলাহা” অর্থ্যাৎ “কোনো উপাস্য নেই” এরপর আসে “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া”। মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদরা ‘আল্লাহ কে’ সেই অস্তিত্বের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার আগে ‘আল্লাহ কে’ তা অস্বীকার করতে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেন। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে আল্লাহ বিভিন্ন নিবিড় ও ঐশ্বরিক গুণ ও বৈশিষ্টের নামে পরিচিত Ñ ভৌত কোনো বৈশিষ্ট দ্বারা নয়। আল্লাহকে কোনো সময়, স্থান ও লিঙ্গের সীমাবদ্ধতার মধ্যে আবদ্ধ নন এবং আবদ্ধ রাখা যায় না।
ইসলামের আল্লাহ সুনিশ্চিতভাবে প্রেমময় ও অনুগ্রহশীল; আবার একই সঙ্গে প্রতিশোধপরায়ণ ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। আল্লাহ সমুদ্রের মতো সুন্দর ও রাজসিক। আল্লাহর অভিজ্ঞতা প্রশান্ত ও তীব্র হতে পারে। যুক্তি ও জ্ঞানের প্রয়োজনে আল্লাহ তাঁর সত্তাকে বিভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করতে পারেন যা আমাদের জ্ঞান ও বোধগম্যতার বাইরে। অতএব মুসলমানরা সবসময় আল্লাহকে কোমলভাবে প্রকাশ হতে দেখার আশা করে না। দুর্ভোগ বা যাতনা তেমন কোনো ধর্মীয় রহস্য নয়, কারণ উদ্দেশের সঙ্গে আল্লাহকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার জন্য সংকটের আবির্ভাব একটি বাস্তবতা।
ইসলামে আল্লাহ মানুষকে পৃথিবীতে প্রতিনিধত্ব করার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন এবং এ দায়িত্বকে কঠোরভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় কোনো নিস্ক্রীয় ধার্মিকতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আল্লাহ কর্মতৎপরতা ও সংগ্রাম আশা করেন — নিয়মিত প্রার্থনা করা, দরিদ্রদের সেবা করা, ভুল থেকে অনুশোচনার চর্চা করা, সৎ কাজে অংশগ্রহণ ও মন্দ কাজ পরিহার করা ইত্যাদি। অত:পর দাসত্ব ও আনুগত্যের পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। সাধারণভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের অভিজ্ঞতার মধ্যে অতি-নাটকীয়তার আশা করা হয় এবং এই অতি-নাটকীয়তা অনেককে হতাশ করে যখন বাণিজ্যিক ধাঁচের কোনো ঘটনা সংঘটিত না হয়। ইসলাম কোনো অলৌকিক ঘটনার প্রতিশ্রুতি দেয় না, বরং আমাদের চারপাশে যেসব অলৌকিক ঘটনা ঘটে চেলেছে সেগুলো অবলোকনের অনুমতি দেয়।
ইশ্বরের মৃত্যু হয়নি, বরং আধুনিকতা আমাদের যে বিচ্যুতি ঘটিয়েছে, সে কারণে ইশ্বর সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধির সক্ষমতার মৃত্যু ঘটেছে। কোরআনের এক আয়াতে প্রশ্ন করা হয়েছে: “হে মানব, তোমার মহামহিম প্রভু সম্পর্কে কী তোমাকে বিভ্রান্ত করল” (৮২:৬)। ভাষ্যকাররা রসিকতা করে বলেন, আল্লাহর উদারতাই আমাদেরকে আল্লাহ থেকে বিচ্যুত করেছে।
বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং আবিস্কারের আনন্দ আধুনিক মানুষের বিচ্যুতির একটি কারণ হতে পারে, কিন্তু তা হওয়া উচিত নয়। আল্লাহ ও বিজ্ঞান কোনো সাংঘর্ষিক অবস্থার মধ্যে নেই। বরং কোরআন পাঠকদের জোর দিয়ে বলা হয়েছে পৃথিবীর দিগন্তে এবং নিজেদের মধ্যে আল্লাহর নিদর্শন অনুসন্ধানের জন্য, (৪১:৫৩) এবং আকাশ ও পৃথিবী পর্যবেক্ষণ করে জীবনের উদ্দেশ সম্পর্কে ভাবতে বলা হয়েছে, (৩:১৯০-১৯১)। মুসলিম সভ্যতা কিছু মহান বিজ্ঞানির জন্ম দিয়েছে এবং তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন করেছেন; বিজ্ঞানিদের কখনো নিপীড়ন করা হয়নি অথবা বিশ্ব নিয়ে তাদের আবিস্কার নিয়ে তাদেরকে অপবাদ দেওয়া হয়নি। বিজ্ঞান কোনোভাবে ধর্মের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে বলে যে ধারণার প্রচলন ঘটেছে তা বিজ্ঞান ও ধর্ম সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির ফল। ধর্মের উদ্দেশ হচ্ছে “কেন” নিয়ে গভীর চিন্তা করা; “কী’ এবং “কীভাবে” নিয়ে নয়।
বৈজ্ঞানিক উপায়-পদ্ধতিই সকল জ্ঞান আহরণে একমাত্র পদ্ধতি বলে দাবী করা ধর্মীয় মৌলবাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম গোঁড়ামি নয়। একজন সাধু যদি বৈজ্ঞানিককে কোনো অনুমান বা ধারণাকে স্বত:সিদ্ধ প্রমাণ করতে বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষানিরীক্ষার পরিবর্তে মন্ত্র জপ করে ল্যাবরেটরি প্রদক্ষিণ করার জন্য বলে, তাহলে আমরা সাধুকে একজন মুর্খ বলে খারিজ করব ও বিদ্রƒপ করব। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানিরা প্রায় দাবী করেন যে সাধুরা ইশ্বরকে সন্ধান করতে যে পদ্ধতি প্রয়োগ করছে, যার অধিবিদ্যাগত কোনো সত্যতা নেই।
আল্লাহর যে নামটি মুসলমানরা অধিক উচ্চারণ করে সেটি হচ্ছে ‘আল-হাই’ — চিরঞ্জীব। এর সামঞ্জস্যপূর্ণ ও ছন্দময় উচ্চারণ আধ্যাত্মিক হৃদয়ে উচ্ছাস আনে। এই উচ্চারণগুলোর মধ্যে একজন আধ্যাত্মিক মানুষ নিজেকে দেখার চেয়ে আল্লাহকে বেশি দেখতে পান। কোরআনে সেজন্যই বলা হয়েছে: “আমি তোমার ঘাড়ের ধমনী চেয়েও অধিক নিকটবর্তী,” (৫০:১৬)। একজন বিশ্বাসীর পক্ষে ইশ্বর থেকে বিমুক্ত হয়ে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা ইশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার চেয়ে অনেক বেশি বিভ্রান্তিকর। “ইশ্বর কি মৃত?” এই প্রশ্নটি একজন মুসলিমের মনে পাল্টা প্রশ্ন সৃষ্টি করে, “ইশ্বর যদি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে আমি কীভাবে জীবিত আছি?”
নবী মুহাম্মদ সা: সংক্ষিপ্ত কিন্তু জটিল ব্যাধিকে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করার পর খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে নবী ঘনিষ্ট সাহাবিদের অন্যতম ওমর ইবন আল-খাত্তাব রা: তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় দিশেহারা হয়ে তাঁর তরবারি বের করে হুমকি দিতে থাকেন যে কেউ যদি মুহাম্মদ সা: কে মৃত বলার সাহস দেখায় তাহলে তিনি তাকে তরবারির দ্বারা আঘাত করবেন। ওই মুহূর্তে অত্যন্ত দৃঢ় কিন্তু শান্ত সাহাবি আবু বকর রা: শোকার্ত জনগণের উদ্দেশে বলেন, “আপনাদের মধ্যে যারা মুহাম্মদ সা: এর অনুসরণ করতেন তারা জেনে নিন যে মুহাম্মদ ইন্তেকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর প্রার্থনা করতে তারা জেনে নিন আল্লাহ সবসময় জীবিত এবং তিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।”
এটি আল্লাহ চিরস্থায়িত্ব ও মহত্বের অনুভূতি, যা এমনকি কঠোর ও চরম দুর্যোগপূর্ণ সময়েও মুসলমানদের মাঝে মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্বের আশাবাদ জাগ্রত করে।
Comments