আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
চতুর্থ বারের মতো স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। তিন বার এসেছি প্রয়োজনে। এবার রক্তের টানে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর ১৯ মার্চ থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ঘরেই আটকে ছিলাম। প্রায় তিন বছর যাবত স্যান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় বাস করছে আমার মেয়ে ও তার স্বামী। আগে নিউইয়র্কেই ছিল। আমাদের জামাতা গুগলে সফটওয়্যার এনালিস্ট ধরনের ভাল জব অফার পেয়ে এখানে চলে আসে। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই ওর কাছে চলে আসতে বলছিল। আসিনি। নিউইয়র্কে তখন করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ ছিল। প্রতিদিন ঘনিষ্ট ও পরিচিত জনের মৃত্যু ও আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ পাচ্ছিলাম। এক সময়ের সহকর্মী স্বপন হাই, মাহতাব ভাইয়ের ছেলে, কমিউনিটি নেতা কামাল আহমেদ ও আজাদ বাকির চলে গেলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের অনেকে ফোনে তওবা করে বিদায়ের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। কে ভাইরাস বহন করছে, কে করছে না সে সম্পর্কে কেউ নিশ্চিত ছিল না। অতএব, এমন অনিশ্চিত অবস্থায় আপনজনের কাছে ভাইরাস বহন করে নেয়ার ঝুঁকি নিতে চাইনি। কিন্তু মেয়ের আবদার ক্রমশ তাগিদ, চিৎকার, ধমক, রাগারাগির পর্যায়ে চলে যায় এবং লকডাউন শিথিল হলে আসতে সম্মত হই। গত জানুয়ারীতেও আমরা মেয়ের কাছ থেকে ঘুরে গেছি। গত বছরও এসেছিলাম। তখন ওরা ফ্রিমন্ট সিটিতে ছিল। আমরা ফ্রিমন্টের কাছাকাছি স্যান হোজে এয়ারপোর্ট হয়ে যাতায়াত করেছি। গত ১৯ জুন সন্ধ্যায় স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে আমি ও আমার স্ত্রী অবতরণ করি। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ব্যস্ত এই এয়ারপোর্টে কর্মব্যস্ততা নেই। লোকজনও নেই। গিফট শপ, কফিশপ, এয়ারলাইনগুলোর কাউন্টার, সিকিউরিটির লোকজন কেউ নেই। যেন পরিত্যক্ত এক স্থাপনা। নিউইয়র্কে জেএফকে এয়ারপোর্টে তুলনামুলকভাবে যাত্রীদের ভিড় এবং অনেক দোকানপাটও খোলা ছিল।
এক মাসের কিছু বেশি সময় আগে ওরা ট্রেসি নামে আরেকটি সিটিতে এসেছে। এয়ারপোর্টে আমাদের আনতে গিয়েছিল মেয়ে ও জামাই। কিন্তু নো শেকহ্যা-, নো হাগ। যান্ত্রিকভাবে গাড়িতে ওঠে হাতে স্যানিটাইজার মেখে, শরীরে ও স্যুটকেসে ডিজইনফেকট্যান্ট স্প্রে করে বাসায় এসে পরনের জামাকাপড় ওয়াশিং মেশিনে নিয়ে শাওয়ার নিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে খেতে বসি। আমরা বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বেলা একটায় খেয়েছিলাম। বলা যায় দশ ঘন্টা অভুক্ত ছিলাম। ছয় ঘন্টার ফ্লাইটে পুরো সময় মাস্ক পরে থাকতে হয়েছে। প্রতি সারিতে উইনডো ও আইল সিটের মাঝখানের আসন যাত্রীশূন্য এবং আসন সারির মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রাখা হয়েছে। জেট ব্লু এয়ারলাইন্সের ঘোষণায় বলা হয়েছে বিমানটি ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল ষ্ট্যাণ্ডার্ড অনুযায়ী ইক্যুইপড। বিমান উড়ে আকাশে স্থির হওয়ার পর একটি জিপার ব্যাগে ২০০ মিলিগ্রামের পানির বোতল ও ২৮ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট বিস্কুট (১৩০ ক্যালরি) ও ২২ গ্রাম ওজনের একটি চকোলোট (১০০ ক্যালরি) দেয়া হয়েছে। চা, কফি, কোল্ড ডিঙ্কস পরিবেশন করা হয়নি। ক্রু মেম্বাররা আইল দিয়ে বেশি যাতায়াত করেনি। যাত্রীরাও বেল টিপে ক্রু মেম্বারদের ডাকেনি। আকাশ যাত্রায় আমি ও আমার গিন্নি সবসময় পাশাপাশি আসনে বসি এবং অধিকাংশ সময় সে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায়। এবার বিমানের আসন বিন্যাসে প্রত্যেক যাত্রীর পাশের আসন যাত্রীশূন্য রাখায় আমার কাঁধে মাথা স্থাপনের সুযোগ ওর হয়নি। সামনে পেছনে উইনডো আসন পড়েছে আমাদের। সে সাথে পান খাওয়ার সব উপকরণ এনেছে। আসনের ফাঁকা অংশ দিয়ে পান চালাচালি করতে করতে আমরা এসেছি। মেয়ের বাসায় আসার পর দেখা গেল এখানে আসর জমিয়ে পান খাবে বলে সে ১৬ ডলার মূল্যে যে পান কিনেছিল তা নিউইয়র্কেই ফেলে এসেছে। এমন ভুল সে প্রায়ই করে। এবারের ভুলের শুভ দিক হলো পান সেবন বন্ধ করার কথা ভাবতে শুরু করেছে। বাকিটা আল্লাহ ভালো জানেন।
দু’দিন পর লিণ্ডা ফোন করলো। লিণ্ডা এল আরিলাগা ও তাঁর স্বামী বিল আরিলাগা ৩২ বছর যাবত আমাদের পারিবারিক বন্ধু। লি-ার বয়স ৭৪ এবং বিলের বয়স ৮১ বছর। দু’জনই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। লিণ্ডা বলে, “বে এরিয়া তোমাকে ছাড়বে না। তুমি যে বয়সে স্ট্যানফোর্ডে এসেছিলে তখন সাদিয়ার (আমার মেয়ে) বয়স ছিল ছয় বছর, আর সাদ (আমার ছেলে) বয়স ছিল দুই বছর। এখন তোমার মেয়ে তোমার তখনকার বয়সী হয়ে এখানে ফিরে এসেছে। পৃথিবীটা কত ছোট।”
স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে প্রথম বার অবতরণ করেছিলাম ৩২ বছর আগে ১৯৮৮ সালে। সের্বাই যুক্তরাষ্ট্রে আমার প্রথম আগমণ। এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে যেতে হবে ষ্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। এয়ারপোর্ট থেকে দূরত্ব বিশ-বাইশ মাইল। কেউ কি আমাকে রিসিভ করতে আসবে? ফ্লাইটের যে ঝামেলা হয়েছে তাতে আমার অ্যারাইভাল টাইম জানানো কঠিন ছিল। কারণ এখনকার মতো ইন্টারনেট বা ফোনে তাৎক্ষণিক যোগাযোগের তখন ছিল না। ফোনে বুকিং দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হতো; বলা হতো ওভারসিজ ট্রাংক কল। অতএব ধরেই নিয়েছি এয়ারপোর্টে আমাকে কেউ রিসিভ করতে আসবে না। তবুও ইমিগ্রেশন, কাষ্টমসের বেষ্টনি থেকে বের হয়ে ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্য করছিলাম আমার নাম লেখা বোর্ড হাতে কেউ অপেক্ষা করছেন কিনা। না, তেমন কোনো বোর্ড চোখে পড়লো না। ভিড় থেকে ট্রলি ঠেলে বের হয়ে আসছিলাম, হঠাৎ দেখলাম, এক বয়স্ক ভদ্রলোক হাতে “স্ট্যানফোর্ড” লেখা একটি কাগজ উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তাঁর কাছে এগিয়ে গেলাম। হাত বাড়িয়ে আমার ও দেশের নাম বললাম। ভদ্রলোক জড়িয়ে ধরলেন। নাম বললেন হ্যারি প্রেস (২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে মারা গেছেন)। নামটা আগেই জানতাম। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের নাইট ফেলোশিপ প্রোগ্রামের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। রয়টার্সের লণ্ডন অফিস উনাকে জানিয়েছে আমি পথে আছি। ফ্লাইট নাম্বার, অ্যারাইভাল টাইম কিছু জানা ছিল না। অনেকটা অনুমান করেই তিনি এয়ারপোর্টে এসেছেন।
আমি তাঁকে আমার পথের বর্ণনাতীত ধকল সম্পর্কে বলি। টানা ৫০ ঘন্টা কেটেছে বিভিন্ন এয়ারপোর্ট ও ফ্লাইটে। এই দীর্ঘ সময়ে মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করতে পারিনি। ১৯৮৮ সালের বন্যার কথা অনেকের মনে থাকতে পারে। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা নগরী বন্যার পানিতে ডুবে ছিল। তখনই সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমার ফ্লাইট ছিল সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের। মতিঝিলে নৌকা চলাচল করছে। এয়ারপোর্টে পানি ওঠে রানওয়ে ডুবে গেছে। সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। শুধু জরুরী আন্তর্জাতিক যাত্রীদের কলকাতা পর্যন্ত নেয়ার জন্য বাংলাদেশ বিমানের ফকার ফ্রেণ্ডশিপ এয়ারক্রাফট রানওয়ের এক চিলতে শুকনো অংশ ব্যবহার করে উড়ছে, নামছে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের অফিস থেকে বলা হলো কোনোমতে যদি কলকাতা যেতে পারি, তাহলে তারা আমাকে যথাসময়ে আমেরিকায় পৌঁছে দেবে। বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা পর্যন্ত টিকেটের ব্যবস্থা করা তেমন মাথাব্যথার কারণ ছিল না। বিমান আমার রিপোর্টিং বিটের মধ্যে ছিল। বিমানের প্রায় সকল উর্ধতন কর্তা আমার পরিচিত। তার ওপর ওই সময়ে পাবলিক রিলেশনসের জিএম ছিলেন হামিদুজ্জামান রবি ভাই (আমি পরবর্তীতে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা – বাসস এ রবি ভাইয়ের সহকর্মী হয়েছিলাম) । ডেপুটি ম্যানেজার আবদুল মালেক ভাইসহ (বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী) সকলের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বিমানের টিকেট নিয়ে নৌকাযোগে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের অফিসে গেলে তারা ঘুরপথের একটি টিকেট ধরিয়ে দিল। নিজের টাকায় টিকেট নিতে হলে আমাকে হাজার বার ভাবতে হতো। কিন্তু টিকেট দিচ্ছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স। ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক, ব্যাঙ্কক থেকে সিঙ্গাপুর, সিঙ্গাপুর থেকে হংকং এবং হংকং থেকে স্যান ফ্রান্সিসকো। তার ওপর ঝামেলা ছিল কলকাতা ছাড়া প্রতিটি এয়ারপোর্টে ওই দেশগুলোর ট্রানজিট ভিসা নেয়া। জুলে ভার্নের “এরাউ- দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ” এর কথা মনে পড়েছে তখন। আমারটা “হাফ অফ দ্য ওয়াল্ড ইন ফিফটি আওয়ার্স। ঝামেলা হলেও আমার মাঝে সুখানুভূতি ছিল। আমি ১৯৮৮-৮৯ সালের জন্য রয়টার্সের ফেলো নির্বাচিত হয়ে স্ট্যানফোর্ডে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে আমিই রয়টার্সের প্রথম ফেলো। আমার পর স্ট্যানফোর্ডের এই ফেলোশিপ প্রোগ্রামে বাংলাদেশের আরেকজন সাংবাদিক মাইনুল খান এসেছিলেন সম্ভবত ২০০২-০৩ সালে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যুক্ত হতে পারাটাই সৌভাগ্য ও মর্যাদার ব্যাপার। আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অন্যতম। ২০২০ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিং এ স্ট্যানফোর্ডের অবস্থান তৃতীয়। উইকিপিডিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে সেরা ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্ট্যানফোর্ড দ্বিতীয়। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ছাত্র ও অভিভাবকদের ড্রিম কলেজ/ইউনিভার্সিটি সংক্রান্ত জরিপে স্ট্যানফোর্ডের অবস্থান প্রথম। এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অন্য কোনো সময়ে বর্ণনা করার ইচ্ছা পোষণ করছি।
শুরু করেছিলাম স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্ট দিয়ে। দ্বিতীয় বার এই এয়ারপোর্টে অবতরণ করি ১৯৮৯ সালের এপ্রিল মাসে। বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করতে নিউইয়র্ক গিয়েছিলাম। ততদিনে স্যান ফ্রান্সিসকো পরিচিতি হয়ে ওঠেছিল। নিউইয়র্ক থেকে এয়ারপোর্টে নেমে সোজা স্ট্যানফোর্ড ক্যাম্পাসে আমার বাসায় চলে আসি। তৃতীয়বার স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে অবতরণ করি ২০১৩ সালে। প্রথম আগমণের ২৫ বছর পর। সেটিও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমাদের রিইউনিয়নে। প্রতি চার বছর পর রিইউনিয়ন অনুষ্ঠিত হলেও আমি অংশ নিয়েছি মাত্র একবার। তখন নিউইয়র্কে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছি। আমার স্ত্রীও সাথে ছিল। লি-া আরিলাগা এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের রিসিভ করে প্রথমে তাঁর বাসায় নিয়ে আপ্যায়ন করে। এরপর আমাদের নির্ধারিত হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যায়।
স্যান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ। বড় বড় আইটি কোম্পানি গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, হিউলেট পেকার্ডসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর এখানে। গুগল সদর দফতরে জামাতার চাকুরির সুবাদে গতবছর গুগল ঘুরে গেছি। এবার করোনাজনিত লকডাউনের কারণে কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। সকাল বিকাল হাঁটাহাটি করি। সব্জি গাছে পানি দেই, আগাছা পরিস্কার করি। বাইরে বের হয়ে ফুল দেখি, অর্নামেন্টাল গাছ দেখি ছবি তুলি। ১১ জুলাই নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সাতটি ষ্টেট থেকে নিউইয়র্কে গেলে পনেরো দিন হোম কোয়ারেন্টানে থাকতে হবে। নতুন করে যোগ হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া। মেয়ে আবার সুযোগ পেয়েছে। ওর চিৎকারের সারমর্ম হচ্ছে, নিউইয়র্কে গিয়ে যদি ঘরেই আটকা থাকতে হয় তাহলে এখানেই আটকা থাকো। রিটার্ন টিকেট ১১ জুলাইয়ের পরিবর্তে করেছে ৩ আগষ্ট। ঠিক আছে, তবুও মেয়েটা মা-বাপকে ক’দিন কাছে পাক। দিন তো ফুরিয়েই যাচ্ছে।
Comments are closed.