আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য মানুষ মরিয়া হয়ে ওঠেছে। ভ্যাকসিন নেয়ার সর্বত্র হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। যাদের বয়সে ভাটার টান লেগেছে, অর্থ্যাৎ বয়স ৬৫ পার হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে তারাও ভ্যাকসিন নেয়ার অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছেন। অতএব আমিও চেষ্টা করেছি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্য। অনলাইনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। কিন্তু আমার চেষ্টায় কাজ হয়নি। মার্চ পর্যন্ত নিউইয়র্ক সিটির কোনো সেন্টারে কোনো তারিখে স্লট ফাঁকা নেই। কিন্তু জগৎ সংসারে করিৎকর্মা লোকের অভাব নেই। যে কোনো কাজে তারা ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়তে পারেন। আমার অনেক পরিচিত তরুণ, যারা পেশা ও বয়সগত কারণে অগ্রাধিকার তালিকায় পড়েন না, তাদের অনেকেই ভ্যাকসিন দেয়ার ছবি পোস্ট করেছেন, “প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিলাম” এবং এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন বা যাবেন বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছেন।
আমি এমনিতেই আল্লাহর শুকরিয়া আাদায় করি। গতবছর ফেব্রুয়ারী মাসে করোনাকাল শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত সুস্থ আছি। কর্মব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। ঢাউস সাইজের দুটি বই Ñ “মী এন্ড রুমী: অটোবায়োগ্রাফি অফ শামস তাবরিজী” এবং “টু হিস্টোরিক ট্রায়ালস ইন রেড ফোর্ট” এর অনুবাদ দুই বছর যাবত ‘হাফ ডান’ পড়ে ছিল Ñ অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, বই দুটির অনুবাদ শেষ করেছি। এছাড়া নতুন চারটি বই Ñ জহির দেহলভীর “দাস্তান-ই-গদর (সিপাহি বিদ্রোহের কাহিনি), নেভিট এরগুন ও জনসনের “ফরবিডেন রুমী” (নিষিদ্ধ রুমী), খুশবন্ত সিং এর “ওয়ার এন্ড পিস উইথ ইন্ডিয়া পাকিস্তান এন্ড বাংলাদেশ”, এবং উইলিয়াম ড্যালরিম্পেলের “দ্য অ্যানার্কি: ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, কর্পোরেট ভায়োলেন্স এন্ড দ্য পিলেজ অফ অ্যান এম্পায়ার” Ñ অনুবাদ কাজ সম্পন্ন করেছি; মোট ৬,২৬,০০০ শব্দ। কমবেশি ২,০০০ পৃষ্ঠা, যার মধ্যে চলতি জানুয়ারী মাসে তিনটি ১,২১২ পৃষ্ঠা সম্বলিত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে (নালন্দা)। বাকি তিনটির পৃষ্ঠা সংখ্যা হবে কমবেশি ৮০০, যে বইগুলো প্রকাশ করবে ‘আহমদ পাবলিশিং হাউস’, ‘বাতিঘর’ ও ‘স্বরে অ’। বলা যায় করোনাকাল আমার জন্য অত্যন্ত উৎপাদনশীল সময় ছিল। আলহামদুলিল্লাহ — সকল প্রশংসা আল্লাহর।
শুধু ঘরে বসে অনুবাদ করেছি, তা নয়। মাঝে মাঝে কিছু লেখা তৈরি করে পাঠিয়েছি বাংলাদেশ প্রতিদিন এর সম্পাদক নঈম নিজামকে। সেগুলো প্রকাশিত হওয়ায় আনন্দ বোধ করেছি। মেয়ে থাকে পশ্চিম উপকূলে ক্যালিফোর্নিয়ায়; স্যান ফ্রান্সিসকোর কাছে ট্রেসি নামে ছোট এক সিটিতে। বার বার তাগিদ দিচ্ছিল ওর ওখানে যেতে। তিন হাজার মাইলের দূরত্ব। বিমান ভ্রমণে নানা শর্ত, কী করতে হবে, কী করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত যেতেই হলো। জুন মাসের মাঝামাঝি গিয়ে পাক্কা দেড় মাস পর আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে ফিরেছি। ক্যালিফোর্নিয়া তখন করোনা সংক্রমণের হটস্পট। নিউইয়র্কে ফেরার পর দুই সপ্তাহের হোম আইসোলেন। সপ্তাহে তিন দিন করে অফিসে কাজ হচ্ছিল। করোনা টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ আসায় অফিসে কাজ শুরু করেছি সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। তখন থেকে সপ্তাহের প্রতি শনি বা রোববার আমরা আট সদস্যের তিনটি পরিবার মিলে নিউইয়র্কের উপকণ্ঠে বিভিন্ন পার্কে গিয়ে সারাদিন বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া ও খেলাধূলা করেছি। হেমন্তের পাতা ঝড়ার সৌন্দর্য দেখতে দূরে পেনসিলভেনিয়ার পোকোনো মাউন্টেনে গিয়ে দুই রাত যাপন করে এসেছি। শীত নেমে আসায় আমাদের ঘোরাফেরা বন্ধ করতে হয়েছে। এর মাঝেই আমাদের সম্পাদক ডা: ওয়াজেদ খান করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তিন সপ্তাহ আমাকে অফিস সামলাতে হয়েছে। অফিসের আরেক কর্মী আহাদ সেলিমের স্ত্রী আক্রান্ত হওয়ায় তাকে বাসা থেকে অনলাইনে কাজ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমাদের ঘোরাফেরার সঙ্গী কবি কাজী জহিরুল ইসলাম সপরিবারে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং ইতোমধ্যে সুস্থ হয়েছেন।
ভ্যাকসিন দিয়ে কথা শুরু করেছিলাম। ষাটের দশকের কথা বেশ মনে আছে। তখন বর্ষাকালে কলেরার ভ্যাকসিন এবং শীত শেষে বসন্তের ভ্যাকসিন দেয়া হতো। ম্যালেরিয়ার জন্যও কী একটা প্রতিষেধক ছিল। আমি স্কুলের ছাত্র। প্রাইমারীতে গ্রামের স্কুলেই ছিলাম। যারা ভ্যাকসিন দিতে আসতেন তারা ‘টিকাদার’ নামে পরিচিত ছিলেন। এই টিকাদারের আগমণ ঘটলে ছাত্ররা স্কুলের বেড়া ভেঙে পালাতো। শুধু ছাত্ররা নয়, ‘টিকাদার’ আসছে শুনলে বয়স্করাও বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতো। ‘টিকাদার’ এর কাজ সবসময় থাকে না, কিন্তু ‘টিকাদার’কে যেখানেই দেখা যেত, শিশুরা ভয়ে পালাতো। এসব দৃশ্য চোখে দেখা। আমার বয়সী প্রায় সকলের দুই হাতের উপরের অংশে দুটি করে চোখে পড়ার মতো ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। বসন্তের প্রতিষেধক টিকা দেয়ার কারণে প্রত্যেকের ঘা হতো এবং আমরা সেই ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছি। ওই টিকা কখন দেয়া হয়েছিল আমার মনে নেই। এখন বসন্ত ও ম্যালেরিয়া নির্মূল হয়েছে। তবুও অনেক সংক্রামক ব্যাধির ভ্যাকসিন নিতে হয়। বিশেষ করে শিশুদের জন্য তো অবশ্যই। এখনকার টিকায় দাগ হয় না। কোনো কোনো ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়।
১৯৬৭ সালে আমি শহরের স্কুলে ক্লাস নাইনের ছাত্র। পৌরসভার ‘টিকাদার’ সাহেব এলেন। শিক্ষককরা জানতেন উনি আসবেন। আগে থেকেই ক্লাসরুমে সামনের দরজা খোলা রেখে বাকি দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেন। ‘টিকাদার’ প্রবেশ করলেন। গণিত স্যার আজিজ বিএসসির ক্লাস ছিল। উনি ছাত্রদের পেটাতে ভালোবাসতেন। ডাকলেন, কে প্রথমে টিকা দেবে। আসলে টিকা মানে ইঞ্জেকশন। এখনকার মত এক সিরিঞ্জ ও এক নিডল ব্যবহার করে ফেলে দেয়ার নয়। বেশ বড় সাইজের সিরিঞ্জ, বড় সাইজের একটি বোতল থেকে পুরো সিরিঞ্জে ভ্যাকসিন ভরে এক সিরিঞ্জ ভ্যাকসিন কয়েকজনকে পুশ করতেন। ফেলে দিয়ে নতুন সিরিঞ্জ ব্যবহার করা হতো না। ওই সময়ের নিয়মই অমন ছিল, এখন বুঝতে পারি সরকারের সামর্থ কম ছিল। স্যারের ডাকে কেউ সাড়া দিচ্ছে না। দু’একজন ক্লাসেই পেশাব করে ফেলেছে। প্রতি বেঞ্চে পাঁচজন বসে। আমি সবসময় ডানদিকের সারির দ্বিতীয় বেঞ্চের বাম সাইডে বসতাম। স্যার দ্বিতীয় বার ডাকলে আমি এগিয়ে গেলাম। টিকাদার আমার হাতে ভ্যাকসিন পুশ করলেন। এরপর প্রত্যেককে একে একে ভ্যাকসিন দেয়া শেষ হলে স্যার চলে যেতেই ক্লাসে পান্ডা গোছের সব সহপাঠি আমার উপর হামলে পড়লো। কিল ঘুষি মারার সাথে গালিগালাজ করছিল, ‘শালা, তোর খুব সাহস হয়েছে।’ কয়েকজন আমাকে উদ্ধার করলো। স্কুলের সবাইকে টিকা দেয়া শেষ হলে সেদিন আর ক্লাস হতো না। কলেরা, বা বসন্তের ভ্যাকসিন হোক; প্রয়োগ করলে জ্বর অবধারিত। জ্বরের চেয়ে ব্যথা হতো বেশি। কয়েকদিন আর স্কুলে যাওয়া হতো না। লবনের পুটলি গরম করে ইঞ্জেকশনের জায়গা সেক দিতাম।
এখন জামানা পাল্টেছে। বাংলাদেশেও কেউ আর ভ্যাকসিন নিতে ভয় পায় না। সবাই সচেতন এবং সবাই বাঁচতে চায়। বাঁচার জন্য টাকা খরচ করে। যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশে ভ্যাকসিন ফ্রি দেয়া হয়। বাংলাদেশে আগে ফ্রি দেয়া হলেও এখন ভ্যাকসিনের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়। করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক ভ্যাকসিন নিতে মাথাপিছু মোটামুটি ১,২০০ টাকা খরচ করতে হবে। সাধারণ মানুষের সঙ্গতির মধ্যে থাকলে ভালো হতো। এত দামে অনেকেই ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহী হবে না। বিনামূল্যেও অনাগ্রহ থাকে। নিউইয়র্কের মেয়র বিল ডি ব্লাজিও বলেছেন, সিটির হাসপাতালগুলোতে কর্মরত ডাক্তারসহ ৩০ শতাংশ চিকিৎসা কর্মী করোনার ভ্যাকসিন গ্রহণ করতে রাজি নন। বাংলাদেশে কেউ যদি ভ্যাকসিন নিতে না চান তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তবে মৃত্যু থেকে পলায়নের চেষ্টা করে লাভ নেই। বাইবেলের কথা হচ্ছে; “মনে রেখো, আদম ও হাওয়াকে মৃত্যুবরণ করতে হবে, ইশ্বরের এমন পরিকল্পনা ছিল না। তারা ইশ্বরের সাথে চিরদিন আনন্দে কাটাতে পারতেন। সৃষ্টিজগতে যখন পাপ প্রবেশ করলো, মৃত্যুও সাথে এলো। যেহেতু আমাদের প্রতি ইশ্বরের প্রেম রয়েছে, সেজন্য তিনি আমাদেরকে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার উপায় সৃষ্টি করেছেন। যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের মাধ্যমে আমাদের জন্য স্বর্গের পথ উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে।”
Comments are closed.