Skip to content →

খুশবন্ত সিংয়ের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

অনুবাদ : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

খুশবন্ত সিংয়ের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তি ফৌজের অস্তিত্বের সূচনা ঘটে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে গণহত্যা শুরু করেছিল। মুক্তি ফৌজের সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজার। আজ এটি দেড় লাখের অধিক সংখ্যক নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত একটি সশস্ত্র গণবাহিনী- এটি জনগণের মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়েছে এবং আরও লাখ লাখ মানুষ তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। শান্তিপ্রিয় বাঙালির আত্মায় কীভাবে এই লৌহের অনুপ্রবেশ ঘটল?

১২ নভেম্বর সকালে ‘সিটি অব সেন্ট অ্যালবানস’ নামে ব্রিটিশ পতাকাবাহী সাত হাজার টনের একটি কার্গো জাহাজ হুগলি নদীর মুখে কলকাতা বন্দরের উদ্দেশে অনেকটা খুঁড়িয়ে চলার মতো অগ্রসর হচ্ছিল। ওপরিভাগে স্টিলের পাতে মোড়া জাহাজের গায়ে সত্তরটি বিভিন্ন আকারের গর্তসহ কার্গো জাহাজটির বাইরের লাল রেখা পানি ছুঁইছুঁই অবস্থায় ছিল। পর দিন স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে জাহাজটির ছবিসহ একটি খবর প্রকাশ করে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর নৌ-শাখার নতুন আহরিত শক্তি সম্পর্কে জানিয়ে ক্ষতিসাধনের কারণ ঘটিয়েছিল। রাজ্য সরকার অবিলম্বে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। জাহাজটির ছবি তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং অন্যান্য সংবাদপত্র যা প্রকাশ করে তা ছিল সংক্ষিপ্ত একটি সরকারি হ্যান্ডআউট ইস্যু করে জানায় যে, জাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলে কোথাও আক্রমণের শিকার হয়েছে।আমার মনে অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। জাহাজটি কী পূর্ব পাকিস্তানে কার্গো নিয়ে যাচ্ছিল? কী ছিল কার্গোতে? ঠিক কোথায় জাহাজটির ওপর আক্রমণ হয়েছে? পাকিস্তানের জলসীমায় অথবা উন্মুক্ত সাগরে? আক্রমণকারীরা কারা ছিল? সাধারণভাবে যা ধারণা করা হয়ে থাকে- তারা যদি মুক্তিবাহিনী হয়ে থাকে, তাহলে কীভাবে, কখন এবং আক্রমণ চালানোর জন্য তারা কোথা থেকে গানবোট সংগ্রহ করল?

চার দিন পর আমি গার্ডেন রিচ ডক, যেখানে জাহাজটি নোঙর করা হয়েছিল, সেখানে প্রবেশের জন্য একটি পাস সংগ্রহ করতে সক্ষম হলাম। অনেক কৌতূহলী ডক শ্রমিক ও কেরানি ঘোরাফেরা করছিল, জাহাজের গায়ে লাগানো মইয়ে ঝুলে অ্যাসিটিলিন ল্যাম্পের ঝাঁজালো অগ্নিশিখা দিয়ে জাহাজের বহির্ভাগে স্টিলের পাত ঝালাই করার কাজে নিয়োজিত মেকানিকদের সঙ্গে কথা বলছিল। আমি একটি গ্রুপে যোগ দিয়ে উৎসাহের সঙ্গে স্টারবোর্ড সাইডে জাহাজের গায়ে সৃষ্ট গর্ত গণনা করছিলাম। আমার একটু সামনে দাঁড়ানো একজন চিৎকার করে বলল, ‘ছাব্বিশটি! নিশ্চয়ই অপর পাশেও একই রকম গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। জয় মুক্তিবাহিনী।’ আমি তার সঙ্গে যোগ দিয়ে জানতে চাইলাম কেন তিনি মনে করছেন যে, এটি মুক্তিবাহিনীর কাজ।

‘আর কে হতে পারে?’ লোকটি জোরের সঙ্গে বলল। ‘এটি হয় তারা করেছে, অথবা আমরা। একই কথা। তাদের জয় মানে আমাদের জয়; তাদের পরাজয়ে আমাদের পরাজয়।’    

কিছুটা পীড়াপীড়ির পর জাহাজটির কলকাতার এজেন্ট আমাকে জাহাজে ওঠার জন্য একটি পারমিট দিলেন। সন্ধ্যায় আমি ক্যাপ্টেন হিনসের কেবিনে বসে তার ও তার সোনালি চুলের স্ত্রী রোজমেরির সঙ্গে ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। মেদবহুল স্কটিশ ক্যাপ্টেন আকস্মিকভাবেই প্রচারণার পাত্রে পরিণত হওয়ার আনন্দ উপভোগ করছিলেন। ‘আপনি জানেন, গত রোববার আমি একটি ব্রিটিশ দুরবিনে চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে ছিলাম! আমি অবশ্য নিজে কিছু দেখিনি। এ বিষয় নিয়ে আমার কথা বলারও কথা নয়, অন্তত সরকারি তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তো নয়ই। আমাদের নেভাল অ্যাটাচি দিল্লি থেকে এসেছেন এবং জাহাজের ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করেছেন। আমার যা বলার আমি তাকে সব বলেছি।’ এরপর তিনি আমাকে বলতে শুরু করলেন যে কী ঘটেছিল।

‘সিটি অব সেন্ট অ্যালবানস’ কলকাতায় এসেছিল কার্গো খালাস করতে। অক্টোবরের ১১ তারিখে জাহাজ নোঙর তোলে এবং হুগলি নদী ধরে বঙ্গোপসাগরে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র-বন্দর চালনার দিকে যেতে থাকে সেখান থেকে পাটের গাঁইট তোলার জন্য। রাত ১:২৫ মিনিটে একটি গানবোট অথবা কয়েকটি নৌকা হঠাৎ করেই প্রায় অদৃশ্য থেকে আবির্ভূত হয়ে সব দিক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করে। ‘দশ মিনিট পর্যন্ত এক নারকীয় অবস্থা বিরাজ করছিল,’ রোজমেরি বলেন। ক্যাপ্টেন আবার মুখ খোলেন, ‘বিগত যুদ্ধের সময়ও আমাকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি বলে যে, সে ভয় পায়নি, তাহলে সে মিথ্যাবাদী। আমি এতটা ভয় পেয়েছিলাম যে, আমি আর দিনের আলো দেখব কিনা। আমরা জাহাজ ঘুরিয়ে কলকাতায় ফিরে আসি।’

‘গর্তগুলো একই আকৃতির বলে মনে হয়,’ আমি বললাম।

‘ওগুলো অবশ্যই একই আকৃতির নয়,’ ক্যাপ্টেন বললেন। ‘আমি অস্ত্র সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ নই। তা সত্ত্বেও আমি বলতে পারি যে, কমপক্ষে দুই ধরনের বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়েছে। গোলার কিছু টুকরা কুড়িয়ে সেগুলো আমাদের নেভাল অ্যাটাচির কাছে হস্তান্তর করেছি।’

‘কে এই হামলা করেছে বলে আপনি মনে করেন?’

‘আমার কোনো ধারণা নেই। তা ছাড়া আমি অনুমান করে কাউকে কিছু বলতে চাই না।’

ক্যাপ্টেন হিনস ও তার স্ত্রীর সঙ্গে এক কাপ হালকা গরম চা পান করে আমি বিদায় নিলাম।

কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইন চিফ। বয়স ৫০ পেরোনোর পরও তিনি হালকা গড়নের মানুষ। তার কালচে মুখের ওপর তুষার ধবল পুরু গোঁফ বেশ দর্শনীয়। কর্নেল ব্লিম্পের ধাঁচে চমৎকার ইংরেজিতে কথা বলেন তিনি। তার কথার মধ্যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান কথ্য শব্দ, ‘ওল্ড বয়’, ‘পাক্কা’, ‘জলি গুড’ ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। কিন্তু তার সম্পর্কে হাসিখুশি হওয়ার মতো কিছু নেই। তার চোখে হারানো, বিষণœ দৃষ্টি। আমি তার সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটালেও তিনি একটিবারের জন্য হাসেননি। যখন তিনি তার ‘কাহিনিতুল্য’ যুদ্ধ এবং তার অধীনস্থ সৈনিকদের সাহসিকতার কথা বলেছেন, তখন তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিচালিত নৃশংসতার কথা বলার সময় ঘৃণায় তার চোখ জ্বলে উঠেছে।

কর্নেল ওসমানীর কাছে পৌঁছা সহজ ছিল না। যেখানেই থেকে থাকুন না কেন, সব সময় তার একটি কথাই ছিল, ‘বাংলাদেশে কোথায়ও’। আমাকে তার ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় গভীর রাতে। তিনি তার রুমে একা বসেছিলেন, মাথার ওপর হিস হিস শব্দে একটি গ্যাসলাইট জ্বলছিল। তার সামনের টেবিলে কোনো কিছু নেই। ঝুপড়ির বাঁশের বেড়ায় কোনো ক্যালেন্ডার বা ছবি ঝুলানো ছিল না। অত্যন্ত যান্ত্রিকভাবে তিনি আমার সঙ্গে হাত মেলালেন এবং কোনো সময় নষ্ট করলেন না। ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’

আমি তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম ‘সিটি অব সেন্ট অ্যালবানস’-এর ঘটনা দিয়ে। জাহাজটির অবস্থান এবং নিরস্ত্র বেসামরিক একটি জাহাজের ওপর আক্রমণ চালানোর নীতি সম্পর্কে কর্নেল ওসমানীর কোনো সন্দেহ ছিল না। ‘জাহাজটি আমাদের জলসীমায় ছিল,’ তিনি জোর দিয়ে বললেন। “তারা আমাদের অনুমতি নেয়নি এবং দুশমনের সঙ্গে বাণিজ্য করছিল। সাধারণ একটি কার্গো জাহাজ নিয়ে বিশ্ব এতটা অস্থির হয়ে পড়েছে? এখনই সময় যে, আমরা বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি, পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বররা যখন আমাদের নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের কচুকাটা করেছে, ধর্ষণ ও লুট করেছে তখন তো কোনো সরকার গিয়ে তাদের এ বর্বরতা থামাতে বলেনি! আমি আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, তখন আন্তর্জাতিক নৈতিকতার কী ঘটেছিল? ক্রুদ্ধভাবে আমার দিকে তাকালেন তিনি।” আমি ‘সিটি অব সেন্ট অ্যালবানস’ প্রসঙ্গ বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সূচনার দিকে ফিরে এলাম।

বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এখন আট মাসের পুরনো একটি বাহিনী। এটি গঠিত হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের বিবেচনায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে’ নির্মূল করার অভিযান শুরু করে। কর্নেল ওসমানী বলেন, ‘এর আগে একটি সেনাবাহিনীকে প্রতিহত করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের ছিল না। পেশাদার সৈনিক হিসেবে রাজনীতিতে জড়িত না হওয়ার ঐতিহ্যে আমাদের গড়ে তোলা হয়েছে। ইতিপূর্বে আমি কাউকে যা বলিনি তা আপনাকে বলছি, ১৯ মার্চ পর্যন্ত, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা চালানোর গুজব বদ্ধমূল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে সেনাবাহিনীর সিনিয়র বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এবং সম্ভাব্য সব পরিণতির জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। আমি বিশ্বস্ত একজন অফিসারের মাধ্যমে মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে একটি গোপন সার্কুলার প্রেরণ করি। তাতে আমি তিনটি বিষয় তুলে ধরি : ‘রাজনীতিতে জড়িত হইও না, তোমাকে নিরস্ত্র করতে কাউকে সুযোগ দিও না, তোমাকে দমন করার চেষ্টা করা হলে যত প্রবলভাবে সম্ভব আঘাত কর।’ পাকিস্তানিরা যদি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তাদের ব্যবস্থা গ্রহণ সীমাবদ্ধ রাখত, সেনাবাহিনী ও পুলিশের বাঙালিরা হয়তো নিরপেক্ষ থাকতে পারত। যখন এমন কথা ছড়িয়ে পড়ল যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সেনাবাহিনীর লোকজন এবং আমাদের হত্যা করার পরিকল্পনা করছে, তখন আমরা বিদ্রোহ করি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীই রাতারাতি মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

কর্নেল ওসমানী কোনো একক নেতার নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, যিনি ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর পর্যন্ত দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন, তিনি বাংলাদেশের পক্ষে তার অবস্থান গ্রহণ করার পর আমাকে বলেন, “সেনাবাহিনী তাদের অভিযান শুরু করার কয়েক সপ্তাহ আগে সিনিয়র বাঙালি অফিসারদের হয় পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয়েছে, অথবা স্বল্প গুরুত্বের কোনো দায়িত্বে ন্যস্ত করা হয়েছে। বিদ্রোহে জুনিয়র অফিসাররাই নেতৃত্ব প্রদান করেছে। তিনি তিনজনের নাম উল্লেখ করেন : মেজর ওসমান, চুয়াডাঙ্গা, মেজর খালেদ মোশাররফ (বর্তমানে আহত অবস্থায় কুমিল্লায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন) এবং মেজর জিয়া, যিনি চট্টগ্রাম সেক্টরের কোথায়ও আছেন।” বাঙালি সৈনিক ও পুলিশ সদস্যরা তরুণ অফিসারদের সঙ্গে থাকে এবং কয়েক দিনের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী গড়ে ওঠে। তারা কর্নেল ওসমানীকে তাদের কমান্ডার ইন চিফ হিসেবে বেছে নেয়, যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

মুক্তিবাহিনী বেশ কিছু সংখ্যক সুনির্দিষ্ট গ্রুপের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সদস্যরা। তাদের অধিকাংশের বয়স চল্লিশোর্ধ্ব অথবা পঞ্চাশোর্ধ্ব এবং যদিও তারা অস্ত্র তুলে নেওয়ার উপযুক্ত ছিলেন না, কিন্তু ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাতীয় সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হওয়ার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তারা একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে।

যোদ্ধাদের মূল অংশ গঠিত হয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (সীমান্তরক্ষী প্যারা মিলিটারি বাহিনী), পুলিশ এবং শহরে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার ও মুজাহিদদের সমন্বয়ে। তাদের প্রায় ১০ হাজার সদস্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের নির্মূল অভিযান থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। এই মূল অংশ অরাজনৈতিক ছিল এবং এখনো তা আছে। প্রমোশন ও পোস্টিংয়ের প্রশ্নে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে অধিকাংশেরই ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও অভিযোগ ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের তাদের মতো থাকতে দিলে তারা হয়তো নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েই থাকত।

স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে গঠিত তৃতীয় একটি গ্রুপ আছে, যাদের তালিকাভুক্ত করেছে মুক্তিবাহিনী (যাদের শারীরিক কারণে বাতিল করা হয়েছিল, তারা পৃথকভাবে নিজেদের দলভুক্ত করে)। এই গ্রুপের অধিকাংশ ছেলের বয়স ১৫-২০ বছরের মধ্যে; স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই গ্রুপের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের মধ্যে দুটি কমিউনিস্ট পার্টি আছে; পিকিংপন্থিরা তাদের বয়োবৃদ্ধ নেতার নামে ভাসানী গ্রুপ হিসেবে পরিচিত এবং বাংলাদেশের মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি পরিচিত মোজাফফর গ্রুপ হিসেবে। কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে যারা যোগ দিয়েছে, তারা তাদের নিজেদের ট্রেড ইউনিয়নের আদর্শ সঙ্গে নিয়ে এসেছে। গত আগস্ট মাসে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ‘কো-অর্ডিনেটিং কমিটি অব দ্য লেফট (সিসিএল) নামে প্রগতিবাদীদের একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলার জন্য।

ছাত্রনেতা ও তাদের অনুসারীদের সমন্বয়ে সম্প্রতি আরেকটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। এটির দুজন বিশিষ্ট নেতা হচ্ছেন তোফায়েল আহমেদ ও ফজলুল হক মনি। তারা উন্নতমানের অস্ত্র ব্যবহারে অধিকতর ব্যাপক ও কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে এবং একটি বাছাইকৃত সেরা বাহিনী গড়ে তুলবে বলে আশা করছে। তারা নিজেদের পরিচয় দেয় ‘মুজিব বাহিনী’ হিসেবে।

আমি মুক্তিবাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা জানতে পারিনি। কর্নেল ওসমানী আমাকে সংখ্যা জানাতে অস্বীকার করেন, ‘আমি এটিকে গণবাহিনী নামে বলাই প্রাধান্য দিই। প্রতিটি সক্ষমদেহী বাঙালি মুক্তিবাহিনীর এক একজন সৈনিক।’ অন্যান্য কর্মকর্তার অধিকাংশই এ সংখ্যাকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বলে উল্লেখ করেন, যা শিগগিরই দেড় লাখে উন্নীত করা হবে। একটি সময় পর্যন্ত এটি সম্পূর্ণ একটি মুসলিম বাহিনি ছিল। এখন বাংলাদেশের প্রায় তিন হাজার হিন্দু এ বাহিনীতে যোগদান করেছে।

বাঙালিরা হয়তো ভাড়াটে বাহিনী (মার্সেনারি) হিসেবে খুব সুনাম অর্জন করেনি, কিন্তু বোমা, ডিনামাইট এবং পিস্তল ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা তাদের স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততা প্রদর্শন করেছে। ব্রিটিশ শাসনামলে বাঙালি সন্ত্রাসীরা অন্য সব ভারতীয় সন্ত্রাসীর চেয়ে বেশি সংখ্যক ইংলিশম্যানকে হত্যা করেছে এবং তাদের অধিকাংশই এখন যে অংশ পূর্ব পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশ, সেখান থেকেই এসেছে। একজন শহুরে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকারী বা বোমা নিক্ষেপকারী থেকে পরিপূর্ণ গেরিলা যোদ্ধায় পরিবর্তিত হতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন পড়ে না।

পশ্চিম পাকিস্তানে প্রভাবশালী পাঞ্জাবি ও পাঠান শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে। যদিও তারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বহাল রেখেছে, কিন্তু খুব কম সংখ্যক বাঙালিকে উচ্চ পদে উন্নীত করেছে। এমনকি ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মাত্র একজন বাঙালি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীতে সমপর্যায়ে কোনো বাঙালির পদোন্নতি হয়নি। একবার আমি আমার এক পাকিস্তানি পাঞ্জাবি যুক্তিতর্কে নিয়োজিত হয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশের বসবাস যখন পূর্বাঞ্চলে, সেক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীতে তারা কখনো সাত শতাংশের অধিক প্রতিনিধিত্ব পায়নি। তিনি পাল্টা উত্তর দেন, ‘তাতে কী! ভেড়ার পাল থেকে তুমি তোমার যোদ্ধা সংগ্রহ করতে পার না। তুমি কী আশা কর যে, ডাল-ভাত খেকোরা যুদ্ধ করতে সক্ষম?’

শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু সিলেটের মোয়াজ্জেম আহমেদ চৌধুরী আমাকে বলেন যে, কীভাবে বাংলাদেশের তরুণরা তাদের আত্মায় লৌহ ধারণ করেছে। “আপনি জানেন আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ। পাঠান, বেলুচি এবং পাঞ্জাবিদের বর্বরতা আমাদের যোদ্ধায় পরিণত করেছে। তারা আমাদের নারী ও শিশুদের পর্যন্ত ছাড়েনি। একটি পশু পর্যন্ত বিপদে পড়লে তার সঙ্গী ও সন্তানদের রক্ষা করতে ঘুরে দাঁড়ায়। ঘৃণা মানুষকে পাতালে গিয়ে যুদ্ধ করতে বাধ্য করে।” বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় যে ঘৃণায় পরিপূর্ণ হয়েছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ ছিল না।

‘আপনাদের ওইসব আমেরিকান বন্ধুদের বলুন,’ কর্নেল ওসমানী আমাকে বলেন, “২৫ এবং ২৬ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের জনগণের ওপর যা করেছে, তা একশ’ মাই লাই (ভিয়েতনামের একটি স্থান, যেখানে নারকীয় হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল) এর চেয়ে জঘন্য। তাদের পুরোপুরি ধ্বংস না করা পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেব না। তাদের লাশ বাংলাদেশে পচবে; আমরা তাদের প্রেতাত্মাগুলোকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেব।”

বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাদের যুদ্ধ করার সামর্থ্য বেড়েছে। গঠিত হওয়ার দুই মাস পর তাদের নাম ‘মুক্তি ফৌজ’ থেকে ‘মুক্তিবাহিনী’তে রূপান্তরিত হয়। ‘ফৌজ’ একটি উর্দু শব্দ, যার বাংলা ‘বাহিনী’। পরিভাষাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এমন ধারণাও পাওয়া যায় এটি সম্পূর্ণ স্থলভাগে তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশে একটি গেরিলা বাহিনী হিসেবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। অস্ত্রসজ্জিত নৌকার মাধ্যমে তারা নদী পথেও তাদের অভিযান চালাচ্ছিল এবং তাদের ফ্রগম্যানরা পাকিস্তানি জাহাজ চলাচলের পথে মাইন স্থাপনের কাজ করছিল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এয়ার মার্শাল হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাদের কিছু সংখ্যক পাইলট থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো বিমান বা এয়ার বেজ নেই। মি. এইচ আর চৌধুরী বলেছেন যে, শিগগিরই তারা যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করতে যাচ্ছেন এবং বিমান ওঠানামার স্থানের ব্যবস্থাও হচ্ছে। আমি জানতে চাই, ‘আপনারা কোথা থেকে বিমান পাবেন?’ তার উত্তর ছিল রহস্যময় এক হাসি।

ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর মুক্তিবাহিনীর অনেক প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়েছে। নিরাপত্তার কারণে এসব শিবিরের অবস্থান প্রকাশ করা হয় না। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের সাধারণ উত্তর : ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো স্থানে। একই অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায় সংগঠন এবং প্রশিক্ষণের ধরন সম্পর্কে।’ কর্নেল ওসমানী বলেন, “আমার কাছ থেকে আপনি শুধু এটুকু জেনে নিতে পারেন যে, আমাদের ধরন ভিয়েতনামের গেরিলা সংগঠনের ধাঁচের নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে আমি আমার লোকদের সেনাবাহিনীতে সাধারণভাবে প্রচলিত ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং প্রচলিত ধরনের যুদ্ধ করেছি। আমরা বিদেশি শক্তিকে পরাস্ত করেছি। তাদের গতিরোধ করেছি, অসম যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছি এবং পাকিস্তানিদের বলেছি বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে যেতে। তা যখন ঘটেনি এবং পাকিস্তানিরা ট্যাঙ্ক, ভারী কামান ও বোমারু বিমানসহ সাড়ে চার ডিভিশন সৈন্য (৮০,০০০) নিয়ে আসে, তখন আমি আমার কৌশলে পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। মে মাসের প্রথম দিকে আমি আমার বাহিনীকে পুনর্গঠিত করে গেরিলা গ্রুপে বিকেন্দ্রীকরণ করি। আকস্মিক যুদ্ধ লড়ার পরিবর্তে আমরা কমান্ডো ধাঁচে ওতপেতে দুশমনের ওপর হামলা চালানোর কৌশল অবলম্বন করি। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে, কিন্তু আমরা দুশমনকে বিস্তৃত প্রতিকূল ভূখন্ডে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সফল হয়েছি। আমরা দুশমনের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি; দুশমনকে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত রেখেছি। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় আমরা দুশমনের একশ সৈন্যকে হত্যা করেছি; তারা প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তানে বিমান ভর্তি কফিন নিয়ে যায়। গতকালই আমার তরুণ কমান্ডোদের একটি দল কুমিল্লার কাছে সেনাবাহিনীর কনভয়ের ওপর হামলা চালিয়ে চীন ও আমেরিকায় তৈরি বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসেছে।”

প্রশিক্ষণ শিবিরে কোনো দর্শনার্থী শুধু দেখতে পায় যে লুঙ্গি পরা ও গেঞ্জি গায়ে ছেলেরা কাঠের রাইফেল নিয়ে ড্রিল করছে। কাউকে তাদের আসল অস্ত্র দেখার অনুমতি দেওয়া হয় না। আমি যখন জানতে চেয়েছি যে কোথা থেকে তারা এসব সংগ্রহ করেছে, তারা সব সময় উত্তর দিয়েছে; “সৈনিক ও পুলিশ সদস্যরা মুক্তিবাহিনীর পক্ষে আসার সময় তাদের সঙ্গে এগুলো নিয়ে এসেছে, বাকিগুলো আমরা দুশমনের কাছ থেকে কব্জা করেছি। তা ছাড়া বিদেশে বসবাসরত বাঙালিদের পাঠানো অর্থ দিয়ে আমরা বন্ধুসুলভ উৎস থেকে ক্রয়ও করেছি।” আমি যখন কর্নেল ওসমানীর কাছে জানতে চেয়েছি যে, কীভাবে পানিতে স্থাপনের মাইন ও গানবোট বাংলাদেশে পৌঁছল, তিনি আমার চোখে চোখ রেখে হাত নেড়ে বললেন, “এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোনো কিছু বলতে চাই না।”

প্রশিক্ষণের সময় কয়েক সপ্তাহ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত এবং তা নির্ভর করে যাদের যে ধরনের দায়িত্বে ন্যস্ত করা হবে, তার ওপর। কীভাবে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত করতে হবে অথবা কোনো রাস্তায় মাইন স্থাপন করতে হবে, তা শিখতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয় না। কামানের গোলা ছুড়তে অথবা স্টেনগান চালাতে বা পানির নিচ দিয়ে সাঁতার কেটে মাইন স্থাপন করার প্রশিক্ষণ নিতে দীর্ঘ সময় লাগে।

মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের দাবির সত্যতা যাচাই করা কঠিন। কর্নেল ওসমানী বলেছেন, “সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ভাগ পর্যন্ত আমরা ২৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করেছি, ২১টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছি, ছয়শর বেশি ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করেছি এবং রেল, সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছি। আপনি নিজে যাচাই করে নিতে পারেন। বাংলাদেশে মাত্র গুটিকয়েক ট্রেন চলাচল করে। চালনা বন্দরে (মোংলা বন্দর) জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। আমরা শিগগিরই চট্টগ্রাম বন্দরকে অকেজো করে দেব।”

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড এনালিসিস বাংলাদেশে নিহত পাকিস্তানির সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার বলে উল্লেখ করেছে। পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কর্তৃক প্রচারিত এবং কলকাতা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রে মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতার খবরকে অসত্য প্রমাণ করার মধ্যে। তথ্য পাওয়ার মোটামুটি দুটি নির্ভরযোগ্য উৎসের মধ্যে একটি হলো, পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরগুলো থেকে আগত জাহাজের ক্রু-মেম্বার এবং বিদেশি রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা, যাদের মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় তাদের মতো করে পরিস্থিতি দেখার জন্য। জাহাজের ক্রু-মেম্বাররা ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের কাহিনির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে চালনা বন্দরে ১৬ হাজার টনের ব্রিটিশ ট্যাঙ্কার ‘টেভিয়ট’ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর অল্প কিছুদিন পর ১০ হাজার টনের আরেকটি ব্রিটিশ জাহাজ ‘চাকদিন’ আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর সেটি মেরামতের জন্য কলকাতা বন্দরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। জাহাজের ক্রু-মেম্বাররা চালনা বন্দরে দুটি পাকিস্তানি স্টিমার, একটি কোস্টাল ট্যাঙ্কার এবং বহুসংখ্যক বার্জ অর্ধ-ডুবন্ত অবস্থায় দেখেছেন বলে জানান। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে (১৪ আগস্ট) চট্টগ্রাম বন্দরে ‘ওহরমাজো’ নামে একটি জাহাজ আক্রান্ত হয়।

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ৯ অক্টোবর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত হাবিব ব্যাংকে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়; যে ভবনে বিশ্ব ব্যাংকের অফিস অবস্থিত সেই ভবনের একটি তলা বিধ্বস্ত হয় এবং একটি পাটের গুদাম ভস্মীভূত হয়। ভারতে যারা বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন তারা ধারণা করছেন, শান্তিকালীন পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানে ৩৮ শতাংশ মালামাল রেলপথে, ৩৪ শতাংশ সড়কপথে এবং ২৮ শতাংশ নৌপথে পরিবহন করা হতো। এখন রেলপথে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে ১০ শতাংশ মালামাল পরিবহন করা হচ্ছে এবং নৌপথে পরিবহন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আহরণকারী পণ্য পাট পরিবহন করা হচ্ছে কুলিদের দ্বারা। শিল্প উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তামাক উৎপাদন কমেছে ৪০ শতাংশ। সীমান্তের নিকটবর্তী ১১টি চা-বাগান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে; অন্য চা-বাগানগুলোতে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম উৎপাদন হচ্ছে। এসবের জন্য দায়ী করা হয়েছে মুক্তিবাহিনীকে এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘পাকিস্তান অবজারভার’ মুক্তিবাহিনীকে বর্ণনা করেছে, “মৃত্যু ও ধ্বংসের হৃদয়হীন অপরাধী…, যারা আঘাত করে পালিয়ে যাওয়ার কৌশল দ্বারা এক অবাস্তব বোধ এবং বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তার এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।”  মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের সাফল্যের একটি দৃষ্টান্ত ছিল যে, তারা ভারতীয় সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার দলকে তাদের ইচ্ছামতো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়ে যেতে ও ফিরিয়ে আনতে পারত। আমার শেষ সাক্ষাৎ নির্ধারিত ছিল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মুশতাক আহমেদের সঙ্গে। তার ব্যক্তিগত সহকারীর রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম রুমটি দর্শনার্থীতে পূর্ণ। এক কোনায় সোভিয়েত সাংবাদিকদের একটি দলকে বাংলাদেশের জন্মের ওপর ব্রিফ করা হচ্ছিল। তারা একটি ম্যাপের ওপর ঝুঁকে ছিল, যেটিতে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মুক্ত এলাকাগুলো চিহ্নিত ছিল। “আপনাদের নিয়ন্ত্রণে কতটুকু অংশ রয়েছে? পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে কতটুকু?” দোভাষী প্রশ্নগুলো তরজমা করে জানতে চাইলেন। “যেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান রয়েছে, সেসব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে। অবশিষ্ট এলাকা আমাদের। রাতের বেলায় তারা শুধু তাদের ব্যারাক নিয়ন্ত্রণ করে, যেখানে তারা ঘুমায়। আমাদের ছেলেরা তাদের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলে। তাদের ট্যাঙ্ক এবং বিমান আছে। আমাদের ছেলেদের হাতে শুধু রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড, স্টেনগান ও মেশিনগান। আমরা ভারী অস্ত্র পাওয়া মাত্র তাদের খোলা ময়দানে আনব। এ জন্য আর খুব বেশি দিন প্রয়োজন পড়বে না।”

ব্রিফিং শেষ হলো। সোভিয়েত দলের নেতা গণতান্ত্রিক শক্তির অনিবার্য ও চূড়ান্ত বিজয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। আন্তরিক ও উচ্ছ্বসিত করমর্দন এবং মাথানত করার মধ্য দিয়ে রুশ সাংবাদিকরা ‘জয় বাংলাদেশ’ ধ্বনি উচ্চারণ করে বিদায় নিলেন।

খোন্দকার মুশতাক আহমেদ পরিপাটি পোশাক পরিধান করেন এবং মন্ত্রিসভায় সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে তার খ্যাতি রয়েছে। আমি যখন তার রুমে প্রবেশ করলাম, তখন তিনি নিজের জন্য একটি সিগারেট মুড়িয়ে নিচ্ছিলেন। আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দিলাম, ‘এখন পবিত্র রমজান মাস। আপনি নিশ্চয়ই রোজা রাখছেন!’ তিনি হাসলেন, ‘আমি জানি এবং আজ শবেকদর। কিন্তু জিহাদের সময় বিশ্বাসীদের রোজা পালন করা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। মুক্তির জন্য এটি আমাদের জিহাদ।’

বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমরা আলোচনা করলাম। তিনি আমার হাত তার হাতে নিয়ে বললেন, “আমার বন্ধু, আমাদের এই চরম পরীক্ষার মুহূর্তে ভারত আমাদের জন্য যা করেছে, আমরা কখনো তা ভুলব না। আমরা জানি, আপনারা আমাদের এক কোটি মানুষকে খাবার দিচ্ছেন এবং তাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে চির বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তুলে এই ঋণ পরিশোধ করবে। বিশ্বের জাতিসমূহ খুব দীর্ঘকাল স্মৃতি ধরে রাখার জন্য খ্যাত নয়,” আমি মন্তব্য করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বাকপটুতা প্রদর্শন করেন, “ফ্রান্স কীভাবে আমেরিকানদের তাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাহায্য করেছিল, তা কী তারা ভুলে গেছে? আমাদের নিজেদের ছায়ার ওপর ঝাঁপ দিতে শেখার চেয়ে বরং আমরা কখনো ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে বিস্মৃত হব না।”

Published in Uncategorized

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *