Skip to content →

করোনার বিপদ, কিয়ামত ও বেহেশতের ভাবনা

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

করোনা ভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে ইতোমধ্যে ষাট হাজারের অধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং প্রতিদিন মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত হারে বেড়ে চলায় করোনা-ভাইরাসজনি মহামারী বিশ্বজুড়ে মানুষের মনে অভাবনীয় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সংক্রমণ ছড়ানো ঠেকাতে দেশে দেশে সরকারগুলো কর্মব্যস্ত নগরী, শহর-বন্দরে লকডাউন ঘোষণা করায় বিশ্বের বড়বড় নগরীগুলো এখন দিন ও রাতের বেলায় প্রেতপুরীতে পরিণত হয়েছে। এই বিপদ শুধু মৃত্যুর বিপদ নয়। বিশ্ববাসীর ওপর স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পড়ার, বিশ্ব অর্থনীতি ধসে পড়ার, দরিদ্র দেশগুলোর আরও দরিদ্র হওয়ার, নজীরবিহীন বেকারত্বের কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা সৃষ্টি এবং আইনশৃঙ্খলা পারিস্থিতির চরম অবনতির আশঙ্কা সৃষ্টি করোর মহাবিপদ ডেকে এনেছে এই ঘাতক ভাইরাস।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ পরিবারিক ও সামাজিক সূত্রগুলোকে পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমিত রোগী দেখলে এমনকি পরিবারের লোকজন পর্যন্ত তাকে এড়িয়ে চলে, সকলের জন্য বিপদের সমূহ কারণ বিবেচনা করে। অনেক খবর পাঠ করেছি, ইটালি প্রবাসী স্বামী দেশে আসবে খবর পেয়ে স্ত্রী ভেগে গেছে। স্বামীর গায়ে জ্বর দেখে স্ত্রী স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। করোনা আক্রান্ত সন্দেহে প্রবাসীর বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। কবরস্থানে করোনায় মৃত ব্যক্তিদের কবর দেওয়ার সুযোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে কবরস্থান কর্তৃপক্ষ। করোনায় মৃতের জানাজায় আত্মীয়রাও হাজির হন না। দাফনে তো নয়ই। এমন বহু ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক সংকট নিয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। স্বাভাবিক মৃত্যুর প্রক্রিয়া মন্থর, যা একজন মানুষকে টেনে টেনে একশ’ বছর পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জন্মগ্রহণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে, এমন বহু জীবিত লোককে এখনো পাওয়া যায়। যতোদিন মানুষ বেঁচে থাকে, ততোদিন মৃত্যুর প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে। এবং এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকে চায় সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে এবং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করতে। অস্বাভাবিক মৃত্যু কেউ কামনা করে না, কারণ অস্বাভাবিক মৃত্যু, তা যদি আত্মহত্যার মতো কিছু হয়, তাহলে একজন বিশ্বাসী মানুষ, তিনি যে ধর্মেই বিশ্বাস করুন না কেন, তার পারলৌকিক জীবনের সুখের হারানোর ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। কিন্তু করোনা সংক্রমণে মৃত্যু জীবিতদেরকে তাদের সকল হিসাব-নিকাশ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে জাগতিক ও পারলৌকিক বিভ্রমের বিষয়ে পরিণত করেছে।

অবশ্য একজন বিশ্বাসী হিসেবে এ পরিস্থিতি আমার কাছে নতুন বা বিচিত্র কিছু মনে হয়নি। এটা সত্য যে
এভাবে কেউ মরতে চায় না, আপনজন, আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুপথযাত্রীর কাছে পর্যন্ত যেতে পারবে না, মৃত্যুর পর স্বজনরা শেষবারের মতো তাদের প্রিয়জনের মুখদর্শন করতে পারবে না, যার যার ধর্মীয় বিধি অনুসরণে মৃতের অন্তিম ক্রিয়াকর্ম হবে না, মৃতের আত্মার সদগতির জন্য সম্মিলিতভাবে প্রার্থনা করা হবে না Ñ কী করে তা হতে পারে! কিন্তু এমন একটি পরিস্থিতি এই ক্ষুদ্র জীবনেও দেখতে হচ্ছে। নিজ ধর্ম সম্পর্কে আমি তেমন বিদ্বান নই, ধর্মের আবশ্যিক কর্তব্যগুলোও যথাবিহিত পালন করা হয় না, তা আলস্যবশত বা ইচ্ছার অভাবের কারণে হোক না কেন। সেজন্য আল্লাহ ক্ষমা করবেন বলেই আশা করি এবং তার উদারতার গুণ পাঠ করেই অনেক সময় ধৃষ্টতা পেয়ে বসে। তা সত্বেও আমি আমার বিশ্বাসের অটলতা থেকেই লিখছি যে, অনেক সময় আল্লাহ পৃথিবীতেই কিয়ামতে আলামতসমূহ প্রদর্শন করেন, যাতে মানুষ সতর্ক হয়। রাসূল (সা:) এর হাদিসেও এসবের উল্লেখ রয়েছে।
কোরআনের বর্ণনা অনুসারে কিয়ামতের ময়দানে কেউ কারো হবে না।“সেদিন মানুষ নিজের ভাই, নিজের মা, নিজের পিতা, নিজের স্ত্রী ও সন্তানাদি থেকে পালাবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর সেদিন এমন সময় এসে পড়বে, সে নিজেকে ছাড়া আর কারো প্রতি লক্ষ করার মতো অবস্থা থাকবে না,” (সুরা : আবাসা, ৩৪-৩৭)।
একটি হাদিসে রয়েছে, “প্রত্যেক ব্যক্তি হাশরের মাঠে ভয়ে বলতে থাকবে ‘আমাকে বাঁচান’, ‘আমাকে বাঁচান’। একমাত্র মুহাম্মদ (সা:) তাঁর উম্মত নিয়ে চিন্তা করবেন।’ (বুখারি)।
আয়িশা (রা:) একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন এভাবে যে, রাসূল (সা:) বলেছেন,“কিয়ামতের দিন মানুষকে খালি পায়ে বস্ত্রহীন ও খতনাবিহীন অবস্থায় সমবেত করা হবে।” আয়িশা জানতে চান, “হে রাসূল! নারী-পুরুষ সবাই কি একজন অন্যজনের লজ্জাস্থান দেখতে থাকবে?” তখন তিনি বলেন, “আয়িশা! ওই সময়টি এতই ভয়ঙ্কর হবে যে কেউ কারো প্রতি তাকানোর সুযোগ পর্যন্ত পাবে না।’ (বুখারি, মুসলিম)
আরও জটিল পরিস্থিতিরি উদ্ভব হয়েছে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে। শুধু বাংলাদেশে নয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এবং উন্নত অনেক দেশেও অভিন্ন চিত্র। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর অনেক ডাক্তাররা রোগী দেখতে ভয় পান। নিজের কারণে না হোক, তাতে তো আরও রোগী দেখতে হয়, এবং তারও পরিবার আছে। তার কাছ থেকে অনেকে সংক্রমিত হতে পারে। অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা রোগীকে ভর্তি করছেন না। রোগী নিয়ে অনেক পরিবার এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটছে এবং শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এমর দৃষ্টান্ত অনেক। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। অনেক বাড়িমালিক তাদের ভাড়াটে ডাক্তার নার্স যারা হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা করেন তাদেরকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছেন।
এ অবস্থাকেও যদি একটি হাদিসের বর্ণনার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে পাঠকরা এটিকে হাদিস হিসেবে না হোক, ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন। এটিতে মূলত বলা হয়েছে যে, হাশরের ময়দানে একটু সুপারিশের জন্য সবাই একে অন্যের কাছে ছোটাছুটি করতে থাকবে। “হাশরের ময়দানে মানুষ আদম (আ:)-এর কাছে গিয়ে বলবে, আপনার সন্তানদের জন্য সুপারিশ করুন, আদম বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, তোমরা ইবরাহিম (আ:)-এর কাছে যাও, কারণ তিনি আল্লাহর বন্ধু। লোকজন ইবরাহিম (আ:)-এর কাছে ছুটে যাবে। ইব্রাহিম বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা মুসা (আ:)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি কালিমাতুল্লাহ, আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। অতঃপর তারা মুসা (আ:)-এর কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা ঈসা (আ:)-এর কাছে যাও। কারণ তিনি রুহুল্লাহ। অতঃপর মানুষ তাঁর কাছে আসবে। তিনি তখন বলবেন, আমি এর যোগ্য নই, বরং তোমরা মুহাম্মদ (সা:)-এর কাছে যাও। এরপর লোকজন তাঁর কাছে আসবে, তিনি তখন বলবেন, হ্যাঁ, আমি সুপারিশ করব।’ (কুরতুবি)
মৃত্যু অনিবার্য, তবুও কেউ মরতে চায় না। বাঁচার জন্য কতো আকুতি, সুস্থ দেহে সুদীর্ঘ জীবনের আশায় অদৃশ্য প্রভুর কাছে কতো নিবেদন, নৈবেদ্য। ধনবান সর্বস্বের বিনিময়ে বাঁচতে চায়, বিশ্ব কাঁপানো প্রবল ক্ষমতাধররা জীবনের আশায় পালায়, পরাজিত বাহিনীর বহু অমিতবিক্রম বীরও নিরুদ্দেশ যাত্রা করে তাদের এক সময়ের অজেয় বাহিনী ছেড়ে। অতীতেও এমন ছিল, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও এমন ঘটনাগুলো ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে।

মৃত্যুর পর পরলোকে অনন্ত সুখের লোভনীয় বিবরণ প্রায় সব ধর্মেই দেয় হয়েছে। যারা পৃথিবীতে ভালো কাজ করবেন তারা তাদের কাজের পুরস্কার হিসেবে পাবেন অনন্ত সুখসহ অমর জীবন। পৃথিবীতে কারো কৃত অপকর্মের পারলৌকিক কঠোর শাস্তিও সমভাবে বিধৃত হয়েছে। অপকর্ম সাধনকারীরা পরকালীন শাস্তির ভয়ে যদি মরতে না চান, তাহলে তাদের ভীতির একটি যৌক্তিকতা বোঝা যেতে পারে; কিন্তু যারা ধর্মে নিষ্ঠাবান, ধর্মের জন্য অনেক অবদান রাখেন, ধর্মানুসারীদের পরজগতের স্বপ্নে বিভোর রাখেন এবং নিজেরাও সেই জগতে অনন্ত সুখ আশা করেন, তারাও তো বেহেশত, স্বর্গ বা বৈকুণ্ঠ অথবা হ্যাভেন বা প্যারাডাইজে যাওয়ার জন্য মৃত্যুবরণ করতে চান না। কেউ পৃথিবী ছাড়তে চান না। সবাই বলেন, “জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়,” Ñ আগে জীবন এরপর পৃথিবী। এসব কারণে বেহেশতের বা অনন্ত জীবনের ধারণায় সংশয় প্রকাশ করার মানুষের অভাব নেই বিশ্বে। নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী ও সংশয়বাদীদের কথা বাদ দিলেও বিশ্বাসীদের মধ্যেও পরকালীন জীবনের প্রতি সন্দেহ পোষণ বা অসারত্ব প্রমাণ করার চেষ্টার মানুষ ছিল, এখনো আছে।
উপমহাদেশের বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিবের কবিতার অনুরাগী হিসেবে তাঁর কবিতা দিয়েই শুরু করছি:

“হাম কো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হাকিকত, লেকিন
দিল কো খুশ রাখনে কো গালিব, ইয়ে খেয়াল আচ্ছা হ্যায়”

(বেহেশতের সত্য সম্পর্কে আমার ভালোই জানা আছে
গালিব, মনকে আনন্দে রাখতে এমন ধারণা রাখা উত্তম)।

“প্রত্যেকেই বেহেশতে বা স্বর্গে যেতে চায়, কিন্তু কেউ মরতে চায় না,” এই সত্যের উৎপত্তিকাল সম্পর্কে জানা না গেলেও যুগে যুগেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং এটি থেকে রসাস্বাদন বা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ যথেষ্ট হয়েছে। এখনো হয়, ভবিষ্যতেও হবে। হিব্রু ভাষায় স্রষ্টা হচ্ছে ‘ইয়াওয়েহ’ বা ‘ইয়াবেহ’, যা ইংরেজিতে উচ্চারিত হয় ‘জেহোভা’ বা ‘জিহোবা’। তিনি মানুষের মধ্যে চিরস্থায়ী জীবনের ধারণা ও আকাঙ্খা জন্ম দিয়েছেন। আদম ও হাওয়াকে বেহেশতে বসবাসের জন্য অনন্ত জীবন দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছিল। তারা যদি শয়তনের প্ররোচনায় না পড়তেন তাহলে তাদের সন্তানদের জন্যও চিরস্থায়ী জীবনের নিশ্চয়তা ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে পাপ ও মৃত্যুর প্রবেশের ধারণা মানুষের কাছে নতুন ও অভিনব ছিল। একজন মানুষ মারা গেলে সোজা কবরে যায়, অন্য কোথাও নয়। এটি অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় দ্বিতীয় শতাব্দীর দিকে খ্রিষ্টজগত পৌত্তলিকদের “মৃত্যু পরবর্তী জীবন” এবং “অমর আত্মা’র ধারণা গ্রহণ করে বলে মনে করা হয়। কিন্তু খ্রিষ্টানদের কোনো বিবরণীতে ‘আত্মা’র উল্লেখ নেই, যেটি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকবে। জেহোভা আদমকে বলেছেন, “তোমাকে মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে, মাটিতেই ফিরে আসবে তুমি।” কিন্তু অমর আত্মার কথা প্লেটো বলেছেন ঈসার জন্মের কয়েকশ’ বছর আগে। নরকে ‘পাপী আত্মা’র কঠোর শাস্তি ধারণা ব্যক্ত করতে গিয়েই তিনি অমর আত্মার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় বিবরণীতে মৃত্যু পরবর্তী জীবনে নরকে পাপীদের অনন্তকাল ধরে জ্বলতে থাকার ধারণাও নেই। অতএব এসব যুক্তির ভিত্তিতে তারা অমর আত্মার ধারণাকে ভ্রান্ত মনে করে; অতএব এর একমাত্র বিকল্প হলো, একজন মানুষ তার মৃত্যুর পর অবশ্যই বেহেশতে যাবেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বেহেশতে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকে প্রস্তুত, কিন্তু কেউ মরতে চায় না।

পার্সোনাল কম্পিউটারের জনক হিসেবে খ্যাত, অ্যাপল কোম্পানির সিইও ষ্টিভ জবস পুরোনো কথাটির সুর টেনে বলেছেন, “মানুষ বেহেশতে যেতে চাইলেও সেখানে যাওয়ার জন্য কেউ মরতে চায় না। কী অদ্ভুত! আমরা যা কিছুর মালিক, ধারক, মানুষের সাথে সম্পর্ক সবকিছুর গন্তব্য তো শেষ পর্যন্ত মৃত্যু। কে মৃত্যু থেকে পালাতে পেরেছে? একজনও না। যা অনিবার্য, তাই হয়েছে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এবং মৃত্যুই সম্ভবত জীবনের একমাত্র ও সর্বোত্তম উদ্ভাবন। মৃত্যু পুরনো অপসান করে নতুনের পথ করে দেয়। ‘ঠিক এই মুহূর্তে তুমিই নতুন, কিন্তু এখন থেকে সেই দিননটি খুব দীর্র্ঘ নয়, তুমি ধীরে ধীরে বৃদ্ধ হবে এবং চলে যাবে। দু:খিত, আমার কথাগুলো নাটকীয় মনে হচ্ছে; কিন্তু এটিই চরম সত্য। তোমার সময় একেবারেই সীমিত। অতএব, আরেকজনের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য অহেতুক সময় নষ্ট করো না।’”

“এভরিবডি ওয়ান্টস টু গো টু হ্যাভেন, বাট নোবডি ওয়ান্টস টু ডাই,” এই প্রতিপাদ্যের ওপর দুটি জনপ্রিয় গ্রন্থ আছে। একটি রচনা করেছেন দু’জন আমেরিকান সঙ্গীত শিল্পী ডেভিড ক্রোডার ও মাইকেল হোগান। তারা আধ্যাত্মিক বিচার বিশ্লেষণ করেছেন বিষয়টির ওপর। একই নামে দ্বিতীয় জনপ্রিয় গ্রন্থটির রচয়িতা দু’জন চিকিৎসক অ্যামি গুটম্যান, জনাথন ডি মোরিনো। তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করেছেন। ক্রোডার ও হোগানের বক্তব্য হলো, “এই মুহূর্তে আমরা এখানে ও সেখানের মধ্যে কোরো এক স্থানে বিরাজ করছি। বর্তমানের জন্য আমাদের যা আছে, এখান থেকে যাওয়ার পর সেসবের পুরোপুরি সেখানে নেই। আমাদের আত্মার নি:সঙ্গতার গান গাইছে নীল ঘাস। এখান থেকে আমরা কেউ প্রাণ নিয়ে যেতে পারছি না, কিন্তু আমরা এই উপসংহারে উপনীত হতে পারি যে, ‘মৃত্যু অনিবার্য বিপর্যয় নয়। দু:খ যখন আমাদের পৃথিবীকে ভেঙেচুরে ফেলে এবং মৃত্যুর যাতনা ও ক্ষতি আমাদের আঁকড়ে ধরে, তখন আমরা সান্তনা পেতে চাই, আমরা একটা উত্তর চাই। তাদের চিন্তাভাবনা ও তাদের সঙ্গীত পাঠককে আশ্বস্ত করে যে, মৃত্যু জয়ী হতে পারে না, এটি সূচনা মাত্র। অপরদিকে আমেরিকান দুই চিকিৎসকের লেখা গ্রন্থে আমেরিকান নাগরিকদের পরজগতের উদ্দেশে যাত্রার আগে তাদেরকে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেসব প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

খ্যাতিমান আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী লোরেটা লীন এর গান আছে, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে;

“প্রত্যেকেই বেহেশতে যেতে চায়
কিন্তু কেউ মরতে চায় না,
একবার আইজ্যাক নামে এক লোক
ইশ্বরের সাথে দিন-রাত হাঁটছিল
কিন্তু সে মরতে চাইতো না।
সে কেঁদে বললো, “প্রভু, দয়া করে আমাকে বাঁচতে দাও,
আমি জানি, আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে।’
হাসলেন ইশ্বর, আইজ্যাকের মাথায় হাত রেখে
তাঁকে আরো পনের বছরের আয়ু দিলেন।
আমি সেই দিনের আকাঙ্খা করি যখন আমার নতুন জন্ম হবে,
এখনো আমি এখানে এই পৃথিবীতেই বাঁচতে চাই।
যিশু যখন পৃথিবীতে জীবিত ছিলেন,
তিনি তাঁর পিতার পরিকল্পনা জানতেন।
তিনি জানতেন যে, তিনি তাঁকে তাঁর জীবন দেবেন
মানুষের আত্মাকে রক্ষা করতে।
যিশুর সাথে জুডাস যখন বিশ্বাসঘাতকতা করে
তাঁর পিতা তাঁকে কাঁদতে শোনে।
যিশুর মৃত্যু পর্যন্ত জুডাস সাহসী ছিল
কিন্তু সে মরতে চায়নি।”

অনেকে মানুষের মাঝেই স্বর্গ ও নরককে দেখতে পান। বাঙালি কবি শেখ ফজলুল করীম বলেছেন;
কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর
মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।”
জন মিল্টনও তাঁর “প্যারাডাইজ লষ্ট” গ্রন্থে বলেছেন, “মন তার নিজের স্থানে আছে, এই মন নরককে স্বর্গে পরিণত করে অথবা একটি স্বর্গকে পরিণত করতে পারে নরকে।”
পরজন্ম বা পরকালীন জীবন সম্পর্কিত ধর্মীয় ব্যাখ্যা যদি কেউ মানতে নাও চান, তারা অন্তত একথার মধ্যে সান্তনা খুঁজতে পারেন যে, মৃত্যুকে ঘিরে যে ভীতি ও দ্বিধা, তা থেকে মুক্তি লাভের উপায় আছে। তা হলো, দেহের মৃত্যু হলে আমরা বেহেশত বা স্বর্গ নামে একটি স্থানে যাই, যেখানে আমরা সবসময় সুখী। এই ভাবনার মধ্যে অনিশ্চয়তা, ভীতি ও দ্বিধা থেকে বেরিয়ে এসে সততার সাথে সত্যের মুখোমুখি হওয়া যায়। কেউ জানে না দেহের মৃত্যুর পর কী ঘটে।
তবে মৃত্যুর প্রস্তুতি সম্পর্কে হযরত আলী যে পরামর্শ দিয়েছেন তা হলো, “মৃত্যুকে মনের মধ্যে এমনভাবে রাখতে হবে যেন আজকের দিনটিই আমাদের জীবনের শেষ দিন। আবার একই সময়ে আমাদের এমনভাবে বাঁচা উচিত যেন আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সামনে আরও হাজার বছর পড়ে আছে।” একজন সুফি কবি শেখ ইবনে আল-হাবীবও (১২৯৬-১৩৯১) প্রায় একইভাবে বলেছেন;

“মৃত্যু আসবে তা তো অনিবার্য,
কিন্তু তুমি তোমার আশা ছেড়ো না
হৃদয় যদি তোমার সাথে রূঢ় আচরণও করে
তোমার মাঝে মৃত্যুর প্রতিফলন রেখো
তাহলে তুমি সজাগ সচেতন থাকবে,
এবং তুমি ভালো কাজের দিকে ফিরবে,
কারণ জীবন তো তোমাকে ছেড়েই যাবে।”

Published in Uncategorized

Comments are closed.