আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত ২৭শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অথিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। বিশ্ব সংস্থায় এটি তাঁর প্রথম ভাষণা হলেও তা ছিল আবেগ ও স্বস্ফূর্ততায় পূর্ণ। গত ৫ই আগষ্ট ভারত সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে কাশ্মীরিদের সাথে তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং জাতিসংঘ গত সাত দশকে গৃহীত এগারটি প্রস্তাবে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরিদের ভাগ্য নির্ধারণের পক্ষে বললেও তা বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ না নেয়ার কারণে ভারতের পক্ষে কাশ্মীরিদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সুযোগ করা হয়েছে বলে তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেন। কাশ্মীর ছাড়াও তাঁর পঞ্চাশ মিনিটের ভাষণে স্থান পেয়েছে পাশ্চাত্যে ‘ইসলামোফোবিয়া’র বিস্তৃতি। প্রতিটি বিষয়ে তার বক্তব্য এতো প্রাঞ্জল, শক্তিশালী ও মর্মস্পশী ছিল যে, উপমহাদেশ, মুসলিম বিশ্ব ছাড়িয়ে পাশ্চাত্যের মিডিয়াতেও তাঁর ভাষণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
ইমরান খানের ভাষণ এবং কাশ্মীরে আশির দশকের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া ভারতীয় নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কাশ্মীরি মুজাহিদদের সশস্ত্র সংগ্রামের উপর নিউইয়র্কে বসবাসরত কাশ্মীরি সাংবাদিক বাশারাত পীরের লেখা স্মৃতিচারণমূলক বই “কারফিউড নাইট” পাঠ করার কারণে ভূর্স্ব্গ নিয়ে আমার সংক্ষিপ্ত স্মৃতি তুলে ধরার ইচ্ছা হলো।
ঘটনা তিন দশক আগে ১৯৯ সালের কাশ্মীরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না আমার। হঠাৎ করেই আমার ভ্রমণ কর্মসূচিতে কাশ্মীর যুক্ত হয়েছিল। আমার গন্তব্য ছিল ইসলামাবাদ। সময় ও পরিস্থিতি কোনোটাই পাকিস্তান ভ্রমণের অনুকূল ছিল না। ১৯৯০ সালের মে মাস। পাকিস্তানে প্রচন্ড গরমের মওসুমের সূচনার সময়। প্রকৃতির দাবদাহকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল সিন্ধু প্রদেশে চলমান মুহাজির-সিন্ধী দাঙ্গা এবং প্রবল হয়ে উঠা কাশ্মীরের স্বাধীনতা অথবা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম। দাঙ্গায় করাচিতে প্রতিদিন ডজন ডজন মানুষ নিহত হচ্ছিল। পাকিস্তান বা উত্তর ভারতের যে কোন স্থানে ভ্রমণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত। তবুও আমাকে যেতে হলো। অব্যবহৃত একটা এয়ার টিকেট ছিল আমার। মেয়াদ ফুরিয়ে আসছিল টিকেটের। বাড়তি অর্থ যোগ না করে পাকিস্তান বা ভারতে ঘুরে আসা যায়। সাত বছর আগে জার্মানি থেকে দেশে ফেরার সময় করাচি বিমান বন্দর থেকে হোটেল পর্যন্ত গিয়ে পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করে কাউকে না পেয়ে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতি দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। সে কারণে পাকিস্তান ভ্রমণ করতে না পারার অতৃপ্তি ছিল। স্কুলের ক্লাস শুরুর আগে এসেম্বলিতে পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাক সার জমিন’ গেয়ে পাকিস্তানের চাঁদতারা খচিত পতাকাকে স্যালিউট করেছি। ১৪ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস, ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করেছি। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের বড় বড় শহর, জিলা, ঐতিহাসিক নিদর্শন, খ্যাতিমান ব্যক্তি, নদী ইত্যাদির নাম পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। মনে আছে পাটিগনিতের অংক কষতে পাকিস্তানের নামী ক্রিকেট খেলোযাড়দের রান সংখ্যা নিয়েও অংকের ফল মিলাতে হয়েছে। ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত সামার অলিম্পিক পাকিস্তান হকিতে স্বর্ণপদক লাভ করায় স্কুলে ছুটি পেয়েছি। আমাদের বৃহত্তর পরিবারের দু’জন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলেন, ছুটিতে তারা বাড়িতে এলে তাদের কাছে পশ্চিম পাকিস্তানের গল্প শুনেছি। ওই সময় পশ্চিম পাকিস্তান এক দেশ ছিল। হাজার মাইল ব্যবধানে আমরা পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম। দেশ বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে আবির্ভূত হলেও পাকিস্তান ভ্রমণের ইচ্ছার মৃত্যু ঘটেনি।
বাংলাদেশ বিমানের করাচি ষ্টেশন ম্যানেজার আনোয়ারুল হক এয়াপোর্টে আমাকে রিসিভ করলেন তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। করাচি শহরে চলমান দাঙ্গা পরিস্থিতি বর্ণনা করে আমাকে সতর্ক করলেন এবং বিমানের গাড়ি দিয়ে ড্রাইভারকে বলে দিলেন আমার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। জনমানব শূন্য রাস্তা, প্যারামিলিটারী সৈন্যদের টহল এবং যানবাহনের স্বল্পতা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট ছিল। গুরু মন্দির রোডের এক রেষ্টহাউজে পৌঁছে দিল ড্রাইভার। রেষ্টহাউজে আমাকে স্বাগত জানানো হলো। আমার কাছে করাচির কয়েকজনের টেলিফোন নম্বর ছিল ÑÑ ১৯৮৩ সালে বার্লিনে আমার স্বজন হয়ে উঠা আজফার আলী খান, বিসিসিআই কম্পিউটার ইন্সটিটিউটের লেকচারার। আমার করাচি আগমণে তিনি উচ্ছসিত হয়ে রাতেই দেখা করতে চলে এলেন। তার বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলেন। ইসলামাবাদ থেকে ফিরে তার বাড়ি যাবো স্থির হলো। পরদিন সকালে কাছেই জিন্নাহ’র মাজার, আরো কিছুদূর গিয়ে করাচির ব্যস্ততম এলাকা সদর ঘুরলাম। বিকেলে আজফার আলী খান এলেন আমাকে করাচির দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য এলেন। তার সাথে ক্লিফটন বীচ, জিন্নাহ’র বাড়ি, বাণ্যিজ্যিক এলাকা ঘুরিয়ে দেখালেন। ভিউ কার্ডে দেখা ছবির কোনো কোনো জায়গার উল্লেখ করলে তিনি সেসব জায়গায় নিয়ে গেলেন।
১৯৮৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওআইসি ফরেন মিনিষ্টার্স কনফারেন্স কভার করতে এসেছিলেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় উর্দু দৈনিক জং এর চিফ রিপোর্টার আরিফুল হক আরিফ এবং জং এর সাপ্তাহিক প্রকাশনা আখবার-এ-জাঁহা’র সম্পাদক ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের প্রফেসর ড. নিসার জুবেরী। ঢাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা ও দেখভাল করা এবং একদিন বাসায় নিয়ে আপ্যায়ন করার কারণে তাদের সাথে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নিসার জুবেরীকে পাওয়া গেল না। আরিফুল হক দৈনিক জং অফিসে আমন্ত্রণ জানালেন। পরদিনই করাচি ছাড়বো জানার পর তিনি আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ লোকের নাম, ফোন নম্বর দিয়ে বললেন ইসলামাদে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রেষ্টহাউজে এক পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হলো। আমিরুল আজিম। তিনি আমাকে বললেন ইসলামাবাদের আগে লাহোর হয়ে যেতে। উর্দুতে একটি ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন লাহোর ষ্টেশনে নেমে কোনো ট্যাক্সি বা স্কুটার ড্রাইভারকে ঠিকানাটি দিলেই জায়গামত পৌঁছে দেবে। সেখানে তিনি থাকবেন। তিনদিন করাচিতে কাটিয়ে লাহোরগামী ট্রেনে উঠলাম। লাহোরে ঠিকানা অনুযায়ী পৌছে গেলাম। সেটিও একটি রেষ্টহাউজ। আমিরুল আজিম অভ্যর্থনা জানালেন। আমাকে বললেন আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজাফফরাবাদ যেতে। সাংবাদিক হিসেবে কাশ্মীর পরিস্থিতি দেখার জন্য আমার যাওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বললেন তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র আবদুল্লাহ ফারুক ভাট্টিকে ডেকে তার গাড়ির চাবি দিয়ে বললেন আমাকে লাহোর নগরী ঘুরিয়ে সন্ধ্যায় সেজান রেষ্টুরেন্টে নিয়ে যেতে। ভাট্টি আমাকে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখালো। মনোরম সবুজে ভরা ক্যাম্পাস। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। রাভি নদীর পানি দূরে কৃষি জমিতে চলে যাচ্ছে। রাভি নদীর পানি নিয়ন্ত্রণ করে ভারত। দিনে ছয় ঘন্টা করে দু’বার পানি পায় পাকিস্তান, দু’বার পানি পায় ভারত। ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ১৯৬০ সালে যে পানি বন্টন চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে উভয় দেশ তা পালন করে চলেছে। ভাট্টির কাছেই জানতে পারলাম পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু বাংলাদেশী ছাত্র আছে, ইচ্ছা করলে আমি তাদের সাথে দেখা করতে পারি। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার বন্ধু তারিক পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করতো। সে এতোটাই প্রভাবশালী ছিল যে এক পর্যায়ে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ষ্টুডেন্টস ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী নির্বাচিত হয়েছিল। সে পাকিস্তান ছেড়েছে বহু বছর আগে। ১৯৮৯ সালের এপ্রিলে নিউইয়র্কে তার সাথে আমার শেষ সাক্ষাত হয়েছে। বাংলাদেশী ছাত্রদের সাথে দেখা করার আগে ভাট্টি আমাকে শাহী কিল্লা, শাহী মসজিদ, কবি ইকবালের মাজার, লাহোর প্রস্তাবের স্মৃতি বিজড়িত মাঠে মিনার-ই-পাকিস্তান, বিশাল বুকষ্টোর ফিরোজ এন্ড সন্সসহ আরো কিছু ঐতিহাসিক জায়গা ঘুরিয়ে আবার পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এসে একটি ছাত্রাবাসে নিয়ে গেল। বাংলাদেশী দু’জন ছাত্র। আতিক এবং আলো। দুই ভাই। (দু’জনই এখন যুক্তরাষ্ট্রে)। একজন ফার্মেসির ছাত্র, আরেকজন ইকনমিকসের এবং ওরা আমার বন্ধু তারিকের ছোটভাই। আমার পাশের উপজিলার। ওরা আরেক দফা আমাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। আরো ছাত্রের সঙ্গে কথা হলো।
সন্ধ্যায় ভাট্টি এসে আমাকে নিয়ে গেল সেজান রেষ্টুরেন্টে। আমিরুল আজিম আমার সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং তার ঘনিষ্ট নবীন প্রবীণ জনা বিশেক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি রীতিমতো বিব্রত। সাংবাদিকদের মধ্যে দু’জন আশির দশকে পেশাগত কাজে ঢাকায় গেছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে সবার অনেক কৌতুহল। অনুষ্ঠানে আমাকে বক্তব্য দিতে হলো, কিছু প্রশ্নের উত্তরও দিতে হলো। তখন আমি ভালোই উর্দু বলতে পারতাম (এখন কোনোমতে বলতে পারি)। ইংরেজিতে না বলে উর্দুতেই কথা বললাম। আমার উর্দু জানা তাদের কাছে বিস্ময়ের মতো। কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উর্দু নিয়েই পূর্ব পাকিস্তানের সাথে প্রথম রক্তাক্ত সংঘাতের সূচনা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানিরা উর্দুকে ঘৃণা করে, তাদের ধারণায় এটাই বদ্ধমূল ছিল। আমি বললাম, ভাষার সাথে বিরোধ ছিল না, চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতাই বিরোধের কারণ। ্আমার বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রায় সবাই প্রশ্ন করলেন। ভাষার প্রশ্নে তাদের বক্তব্য হলো, আমরা পাঞ্জাবী, উর্দু আমাদের কারো ভাষা নয়। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে আমরা উদর্ৃূকে গ্রহণ করেছি। আমি বলি, ভাষার রাজনৈতিক দিক নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি উর্দু কবিতা-গান আমাকে মুগ্ধ করে এবং সেই মুগ্ধতা থেকেই সামান্য উর্দু চর্চা করতে চেষ্টা করেছি। পরদিন আমার আপ্যায়নকারী আমার হাতে লাহোর-রাওয়ালপিন্ডির বিমান টিকেট ধরিয়ে জোর করে পকেটে বেশকিছু রুপি গুঁজে দিলেন। রাওয়ালপিন্ডির কয়েকজনের নাম ও টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললেন, যে কাউকে ফোন করলেই তারা আমাকে মুজাফফরাবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।
রাওয়ালপিন্ডির চাকলালা বিমানবন্দরের নাম কতো শুনেছি। সেই বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। ওআইসি পরিচালিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী ছাত্র ফজলু বিমানবন্দরে আমাকে রিসিভ করে দশ মাইল দূরে ইসলামাবাদে তার ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। দু’দিন ইসলামাবাদে কাটিয়ে আমাকে দেয়া একটি নম্বরে ফোন করলে রাতে এক যুবক এসে মোটর সাইকেলে তুলে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে এক বহুতল ভবনের অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে দিল। একটি কাশ্মীরি সশস্ত্র গ্রুপের রাজনৈতিক সদর দফতর। নেতাদের সঙ্গে পরিচয় হলো। শীর্ষ নেতা প্রফেসর আশরাফ শরফ। শ্রীনগরের এক সরকারি কলেজের শিক্ষক। ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে রাজনৈতিক পর্যায়ে কাজ করছেন। রাতে আরো বেশ ক’জন নেতার সাথে খেতে বসে তারা কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বললেন। আমাকে অনেক জেরা করলেন আমি যে যথার্থই একজন সাংবাদিক এবং সন্দেহভাজন কেউ নই তা নিশ্চিত হতে চাইছিলেন তারা। তাদের সাথেই রাত কাটালাম। সকালে নাশতা সেরে প্রফেসর আশরাফ শরফের সাক্ষাতকার নিলাম। দশটার দিকে একজন আমাকে চাকলালা বিমানবন্দরে নিয়ে মুজাফফরাবাদের টিকেট হাতে দিল। চৌদ্দ আসনের ছোট বিমান। আধা ঘন্টা পর মুজাফফরাবাদে পৌছলাম। ছোট্ট বিমানবন্দরের অল্প দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে খর¯্রােতা এক নদী। সেখানে একটি গাড়ি নিয়ে আমার অপেক্ষায় ছিল তিনজন। প্রথমে তারা আমাকে একটি রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সেখানে আরো কয়েকজন কাশ্মীরি যুবক। তারা পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। তাদের মধ্যে একজন তার বন্ধুর বিয়েতে রাজশাহী গিয়েছিল। বাংলাদেশের আতিথেয়তায় সে মুগ্ধ। এরপর তারা পাহাড়ি পথে চারদিকে উঁচু পর্বতশ্রেনীর মাঝে খোলা প্রান্তরে বড় ধরনের একটি তাবুতে নিয়ে গেল আমাকে। তাবুতে শ’খানেক যুবক। তাদের কাছে আমার পরিচয় দেয়া হলো। এসব যুবক ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর থেকে আজাদ কাশ্মীরে এসেছে অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণ নিতে এবং প্রশিক্ষণ শেষে কাশ্মীরে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ইতোমধ্যে বেশ ক’টি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে এমন ক’জন যুবকও ছিল সেখানে। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা তুলতেই তারা ঘাড়ে ঝুলানো স্কার্ফে মুখ ঢাকলো। তারা যা বলার জন্য নির্দেশিত এর বাইরে কোনো কিছু নিয়ে মুখ খুললো না। আমি যেহেতু দীর্ঘ সময়ের জন্য আসিনি সেজন্য আমি খুব পীড়িাপীড়ি করলাম না বা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানার চেষ্টা করলাম। আমাকে বললো তাদের সাথে যুদ্ধে গিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করতে। এবার তাদের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব নয় বলে দু:খ প্রকাশ করলাম। তাবুতে বিশাল ডেকচি ভর্তি চা। আমাকে চায়ে আপ্যায়ন করলো। মশলা ও লবন মিশ্রিত চা, ওরা বলে ‘কাওয়া’। প্রচন্ড গরমে পানিশূন্যতা কাটাতে ওরা দিনভর এই চা পান করে। সেখান থেকে আরেকটি ক্যাম্পে গেলাম। অসংখ্য কাশ্মীরি যুবক। তারাও ভারতের বিরুদ্ধে জিহাদে জয়ী হওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করলো। এরপর মুজাফফরাবাদে কাশ্মীরি নেতাদের মূল অপারেশনাল হেডকোয়ার্টারে গিয়ে নেতৃস্থানীয় কাশ্মীরিদের সাথে সাক্ষাত হলো। তারা জিহাদে জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। সন্ধ্যায় আমি একটি বাসে উঠে বেশ রাতে ইসলামাবাদে ফিরে এলাম।
আমার পাকিস্তান অবস্থানকালেই ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দুটি বড় ধরনের ঘটনা ঘটে। একটি হলো কাশ্মীরের প্রভাবশালী ও শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা এবং অল পার্টি হুররিয়াত কমিটির চেয়ারম্যান মিরওয়াইজ মৌলভি ফারুককে শ্রীনগরে তার প্রতিপক্ষ সশস্ত্র গ্রুপ গুলি করে হত্যা করে। তাঁর শবযাত্রায় অংশগ্রহকারীরা তাদের ধর্র্মীয় নেতার হত্যাকান্ডে উত্তেজিত ও বিশৃঙ্খল হয়ে উঠলে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করলে চার মহিলাসহ ৭২ জন লোক নিহত হয়। মিরওয়াইজ বংশানিক্রমিক উত্তরাধিকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবং নিহত মৌলভি ফারুক ছিলেন ক্রয়োদশ মিরওয়াইজ। তাঁর সতের বছর বয়স্ক পুত্র ওমর ফারুক নতুন মিরওয়াইজ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপর ঘটনাটি ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (র) এর সাবেক পরিচালক গিরিশ চন্দ্র সাকসেনাকে জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দান। আমি রাওয়ালপিন্ডিতে বিদ্রোহী নেতাদের সাথে অবস্থানের সময়ই সাকসেনার নিয়োগে তাদের মধ্যে অস্বস্তির ভাব লক্ষ্য করেছি। (সাকসেনা তার প্রথম মেয়াদে ১৯৯০ সথেকে ১৯৯৩ এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীরের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন)।
এুফফরাবাদ থেকে ফিরে পরদিন সকালে কিং ফয়সল মসজিদে গেলাম। মারগালা হিলসের পাদদেশে মসজিদের মূল ও চারপাশের উদ্যান মিলে ৩৩ একর জায়গার উপর বেদুইনদের তাবু সদৃশ বিশাল মসজিদ। মসজিদের পাশেই মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মাজার। ইসলামাবাদের প্রধান ল্যান্ডমার্ক। মসজিদের মূল ইবাদত কক্ষ, আশপাশের চত্তর মিলে দুই লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মসজিদ পরিদর্শন ও জিয়াউল হকের মাজার জিয়ারত করতে আসে। ওই সময় ওআইসি পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ছিল মসজিদ কমপ্লেক্সেই। ইউনিভার্সিটির হিষ্টরিরর প্রফেসর আহসান আমার সিনিয়র বন্ধু। একসময় একই স্কুল ও কলেজে পড়েছি। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি আমেরিকান সিটিজেন। তার সাথে সাক্ষাত করতেই ক্যাম্পাসে গেছি। ক্লাস শেষ করে তিনি বের হলেন। তার পেছনে বের হয়ে এলো সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরিহিত জনা ত্রিশক সেনা অফিসার। মেজর থেকে কর্নেল পর্যন্ত। তারা পরিচিত হলেন। দু’জনকে পাওয়া গেল, যারা ঢাকার মীরপুর ক্যান্টনমেন্টে আর্মি ষ্টাফ কলেজে কোন কোর্সে অ্যাটেন্ড করেছেন। তারা অন্য ক্লাসে চলে যাওয়ার পর আহসান ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম, এরাই কী আপনার ছাত্র? উনি বললেন, পাকিস্তানের প্রায় সব বিশব্ববিদ্যালয়ে সামরিক বাহিনীর অফিসাররা ছাত্র হিসেবে আসে। তারা ক্লাস এনজয় করে, রেজাল্টও ভালো করে এবং প্রমোশনে এই রেজাল্ট মূল্যায়ন করা হয়। দিনের অবমিষ্টাংশ কাটালাম কিছু শপিং এরিয়ায় ঘুরে এবং বিকেলে গেলাম মারগালা হিলসের সবচেয়ে উচু জায়গা ‘দামন-এ-কোহ’ (পর্বতের আঁচল) এ। সেখান থেকে সবুজে ঢাকা পুরো ইসলামাবাদ সিটি এবং অদূরে রাওয়াল লেকের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
পরদিন সকালে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ট্রেনে উঠে সাতাশ ঘন্টা পর করাচি ষ্টেশনে পৌছলাম। কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে রেষ্টহাউজের কাছেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাজার জিয়ারত করে ফেরার পর আজফার আলী খান এসে আমাকে তার বাসায় নিয়ে গেলেন। বার্লিনে অবস্থানের সময় তার একটি মাত্র মেয়ে ছিল, আসমা। সাত বছরের ব্যবধানে তার সংসারে আরো তিনটি ছেলে যোগ হয়েছে। আমাকে আপ্যায়ন করতে তার স্ত্রী অনেক খাবার রান্না করেছেন। আরো ক’জন আত্মীয় ও বন্ধুকে আমন্ত্রণ করেছেন। আত্মীয়দের একজন একাত্তরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ঢাকায় এক ব্যাংকে চাকুরি করতেন। তার ঢাকার স্মৃতি নিয়ে উর্দুতে একটি বই লিখেছেন। আমাকে উপহার দিতে চাইলেন। কিন্তু আমি উর্দু পড়তে পারি না জেনে হতাশ হলেন। বার্লিনেও ভাবী অনেক খাওয়াতেন। আমি যেহেতু একা থাকতাম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস করতাম, সেজন্য প্রায়ই আমাকে তার বাসায় দাওয়াত করতেন। ফেরার সময় কয়েক বেলার খাবার সাথে দিয়ে দিতেন, যাতে ক’দিন আমাকে রান্না করতে না হয়। খেতে খেতে অনেক আলাপ হলো। বার্লিনের স্মৃতি রোমন্থন করলাম। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আজফার আলী খান হতাম। বড় আশা নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন দেশ সেবা করবেন বলে। কিন্তু তা আর হলো না। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দেশে আর থাকবেন না। কানাডায় চলে যাবেন। (তিনি এখন কানাডায় বাস করেন)। আমাকে রেষ্টহাউজে পৌছে দিলেন। পরদিন ১লা জুন। আমার রিটার্ন ফ্লাইট। সকালে বিমানের করাচি ষ্টেশন ম্যানেজারকে ফোন করলাম। উনি বললেন, আপনি তো ফ্লাইট মিস করেছেন। ফ্লাইট ছিল কাল রাত একটায়। আপনাকে এয়ারপোর্টে অনেক খুঁজেছি। আমার হুশ হলো। তাইতো! ১লা জুন রাত একটা মানে ৩১শে মে রাত ১২টার পর।আগে কখনো এমন ভুল হয়নি। সেদিন বিমানের কোন ফ্লাইট ছিল না। পরের ফ্লাইট ৩রা জুন। আনোয়ার সাহেব আমাকে হোটেল মেহরানে বিমান অফিসে যেতে বললেন। আমি গিয়ে টিকেট ঠিক করে আনলাম।উনি না থাকলে আমাকে নতুন করে ফিরতি টিকেট কিনতে হতো। অতিরিক্ত সময় হাতে পেয়ে করাচি সিটির আরো কিছু জায়গা একা ঘুরে কাটিয়ে দিলাম।
পাকিস্তানে আমার অবশিষ্ট দিনগুলোতে আমি কাশ্মীর পরিস্থিতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। কাশ্মীরিদের সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্য এক ছিল না। দল-উপদলে বিভক্ত কাশ্মীরিরা অভিন্ন লক্ষ্য স্থির করতে ব্যর্থ হয়েছে। সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল কাশ্মীরের এক সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা শেখ আবদুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম দল কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে। শেখ আবদুল্লাহর ন্যাশনাল কংগ্রেস বরাবর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মিত্র, আর পিডিপি ভারতীয় জনতা পার্টিও মিত্র। চলতি বছরের নির্বাচনে পিডিপি-বিজেপি জোট কাশ্মীর ৬টি লোকসভা আসনের মধ্যে তিনটিকে জয়ী হয়েছে। ১৯৪৭ সালে কাশ্মীরের মহারাজা হরি সিং কাশ্মীরের ভারতভূক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে শেখ আবদুল্লাহ তা সমর্থন করেন। কারণ তিনি ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে যোগ দিতে চাননি। কাশ্মীরে সরকার গঠনকারী বড় দুটি দলই যদি ভারতভূক্ত থাকতে চায়, সেক্ষেত্রে কাশ্মীরের স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার যুদ্ধ কতোটা সফল হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। ছোটছোট বিদ্রোহী দলগুলোর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা অস্ত্র তুলে নিয়েছিল তাদের মধ্যেও ছিল নানামুখী স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা। একটি গ্রুপ লড়াই করছিল কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য। আরেকটি গ্রুপ চাইছিল কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করতে। ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে ভারতভূক্ত হওয়ার পক্ষে ছিল কাশ্মীরের হিন্দু পন্ডিতরা ছাড়াও অনেক কাশ্মীরি এবং ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে তারা গোপনে কাজ করতো। এ-ধরনের বিপরীতমুখী ও পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য এবং পরবর্তী বছরগুলোতে হয়েছিল তাই। বহুধা-বিভক্ত কাশ্মীরিদের অনৈক্য ও চিন্তাধারার বৈপরীত্যকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী কয়েক বছরের ব্যবধানেই কাশ্মীরিদের মধ্য থেকে প্রতি-বিপ্লবী গ্রুপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোকে অকার্যকর তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটি পরিস্থিতির অপেক্ষায় ছিল। অন্যান্য দলের সরকার ক্ষমতায় এসে কাশ্মীর প্রশ্নকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভাবলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি — বিজেপি’র কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের ব্যাপারে আপোষহীন ছিল এবং এবার তারা বিশেষ মর্যাদার গ্যারান্টি দানকারী সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং ৩৫ ধারা বিলোপ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভূক্ত করেছে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে উপমহাদেশ হয়তো আরো বেশি সংঘাত, আরো বেশি রক্তপাত দেখবে।
Comments are closed.